banner

সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: May 16, 2024

 

‘লিন্ডা একটি শাড়ী কিনেছিল’ পর্ব-১

জাজাফী


বুধবার বিকেলে লিন্ডার ফোন পেলাম।আমি তখন বাইরে বের হবো বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় ফোন এলো। অপরিচিত নাম্বার। কান্ট্রিকোড দেখে বুঝলাম ফোন কোথা থেকে এসেছে। তবে বুঝতে পারিনি কে ফোন করতে পারে। রিসিভার তুলে কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে লিন্ডার কন্ঠ ভেসে এলো। কন্ঠ শুনে বুঝিনি যে ওটা লিন্ডা কারণ ওর সাথে আমার দেখা হয়নি বিশ বছর।

আর কথা হয়েছে কালেভদ্রে মাসে দু মাসে। ম্যানহাটন জুনিয়র হাইস্কুলে আমি আর লিন্ডা একসাথে পড়তাম। গ্রেড ফোরে পড়াকালীন যখন আমি আর মম এদেশে চলে এলাম তখন থেকে একটু একটু করে লিন্ডার সাথে আমার যোগাযোগ কমতে থাকলো।

ইমেইলে কথা হতো মাঝে মাঝে তবে ফেসবুক যুগে প্রবেশের পর বেশ যোগাযোগ হয়।আমি যখন মমের সাথে ম্যানহাটনে থাকতাম তখন লিন্ডা ওর সিঙ্গেল মাদারের সাথে ম্যানহাটনেই থাকতো। ও বলেছিল ওর সিঙ্গেল মাদার তবে আমার তখনই মনে হতো আসলে কথাটি ঠিক নয়। কোন এক অজ্ঞাত কারণে ওরা বাবার কথা চেপে যেতে চায়। আমিও তাই কখনো তোড়জোড় করিনি।

লিন্ডার পুরো নাম লিন্ডা ওয়াটসন। ওর গ্রান্ডফাদার জেমস ওয়াটসন আমেরিকার প্রখ্যাত ব্যবসায়ী ছিলেন। বাংলাদেশে চলে আসার পর লিন্ডার সাথে যোগাযোগ কমে গেলেও কখনো বিচ্ছিন্ন হইনি আমরা। স্কুল কলেজ পেরিয়ে দুজন দুই দেশের দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে নিজেদের মত করে দিন কাটাচ্ছি ঠিকই তবে ফেসবুকে দুজন দুজনের অম্ল মধুর স্মৃতিগুলি ফ্রেমে ধরে রেখে শেয়ার করছি একে অন্যের সাথে। এর ফলে কখনো মনেই হয়নি আমরা আর আগের মত একসাথে নেই।কোন এক বিচিত্র কারণে লিন্ডার কোন বয়ফ্রেন্ড জোটেনি অথচ ও এতো সুন্দর যে একবার তাকালে সহজে চোখ ফেরানো যায় না। আমি একবার জানতে চেয়েছিলাম তোমার কোন বয়ফ্রেন্ড নেই?ও বলেছিল না নেই তবে আছে একজন কিন্তু সে আসলেই আমার বয়ফ্রেন্ড কিনা তা আমি নিজেও জানি না কারণ তাকে কখনো কথাটি বলা হয়নি। আমি ওকে নিজ থেকে উৎসাহ দিয়ে বলেছিলাম তুমি তাহলে অপেক্ষা করছো কেন? বলে দাও তার পর দেখো সে তোমাকে নিশ্চই এড়িয়ে যেতে পারবে না। তুমি হলে সেই লাল শিখা যার আকর্ষণ এড়ানোর ক্ষমতা নেই কোন পোকার। পোকারা যেমন জ্বলন্ত শিখার দিকে মোহগ্রস্থের মত ছুটে যায় তেমনি সেও তোমার দিকে ছুটে আসবে।লিন্ডা অন্যমনস্ক হয়ে যায়।

তবে কথা না ঘুরিয়েই বলে সে তো আর পোকা নয় আর আমিও জ্বলন্ত শিখা নই।তাছাড়া সে হলো আকাশের চাঁদের মত যাকে চাইলেই ধরা যায় না ছোঁয়া যায়না। তাকে দেখতে হয় দূর থেকে ছুতে হয় কল্পনায় আর আঁকতে হয় নিজের মনের সাতরঙে।

লিন্ডার কথাগুলো আমার খুব ভালো লাগে। কি মিষ্টি করে কথা বলে। তার চেয়েও অদ্ভুত লাগে সেই মানুষটির কথা চিন্তা করে যাকে লিন্ডা পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারেনা ছুতে পারে না। লিন্ডাকে উপেক্ষা করার মত মানুষও যে থাকতে পারে তা আমার জানা ছিল না। বিকেলে লিন্ডার ফোন পেয়ে আমি বেশ পুলকিত হলাম। বেশ অনেক দিন পর ফোন করেছে এটা আনন্দের একটি কারণ তার চেয়ে বড় কারণ হলো লিন্ডা এই সামার ভ্যাকেশানে বাংলাদেশে ঘুরতে আসতে চায়। আমার বেশ আনন্দ হলো।

