banner

সোমবার, ২০ মে ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: May 16, 2024

 

“বিউটি খুন” খুনির হাতে তুলে দিয়েছিল স্বয়ং বাবা ছায়েদ!

বহুল আলোচিত হবিগঞ্জের বিউটি আক্তার হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে এসে পড়েছে। এ লোমহর্ষক ঘটনার সাথে জড়িত বিউটির বাবা ছায়েদ আলী শনিবার পাঁচ ঘন্টা ধরে অবকাশকালীন দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট তৌহিদুল ইসলামের কাছে বিউটি হত্যার পুরো কাহিনী বর্ণনা করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। এ নিয়ে বিউটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিউটির বাবা ছায়েদ মিয়া, ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ও কাজিন ময়না মিয়া আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন।

হত্যাকাণ্ডের পর যার ফাঁসির জন্য দেশ উত্তাল ছিল সেই প্রেমিক বাবুল মিয়া শুধু বিউটি আক্তারের সাথে প্রেমের কথা স্বীকার করেন এবং একসাথে বসবাস ও একসাথে চাকরি করার কথা স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন। যার বসতঘর থেকে বিউটি আক্তারকে নিয়ে আসা হয়েছিল বিউটি আক্তারের সেই নানি ফাতেমা আক্তার ১৬৪(১) ধারায় স্বাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন আদালতে। একইভাবে স্বাক্ষী হিসাবে জবানবন্দী দিয়েছেন ঘাতক ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা আক্তার। বাড়িতে নেই বিউটি আক্তারের মা হুসনে আরা ও ভাই সাদেক মিয়া। একটি সূত্র জানিয়েছে, তারা বেশ কয়েক দিন যাবত আইন শৃংখলা বাহিনীর হেফাজতে আছেন। তবে এ কথা স্বীকার করেননি মামলার আইও শায়েস্তাগঞ্জ থানার ওসি মানিকুল ইসলাম।

প্রেম থেকে পলায়ন : বাবুল মিয়া ও বিউটি আক্তারের বাড়ি একই গ্রামে শায়েস্তাগঞ্জ থানার ব্রাহ্মনডুরায়। বাবুল মিয়া বিবাহিত হলেও তাদের মাঝে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠে। আর্থিকভাবে অনেকটা স্বচ্ছল বাবুল মিয়ার সাথে গত ২১ জানুয়ারি পালিয়ে যান বিউটি আক্তার। বিউটি আক্তার পালিয়ে যাওয়ার পর তাকে ফিরিয়ে আনার তেমন কোনো উদ্যোগও নেননি ছায়েদ মিয়া। সবকিছু ভালোভাবেই চলছিল। বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর বিউটি আক্তার চাকরি নেন তাদের গ্রামের পাশেই গড়ে উঠা একটি কোম্পানিতে। প্রতিদিন পরিবারের লোকজনের চোখের সামনেই বিউটি আক্তার বাবুল মিয়ার আলাদা বসতঘর থেকে কোম্পানিতে যাওয়া আসা করে। হঠাৎ করেই কোম্পানি থেকে বিউটি আক্তারকে নিয়ে আসেন তার বাবা মা। বিউটি আক্তারের ভাষায় “আমি আসামি বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর একটি কোম্পানীতে চাকুরী শুরু করি। ঐ কোম্পানী হতে আমার আব্বা আম্মা আমাকে নিয়ে আসে। আমি ঘটনার তারিখ হতে নিজের ইচ্ছায় আসামী বাবুল মিয়ার সাথে ১৮ দিন ছিলাম”। পরে মামলা দায়ের করা হয়।

ইউপি নির্বাচনে বন্ধুর স্ত্রীর পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে নিজ মেয়েকে হত্যা : বিউটি আক্তারের পিতা ছায়েদ মিয়া এবং একই গ্রামের ময়না মিয়া ঘনিষ্ঠ বন্ধু। গত ডিসেম্বর মাসে হবিগঞ্জের ৭৮তম ইউনিয়ন হিসেবে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ব্রাহ্মনডুরা ইউনিয়নে। সেই নির্বাচনে মহিলা মেম্বার প্রার্থী ছিলেন ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ময়না মিয়ার স্ত্রী আসমা খাতুন। তিনি নির্বাচনে পরাজিত হন। নির্বাচনে বিজয়ী হন বিউটি আক্তার ধর্ষণ মামলার প্রধান আসামি বাবুল মিয়ার মা কলম চান বিবি। সেই থেকে বিরোধ শুরু।

