banner

সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: May 16, 2024

 

সন্তান: স্বপ্নের পরিচর্যা (‘বই রিভিউ’ পর্ব-২)

অনবরত বৃক্ষের গান


সাহসের ভিত্তি হচ্ছে বিশ্বাস, আপনার সন্তানকে কি আপনি সাহস যুগিয়ে থাকেন? সন্তান প্রতিপালনের জন্য বাবা-মায়েদের অবশ্যই সন্তানের কিছু মৌলিক বিষয় অবগত করার মাধ্যমে বিশ্বাস স্থাপন করাতে হবে, সন্তানকে ঝুঁকি নিতে উদ্ভূত করুন, সম্ভাবনাকে তুলে ধরুন। সন্তানকে ভুল করতে দিন, ভুল থেকে মৌলিক বিষয়টি শিখতে সহযোগিতা করুন। সন্তান সাহায্য করুন তার উৎসাহের বিষয়কে খুঁজে পেতে। কেন না, প্রতিটি আগ্রহই উৎকর্ষের শীর্ষে পৌছে দেয় সন্তানের সম্ভাবনা সমুহকে। সন্তানকে এমনভাবে তৈরি করুন, সে নিজেকে কোথায় পৌছাতে চায়,
খুঁজে পায়,
জিজ্ঞেস করুন জানার চেষ্টা করুন, জানুন।

উল্লেখ্য, বিপুল উপকরণের ভীড়ে,তাঁকে দরকারী বিষয়গুলো দিয়ে সজ্জিত করুন, তার মননশীল চারপাশ।

স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক

পিতামাতাকে তাঁর সন্তানকে জীবনের উদ্দেশ্য কি,তা বোঝাতে হবে,কেন তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছে,স্রষ্টা তাকে কেনই বা সৃষ্টি করলেন।জীবনের প্রতিটি কাজ যেন তাঁর সন্তুষ্টিরর জন্য হয়,তেমনি চেতনা গ্রোথিত করে দিতে হবে।

ছোট্ট সোনামনিকে কোলে নিয়ে চাঁদের আলো দেখাতে পারেন, ফুল পাখি,নদী, এমনকি প্রতিটি ক্ষুদ্র জিনিস দেখিয়েও তাঁকে রবের মহিমা শেখাতে পারেন, আল্লাহ চিনতে সাহায্য করতে পারেন।

সুন্দর করে মনীষি, নবী-রাসূলদের জীবনী শুনাতেন পারেন, যা সন্তান তাদের জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে পারে।

বাচ্চাদের সাথে নিয়ে সালাত আদায় করতে পারেন, বারবার সুন্দর বিষয়গুলো শেয়ার করতে পারেন, যাতে তারা আস্তে আস্তে বুঝতে শিখে।

তাদের সাথে রাজনৈতিক কিংবা ঐতিহাসিক যেকোন বিষয়ই আলোচনা করে শুনাতে পারেন, এমনকি কবিতাও।

যেটা তাদের চিন্তায় দাগ কেটে যায়। তাতে শৈশব থেকেই চিন্তা করার ক্ষমতা বাড়বে,গভীরতা আসবে।

সন্তানের সার্বিক উন্নয়নে ইনভেস্টমেন্টের প্রশ্নপত্র

আপনি কি সন্তানের সার্বিক উন্নয়ন বলতে, প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা ও খেলাধুলাকেই বুঝে থাকেন? আপনার সন্তানের আত্মিক উন্নয়ন হচ্ছে কি? সন্তান চাওয়া মাত্রই তা পূরণ করেন, নাকি ধৈর্যশীলতার প্রশিক্ষণ দেন?

অনুপ্রেরণা
আপনার সন্তানকে দীর্ঘমেয়াদী সাফল্যে লাভে অনুপ্রেরণা দিন, যার প্রতিশ্রুতি পৃথিবীর কোনো বিনিয়োগেই দেওয়া হয়নি।

ত্যাগের মানসিকতা অর্জন
বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খেলনা ভাগাভাগি করে খেলতে শিখান, এতে সে ত্যাগের মানসিকতা অর্জন করবে।

মিলেমিশে খাওয়ার অভ্যাস
খাবার খাওয়ানোর বেলায়ও মিলেমিশে খেতে অভ্যস্ত করুন।

ভালো আচরণ
পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে ভালো আচরণ করতে অভ্যস্ত করুন। সন্তানের আত্মিক উন্নয়নের দিকে নজর দিন।

শৈশব হচ্ছে চমৎকার সুযোগ,সন্তানকে সুন্দর করে গড়ার। এ সময় আপনি তাঁকে যেভাবে চান, সেভাবেই তৈরি করতে পারেন।

আপনি যদি নিজে স্রষ্টার সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দেন, গভীর রজনীতে নিভৃতে তাঁকে খুঁজেন, সন্তানও তাঁর সান্নিধ্য চাইবে।বার্ধক্যের সময় রাত জেগে, আপনার সেবা করবে,উদার ও সহনশীল মানসিকতা নিয়ে গড়ে উঠবে। আপনি যখন কবরে শায়িত থাকবেন, আপনার জন্য দু’হাত তুলে দোয়া করবে।

লেখিকা: ইসলামিক স্টাডিজ, অনার্স ৩য় বর্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

আমি না হয় নদীই হলাম

ডা. ফাতিমা খান


আঁকতে বসলে আমার নীল আর আকাশী রঙ টা কম পড়ে যায় সবসময়ই। আকাশের পরিধি মাপতে মাপতেই আমার রঙ শেষ, হাত ক্লান্ত! আজকাল লিখতে বসলেও শ্রান্ত মনে শব্দের ঘাটতি পড়ে , হাতিয়ে পাতিয়ে কোন রকমে অল্প কিছু শব্দই খুঁজে পাই।
“নাতি-খাতি বেলা গেল শুতি পারলাম না” জাতীয় দিনকাল যায় রোজ। “শুতি পারলাম না” অংশটুকু ঠিক থাকলেও “নাতি- খাতি” র ব্যাখ্যা দিতে গেলে এক বিশাল হ্যাভ টু-ডু আর ইউসড টু-ডু লিস্টের মেলা খুলে বসতে হবে। কর্তব্যের খাতিরে চব্বিশ ঘন্টায় অন্তত বারো বার নিজের স্বরূপ বদলাই। মা, রাধুনী, শিক্ষক,কাজের বুয়া, বন্ধু, খেলার সাথী, শাসক, চিকিৎসক… আরো কত কি! কাজের ফাঁকেফাঁকে ইউ টিউবে গল্প শুনি। রিল্যাক্সড হই।

