banner

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫ ইং, ,

Monthly Archives: May 2025

 

‘মিম হত্যাকারী চালকদের অণুঘটক কে’

ডা. এম এস কবীর জুয়েল


“এই সব ‘বিকৃত হাসি’-ই ওই সব পাষাণ হৃদয়ের অনুপ্রেরণা ও অনুঘটক, যাহাদের কারনে আমরা সারা মাস ব্যাপিয়া ওদের কাউন্সিলিং করিয়া রাস্তায় ছাড়িয়া দিলে-ও তাহারা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়া যায়”

রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত। ওই দুর্ঘটনায় মারা যাওয়া দুইজন হলেন- শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী দিয়া খানম মিম ও বিজ্ঞান বিভাগের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল করিম রাজিব।

আমার অভিজ্ঞানে পরিবহন কর্মীদের ৫৬% মাদকাসক্ত ও বিকৃত মানসিকতায় আক্রান্ত, আমাদের CSR(Corporate Social Responsibility) -এর অধীনে স্বল্পমূল্যের মাদকাসক্তি চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র গুলোর পরিসংখ্যান তা-ই বলে। ব্যস্ততা সত্ত্বেও অভিজাত এলাকার সেন্টারগুলো থেকে সময় বের করে আমি অনেক কাঁদা জল পেরিয়ে নগরীর ঘিঞ্জি এলাকায় সপ্তাহে এক দিন হলেও যাই। ওদেরকে সৎ ও সুন্দর জীবনবোধ, পেশাগত শৃঙ্খলা, মানবতা ও সর্বোপরি মাদকমুক্ত ধর্মাশ্রয়ী উপার্জনের ওপর গুরুত্তারোপ করে থাকি।

রাজধানীতে চলাচলরত যানবাহনের অধিকাংশরই লুকিং গ্লাস, ব্রেক লাইট ও সিগন্যাল লাইট নেই। থাকলেও সেগুলো কাজ করে না। এমনকি অনেক যানবাহনের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ফিটনেসও নেই। মরদেহ দুটি পড়েছিল রাস্তায়। নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গেছে। থেঁতলে গেছে মুখ। হাত-পা ভেঙে খণ্ড খণ্ড। কংক্রিটের কালছে বর্ণের রাস্তা লাল রক্তে ভাসছে। মরদেহ দুটি ঘিরে চলছে সহপাঠীদের আহজারি, হাউমাউ কান্না আর বিলাপ।

এ দায় তো পরিবহন কর্মীদের ও, তাই অন্যদের জীবনাচারে ওদের পেশার ভূমিকা শীর্ষক আলোচ্য বিষয়াদি আমাদের কাউন্সিলিং সেশন গুলোতে প্রাধান্য পায়।
উন্নত মডেলের যানবাহন হলেও দ্রুতগামীতার জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে-ও ভয়ংকর রকম সড়ক দূর্ঘটনা হয়ে থাকে। তবে সেক্ষেত্রে পার্থক্য হলো ঔসব দূর্ঘটনাতে মদ্যপ চালক নিজেও পগার পার হন, সাধারণ মানুষের ওপর এর ধকল পড়েনা। কারন ড্রাইভিং লাইসেন্স-এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ, চালকদের শিষ্টাচার,অধিক লেনের চওড়া রাস্তা ও সুশৃঙ্খল ট্রাফিকিং ব্যবস্থা এবং মদ্যপ্রবণদের জন্য নিয়মিত কাউন্সিলিং ও প্রয়োজনানুসারে Occupational Therapy -এর বিধান রয়েছে। আমরাও ইচ্ছে করলে রাষ্ট্রীয় ভাবে চালকদের প্রশিক্ষণ দিতে পারি, ওদের আরো অধিক সৎ পেশাদার মনোভাবাপন্ন করে গড়ে তুলতে পারি, এ জন্য দরকার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যহীন সুশৃঙ্খল পরিবহন শ্রমিকসংঘ দরকার।

এ দেশের রাজনীতিজ্ঞরা পরিবহন সেক্টরকে কেবল কলুষিত-ই করেননি বরং রাজিব, আয়েশা, পায়েল, মিম-দের মতো অসংখ্য নিরীহ আত্মার বর্বর খুনী তৈরী করেছেন। যারা নিজেদের দোষ ঢাকতে আহত পায়েল-এর মুখ থেঁতলে নদীতে ফেলে দিতে এক চিলতে দ্বিধান্বিত হয়নি। কারন তারা জানে এ দেশে তাদের শাস্তিদাতার চেয়ে অনুপ্রেরকের সংখ্যা অনেক বেশী, শুধু দলাশ্রয়ী হলেই সব খুন মাফ। ছবিসূত্র: ডা. এম এস কবীর জুয়েল

ডা. এম এস কবীর জুয়েল
এমবিবিএস, বিসিএস, এম.ফিল(নিউরো-সাইকিয়াট্রি), ডক্টর অফ মেডিসিন(এম.ডি) মনোরোগ
সৌদি বিশেষায়ীত স্বাস্থ্য কমিশন সার্টিফাইড ইন সাইকিয়াট্রি এন্ড সাইকোথেরাপী
ভূতপূর্ব মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল, আল জউফ, সৌদি আরব
ভূতপূর্ব সহযোগী অধ্যাপক
এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মেডিসিন, সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কেদাহ্, মালয়েশিয়া
ইউনিট প্রধান, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সিলিং ইউনিট, মনোরোগ বিভাগ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল

 

সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে

আফরোজা হাসান


“সংসার সুখের হয় পুরুষের গুণে” ভাবছি এই শিরোনামে একটা সিরিজ লিখবো। নারীর গুণে সংসার সুখের হবার বা জীবনে হাসি-আনন্দ বিকশিত হবার অনেক কাহিনী শুনেছি, পড়েছি, দেখেছিও। কিন্তু একটা সংসার সুখী হবার পিছনে একজন পুরুষের অবদান কতখানিক হতে পারে এটা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পড়া বা শোনা আমার অন্তত হয়নি। তবে দেখা? হুমম…অনেক দেখা হয়েছে। নানুমণি, মামণি, খালামণি, মামীমা, চাচীমা, ফুপ্পিদের থেকে নিয়ে শুরু করে নিজেকে, বোনদেরকে, বান্ধবীদেরকে এমনকি কয়েকদিন আগে হওয়া ভাতিজীর সংসার দেখেও এই চিন্তাটাই আরো দৃঢ় হয়েছে যে, আমাদের পরিবারের প্রতিটি সংসারের সুখের পেছনে নারীদের চেয়ে পুরুষদের অবদানই বেশি।

গতকাল আমাদের বোনদের সাপ্তাহিক আলোচনা সভাতে হঠাৎ করেই সংসারে সুখী হবার পেছনে কার অবদান বেশি সেটা নিয়ে কথা উঠলো। ভাবী ও বোনেরা মিলে আমরা তেরো জন এক বাক্য স্বীকার করে নিয়েছিলাম যে, আমরা সুখী এর নাইনটি পারসেন্ট ক্রেডিট আমাদের হাজবেন্ডদের। তখন মনেহলো কেমন হয় নিজেদের সংসার গুলোকে নিয়ে একটু গবেষণা করে দেখলে? যেই মানুষগুলো দ্বারা জীবন অনিন্দ্য সুন্দর রূপ ধারণ করে এসেছে আমাদের কাছে। সেই মানুষগুলোর এত ভালো হবার রহস্য কি? নারীদের মহিমা নিয়ে তো অনেক কাব্য, মহাকাব্য লেখা হয়েছে। আমরা একটু ভিন্ন কিছু লেখার চেষ্টা করে দেখি না নিজ নিজ অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার থেকে।

খুঁজতে গিয়ে দেখলাম আমাদের সবার হাজবেন্ডদেরই কিছু বিষয় কমন। উনারা প্রত্যেকেই ভয়াবহ রকমের ব্যস্ত মানুষ। তবে পরিবারের জন্য যতটুকু সময় নির্ধারিত চেষ্টা করেন সেই সময়টুকুর সবটুকু দিতে। পারুক বা না পারুক নিজ নিজ স্ত্রীকে সাহায্য করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকেন উনারা। মেয়েদের রাগ হচ্ছে অনেকটা আগুনের মত। উনারা কখনোই আগুনে তেল বা বাতাস দেন না। বরং এমন পরিমাণ পানি ঢালেন যাতে ধোঁয়াও না বের হয়। নারী জাতি স্বভাবগত ভাবে বাঁকা। আর প্রচলিত আছে সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুল বাঁকা করতে হয়। কিন্তু উনারা আঙুল বাঁকা না করে এমন মাত্রায় উত্তাপ দেন যে ঘি গলে গিয়ে নিজ থেকেই বেড়িয়ে আসে। এমন আরো অনেককিছু আছে যা আসলে উদাহরণ ছাড়া ঠিক বোঝানো সম্ভব নয়।

তবে সিরিজটা আমি মজা করার জন্য লিখতে চাচ্ছি না। লিখতে চাচ্ছি কারণ জীবনের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে থাকে ভালো থাকার নানা উপকরণ। কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে অনেক সময় আমরা সেসব দেখতে বা খুঁজে নিতে পারি না সেই । অনেক সময় অন্যের অভিজ্ঞতা শুনে উপলব্ধি করি যে, আরে এমন অনেক মুহুর্ত তো আমার জীবনেও প্রায়ই আসে। এর মধ্যে যে এত আনন্দ ও সুখ থাকতে পারে সেটা তো জানাই ছিল না। হুমম…এই উপলব্ধিটুকুই মনে জাগিয়ে যেতে চাই গল্পে গল্পে। স্বাভাবিক বলে যে সুখ মানুষের নজরেই আসে না, অন্যের অভিজ্ঞতা শুনে বা জেনে তখন রঙতুলির ছোঁয়া লাগে ভাবনাতে। আবার অনেক সময় জানাই থাকে না যে স্যাক্রিফাইস কিভাবে করতে হয়। স্যাক্রিফাইস শব্দটা শুনলেই বিশাল কিছু ছাড় দেবার ইমেজ চলে আসে মনে। অথচ ছোট ছোট ত্যাগই জীবনকে করে তোলে স্বপ্নিল।

যাইহোক, অনেক লম্বা প্রাসঙ্গিক সূচনা দেয়া হয়ে গিয়েছে। আমি এখন বিশ্লেষণের দিকে যাই……।

 

নীরু

জান্নাতুন নুর দিশা


“আচ্ছা রশীদ, নীরুকে তুই ছেড়ে দিয়েছিলি কেন?”