বিউটি আক্তার বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যাওয়ার পর কলম চান বিবির পরিবারকে একটি বড় শিক্ষা দেয়ার জন্য বিভিন্ন ফন্দি আটতে থাকেন ময়না ও ছায়েদ মিয়া। এরই অংশ হিসাবে প্রথমে বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে অপহরণ ও ধর্ষণের মামলা দায়ের করেন ছায়েদ মিয়া। পরিকল্পিতভাবে সেই মামলার অন্যতম স্বাক্ষী হিসাবে রাখা হয় ময়না মিয়াকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে দায়েরকৃত অপহরণ ও ধর্ষণ মামলাটি তখনো আদালত থেকে থানায় পৌছেনি। এরই মধ্যে বাবুল মিয়ার বিরুদ্ধে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে ফৌজদারী কার্যবিধির ১০৭ ধারায় জানমালের নিরাপত্তা চেয়ে আরো একটি মামলা দায়ের করেন ছায়েদ মিয়া। এসব মামলা পরিকল্পিত একটি হত্যাকাণ্ড ঘটানোর জন্য ক্ষেত্র তৈরী করাই উদ্দেশ্যে ছিল বলে মনে করছেন অনেকেই। ওই ২টি মামলার গুরুত্ব কমিয়ে দেন বিউটি আক্তার নিজেই। তিনি গত ১২ মার্চ তারিখে ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছে নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে বাবার আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, নিজ ইচ্ছায় তিনি বাবুল মিয়ার সাথে পালিয়ে যান এবং তারা একসাথে বসবাস করেন। বিউটি আক্তারের জবানবন্দী ফলে বাবা ছায়েদ মিয়া ও বাবার বন্ধু ময়না মিয়ার পরিকল্পনা অনেকটা ভণ্ডুল হয়ে যায়। শুরু হয় নতুন কৌশল। এবার বিউটি আক্তারকে খুন করে বাবুল মিয়া ও কলম চান বিবিকে ফাঁসানোর ষঢ়যন্ত্র করেন তারা।

ঘাতকদের হাতে নিজ মেয়েকে তুলে দেয় ছায়েদ মিয়া : বাবুল মিয়া, তার মা কলম চান এবং প্রতিবেশী সাথী আক্তারকে আসামি করে বাবার মামলা দায়ের করার বিষয়টি পছন্দ ছিল না বিউটি আক্তারের। বাবুল মিয়ার সাথে বিউটি আক্তারের গভীর প্রেমের কারণে বাবা-মার সাথে বিউটি আক্তারের প্রায়ই বচসা হতো বলে জানা গেছে। আবারো বাবুল মিয়ার সাথে বিউটি আক্তার চলে যেতে পারে এমন আশঙ্কা থেকেই লাখাই উপজেলার গুণই গ্রামে বিউটি আক্তারের নানার বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয়।

অবশেষে সেখান থেকে বিউটি আক্তারকে নিজ বাড়িতে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নিয়ে আসেন ছায়েদ মিয়া।

বিউটির নানী ফাতেমা আক্তারও স্বীকার করেছেন, তার বাড়ি থেকে ছায়েদ আলীই বিউটিকে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যেই অপেক্ষা করছিল ঘাতকরা। ঘাতক ছায়েদ আলীরই বন্ধু ময়না মিয়া। ময়না মিয়াদের হাতে মেয়েকে তুলে দিয়ে চলে আসেন ছায়েদ মিয়া। পরের ঘটনা সবুজ শ্যামল ঘাসের উপর বিউটি আক্তারের ক্ষতবিক্ষত লাশ। স্বাধীনতা মাসের ১৭ মার্চ তারিখের সেই লাশের ছবি দেখে হতবাক দেশ। লাল রংয়ের জামা কাপড় পরা বিউটির লাশটি ছিল সবুজের মধ্যে লাল বৃত্তের মতো। বিষয়টি প্রথমে একটি সাধারণ হত্যাকাণ্ড হিসাবেই দেখা হয়েছিল। মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা সমালোচনা হয় দেশে বিদেশে।