আজ আমার প্রিয় গল্পগুলোর মধ্যে একটা গল্প আপনাদের শোনাব।

এক শতবর্ষী নদী গেল পাহাড়ের কাছে, তার অভিযোগের ঝুড়ি নিয়ে।

বলল, ”কি গম্ভীর, কি বলিষ্ঠ তুমি! বয়সে তুমি হাজারবর্ষী। আচ্ছা তুমিই আমায় একটা কথা বলে দাও দেখি! এই যে দেখছ শত বছর ধরে আমি অবিরাম বয়েই চলেছি, কখনো শান্ত, কখনো বা চঞ্চল পায়ে, সবাই আমার উপর নেয়ে পিয়ে চলে যায়, নৌকা আর জাহাজ গুলো দেখ কেমন নির্দয় ভাবে আমার উপর ছুটে চলে, ক্লান্ত পথিক আমার তীরে বসে জিরায় আর পাথর ছুড়ে আমার গায়ে, বাড়ির বউ ঝিরা ধোঁয়া কাঁচা সেরে আবার কলসি কাঁধে খানিকটা পানি তুলে নিয়ে যায়…কেউ একবারও তো ডেকে বলে না, ভাল আছ নদী?

..এইটা কি ঠিক হল? আমি বড় ক্লান্ত, ভাবছি অনেক হয়েছে, এবার আমি ক্ষান্ত হব!”

পাহাড় সব শুনে হো হো করে হেসে উঠে। তার হাসিতে যে কম্পন, যে অনুরণন তা ভূতল কাঁপিয়ে দেয়! আর যা হোক, পাহাড়ের হাসি তো!

”থামো থামো বন্ধু, দোহাই লাগে আর হেসো না ! তোমার হাসি প্রলয় ডেকে আনবে!” – ভীত নদী বলে ওঠে।

”তুমি শুধু নিজের কথাই ভাবলে, এটা কি ঠিক হল নদী?” – পাহাড়ের গম্ভীর জবাব।

”আচ্ছা একবার ভেবে দেখ, এই যে আমি হাজার বছর ধরে এক জায়গায় ঠায় দাড়িয়ে আছি, একটু নড়ে চড়ে বসার তো কোন উপায় নাই! আর এই তুমি, দেখলে, তুমিও তো আমাকে হাসতে বারণ করলে। আমি হাসলেও বিপদ! অথচ তোমার মত অসংখ্য নদীর জন্ম হয়েছে আমার বুক চিরে! ঝড় ঝঞ্ঝা, বৃষ্টি বাদলা, ভূকম্পন কেউ আমাকে ছাড় দেয়নি, সব কিছুই নিরবে সয়ে আসছি। প্রকৃতি ক্ষেপলে অকারণেই আমার খানিকটা খেয়ে ফেলে। শৌখিন মানুষগুলো আমায় কেটে কুটে ঘর বাড়ি বানায়… এই বলিষ্ঠ আমি চুপ করেই থাকি! ‘তোমার গতি আছে, ছন্দ আছে। তুমি নাচতে,গাইতে পার, যখন যেখানে খুশী বইতে পার, তোমার পানি পান করে তোমার তীরে বসে পথিক তোমায় দোয়া দেয়…. তারপরও??? তারপরও তোমার এত অভিযোগ?”

নদী বুঝতে পারে। নদী বুঝতে পারে তার অভিযোগ গুলো অন্য কারো আকুল আরজি! এরপর সে আর অভিযোগ করেনি, সেই যে চলছে আর কোনদিন থামেনি…। ছবি: সাঙ্গু নদী,বাংলাদেশ।

লেখক কর্মরত: আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ, জেদ্দা, সৌদি আরব।

 

‘নারী মুক্তি’ সময়ের অপরিহার্য দাবি!

সাজেদা হুমায়রা হিমু


নারী কেবলমাত্র একটি সত্তার নাম নয় বরং একটি চালিকা শক্তি যাকে ছাড়া পুরো পৃথিবী স্তব্ধ, স্থবির। তবুও নারীর কাঙ্ক্ষিত মূল্যায়ন হচ্ছে না কোনো ভাবেই।

তাই একবিংশ শতাব্দীর আলো ঝলমলে পৃথিবীতে দাঁড়িয়েও নারী আজ বড় অসহায়! বড়ই পরাধীন!

প্রতিনিয়তই নারী নির্যাতিত শারীরিকভাবে….মানসিক ভাবে।
নারীকে কখনো একজন মা, কখনো একজন স্ত্রী, কখনো ছেলের বউ, কখনো বোন বা কন্যা, কখনোবা একজন সাধারণ মেয়ে হিসেবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এ নির্যাতন শুধু পুরুষ কর্তৃক হচ্ছে তা নয়, নারী কর্তৃকও হচ্ছে।

সত্যি নারীরা আজ ভালো নেই। নারী কেন্দ্রীক বিভিন্ন সমস্যার বিষবাষ্পে জর্জরিত আমাদের প্রিয় এ জন্মভূমি।

বেশিরভাগ পরিবারেই নেই নারীর মত প্রকাশের স্বাধীনতা…নেই তার অবদান আর কষ্টের স্বীকৃতি…
যৌতুক, তালাক নারী নির্যতনের রেকর্ডে যোগ করেছে এক চরম নির্মমতা!
বিগত কয়েক বছরে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ধর্ষনের ঘটনা!
নারীকে বঞ্চিত করা হচ্ছে সম্পত্তি থেকে…..বঞ্চিত করা হচ্ছে উপার্জনের ক্ষেত্রে।
পথে পথে চলছে নারীর শ্লীলতাহানি!
কন্যা শিশু থেকে বৃদ্ধা নারীরা পর্যন্ত প্রতিনিয়তই শিকার হচ্ছে যৌন নির্যাতনের….
বাস, অফিস, গৃহ কোন স্থানই আজ নিরাপদ নয়।
বিভিন্ন বয়সের পুরুষের দ্বারা ইভটিজিং এর শিকার নারীরা প্রচণ্ড মানসিক পীড়নে থাকছে।
আর ইতি ঘটাতে বাধ্য হচ্ছে শিক্ষা জীবন, কর্ম জীবন এমনকি নিজেদের জীবনেরও!