“আর বলিস না রে, আকাশ! ওমন আত্মভোলা মেয়ের সাথে সংসার করা যায়?”

“তোদের তো প্রেমের বিয়ে ছিলো।”

“তা ছিলো।”

“তবে ছাড়লি কেন ওকে বিয়ের ছ’মাসের মাথায়?”

“অসহ্য লাগছিলো ওকে। সংসারী ছিলো না একদম। ধর অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরেছি, ও বলতো টংয়ের চা খেতে যাবে। আচ্ছা বল, এসব ভালো লাগে? বাসায় এসে বউয়ের হাতের এক কাপ চা না পেলে?।

“তা বটে!”

“এত রোমান্টিসিজম কোথা থেকে আসতো ওর কে জানে! আমাদের বিয়ের সময়টা ছিলো আষাঢ় মাস। বিয়ের পর প্রায় বৃষ্টি থাকতো। এই মেয়ে বৃষ্টিতে ভিজবে। তাও একা না, আমাকেও ভিজতে হবে। এভাবে প্রতিদিন প্রতিদিন বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর বাঁধিয়ে ফেলতাম দুজন। ওর এসব অত্যাচার অসহ্য লাগতো।”

“বিয়ের আগেও তো নীরু এমনই ছিলো। তখন অসহ্য লাগতো না?”

“বিয়ের আগের ব্যাপারটা ভিন্ন। বিয়ের পরে তো সংসারী হতে হয় তাই না?”

“সংসারী ছিলো না ও?”

“একদম না। টাকাপয়সা গুছিয়ে রাখতে জানতো না। আমার হাতেই রাখতে হতো সব টাকা। ওর হাতে দিলে তো বেলি ফুলের মালা, আর্ট এক্সিবিশন থেকে ছবি, কবিতার বই এসব কিনে নষ্ট করতো টাকা।”

“সব টাকা নিজের কাছে রাখতি? নীরু কিছু চাইতো না তোর কাছে? কিছু কিনে দিতে বলতো না?”

“বিয়ের পর ছ’মাসে একবার একটা টাঙ্গাইল শাড়ি চেয়েছিলো শুধু। আর ডিভোর্সের আগের দিন বলেছিলো পরদিন যেন কোর্টে এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে যাই।”

“গোলাপ হাতে দিয়েই তারপর ডিভোর্স দিয়েছিলি?”

“হ্যাঁ।”

“একটুও কষ্ট হয় নি তোর? নীরু কি কাঁদে নি?”

“আমার একটুও কষ্ট হয় নি। নীরুও কাঁদে নি। ডিভোর্স ও চায় নি। যেদিন রাতে।ওকে জানিয়েছিলাম রুমাকে আমি বিয়ে করবো। সেদিন খুব কেঁদেছিলো। এর পরের একমাস প্রতিটা দিন কেঁদেছে। কিন্তু ডিভোর্সের দিন কাঁদে নি। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে গোলাপ গুচ্ছ হাতে নিয়ে চুপচাপ চলে গেছে।”

“ওহ। কি অদ্ভুত মেয়ে তাই না?”

“অদ্ভুত তো বটে! ওকে নিয়ে সংসার করলে দেউলিয়া হতে হতো।”

” তা রুমাকে নিয়ে এখন সুখে আছিস এখন?”

“এখন? রুমাকে নিয়ে?”

“হ্যাঁ?”

“জানি না। নারী জাতি বড় অদ্ভুত! এদের কিছু দিয়েই খুশী করা যায় না রে।”

“নীরু তো কিছু না পেলেও খুশী ছিলো। সে কি নারী ছিলো না রশীদ?”

“এসব বাদ দে, আকাশ।”

“ভয় হয় এসব প্রশ্নে? উত্তর খুঁজে পাস না?”

“বিদেশ থেকে এত বছর পর এসেছিস বন্ধুর খবর নিতে না জেরা করতে?”

“না রে, আমার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছি। এই নে কার্ড। আগামী শুক্রবার বিয়ে। আসবি রুমা ভাবীকে নিয়ে। আসি রে।”

***
“কী ব্যাপার রশীদ? ফিরতে এত দেরী হলো?”

“অফিসে আকাশ এসেছিলো। আমার বন্ধু। ওর বিয়ের দাওয়াত দিতে।”

“ওহ। এরকম মাথায় হাত দিয়ে শুয়ে আছো কেন?”