ঢাকায় সাংস্কৃতিক কর্মীরাও মানববন্ধন করেন বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডের মূল আসামি বাবুল মিয়ার ফাঁসির দাবিতে। প্রতিদিন টিভি মিডিয়ায় স্বাক্ষাতকার দিতে থাকেন ছায়েদ মিয়া, তার স্ত্রী হুসনে আরা এবং ছায়েদ মিয়ার বন্ধু ময়না মিয়া। তুমুল প্রতিবাদের মুখে সিলেটের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে গ্রেফতার করা হয় বাবুল মিয়াকে। সে বিউটির সাথে প্রেমের কথা স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে কিছু আলামত দেন আইন শৃংখলা বাহিনীকে, যাতে খুব সহজে হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করতে পারে পুলিশ। হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনের মাথায় প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বিউটি আক্তার হত্যাকাণ্ডের সাথে জন্মদাতা পিতা মাতা ও তাদের বন্ধুরা জড়িত।

কার কাছে কে নিরাপদ :

২০০৩ সালের ঘটনা। হবিগঞ্জের রেললাইনে পাওয়া যায় অষ্টাদশী এক কিশোরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ। সেই লাশ ছিল সদর উপজেলার গোপায়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ইছাক মিয়ার কন্যার। তখনো ঝড় উঠেছিল সর্বত্র। কয়েক দিনের মাথায় প্রমাণিত হয় প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজের মেয়েকে খুন করেছেন ইউপি চেয়ারম্যান ইছাক মিয়া নিজেই। সেই মেয়ে খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় ইছাক চেয়ারম্যানের। জামিনে মুক্তি পাওয়ার কিছু দিনের মাথায় ইছাক মিয়া খুন হন বাড়ির সীম সীমানা-সংক্রান্ত বিষয়কে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের আঘাতে।

রংপুরের এডভোকেট রথীশ চন্দ্র ভৌমিক। নিখোঁজ হওয়ার পর সেই ধরপাকড়। অবশেষে প্রমাণিত হয়েছে স্ত্রীর কাছেই প্রাণ দিতে হয়েছে স্বামী রথীশ ভৌমিককে।

হবিগঞ্জের আলোচিত বিউটি হত্যা। হত্যাকাণ্ডের ২০ দিনের মধ্যে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে বিউটি হত্যাকাণ্ডের সাথে বাবা নিজেই জড়িত। এসব ঘটনার পর সর্বত্র একই প্রশ্ন আসলে কার কাছে কে নিরাপদ? সুত্র:নয়াদিগন্ত

 

নাইওর

মুক্তারা বেগম নদী


অদ্ভুত বিষণ্ন এক বিকেল, যেন এক একটা কালো চাদরে নিজেকে জড়িয়ে আছে পুরো পৃথিবীটা। বেশ মেঘ করেছে আকাশে, গুমোট বৃষ্টি হবে, যেন এক অভিমানী কিশোরী গাল ফুলিয়ে আছে।

ইশা জানালার দিকে তাকিয়ে অনেক দূরে কোথাও কিছু দেখার চেষ্টা করে কিন্তু কি দেখছে কিংবা দেখতে চায় নিজেও জানে না। জীবনের এই প্রান্তে এসে হালখাতার দিকে তাকিয়ে খরচের তালিকাটা অনেক লম্বা, অনেক। জমার খাতা শূন্য। স্বপ্নগুলো বন্দি নিয়তির কাছে আর ইচ্ছেগুলো পাখা ভেংগে পড়ে আছে বিরান ভূমিতে।

আজকাল ওর খুব ইচ্ছে করে দূরে বহুদূরে, কেউ নিয়ে যাক তাকে কোন সবুজ পাহাড়ে, ছোট সুন্দর সবুজ ঘেরা-নদী ঘেঁষা কোন গাঁয়ে। নিজেকে কেবলই খাঁচায় পোষা বন্দি পাখির মতো মনে হয়। জন্মাবধি একটা শিকড় উপড়ানো গাছের মত জীবন চালিয়ে আসছে। কিন্তু সত্যিকারের বেড়ানো বলতে সে তেমন কোথাও যায়নি। কি অদ্ভুত একটা কষ্ট হয় ইশার, কষ্ট হয় সে আজও সমুদ্র দেখেনি, পাহাড় দেখেনি, ঘন সবুজ বন দেখেনি। আজ কতদিন হল কোথাও যায় না, কেউ আসেও না তেমন। নাক উঁচু স্বভাবী ইশার সব কিছুতেই খুঁতখুঁতে, বন্ধুত্বেও । হাসি খুশি প্রাণবন্ত ইশার খুব বেশি কাছের বন্ধু বেশি ছিলো না কখনোই। আর যারা ছিল বা আছে তারা খুব বিশেষ কেউ না।

জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে আজকাল হিসেবে খালি গোলমেলে মনে হয়। ইশা ভেবেই পায় না ভুলটা কোথায় ছিল!
পাশের বাসার ভাবি নাইওর গেল, খুশি যেন তার ধরে না। কবে থেকেই গল্প করছে ইশা আমি বাপের বাড়ি যাচ্ছি, মা আমার জন্য অনেক রকম আচার বানিয়ে রেখেছে আর পিঠাপুলি! জানই তো পিঠে পুলি আমার ভীষন পছন্দ। মা আমার অনেক রকম পিঠে পুলি করতে জানেন। আসার সময় তোমার জন্য নিয়ে আসব।
ইশা প্রতি উত্তরে শুধু মিষ্টি হাসে।

ভাবি অনেক সুখী মানুষ, বর ভাল চাকরী করে, নিজের ফ্ল্যাট-গাড়ি সব আছে, পরীর মত দুটো মেয়ে, ইশা আন্টি বলতে পাগল তারা। ভাবির একটাই গোপন দু:খ, ছেলে নেই। তার বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ির এত সহায় সম্পত্তি কার জন্য, এই নিয়ে দুশ্চিন্তা। তবু এর মধ্যেই নিয়ম করে পার্লারে যান। বলেন ইশা, চেহারা ঠিক না রাখলে কি উপায় আছে! আজকালকার পুরুষ মানুষ গুলো হারামী, কোন দিকে আবার মজে যায় কে জানে। ভাইয়ের অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরী হলেই অস্থির পাগল হয়ে যান। প্রথম প্রথম ইশা ভাবত এটা প্রেম, এখন জানে এটা নিরাপত্তাহীনতা, একজন সাধারনত বাঙালি রমণীর।

ইশাও অপেক্ষা করেছিল অনন্তকাল, অপেক্ষা করেছে, নৈবদ্য সাজিয়েছে, বিরহে কাতর হয়েছে, কালিদাসের বিরহের কাব্যের মত তার অপেক্ষা, বিরহ আর ভালবাসার কথা কেউ জানে না। কেউ জানে না কত খানি অনলে পুড়েছে, কত রক্তক্ষরণ ঝরেছে তার। সেও এমন করে কোন এক সুখী রমণীর মত প্রতিটা সন্ধ্যায় কারো জন্যে অপেক্ষা করতে চেয়েছিল। সেও চেয়েছিল মাঝ দুপুরে কাউকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে, এই তুমি খেয়েছ? আজও কিন্তু মিষ্টি খেতে ভুলো না যেন !

ফেরার পথে সে প্রায়ই নিয়ে আসত ইশার প্রিয় বেলী বা কদম। সূর্য তার সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়ে যখন শ্রান্ত, প্রিয় মানুষটির জন্য তার পছন্দের রান্না শেষ করে, টেবিল সাজিয়ে ইশা তখন স্নান সেরে শাড়ী পড়ে, পিঠ জুড়ে একরাশ ভেজা চুল নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়াত। নিজেকে সাজাতো তার পছন্দের রং এর কাঁচের চুড়ি, টিপ আর নাকফুলে, মাঝে মাঝে হয়ত কাজলও আঁকতো চোখে। ছুটির দিন বিকেলটা কাটত প্রিয় ব্যলকনিতে, ছোট বাগানটায় পাশাপাশি মুখোমুখি চায়ের কাপ হাতে। সেই সাথে শুনত চৌরাশিয়ার বাঁশি, প্রিয় গজল বা কোন প্রিয় কবিতা। কিংবা হঠাৎ কোন দিন কোন ছোট নদীর তীরে, সবুজ বনের ধারে কোন এক পুরোনো পোড়াবাড়ি দেখতে যেত । নাহ ইশার জীবনে কোন প্রেম বা সুখের স্মৃতি নেই। তার প্রেম, অপেক্ষা আর বিরহ অদেখা আর মলিন, রবী ঠাকুরের ছোট গল্পের মতই, শেষ হয়েও হয়নি শেষ।