কেন আজ নারীর এই অসহায়ত্ব? কেন হচ্ছে এই নির্যাতন? তা নির্ণয়ের চেষ্টা করছেনা কেউ।

নারীর অবস্থার উন্নয়নে সময়ের সাথে সাথে প্রণিত হচ্ছে বিভিন্ন নীতিমালা, বিভিন্ন পদক্ষেপ… তবুও পরিবর্তিত হচ্ছে না নারীর অবস্থার।

তাই আল্লাহ প্রদত্ত নারীর মর্যাদা ও অধিকারের ব্যাপারে সচেতনতা আজ বড় প্রয়োজন…..প্রয়োজন সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন….প্রয়োজন নারী নির্যাতনকারীদের প্রতিরোধে শক্তিশালী আইনের প্রয়োগ।

অযৌক্তিক সমানিধিকারের দাবীর মাধ্যমে নারীর কাঁধে কয়েক গুন বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নারীমুক্তি কখনোই সম্ভব নয়।

তাই..
সম অধিকার নয়,
প্রাপ্য অধিকার চাই।
প্রাপ্য স্বাধীনতা চাই।

নারী দিবসের শুভেচ্ছা।

 

সবজি বিক্রি করে গরীবের জন্যে হাসপাতাল বানিয়েছেন যিনি!

মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহা


স্ত্রী মমতাজ বেগমের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন স্বরূপ মুঘল সম্রাট শাহজাহান নির্মাণ করেছিলেন তাজমহল, লোকে সেটাকে ভালোবাসার প্রতীক হিসেবেই জানে। সুভাষিণী মিস্ত্রি বিশাল কোন সাম্রাজ্যের অধিপতি নন, অনেক টাকাপয়সাও নেই তার। কিন্ত যে কাজটা তিনি করেছেন, সেটা হয়তো ছাড়িয়ে গেছে শাহজাহানের ভালোবাসা কিংবা তাজমহলের কীর্তিকেও। বিনা চিকিৎসায় স্বামীকে হারানো এই ভদ্রমহিলা মানুষের বাড়িতে কাজ করে আর সবজি বিক্রি করেই গড়ে তুলেছেন হাসপাতাল, যাতে গরীব মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মারা যেতে না হয়!

বারো বছর বয়সে একটা মেয়ের স্কুলে যাওয়ার কথা, বান্ধবীদের সঙ্গে পুতুল খেলার কথা। সেই বয়সে সুভাষিণীকে দাঁড়াতে হয়েছিল ছাদনাতলায়। পুতুলের বিয়ে দেয়ার বয়সে তার নিজেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল, সংসার নামের কঠিণ একটা জগতে প্রবেশ করতে হয়েছিল সেই অল্প বয়সে। স্বামীর ভালোবাসায় সেই সংসারজীবনে অভ্যস্তও হয়ে গিয়েছিলেন সুভাষিণী। কিন্ত যখন তার বয়স মাত্র তেইশ, তখনই জীবনের সবচেয়ে বড় আঘাতটা পেলেন তিনি। ১৯৭১ সালে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা যান সুভাষিণীর স্বামী। হাসপাতালের বারান্দায় বড় অবহেলা পড়েছিল তার দেহটা, টাকার অভাবে ঔষধ কিনতে পারেননি, ডাক্তারদের দেয়া টেস্টগুলোও করানো সম্ভব হয়নি। তাকিয়ে তাকিয়ে শুধু মৃত্যুপথযাত্রী স্বামীর কষ্টটা দেখেছেন সুভাষিণী।

স্বামীর মৃত্যুর পরে চার সন্তানকে নিয়ে পথে নেমে আসতে হয়েছিল তাকে। সংসারে একটা পয়সা আয় নেই, সঞ্চয় বলতে কিছুই রেখে যেতে পারেননি তার দিনমজুর স্বামী। দুমুঠো অন্নের জন্য পরের বাড়িতে ঝি-গিরি থেকে শুরু করে চায়ের দোকানে কাজ, রাজমিস্ত্রির ঢালাইয়ের কাজ, ছাদ পেটানোর কাজ, ধাপায় কয়লা কুড়ানোর কাজ, মাছের ভেড়িতে পানা পরিষ্কার করার কাজ, জমিতে চারা বসানোর কাজ, ধান চাষ—আরও কত কী করেছেন তিনি! তবুও পাঁচজনের সংসার চলছিল না। সারাদিন কাজ করে চালডাল কিনে এনে হাড়িতে চড়াতেন সুভাষিণী, তাতেও পেট ভরতো না সবার। বাধ্য হয়ে এক ছেলেকে অনাথ আশ্রমে দিয়ে দিলেন, তাতে যদি কিছুটা সাশ্রয় হয় সবার!