“মাথা ধরেছে রুমা।”

“আচ্ছা দাঁড়াও আমি চা আনছি। আর শোনো, পাশের বাসার ওরা একটা ফ্রিজ কিনেছে জানো? চৌত্রিশ হাজার টাকা দাম পড়েছে। ফ্রিজটা আমার পছন্দ হয়েছে। কাল কিনতে যাবো। যদিও ফ্রিজ একটা আছে। বাট মডেল পুরনো।”

“রুমা, আমার মাথা ধরেছে।”

“হ্যাঁ, আমি চা আনছি। ফ্ল্যাটের বুকিং দিয়েছো রশীদ? প্রথম কিস্তি কত দিলে? ভাড়া ঘরে আর কতদিন? স্ট্যাটাস তো যায় যায়।”

“রুমা, আমার মাথা ধরেছে।”

“হ্যাঁ যাচ্ছি চা আনতে। আচ্ছা তোমার বন্ধু আকাশ তো বিলেত ফেরত তাই না? ওনার বিয়েতে পড়ার জন্য আমাকে একটা দামী শাড়ি কিনে দিও তো। মোটামুটি সাত-আট হাজার টাকার। স্ট্যাটাস মেইনটেইনের তো ব্যাপার আছে। আচ্ছা ওনার হবু ওয়াইফের কথা কিছু বলেছে? কী করে উনি?

“নীরু! নীরু!”

“নীরু? নীরু মানে? তুমি এখনো তোমার আগের বউকে ভুলতে পারো নি তাই না? তার নাম জপ করছো?”

“আকাশের হবু স্ত্রীর নাম নীরু! রুমা, আমার মাথা ধরেছে। যাও এখান থেকে।”

“আচ্ছা যাই টিভিতে আমার প্রিয় নাটক শুরু হয়ে গেছে। তোমাকে আধা ঘন্টা পর চা দিচ্ছি।”

রশীদ এখনো অস্ফুট স্বরে ডেকে যাচ্ছে, “নীরু! নীরু! নীরু!”

 

জীবনে কয়েকজন হিরো

 কানিজ ফাতিমা


আমার জীবনে কয়েকজন হিরো আছে, সবারই থাকে। বেশীর ভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই মিডিয়ার কেউ বা জীবনে সফল কোনো ব্যক্তিত্ব হন তার হিরো। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। আমার হিরোরা ব্যতিক্রম। যেমন আমার হিরোদের একজন হলেন এক ভিক্ষুক – ১৮/ ১৯ বছর বয়সী এক ভিক্ষুক – এলিফেন্ট রোডের ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করত সে। আমি তখন একটা প্রইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতাম আর প্রতিদিন তার সামনে দিয়ে ভার্সিটি যেতাম।

সে কি দাড়িয়ে ভিক্ষা করত নাকি বসে করত তা আমি নিশ্চিত জানিনা – কারণ তার শরীর কোমর পর্যন্ত এসে থেমে গেছে। তার কোনো পা ছিলনা, এমনকি তার কোনো হাতও ছিলনা- শধু ধর আর মাথা। নিকের ভিডিও আমি দেখেছি তাকে দেখার অনেক পরে। নিকের অন্তত “ড্রাম স্টিক” আছে (নিক তার পা কে মজা করে ড্রাম স্টিক বলে); ওর তাও ছিলনা , নিক পুরুষ আর সে ছিল নারী , নিক অস্ট্রেলিয়ায় জন্মেছে আর সে জন্মেছে বাংলাদেশের বস্তিতে।

আমি অনেকবার ভেবেছি এর থেকে আর হতভাগা হয়ে জন্মানো সম্ভব কিনা- জবাব খুঁজে পাইনি। একদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে আমার – সেদিন বৃষ্টি হচ্ছিল। আমি ছাতা মাথায় হেটে যাচ্ছিলাম আর মেয়েটি ভিজছিল – মাত্র এক হাত পেছনে সরলেই ছাউনী। তার সমর্থ ছিলোনা মাত্র এক হাত পেছনে সরার। সকালে তাকে কেউ এখানে রেখে গেছে , দিন শেষে তাকে তুলে নিয়ে যাবে- এর মধ্যে এক চুলও সরতে পারবে না সে ।

আজ মনে হয় তাকে আমার সেদিন সরিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। ভেবেছিও সেদিন সে কথা। কিন্তু নারী সুলভ সংকোচে হয়ে ওঠেনি। সেদিন আমার আর একটু সাহসী হবার দরকার ছিল, কারণ মেয়েটির কাছে আমি ঋণী। আমি ঋণী কারণ আমার হতাশার সময় তার বৃষ্টি ভেজা হাসি মুখটি আমার মনে হয় আর মহুর্তেই আমার কষ্টগুলো হালকা হয়ে আসে, নাপাওয়া গুলোর গুরুত্ব কমে যায়; আমি আবার হাসতে পারি।
আমি তাকে ওই পথে দেখেছি এক বছরের কিছু বেশী সময় এবং প্রতিদিনই সে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসতো।

আমি আজও ভেবে ভেবে অবাক হই – এমন জীবন নিয়ে কি করে একটা মানুষ হাসতে পারে – প্রতিদিন? নিজের কষ্ট যখন বুকের ভেতর জমতে জমতে নিশ্বাস আটকে দিতে চায় তখন তার কথা মনে হয় আর তখনই নিজেকে মনে হয় দুর্বল। দুর্বল নিজেকে ধমক দিয়ে বলি “তোমার জীবনের পাওয়া গুলোর দশ ভাগের একভাগ পেলেও ওই মেয়েটি ধন্য হয়ে যেত। রাখো তোমার অকারণ দুঃক্ষ বিলাস, হাসো সন্তুষ্টির হাসি। ও যদি হাসতে পারে তবে তোমার কাদার কোনো অধিকারই নেই।”