ইশারও খুব ইচ্ছে করে নাইওর যেতে। ওর কাছে নাইওর শব্দটা অনেক মিষ্টি লাগে। আহ, নাইওর! সে তো বিয়ের পর বাপের বাড়ি যাওয়া। ইশার বাপের বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি বলে কিছু নেই। কিন্তু নিজের বাড়ি আছে। ক’টা মেয়ের নিজের বাড়ি হয়? ইশার হয়েছে কিন্তু ইশা নিজের বাড়ি চায়নি। সে চেয়েছিল বাপের বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি। সেও চেয়েছিল বছরে ২/৪ বার বাপের বাড়ি নাইওর যাবে আর যাবার সময় তার প্রিয় মানুষটি ভীষন রকম মন খারাপ করে থাকবে। যেতে দিতে চাইবে না আবার বলবে আচ্ছা যাও, ২ দিন পরেই কিন্তু আমি তোমায় নিতে আসব। ওইদিকে মা বাবা, ছোট ভাই বোন অস্থির হয়ে থাকবে ইশার জন্য। বাবা লঞ্চ ঘাটে সেই সকাল থেকে দাঁড়িয়ে থাকতেন, ইশার মাও ভাবির মায়ের মত আচাড়, পিঠে পুলি, ছোট মাছ, বাগানের নানান রকম সবজি রান্না করতেন। রান্না করতেন ইশার প্রিয় হালুয়া, ওর রুমটা সাজানো থাকত ঠিক বিয়ের আগের মতই।
ইশার কোনদিন নাইওর যাওয়া হয়নি, হবেও না। বাড়িই যায় না কত বছর, শুনেছে এখন ব্রিজ হয়েছে, এখন আর ফেরী পার হতে হয় না। অথচ এই ফেরী পার হবার সময় কত রকমের মানুষ দেখত ও। কেউ আসছে, কেউ যাচ্ছে।

যাত্রীদের মধ্যে দম্পতি থাকলে ও আড়চোখে দেখত, দেখতো বররা তাদের বউকে কত আদর করে এটা সেটা কিনে খাওয়ায়। গ্রামের মিষ্টি লাজুক ঘোমটা পড়া বউগুলোকে লোভীর মত দেখত ইশা। ভাবত একদিন সেও এমন করে নাইওর যাবে, বাপের বাড়ি।

বাপের বাড়ি। বাপই নেই যার তার আবার বাপের বাড়ি। বাবা হারা মেয়েগুলো কি ভীষণ একা হয়। সমস্ত পৃথিবীর দুঃখগুলো যেন পাহাড় ভেংগে পড়ে তাদের জীবনে, যেন এক অসীম প্রতিযোগিতা, কে কত কষ্ট দিতে পারে পিতৃহীনাদের! আজকাল প্রায়ই শরীর খারাপ থাকে ইশার, মাঝরাতে বা ভোরে ঘুম ভেঙ্গে যায় প্রচন্ড বুকের ব্যাথায়। নিজের প্রতি উদাসীন বলে খাওয়া দাওয়া তেমন করে না, এ্যাসিডিটি হবার সম্ভাবনা আছে কিন্তু এই ব্যাথা অন্য রকম। মনে হয় কেউ যেন কোন ধারালো ছুরি দিয়ে তার বুকটাকে ঝাঁজরা করে ফেলছে। ভীষণ কষ্ট হয়। প্রতিবারই মনে হয় আজই শেষ কিন্তু তারপরও বেঁচে থাকে, আরও বেশি পুড়বার জন্য। এক জীবনে কত যে কষ্টের রূপ দেখল ইশা!
ক’দিন পরেই পাশের বাসার ভাবি ফিরে এলেন, হাতে নানান রকম পিঠা আর আচার। সেই কখন থেকে ইশার দরজায় নক করে যাচ্ছেন। আজ ছুটির দিন, ইশা তো এত বেলা করে ঘুমায় না, সে ফজরের নামাজ পড়ে একটু ঘুমায়। কিন্তু যেহেতু কাজের দিনগুলিতে সাতটায় ঘুম থেকে উঠতে হয় তাই, ছুটির দিনেও তার একই সময়ে ঘুম ভাংগে। ভাবি ফিরে গিয়ে খাবার গুলো রেখে, নীচে ইন্টারকমে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন আজ ইশার বুয়া খালা এসেছিল কি না, দারোয়ান চাচা বলল এসেছিলো, ফিরে গেছে কারণ ইশা আজ দরজা খুলেনি। ভাবির বুকটা হঠাৎ করেই কেমন করে উঠল। পাশের রুমে গিয়ে স্বামীকে সব বললে উনিও অবাক হলেন। ইশার সাথে উনার কোন দিন কথা হয়নি কিন্তু খুবই সম্মান করেন আত্মবিশ্বাসী, স্বাবলম্বী, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মেয়েটিকে।