এতকিছু করেও যখন পোষাচ্ছিল না, তখন একজনের পরামর্শে কিছু টাকা ধার করে নেমে পড়লেন সবজির ব্যবসায়। কলকাতার বাইরের হাঁসপুকুর থেকে অল্প দামে সবজী কিনতেন সুভাষিণী, তারপর সেগুলো মাথায় করে মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে ঢুকতেন শহরে, পার্ক সার্কাসের চার নম্বর ব্রীজ লাগোয়া অস্থায়ী বাজারে বিক্রি করতেন সেসব। প্রতিদিন সেই একই কাজ, বিশাল একটা তরকারীর ঝাঁকা মাথায় করে নিয়ে আসছেন এক মহিলা, নিত্যদিনের দৃশ্য হয়ে উঠেছিল সেটা।

সবজি বিক্রি করে খানিকটা স্বচ্ছ্বলতা এলো, মানে অন্তত খেয়েপরে বাঁচাটা নিশ্চিত হলো। কিন্ত সুভাষিণী তো এতেই থেমে যাওয়ার মানুষ নন। মনের ভেতরে অদম্য একটা স্বপ্নকে লালন করে এসেছেন স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে, গরীব অসহায় লোকজন, যারা টাকার অভাবে দামী ডাক্তার বা হাসপাতালে যেতে পারেনা, সরকারী হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে যাদের মৃত্যু হয়, সেই মানুষগুলোকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেয়া যাবে না কোনভাবেই। সেজন্যেই তো নিজে না খেয়ে টাকা জমিয়েছেন এতগুলো বছর ধরে, ছেলেদের ডাক্তারী পড়িয়েছেন, মেয়েদের নার্সিং ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছেন।

জমানো টাকা ভেঙে চব্বিশ পরগণার হাঁসপুকুরে এক টুকরো জমি কিনলেন সুভাষিণী। লোকে জমি কেনে বাড়ি করবে বলে, সুভাষিণী কিনলেন হাসপাতাল বানাবেন বলে, তাও গরীব মানুষের জন্যে! বড় ছেলে অজয় ততদিনে ডাক্তার হয়েছে, তাকে ডেকে নিজের ইচ্ছের কথা জানালেন সুভাষিণী। শুরু হয়ে গেল এতদিনের স্বপ্নপূরণের মিশন।

১৯৯৩ সালে ছোট্ট একটা টিনের ছাউনি দেয়া ঘরে শুরু হয়ে গেল হাসপাতালের কার্যক্রম, গ্রামের মানুষজনের সহায়তায় গঠিত হলো ট্রাস্টি বোর্ড। প্রথম দিনেই আড়াইশোর বেশী গরীব রোগীকে বিনেপয়সায় চিকিৎসা দেয়া হলো, নিজেদের উদ্যোগেই মেডিকেল ক্যাম্প করলেন অজয় আর তার ডাক্তার বন্ধুরা। রোগীদের ভীড় দেখে অজান্তেই সেদিন নিজের চোখে জল এসেছিল সুভাষিণী মিস্ত্রির।

টিনশেড সেই ঘরটা এখন আর নেই। এক কাঠার ছোট্ট জায়গাটা এখন ছড়িয়ে কত বড় হয়ে গেছে! তিন একরের বিশাল এলাকা জুড়ে হাসপাতাল প্রাঙ্গণ, তার মাঝখানে বিশাল বিল্ডিংটা, নাম রাখা হয়েছে ‘হিউম্যানিটি হসপিটাল’। সুভাষিণীর ছেলে অজয়ই সবকিছু দেখাশোনা করে, আছে অভিজ্ঞ ডাক্তার-নার্স; আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার যেটা, এখানে রোগীদের বিনাপয়সায় চিকিৎসা দেয়া হয়। ঔষধপত্রও সরবরাহ করা হয় হাসপাতালের তরফ থেকেই।

অর্থোপেডিক, গাইনো, ইউরোলজি সহ অন্যান্য বিভাগ ও ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাও চালু হয়েছে এখানে। হিউম্যানিটি হসপিটাল এখন পশ্চিমবঙ্গের গরীব অসহায় রোগীদের সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল, দূর-দূরান্ত থেকে রোগীরা আসেন এখানে, এখানকার ডাক্তার-নার্সেরাও চেষ্টা করেন নিজেদের পক্ষে সর্বোচ্চটা করার।

সুভাষিণী মিস্ত্রির বয়স এখন আশি’র ওপরে। তেইশ বছর বয়সে স্বামীকে হারানোর পরে যে সংগ্রামটায় লিপ্ত হয়েছিলেন তিনি, সেটার ফল এখন পাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের গরীব মানুষেরা। পুরো চব্বিশ পরগণা কিংবা গোটা রাজ্যেই সবাই তাকে একনামে চেনে, হিউম্যানিটি হসপিটালের কথা জানে সবাই।

শুধু হিউম্যানিটি হসপিটালই নয়, ঘুর্ণিঝড় সিডরের পরে সুন্দরবনের উপকূলীয় এলাকায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যে পঁচিশ শয্যার আরো একটি হাসপাতাল স্থাপন করেছেন সুভাষিণী, এখানেও গরীব রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হয়। সুভাষিণীর এই মহৎ কীর্তিকে সম্মান জানিয়েছে তার রাষ্ট্রও, এবছর তাকে প্রদান করা হয়েছে ‘পদ্মশ্রী’ সম্মাননা।

বাস্তবতা কখনও কখনও কল্পনাকেও হার মানায়। মানুষের বাড়িতে কাজ করে, দিনমজুরি করে, সবজি বিক্রি করে এক-দুই-পাঁচ টাকা করে জমিয়েছিলেন সুভাষিণী। অভাবের তাড়নায় না খেয়ে থেকেছেন, তবু সেই সঞ্চয়ে হাত দেননি কখনও; সেটাকে ‘গরীব মানুষের অধিকার’ হিসেবে আগলে রেখেছেন বছরের পর বছর।

অবশেষে হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নটা পূরণ করেছেন তিনি। অমানবিকতার অন্ধকারে মানবতার ডাকে অসাধ্য সাধন করা সুভাষিণী মিস্ত্রি তো অনন্য একজন, যাকে নিয়ে পুরো মানবসভ্যতাই গর্ব করতে পারে। সুত্র: ইনসাইড বাংলাদেশ।

 

প্রসব পরবর্তীকালীন বিষণ্ণতা

ডা.সংগীতা হালদার রায়


কিছুদিন আগে এক দাওয়াতে গিয়ে ‘বেবি ব্লুজ’ বা ‘প্রসব পরবর্তীকালীন বিষণ্নতা’ নিয়ে কথা উঠেছিলো।

টেবিলে বসা পুরুষদের একাংশের ধারণা এটা মর্ডাণ মেয়ে / মায়েদের হয় যেহেতু তারা ক্যারিয়ার / শপিং / স্টাইলিং ইত্যাদিকে জীবনে অত্যাধিক প্রাধান্য দিয়ে থাকেনন যা আগের যুগের মায়েদের বেলায় হত না।