আমি লিন্ডাকে ফোনে রেখেই মমকে বললাম যে জানো মম লিন্ডা বাংলাদেশে আসছে! আমার মুখ থেকে কথাটি শোনার সাথে সাথে মমের মুখটা যেন একশো ওয়াট বাল্বের মত আলোকিত হয়ে উঠলো। মমের দিকে তাকিয়ে আমি খুবই অবাক হলাম। যেন মনে হলো লিন্ডা মমের খুব আপন কেউ অথচ মমের সাথে তার তেমন কোন সম্পর্কই ছিলনা। সেই ছোট্ট লিন্ডাকে মম খুব কমই দেখেছে। তাছাড়া আমাদের ম্যানহাটনের বাসাতেও সে একবারের বেশি দুবার আসেনি। মম আমার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে কানে লাগিয়ে এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলো যে লিন্ডা নিজে পারলে তখনি উড়ে চলে আসে। ও কেন বাংলাদেশে আসতে চায় তা জানি না তবে তখন মনে হচ্ছিল মমের ভালোবাসাটুকু পাওয়ার জন্য হলেও সে বাংলাদেশে আসবেই।

মম খুটিয়ে খুটিয়ে অনেক কথা জানতে চাইলেন তার পর আমার হাতে দিলেন ফোনটা। আমি আরো কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিলাম। ও অলরেডি ভিসা পেয়ে গেছে আগামী সাটারডেতে ওর ফ্লাইট। হাতের কর গুনে দেখলাম সময় বেশি দেরি নেই।

চলবে….

 

বাবা ও বই

তাহেরা সুলতানা


বিশ্ব বই দিবস। তাই বইয়ের সাথে সখ্যতা আর আমার বাবার সাথে কাটানো শৈশবের কিছু স্মৃতি আজকে তুলে ধরবো।
আমার আব্বা একজন কলেজ শিক্ষক ছিলেন। একটা গ্রামের কলেজে রসায়ন পড়াতেন। আমিও সে কলেজেরই ছাত্রী ছিলাম। রসায়ন অনেকের কাছেই হয়তো বেশ খটমটে সাবজেক্ট! আব্বা ছাত্র-ছাত্রীদের রসায়নের বিভিন্ন বিষয়ের সাথে সাহিত্যের বিভিন্ন অংশ সংযুক্তি করে খুব মজা করে পড়াতেন।

এরপরও কোন বিষয় কারো বুঝতে অসুবিধা হলে বলতেন, “গল্প-উপন্যাস যেমন করে পড়, সেভাবেই বুঝে বুঝে পড়। রসায়নের রস এমনিতেই টুপ টুপ করে পড়বে।”

আব্বার কাছে বই ছিল অনেকটা সন্তানের মতোই। ১৯৮৮ সালের বন্যায় আমাদের বাসায় ২ আলমারী ভর্তি বই নস্ট হয়ে যায়। আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। আমার স্পষ্ট মনে আছে, আব্বা হাউ মাউ করে কেঁদেছিলেন।

এরপর আব্বা একটু একটু করে আবার গোছাতে শুরু করলেন। আমি আর আমার ইমিডিয়েট ছোট বোন তখন আব্বাকে সহযোগিতা করতাম। ১৯৯৮ সালের বন্যাতেও অনেক বই নস্ট হয়ে যায়।
তখনো আব্বাকে কাঁদতে দেখেছি।
আমাদের ৬ ভাইবোনেরই বই পড়ার নেশা ছিল চরম। আব্বার উৎসাহ-ই কারণে নেশাটা তৈরী হয়েছিল।

পাঠ্যপুস্তকের বাইরে বই পড়ার জন্য আব্বা নিজেই টাইম বেধে দিতেন, যাতে রেজাল্ট খারাপ না হয়ে যায়। তারপরও পড়ার বইয়ের মধ্যে লুকিয়ে গল্প উপন্যাস পড়া ছিল একটা নেশার মতো!

ঈদের ছুটি অথবা স্কুল থেকে বড় কোন ছুটি পেলে আমরা আনন্দে লাফাতাম। কারণ তখন বই পড়া নিয়ে কোন টাইমটেবিল থাকতো না। বিশেষ করে ঈদের সময় আমরা নতুন জামার সাথে নতুন কিছু বই পেতাম, যেগুলো ঈদের দিন পড়তাম। আমাদের বাইরে ঘুরে বেড়ানোর থেকে বই পড়ে সময় কাটানোই বেশি পছন্দনীয় ছিল।

স্কুল পাঠাগারের প্রতিটা বই যে কতবার রিভিশন দিয়েছি, তার হিসাব নেই! গ্রামের বাজারে একটা পাঠাগার ছিল, সেখানকার প্রতিটা বইও প্রায় ২/৩ বার করে পড়া হয়ে যেতো। আমার এক বান্ধবী ছিল, জাকিয়া জেসমিন, ওর সাথে আমার সবচেয়ে বেশী বই আদান-প্রদান হতো। ও অবশ্য অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করতো। বইয়ে কোন দাগ দেয়া যাবে না! বইয়ের কোনা ভাঁজ করা যাবে না! আরো কতো কি!