সকাল প্রায় দশটার দিকে সবাই মিলে সিদ্ধান্তে আসলেন ইশার বাসার দরজা ভাঙ্গার। দরজা ভেঙ্গে বাইরে থেকে সবাই ইশার নাম ধরে কিছুক্ষণ ডাকলেন, সাড়া না পেয়ে সবাই ভাবির দিকে তাকালেন। ভাবির পা যেন নড়ছিল না, হঠাৎ করেই ভাবির মেয়ে দুইটা হাউমাউ করে কান্না শুরু করল। ভাইয়া একটু মৃদু ধাক্কা দিলেন ভাবির পিঠে, ভাবি অনেক কষ্টে এক পা এক পা করে ইশার বাসার ভিতরে ঢুকলেন।

ইস কি মিষ্টি গন্ধ বেলী ফুলের, অনেক সুন্দর সাজানো গোছানো সংসার ইশার। আস্তে আস্তে করে শোবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। ইশার প্রিয় নীল রংয়ের পর্দাগুলো যেন অসহায় ভাবে ঝুলছে। মাথার উপর সিলিং ফ্যানের একঘেয়ে শব্দ ছাড়া ঘরে আর কোন আওয়াজ নেই। বাইরে দরজার কাছে সবাই এক অশুভ আতঙ্ক নিয়ে অপেক্ষা করছেন। ইশা, অভিমানী, একাকী, নিঃসঙ্গ মেয়েটি নিথর হয়ে পড়ে আছে বিছানার এক পাশে। একটা হাত বিছানার বাইরে। যেন কোন কিছু হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার অপেক্ষায়, যেন কাউকে ডাকছে ব্যাকুল হয়ে। সাইড টেবিলের পানির গ্লাসটি নীচে পড়ে ভেংগে আছে। আশেপাশে পানি নেই এক ফোঁটাও। চলে যাবার আগে বুঝি খুব তৃষ্ণা পেয়েছিল মেয়েটির। আহা শেষ বেলায় এক ফোঁটা পানিও পেল না! ঘাড়টা হেলে আছে বাঁকা হয়ে। ঠোঁটগুলো শুকিয়ে কেমন খটখটে হয়ে আছে। ভাবির খুব ইচ্ছে করে ইশাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি খাওয়াতে কিন্তু বড্ড দেরী হয়ে গেল যে।

আজ ইশা নাইওর যাচ্ছে, বাপের বাড়ি, বাপ সোহাগী মেয়েটির খুব ইচ্ছে ছিল বাপের পাশে যেন ওকে শুইয়ে দেয়া হয়। ফেরী পার হবার সময় কেবলই বারবার মনে হচ্ছিল পাশের বাসার ভাবির, কথাটি। নাইওর শব্দটা অনেক প্রিয় ছিল মেয়েটার, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত নাইওর যাচ্ছে কিন্তু এভাবে কেন? ”

জীবনের অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মেলে না, জানা হয় না, কোন কোন মানুষ এত কষ্ট পায় কেন, কেন এত অপূর্ণতা তাদের জীবনে? কেন কোন কোন তারা তাদের সমস্ত উজ্জ্বলতা দিয়ে অন্যের জীবনে আলো ছড়িয়ে নি:শব্দে ঝরে যায়?
খুব বেশি কিছু চেয়ে ছিল কি, মেয়েটি?