 

মানুষ হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ

জান্নাতুন নুর দিশা


একসময় এদেশের মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সার্টিফিকেট ছিলো না, কিন্তু মনুষ্যত্ব ছিলো। এখন যা অবস্থা হয়েছে এদেশের মায়েরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে, তবে অনেকেই হারাচ্ছেন মনুষ্যত্ব।
দুয়েকটা উদাহরণ দেই।
শিক্ষকতা পেশায় আছি সাড়ে তিন বছর। প্রথম যোগদান করেছিলাম এক কিন্ডারগার্টেন স্কুলে।
সেখানে যে কিছুদিন পড়িয়েছি, বাচ্চাদের মায়েদের অদ্ভুত কিছু মনোভাব দেখিছি।
একবার স্কুলের মিডটার্ম পরীক্ষায় ক্লাস টু’তে পড়ুয়া এক বাচ্চার ব্রাইটার গ্রামার পরীক্ষার খাতা নিয়ে এলেন বাচ্চার মা। খাতা মূল্যায়ন করেছিলাম আমি।
ভদ্রমহিলার দাবী ছেলে একশোতে একশোই পাবে, আমি দিয়েছি সাতানব্বই! প্রিন্সিপাল আমাকে ডাকলেন।
এমন ভুল হবার তো কথাই না আমার। খাতা দেখলাম উল্টেপাল্টে। বাচ্চা যে দুটো ওয়ার্ড মিনিং ভুল করেছিলো, পেন্সিলে লেখা হওয়ায় বাচ্চার মা ভুল বানান দুটো মুছে নিজে শুদ্ধ বানানটা লিখে নিয়ে এসেছে! উদ্দেশ্য নিজের বাচ্চাককে ফার্স্ট বানানো, এই তিন নাম্বার কম পাওয়ায় ওনার বাচ্চা ফার্স্ট না হয়ে সেকেন্ড হয়েছে।
যথাসম্ভব চেষ্টা করেছে ছেলের লেখার মত করে লিখতে, তবু অন্যান্য লেখার সাথে মিলিয়ে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো এই লেখাটা বাচ্চাটার ছিলো না। প্রিন্সিপাল আর আমি দুজনেই বাচ্চার মা’কে বুঝিয়ে বললাম ওনার এই জালিয়াতি আমরা ধরতে পেরেছি।
এই ভদ্রমহিলা গ্রেজুয়েট। উনি যখন ভুল উত্তর মুছে শুদ্ধ উত্তর লিখে দিচ্ছেন খাতা হাতে পাবার পর, নিশ্চয়ই বাচ্চা পাশে বসে ছিলো। এই বাচ্চাটা তার জীবনের প্রথম শিক্ষক তার মায়ের কাছ থেকে এত ছোট বয়সেই প্রতারণা শিখে নিয়েছে। বড় হয়ে এসব বাচ্চা যদি প্রতারণা, দুর্নীতি করে দায়ভার কার?
আরেকটা ঘটনা বলি, ক্লাস থ্রিতে একটা ফুটফুটে বুদ্ধিদীপ্ত মেয়ে পড়তো নাম মিতা। আমি খুব স্নেহ করতাম মেয়েটাকে। মেধাবী ছিলো। মিতা মেয়েটা একবার ইংরেজি বই হারিয়ে ফেললো। বাসায় মায়ের বকার ভয়ে মিতা মা’কে বলেছিলো বই মিসকে দিয়েছিলাম, মিস হারিয়ে ফেলেছে।
বাচ্চার মা মেয়েকে দিয়ে আমার কাছে একটা কাগজ পাঠালো। কাগজে লেখা, “আপনি আমার মেয়ের বই হারিয়েছেন, ওকে বই কিনে দেবেন!”
এই কাগজ আমার হাতে দিয়ে মেয়েটা লজ্জায় অঝোর ধারায় কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মিস, বইটা আমিই হারিয়েছি। মা মারবে বলে আপনি হারিয়েছেন বলেছি। এখন মা আমাকে বলেছে আপনার কাছে বই চাইতে। আমি পারবো না বলায় এই কাগজ আপনাকে দিতে বলেছে।”
ভদ্রমহিলার এই আচরণ আমাকে অবাক করেছিলো প্রচণ্ড। মিতাকে পরের দিন ঐ হারিয়ে যাওয়া টেক্সট বই সাথে দুটো গল্পের বই রেপিং পেপারে মুড়ে উপহার দিলাম।
এরপর মিতার মা যতবার স্কুলে এসেছে, লজ্জায় আমার দিকে আর তাকাতে পারে নি।
আজকালকার অভিভাবকদের এমন অসংখ্য নীতিহীন আচরণ আমি শিক্ষকতা পেশায় থেকে দেখেছি, দেখছি।
ছোট ছোট প্লে, নার্সারির বাচ্চাদের পরীক্ষার হলে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থেকে মায়েদের উত্তর বলে দেয়া, চিরকুটে উত্তর লিখে দেয়া, বাচ্চা ফার্স্ট, সেকেন্ড না হলে মারধোর করা অদ্ভুত অসুস্থ সব আচরণ। যতটা প্রতিযোগিতা না বাচ্চাদের থাকতো, তারচেয়ে বেশি প্রতিযোগিতা অভিভাবকদের।
কচি মনগুলোকে খুব ছোট বয়স থেকেই এক অসুস্থ প্রতিযোগিতা আর হতাশার দিকে ঠেলে দিচ্ছে মায়েরাই। এসব বাচ্চারাই বড় হয়ে আত্মহত্যা করে হতাশায়।
প্রচন্ড রকম মানসিক শক্তিহীন একটা প্রজন্ম গড়ে দিচ্ছে এ যুগের মায়েরা, এদেরই বড় হয়ে মোটিভেশন প্রয়োজন হয়। এদের সেল্ফ কনফিডেন্স, সেল্ফ মোটিভেশন পাওয়ার শৈশবেই নষ্ট করে দেয়া হয়।
এখনকার মায়েরা চাঁদ মামার ছড়া শোনানোর বদলে বাচ্চাদের হাতে তুলে দিচ্ছে দশ-বারোটা শক্ত শক্ত বই। মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর যত কঠিন হিসাব, “তোমাকে ফার্স্ট হতে হবে”।
অথচ ফার্স্ট হওয়ার চেয়ে মানুষ হওয়াটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