সেই রাত থেকেই মনে হচ্ছে একজন ডাক্তার ও মা হিসেবে আমার উচিত আমার বন্ধুদের কিছু জানানো যা আমি জানি;

বেবি ব্লুজ : বই অনুযায়ী ৭০% – ৮০% মায়েদেরই হয়। আমার ধারণা আরো বেশি সংখ্যায় হয়ে থাকে কিন্তু ডাক্তারের কাছে ‘কেস’ খুব কম আসে বলেই বই এ ডকুমেন্টারি কম আছে।

হওয়ার কারণ : প্রেগন্যান্সির সময় প্রয়োজনয়ীয় হরমোন ১০০ – ১০০০ গুন (100- 10000 fold decrease) কমে যাওয়া এবং MAO – A হরমোনের হঠাৎ বেড়ে যাওয়া যা ব্রেইন সেলে বিষণ্নতা উৎপন্নকারী হরমোন বাড়িয়ে দেয় ।

সময় : প্রসবের পর থেকে শুরু হয় এবং ২-৩ সপ্তাহ স্থায়ী হয় সাধারণত । দিনে কয়েক মিনিট থেকে কয়েক ঘন্টা হতে পারে এর স্থায়ীত্বকাল ।

স্টেজ: মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায় ।

(লক্ষণ সমূহ হিসেব করলে ডাক্তারী হিসেব মতে মোট ৬ টা স্টেজ , কিন্তু যারা ডাক্তার নন আবার সচেতন থাকতে চান তারা তিনটা জানলেই চলবে )

ক) বেবি ব্লুজ
মন খারাপ হয় কারণ ছাড়া, শুধু শুধুই কান্না পায় ( weeping ), খুব বেশি গুরুতর কারণ ছাড়াই বিরক্তি লাগে , মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে , বাচ্চা ও বাচ্চার যত্ন নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন হয় (বাচ্চার বাবার কোলে বাচ্চা দিতেও টেনশন হয় )

প্রতিকার
শুধু মিষ্টি ব্যবহার , সহানুভূতিসম্পন্ন কথা ও ব্যবহার (তুমি ঠিক পারবে , সবারই এরকম অসুবিধা হয় আর এটাই স্বাভাবিক) বাচ্চা সামলাতে সহানুভূতিশীল সাহায্যই যথেষ্ট’
‘আমরা তো অমুক করেছি’ বা ‘আমরা যেন আর বাচ্চা সামলাই নাই ‘ টাইপ কথা বলা মানুষজনকে ১০০ x ২ = ২০০ হাত দূরে রাখা খুব দরকার।

খ) পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন
বাচ্চা হবার তিন মাস পরেও যখন লক্ষণসমূহ থেকেই যায় বরং আগের সমস্ত লক্ষণ আরো প্রকট হয় , নিজের ছোট্ট বাচ্চাকে সহ্য করতে না পারা , নিজের উপরে নিজের অসন্তোষ , নিজের ক্যারিয়ার + নিজের রূপ সবকিছু নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগা, নিজের জীবনের প্রতি মায়া চলে যাওয়া।

প্রতিকার
কোন এমন মানুষের সাথে মনের কথা বলা যার উপরে মা পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন , বাচ্চা সামলানোর জন্যে সাহায্যকারী যাতে মা অন্য কিছু করেও নিজেকে ভুলিয়ে রাখতে পারেন, একটু কোথাও ঘুড়ে আসা তা পাশের পার্কেও হতে পারে

গ) পোস্টপারটাম সাইকোসিস
মা মনে করতে থাকেন শুধু তিনি মরে গেলেই মানুষ বুঝবে যে তিনি তার শিশুকে কত্ত ভালোবাসতেন , আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং শিশুকে মেরে ফেলার ঘটনাও লিপিবদ্ধ আছে ।

পরিশেষে বলবো , এরকম আগেও হত ( ঘরে ছোট ভাইবোন আসার পরে মায়ের পিট্টি খাওয়া বা অতিরিক্ত কাজের চাপ নিয়ে মায়ের খিটখিটে হয়ে যাওয়া বা মা- বাবার / মা- দাদীর ঝগড়া বেড়ে যাওয়ার স্মৃতি মনে করে দেখুন ) আর এর সাথে ‘MODERNISM’ কোন সম্পর্ক নেই ।

‘উত্তম ব্যবহারেই উন্নত বংশের পরিচয়’ আর ‘সৃষ্টিকর্তাও একজন প্রসবিনীর প্রসব-পূর্ব সমস্ত পাপ মাফ করে দেন’ এগুলো তো অনেক প্রচলিত জানা কথা ।
কাজেই একটু ধৈর্য ধরে সহানুভূতিশীল ব্যবহার করুন। কারণ প্রতিটি মা-ই তার সন্তানকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসেন । তাকে মন ও শরীরে সম্পূর্ণ সুস্থ একজন মা হয়ে ওঠার সময়টুকু দিন প্লিজ।

ফরমাল লেকচারার
শাহাবুদ্দিন মেডিকেল কলেজ, ঢাকা

 

‘প্রি- টিনেজার ও টিনেজার প্যারেন্টিং’ পর্ব-৩

ফাতিমা খান


বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা মানেই আমার ঘরে অন্যরকম একটা আমেজ । বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরলে ওদের ক্লান্ত চেহারাতেও একটা “তাইরে নাইরে না” টাইপ ভাব দেখি। আমার শত ক্লান্তির মাঝেও ওদের আনন্দ আমাকে পেয়ে বসে, বৃহস্পতিবারের সন্ধ্যা থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ওদের “যা খুশী তাই কর” দিন, রুটিন-ছাড়া, বাধনহারা সময়। আমার বয়সটা ঠুস করে কমে একদম ওদের সমান সমান হয়ে দাঁড়ায়।