সব শর্ত মেনেই বই ধার নিতাম।
রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিভূতিভূষণসহ ওপার বাংলার বহু লেখকের বই তখন সংগ্রহ করে পড়তাম। তবে পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি সংগ্রহে থাকতো হুমায়ন আহমেদের বই। আব্বার পছন্দের লেখকদের মধ্যে শরৎচন্দ্রের নাম না নিলেই নয়। এছাড়া তিন গোয়ান্দা সিরিজ, শার্লক হোমস, মাসুদ রানা সিরিজ, সাইমুম সিরিজ আর নবী রাসূলদের জীবনকাহিনীর উপর লেখা বইগুলো তালিকার প্রথমদিকে থাকতো।

বই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে আব্বার বিধিনিষেধ খুব একটা ছিল না। বয়সানুযায়ী আমাদের সব ধরনের বই পড়তে উৎসাহ দিতেন, যাতে ভালো-মন্দের পার্থক্য করতে পারি। তবে কুরআন হাদিস আর ইসলামিক বইপুস্তক পড়ার প্রতি বেশী উৎসাহ দেখাতেন।

বলতেন, “ওগুলো হচ্ছে বেস। তাহলে যাই পড় না কেন, ভুলটা শিখবে না।”

নিজেও আমাদের সাথে পড়তেন আর বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা করতেন। পারিবারিক বৈঠক করতেন। সেখানেও আদবকায়দা শেখানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বইয়ের আলোচনা গুরুত্ব পেতো।
জন্মদিন পালন করার কোন রেওয়াজ আমাদের বাসায় ছিল না। কিন্তু কোনভাবে যদি একটা বই উপহার পেতাম, সেদিন আর আনন্দের সীমা থাকতো না! স্কুলের বিভিন্ন প্রোগ্রামে কবিতা আবৃত্তি, উপস্থিত বক্তৃতা বা যেকোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের জন্য আব্বাই উৎসাহ দিতেন। আবৃত্তির প্রথম হাতেখড়ি আব্বার কাছ থেকেই পাওয়া। লেখালেখির ব্যাপারেও উনার উৎসাহের অভাব ছিল না। আমার সবগুলো বোন এখনো টুকটাক লেখালেখির সাথে জড়িত। কেউ ‘পাঠশালা’য় লিখে। কেউ ‘জানালা’য় লিখে। বাস্তবতার বেড়াজালে কারোরি বড় লেখক হয়ে উঠা হয়নি। তবে সবারই হাতেখড়ি সেই ছোটবেলায় আব্বার হাতে।

আব্বাই প্রুফ দেখে দিতেন, লেখা ঠিক করে দিতেন। আমার ৪ নং বোনের নাম সুমি। ও ক্লাস সিক্স এ থাকতে একবার ‘পেসমেকার’ নিয়ে দৈনিক ইনকিলাবে একটা লেখা লিখেছিল। ওকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কত চিঠি যে এসেছিলো! প্রতিটা চিঠি আব্বাকে পড়ে শুনাতে হতো।
বইপড়া যে কি নেশা ছিল, তার একটা ছোট্ট উদাহরণ হলো, ইউনিভারসিটি ভর্তি কোচিং করতে এসেও বান্ধবীরা মিলে মোটা মোটা কয়েকটা উপন্যাস শেষ করেছিলাম। এরমধ্যে বিশেষভাবে ২টার কথা মনে পড়ে। ‘পার্থিব’ আর
‘সাতকাহন’।

আব্বা যখন রিটায়ার্ড করলেন, তখন আমরা উনাকে জিজ্ঞেস করলাম,
“আব্বা, এখন কি কিছু করতে চান? না শুধুই রেস্ট নেবেন?” কোনকিছুতে ইনভল্ভ না থাকলে যদি অসুস্থ হয়ে যান, এই ভয়টা তখন কাজ করতো!
আব্বা হেসে উত্তর দিয়েছিলেন,
“তোমরা আমাকে নিয়ে কেনো এতো ভাবছো? আমার তিন বন্ধু তো আছেই। কলেজের ব্যস্ততার কারনে তাদেরকে সময় অনেক কম দেয়া হয়েছে। এখন ইনশাআল্লাহ সময় দিবো।”

আমরা খুব আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কারা তারা? আমরা কি চিনি আব্বা?”
তিনি বললেন, “অবশ্যই চিনো। কুরআন, হাদীস আর বই।”

আব্বার উত্তরটা শুনে যেমন খুব অবাক হয়েছিলাম, তেমনি খুব ভালোও লেগেছিল। আর এমন একজন মানুষের সন্তান হতে পেরে খুব গর্ববোধ হচ্ছিল। এখনো সবাই যখন কনফারেন্স কলে থাকি, আব্বার কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনি। আমার কাছে সাদা মনের মানুষের উজ্জল দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমার আব্বা।
আল্লাহ্‌পাক আমাদের সবার বাবামাকে ভালো রাখুন। সুস্থ্য রাখুন। আমিন।

রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বাইয়ানি সগীরা।