 

নারীর দায়িত্ববোধ (শেষ পর্ব)

রেহনুমা বিনত আনিস


যে নারী জ্ঞানবিমুখ, যে নিজের মূল্য, অবস্থান, দায়িত্ব বোঝেনা সে কি করে নিজের সন্তানকে অপর নারীদের মূল্যায়ন করতে শেখাবে? রাসূল (সা) বলেছেন, ‘সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলোনা, যে মানুষের শুকরিয়া আদায় করলোনা’ (সুনান আবু দাউদ ৪৮১১)। যে নারী সন্তানের মাঝে নিজের প্রতি কৃতজ্ঞতার সঞ্চার করতে পারলোনা, সে তো সন্তানের দাসীতে রূপান্তরিত হোল। অথচ পৃথিবী ধ্বংসের একটি আলামত এই যে দাসীরা তাদের মুনিবদের জন্ম দেবে!
একজন জ্ঞানী ব্যাক্তির জীবনের লক্ষ্য থাকে সন্তানদের মাঝে জ্ঞানের ধারা অব্যাহত রাখা যেন তারা উত্তম মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে, মানবসমাজের জন্য কল্যাণকর ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু যে নারী নিজেই জ্ঞান আহরণ সম্পর্কে উদাসীন সে কিভাবে সন্তানকে জ্ঞানের পথে পরিচালিত করবে?

এই নারীরাই অপর নারীদের হাত ধরে এগিয়ে আনার পরিবর্তে অন্ধকারের আবর্তে ঠেলে দেয়, আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করে, সংসারে অশান্তির সৃষ্টি করে, অন্যের হক নষ্ট করে। তাঁরা নিজেদের গন্ডি এত সংকীর্ণ করে নিয়েছেন যে তাঁরা নিজেদের, সন্তানদের, পরিবারের, বন্ধুবর্গের উপকারেও নিয়োজিত করতে অক্ষম বা প্রেরণার অভাবে ভোগেন।
সমাজের উপকার তাঁদের দ্বারা কি করে হবে?

অপরদিকে রয়েছেন তাঁরা যারা নীরবে নিভৃতে সমাজ, সংসার, সন্তানদের জন্য করে যাচ্ছেন। একদিকে তাদের প্রচারবিমুখতা, অপরদিকে তাদের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ‘এ আর এমন কি’ ধরণের মনোভাব তাদের কৃতিত্ব জানার সুযোগ রাখেনা। ফলে তাঁরা যে অন্যান্য নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারতেন সে সুযোগটুকুও হারিয়ে যায়।

নারীর অবস্থান পরিবর্তনের প্রথম নিয়ামক নারীর নিজেকে পরিবর্তন। নিজের মর্যাদা, অধিকার এবং দায়িত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করা। নিজের চরিত্র, যোগ্যতা, আচরণ সুসজ্জিত করা। এই কাজ শুধু সাহস দিয়ে হয়না। এর জন্য প্রয়োজন প্রেরণা। এই প্রেরণা আসে দায়িত্ববোধ থেকে।

একজন মানুষ তখনই নিজেকে কঠোর অধ্যাবসায়, সাধনা এবং প্রচেষ্টায় নিয়োজিত করতে পারে যখন নিজের এবং অপরের প্রতি দায়িত্বানুভূতি সে সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
এই উপলব্ধি নিজের মাঝে গড়ে তোলাই হোক আমাদের আগামীর লক্ষ্য। এই লক্ষ্যের হাত ধরেই একদিন ফিরে আসবে নারীদের সেই সোনালী যুগ যখন নারীসমাজ এবং পুরুষসমাজ সত্যিকার অর্থেই ছিলেন পরস্পরের বন্ধু এবং সহযোগী। সেই সোনালী সুদিনের প্রত্যাশায় …।

১ম পর্ব

 

সোনামণিদের দাঁতের যত্ন

ডা. ফাতিমা খান


গর্ভাবস্থায় আপনি যেসময় অনাগত সন্তানটার ছোট্ট মিষ্টি অবয়ব কল্পনায় ভেবে আপনার সব ক্লান্তি আর কষ্টগুলো ভুলে থেকেছেন, ঠিক ওই সময়েই আর সব অংগ প্রত্যঙ্গ এর সাথে আপনার শিশুর দুধ দাঁত আর স্থায়ী দাঁতের গঠন শুরু হয়েছিল। গর্ভবতী মায়ের দৈনিক খাবারের তালিকায় তাই যথেষ্ঠ পরিমাণ ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার থাকতে হয়। আপনি ঠিকমতো খেয়েছিলেন তো?