বাচ্চাদের মাঝে মাঝে এই ছাড় দেওয়া ওদের অনেক রিল্যাক্স আর রিফ্রেশ করে। আজকাল স্কুল কলেজের পড়াশোনার চাপ এত বেশী থাকে যে ওরা নিজস্ব সৃজনশীলতা প্রায় হারাতে বসেছে। প্রত্যেক মানুষ কোন না কোন বিশেষ গুণ নিয়েই পৃথিবীতে আসে।

এই বিশেষ গুনগুলো লালন করার জন্য একটু অবকাশ খুব দরকার যেন পরের ব্যস্ত ওয়ার্কিং ডে গুলোর জন্য ওদের দেহ ও মন-মস্তিষ্ক সতেজ হয়।

সংসার, চাকুরী, ঘর সামলে ক্লান্ত শুধু আমরাই হই না, ওরাও হয়, কিন্তু ধরন আর কারণটা ভিন্ন। একটু শিকল ছাড়া সময় আর বাবা মায়ের সান্নিধ্য পাওয়ার অপেক্ষাতেই মানসিক ভাবে ওরা ক্লান্ত থাকে, যা ওরাও প্রকাশ করে না আর আমরাও বুঝতে পারি না।

প্রায় বছর দুয়েক আগে আমেরিকায় করা একটা জরিপে দেখেছিলাম পনের বছর বয়স পর্যন্ত দৈনিক অন্তত আধা ঘন্টা মায়ের নিবিড় সান্নিধ্যে থাকা বাচ্চাগুলো মেধাবী হয়।

জীবন কতটা জটিল হলে মায়ের কাছে সন্তানের জন্য আধা ঘন্টা সময়ের দাবী করে জরিপ করা হয়েছিল তাই ভেবে কিছুটা হতাশও হয়েছিলাম।

আজ রাত নয়টায় বাসায় ফিরে দেখি আমার বড় ছেলে পপস্টিকাল স্টিক দিয়ে বাড়ি বানায়, ডুপ্লেক্স বাড়ি। আমার ছোটজন তার বাধ্য এসিস্ট্যান্ট। কোলের উপর বিশাল ওজন ওয়ালা ‘Big book of home plans’ বই নিয়ে ভাইকে গাইড করছে। আমার সারা ঘরের মেঝেতে সদ্য কিনে আনা ক্রাইলিক পেইন্টের ছড়াছড়ি। পপস্টিকাল স্টিকের বাড়ির ওয়াল পেইন্ট হচ্ছে।

আমাকে দেখেই বড়জন বলল, ” আম্মু আমাদের ফিউচার বাড়ির মডেল বানাই। ডুপ্লেক্স বাড়ি হবে আমাদের। নিচতলায় একপাশে নানাভাই নানুমণি থাকবে, আরেকপাশে দাদু। আমরা থাকব উপরে। নাইন সিটারের একটা গাড়ী থাকবে আমাদের। যেখানে যাব সবাই একসাথে যাব। ড্রাইভিং সিটে বসব আমি, পাশে নানাভাই। বাকী সবাই পেছনে।” আমার ছেলের চোখ স্বপ্নময়, মুখ হাসি হাসি।

ছোটজন আবার একটু ভাবুক। সে প্ল্যানের বাকীটা বলে ফেলল ” আর বাড়িটা হবে লেকের পাশে। একটা ওয়ালের পুরাটাই গ্লাসের উইন্ডো হবে। আর থাকবে অনেক বড় এয়ার এলার্ম। বাতাস আসবে আর এলার্ম বাজবে…আআআহহহহ ”(তার চোখ অলরেডি বন্ধ হয়ে গেছে)।

আমিও বোধ হয় হারিয়ে গিয়েছিলাম…!

আজ ওদের কান্ড দেখে নতুন কিছু প্যারেন্টিং এর আইডিয়া পেলাম।

♦ আমাদের প্রি-টিনেজার বা টিনেজার কে তাদের স্বপ্নগুলো লালন করার জন্য একটা মুক্ত ক্যাম্পাস দেয়া উচিৎ যেখানে তারা মনের সব কল্পনা আর রঙ মিশিয়ে স্বপ্ন গড়বে। এই চর্চাই একদিন তার যোগ্যতা ও ব্যক্তিত্ব গঠনের সোপান হবে।

♦ ওরা নিরপেক্ষ সিদ্ধান্ত দিতে পারে অকপটে, যেগুল আমরা বড়রা সাত পাঁচ ভেবে বা ইগো সমস্যার জন্য হয়ত বলতে পারি না। পরিবারের যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ওদের পরামর্শও নেওয়া উচিত। ওদের চিন্তার প্রসারতা ও ভালমন্দ জ্ঞান বাড়ানোর জন্যও এটা খুব ভাল উপায় হবে।(চলবে)

লেখিকা কর্মরত:আল হিবা মেডিক্যাল গ্রুপ,জেদ্দা,সৌদি আরব।

 

মনের মাঝে স্মৃতি প্রিয়জনের

আফরোজা হাসান


ছেলে স্কুলে আর ছেলের বাবা কাজে চলে যাবার পর দীর্ঘ পাঁচ ঘণ্টার একান্ত বাস আমার। অবশ্য বই পড়ার তীব্র নেশা থাকার কারণে সময় কাটানো নিয়ে কখনোই তেমন সমস্যায় পরতে হয় না আমাকে। উল্টো বরং সময়কে ধরার জন্য ছুটতে হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে দু’একটা দিন এমন আসে যে বই পড়তে ইচ্ছে করে না। সংসারের কাজগুলো পড়ে আছে দেখেও হাত লাগানোর তাগিদা অনুভব করে না মন। বিছানার চাদরে সামান্য ভাঁজ দেখলে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলা এই আমিই, পুরো এলোমেলো বিছানার দেখেও নির্বিকার বসে থাকি। সময়টা তখন কেমন যেন থমকে দাঁড়ায়। ঘড়ির দিকে তাকালে মনেহয় সেই কখন দেখেছি দশটা বাজে, এতক্ষণে মাত্র দশ মিনিট পেরিয়েছে……? আমার জীবনে এমন যতগুলো দিন এসেছে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও এলোমেলো করে দিয়ে গিয়েছে আমার ছোট্ট ভুবনটাকে। খুব খেয়ালি আমাকে করে দিয়েছে ভীষণ রকম বেখেয়ালি। তাই হিসেব কষতে বসলাম কেন হয় এমন? কেন মন হঠাৎ শরতের আকাশ হয়ে যায়? এই মেঘ তো এই রোদ্দুর……? বাঁধ ভাঙ্গা জোছনা ভরা আকাশে কেন আঘাত হানে কালবৈশাখীর ঝড়……? মন বলল তোমার প্রিয়জনরা যে তোমার থেকে দূরে…..বহুদূরে……….