ছয় মাস বয়সে সাধারণত একটি শিশুর প্রথম দুধ দাঁত আসে। শিশুর গঠন,পুষ্টি ও স্বাস্থ্যভেদে অথবা কোন কারণ ছাড়াই সময়টা কিছু আগে বা পরেও হতে পারে। অনেক শিশু মুখে দাঁত নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। এ ধরনের দাঁতকে বলে ”ন্যাটাল টুথ”। আবার জন্মের প্রথম মাসে কারও কারও প্রথম দাঁতটি দেখা যায়, যাকে বলা হয় ”নিওন্যাটাল টুথ”। সাধারণত প্রথম দাঁতটি উঠার কিছুদিন পরই আসে ঠিক পাশের দ্বিতীয়টি।

সন্তানের দু’দাঁতের ভুবনজয়ী হাসিটিকে স্মৃতিবন্দী বা ক্যামেরাবন্দী করেননি এরকম মা বাবা আজকাল হয়ত পাওয়া বড় কঠিন ! কিন্তু একটি ব্যাপার আমাদের অনেকেরই অজানা , বা জানা থাকলেও হয়ত চর্চা নেই; তা হল, আপনার শিশুর মুখে দুধ দাঁতগুলো আসার পর থেকেই এর নিয়মিত যত্ন নেয়া উচিৎ। ক্যারিজ মুক্ত ও পরিচ্ছন্ন দাঁত, পরিষ্কার মাড়ি, জিহ্বা ও মুখগহ্বর আপনার শিশুর সার্বিক সুস্থতা ও বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যক। অন্যথায় ওর মুখের ভেতরটিই হতে পারে ব্যাকটেরিয়া ও ফাংগাসের আবাস্থল।

আপনার শিশুর স্থায়ী দাঁতের গঠন ও বৃদ্ধির জন্য দুধদাঁত গুলোর সুস্থতা জরুরী। দুধদাঁত কিছুদিন পর পড়ে গিয়ে নতুন দাঁত আসবে এরকমটা ভেবে আমরা অনেক সময় বাচ্চার দুধদাঁতের প্রতি যত্নবান হইনা। এমনটা ভাবা উচিত নয়। শিশুর দাঁতের যথাযথ গঠনের জন্য আমরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলো মেনে চলতে পারি।

১.শিশুর দাঁত ওঠার আগে থেকেই নরম তুলা না কাপড় দিয়ে মাড়িটি পরিষ্কার করে দিবেন। তাতে ক্যান্ডিডোসিস বা ওরাল থ্রাশ হওয়ার সম্ভবনা থাকেনা।

২. শিশুর দাঁত ওঠার পর থেকে প্রতিদিন দুবার (সকালে ও রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে) ফ্লোরাইডযুক্ত টুথপেস্ট তুলা বা নরম কাপড়ে লাগিয়ে দাঁত পরিষ্কার করে দিন। যদি সম্ভব হয় শিশুদের উপযোগী নরম ব্রাশ ব্যবহার করতে পারেন। বাজারে বিভিন্ন রঙ বেরং এর ও কার্টুনওয়ালা কিডস টুথব্রাশ কিনতে পাওয়া যায়। আপনার বাচ্চাকে প্রথম থেকে টুথব্রাশে অভ্যস্ত করাতে পারলে ভাল হয়। তা না হলে দেড় দুবছর বয়স পর্যন্ত তুলা বা গজ ব্যবহার করতে পারেন।

৩. প্রতি ছ’মাসে একবার শিশুদের দাঁতের একবার চেক আপ করিয়ে নেয়া ভাল। তাতে যেকোন সমস্যা প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে ও সহজভাবে চিকিৎসা শেষ করা যায়। এর আরেকটা ইতিবাচক দিক হল শিশু যখন কোন আপারেটিভ পদ্ধতি ছাড়া এমনিতেই ডেন্টিস্টের অফিসে আসা যাওয়া করবে তখন তার মন থেকে ডাক্তার, ডেন্টাল চেয়ার ও যন্ত্রপাতি জনিত ভয় দূর হয়ে যাবে। বিদেশে এর একটা প্রচলন থাকলেও আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ এখনো এ ব্যাপারে তেমন সচেতন হয়নি।

৪. যেসব শিশু ফিডারে দুধ বা পানীয় গ্রহণ করে তাদেরকে রাতের বেলা ফিডার খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস করানো যাবেনা। এটা একপর্যায়ে দাঁতের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। “নার্সিং বটল ক্যারিজ” বা “বেবি বটল টুথ ডিকে” এরই কুফল। এর ফলে শিশুর সামনের দাঁতগুলো ক্যারিজ আক্রান্ত হয় এবং নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই ভেঙে যায় বা ইনফেকশন দেখা দেয়। ফর্মুলা দুধে বা ফলের রসে মেশানো চিনি মূলত এ ক্ষয় রোগের কারণ।