সবার জীবনেই প্রিয় মানুষেরা সবসময় আলাদা স্থান দখল করে থাকে। জীবনে চলার পথে আমরা যত এগোতে থাকি, বাড়তে থাকে প্রিয় মানুষদের সংখ্যা। মনের পাতায় ছাপ ফেলতে থাকে কারো কথা, কারো লেখা, কারো হাসি, কারো সঙ্গ……! ধীরে ধীরে আপন অস্তিত্বের সাথে একাকার হয়ে যেতে থাকে প্রিয় মানুষগুলো। সময়ের স্রোতে ভেসে কিছু প্রিয় মানুষ দূরে চলে যায়, মনে নোঙ্গর গাড়ে নতুন প্রিয়রা। তাদেরকে সাথে নিয়ে এগিয়ে চলে জীবনের পথ। কিন্তু যারা দূরে চলে যায় নানা কারণে তারা কি সত্যিই হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে…? আমার উপলব্ধি বলে নিষ্ঠুর নিয়তি মন থেকে কাউকেই একেবারে মুছে যেতে দেয় না। আর ভুলে যে যাবো তারও উপায় নেই, কারণ তারা যে আমাদের প্রিয়জন। প্রি-য়-জ-ন…..! চাইলেই কি তাদেরকে ভুলে যাওয়া যায়…..? লাইব্রেরীতে গেলে আব্বুর সাথে বইমেলাতে ঘুরে ঘুরে বই কেনার স্মৃতি মনেপরে, ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঘুম পাড়ানোর সময় মনেপরে আম্মুর কথা, আইসক্রিম মনে করিয়ে দেয় ছোটভাইটার কথা, বেগুনী অর্কিডে বোনের মিষ্টি চেহারাটা দেখতে পাই, শিশুদেরকে যখন দেখি মনের পর্দায় ভেসে ওঠে খেলার সাথীরা। নানু-দাদু-মামা-খালামনি-চাচ্চু-ফুপ্পি…কত প্রিয়জনকে ঘিরে কত শত রঙ-বেরঙের স্মৃতি……

প্রিয়জনরা আনন্দের বারিধারা হয়ে যেমন ঝরে, প্রচণ্ড খরা হয়ে চৌচিরও করে দেয় মনের বনভূমিকে। কিন্তু কেন এমন হয়? কেন প্রিয়জনরা কষ্ট দেয়? যাদের কারণে সুখ-শান্তিকে উপলব্ধি করতে শেখে মন, তারাই আবার দুঃখ-ব্যথাকে বোঝানোর দায়িত্ব পালন করে পারদর্শিতার সাথে। তারপরও তারা যে কতোটা প্রিয় সেটা দূরে না এলে অনুভব করা যায় না সঠিকভাবে। কাছে থাকতে নির্বোধ মন মানতেই চায় না ভালোবাসা দেবার সাথে সাথে কষ্ট দেবার অধিকারও যে প্রিয়জনদের আছে। প্রিয়জনদের কারণেই যেহেতু আমাদের মনে সুখ-শান্তির অনুভূতি আসে, সেহেতু দুঃখ-বেদনা তো তারা দিতেই পারেন কারণে-অকারণে। কিন্তু আমাদের স্বার্থপর মন শুধু ভালোটাই পেতে চায় সবার কাছ থেকে। একবারও ভেবে দেখে না যে আমি কি সর্বক্ষেত্রে সবার সাথে ভালো? আমার দ্বারা কখনোই প্রিয়জনরা কষ্ট-ব্যথা পাননি বা পান না তা কি আমি জোরের সাথে বলতে পারবো………?

মতের অমিল, ঝগড়া-বিবাদ, কথা কাটাকাটি সন্তর্পনে প্রিয়জনদের সাথে সম্পর্কের ভিতকে নড়বড়ে করে দিতে থাকে। ঘুণপোকার মতো ধীরে ধীরে ক্ষয় করতে থাকে ভালোবাসার বন্ধনের খুঁটিকে। আর এই ক্ষয় হতে থাকা খুঁটির উপর ভরসা করেই চলতে থাকে জীবনের পথচলা। অথচ মন একবার যাদেরকে আপন করে নেয় তাদেরকে কখনোই ভুলে থাকা যায় না। ভুলে থাকতে চাইলেও সম্ভব হয় না। তবে জীবনের প্রয়োজনে কখনো কখনো ভুলে থাকতে হয়। স্মৃতিরা ঝাঁকে ঝাঁকে হানা দিয়ে মাঝে মাঝে মনকে ঘিরে ফেললেও, বেশির ভাগ সময়ই আমরা স্মৃতিদের এড়িয়ে চলা রপ্ত করে ফেলি। কারণ স্মৃতির ভাণ্ডারে অসংখ্য মণি-মুক্তা-জহরতের সাথে ধারালো-সূচালো কাঁচের টুকরোও যে আছে। যার সামান্য আঘাত মনকে করে ক্ষত-বিক্ষত…রক্তাক্ত…! আর কেই বা চায় হৃদয় চিড়ে বেদনা কুড়াতে…? তারচেয়ে দূরে সরে থাকা কিংবা ভুলে থাকাটাই উত্তম মনেহয়। কি জানি এটাই হয়তো জীবনের নিয়ম………..।

আমরা সবাই সবসময় আলোকোজ্বল এক জীবন পেতে চাই। কিন্তু এমন জীবন গড়ে তুলতে সম্পর্কের মাঝে প্রয়োজন ভালোবাসা-ত্যাগ আর শ্রদ্ধাবোধের সংমিশ্রণ। কিন্তু সুখের মাঝে যেমন অসুখ থাকে, তেমন ভালোবাসা-ত্যাগ আর শ্রদ্ধাবোধের সংমিশ্রণ থাকার পরও সম্পর্কের মাঝে ঘটে ছন্দপতন। এই ছন্দপতনের দ্বন্দ্বে পড়ে যাতে আমরা বিভ্রান্ত হয়ে না যাই। প্রিয়জনদের প্রতি আমাদের আচরণ যেন অসাবধানী হয়ে না যায়। একে-অন্যেকে যাতে দোষারোপ না করি, ঝাঁপিয়ে যেন না পড়ি কারো উপর জিভের তরবারি নিয়ে। ভুলে যাতে না যাই তারা যে আমাদের প্রি.য়…জন.ন…………।

বিষয়: মনের জানালা

 

শরীয়ত ভিত্তিক দাম্পত্য কাউন্সিলিং (কেস স্টাডি)- ১ম পর্ব

আফরোজা হাসান


ছোট্ট সুখের নীড় বলতে যা বোঝায় ঠিক তেমনটিই ছিল আমার জীবন। আদর, সোহাগ ও ভালোবাসায় আগলে রাখা একজন প্রেমময় অসাধারণ স্বামী। এক ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে ভীষণ আনন্দময় একটা জীবন কাটাচ্ছিলাম। প্রচন্ড ভালোবাসতো আমাকে আমার স্বামী। পিতা হিসেবেও খুবই দায়িত্ব সচেতন ছিলেন সবসময়ই। সুখের সাগরে ভেসে কাটছিল আমাদের দিন।

এরই মধ্যে একদিন জানতে পারলাম আমার স্বামীর অন্য একটি মেয়ের সাথে গোপন সম্পর্কের কথা।

প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায়নি মন। কিন্তু খোঁজ খবর নেবার পর বুঝলাম যা শুনেছি সবই সত্যি। অন্য একটি মেয়ের সাথে প্রায় দেড় বছর যাবত চলছে তার এই গোপন অনৈতিক সম্পর্ক। পুরো দুনিয়া থমকে গিয়েছিল আমার সামনে। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারণ কোনদিন স্বামীর ব্যবহার থেকে এমন কিছুই আঁচ করতে পারিনি আমি। আমাদের সম্পর্কের মাঝেও কখনোই এমন কোন সমস্যা আসেনি যে সে এমন কিছু করতে পারে। কি করবো কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না। কার কাছে বলবো এই ভয়াবহ লজ্জার কথা?!

কয়েকটা দিন গোপনে শুধু কান্না করেছি আর আল্লাহর কাছে সাহায্য চেয়েছি। আমার মানসিক অবস্থা দেখে স্বামী খুবই অস্থির হয়ে পড়েছিল। বারবার জানতে চাইছিল কি হয়েছে আমার। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করে দিয়েছিল। তখনো আমার ভাবতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো এত ভালোবাসা যার চোখে মুখে সে কেমন করে এমন করতে পারলো আমার সাথে? কেমন করে অন্য মেয়ের সাথে জড়ালো?!

শেষপর্যন্ত খুব কাছের এক বান্ধবীর কাছে খুলে বললাম মনের সব কথা। বান্ধবীটি খুবই প্রাক্টিসিং একজন মুসলিমাহ ছিলো। সে আমাকে সাহস দিলো। আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ধৈর্য্য ধারণের পরামর্শ দিলো। বললো পরিবারকে না জানিয়ে আগে নিজেই স্বামীর সাথে কথা বলতে। যেহেতু আমার আর আমার স্বামীর মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল বিয়ের প্রথম থেকেই। আমি বান্ধবীর পরামর্শ মেনে নিয়েছিলাম। সরাসরি আমার সন্দেহের কথা স্বামীকে বললাম। প্রথমে সে অস্বীকার করলেও একসময় মেনে নিলো তার অনৈতিক কাজের কথা। খুবই অনুতপ্ত হয়েছিল সেদিন সে। বারবার আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলো। ভুলের পথ থেকে ফিরে আসবে এই ওয়াদা করলো।

আমি চাইনি আমার সংসারটা ভেঙ্গে যাক।

প্রথমত, আমার সংসার সুখেরই ছিল এই ঘটনা জানার আগে।

দ্বিতীয়ত, আমাদের তের বছর ও নয় বছর বয়সী দুটি ছেলে-মেয়ে ছিল। সংসার ভাঙ্গা মানে তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দেয়া।

তৃতীয়ত, আমি স্বাবলম্বী কোন নারী না। বাবার বাড়িতেও আমার বোঝা তুলে নেবেন হাসিমুখে এমন কেউ নেই। আর সবচেয়ে বড় কারণ দীর্ঘ পনেরো বছরের সংসারের মায়া এত সহজে ছেড়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

এরচেয়েও বড় কারণ স্বামীর প্রতি আমার ভালোবাসা নিখাদ ও পবিত্র ছিল। তাই সংসারটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যতটুকু ত্যাগ স্বীকার আমার পক্ষ থেকে করা সম্ভব ছিল আমি করেছি। এরপরের তিন-চার মাস ভালোই কেটেছে আমাদের। তারপর আবারো জানতে পারলাম যে আমার স্বামী ঐ পথ থেকে ফিরে আসেনি। সে এখনো মেয়েটির সাথে যোগাযোগ করেই চলছে। চলছে তাদের অনৈতিক সমস্ত কাজকর্মও। খুব ভেঙে পড়লাম তখন মানসিক ভাবে। মেয়েটির বয়স তেরো বছর। অনেককিছুই বুঝতে শিখেছিল ততদিনে। আঁচ করে ফেলেছিল কিছু একটা সমস্যা চলছে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মাঝে। আবারো ছুটলাম সেই বান্ধবীর কাছে। ওর পরামর্শ মতো আপনার কাছে এলাম।

একদম চুপ করে কোন রকমের বাঁধা না দিয়ে ভদ্রমহিলার সব কথা শুনছিল নুসরাহ।

আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার স্বামীর এমন অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ার পেছনে আপনার নিজের দায় কতটুকু সেটা কি কখনো ভেবে দেখেছেন?

চলবে…

পর্ব-৩