৫. মিষ্টি জাতীয় খাবার কার না প্রিয়? আর তা যদি হয় চকলেট, চুইংগাম, আইস্ক্রিম, মার্শম্যালো? তাই আপনার শিশুকে এগুলো থেকে পুরোপুরি বিরত না রেখে পরিমানের নির্দিষ্টতা করে দিন ও খাওয়ার পর ভাল করে দাঁত ও মুখ পরিষ্কার করে নিতে বলুন। সবচেয়ে ভাল হয়, সন্ধ্যার পর মিষ্টি জাতীয় খাবার কম খাওয়া বা না খাওয়া। কেননা রাতের বেলা মুখের ভেতর ব্যাকটেরিয়া তুলনামূলক ভাবে বেশী সক্রিয় থাকে।

৬. কোল্ড ড্রিংক্স, বাজারের প্যাকেটজাত চিপ্স, অতিরিক্ত চিনিওয়ালা ক্যান্ডি ইত্যাদি শিশুদের না দেওয়াই ভাল। এগুলো কোন উপকার না করলেও অনেকক্ষেত্রে দাঁত ও মাড়ির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৭.শিশুর সার্বিক সুস্থতা ও সঠিক শারিরীক গঠনে সুষম ও টাটকা খাবারের জুড়ি নেই। তাদের প্রতিদিনের খাবারের মেন্যু, পরিমাণ ও খাবারের সময় নির্বাচনে আপনাকে সচেতন হওয়ার বিকল্প আর কোন উপায় নেই।

আমাদের শিশুরা সুস্থ থাকুক, ভাল থাকুক এটাই আমাদের কাম্য। সব শিশুর মুখে থাকুক সুস্থ, নির্মল হাসি। তার জন্য আমাদের, আপনাদের একটু যত্ন একটু সদিচ্ছা আর চেষ্ট থাকলেই হবে। ছবিতে আছেন: আয়ান(৬)

 

রাহাতের বিয়ে

                                              জুয়াইরিয়া জাহরা


বিয়ের উপহারে যারা এখনো কাঁচের প্লেট- পিরিচ উপহার দেন, তাদের আমি চূড়ান্ত অপছন্দ করি!
ব্যাপারটা আমার কাছে কিছুটা অপমানজনকও লাগে। যাবো- খাবো; তাই দিয়ে দাও কিছু একটা, এমন মনে হয়। কিন্তু, রাহাতের বিয়েতে আমি প্লেট- গ্লাস উপহার দিবো, এটা আমি গ্র‍্যাজুয়েশনের শেষ দিনের করা গুরুত্বপূর্ণ ওয়াদা। বলেছিলাম, একটা প্লেট আর একটা গ্লাস হবে আমার পক্ষ থেকে রাহাত দম্পতির জন্য উপহার আর এ উপহার তাদের প্রতিদিন ব্যাবহার করতে হবে।
কিন্তু, এমন হুট করে ওর বিয়েটা যে ঠিক হয়ে যাবে, বুঝতে পারিনি। সবচাইতে বড় বিষয়, ছেলেটা যে মনে করে আমাকে দাওয়াত দিবে, এমনটা আশাও করিনি। দিনাজপুরে আছি, কারো সাথে তেমন যোগাযোগ নেই, খুব কষ্ট করে আসিফ না সাকিব কার থেকে যেন আমার নাম্বার যোগাড় করে ফোন দিয়েছে সকালে। খুব করে বলেছে যেন যাই ওর বিয়েতে।
এখন দুই সপ্তাহের মধ্যে রুপার প্লেট গ্লাস কোথা থেকে বানানো যায় ভাবছি। বাজেটে কুলালে গোল্ড প্লেট করে ফেলবো, দেখি। রাফসান ফিরুক, আজকেই কথা বলতে হবে। ভদ্রলোক এখন আর আমার কর্মকান্ডে তেমন অবাক হন না। তবে রুপার প্লেট গ্লাস বানাতে চাই শুনলে আকাশ থেকে পড়তে পারেন!
আসলে, আজকে কিছুই করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রায় ৪/৫ বছর আগের স্মৃতি একটার পর একটা ফ্ল্যাশব্যাক হচ্ছে। রাফসান অফিসের জন্য বের হলে আমি একবার ছাদে যেয়ে গাছগুলো দেখে আসি। ডিমের খোসা-কলার খোসা জমিয়ে ব্লিন্ড করে সার বানিয়েছিলাম গতকাল। আজকেই নতুন গাছগুলোর জন্য মাটি রেডি করতাম। অনেকদিন হয় একুরিয়ামটা পরিষ্কার করা হয় না। আজকে করবো ঠিক করেছিলাম। কিন্তু কোন কাজই হাতে উঠছে না! বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি কতক্ষণ ধরে।
রাহাত আমার ভার্সিটি জীবনের একজন কাছের বন্ধু। বন্ধুর চাইতে বড় কথা ও ছিল আমার একজন প্রিয় মানুষ। যাবতীয় কথা, লেইম থেকে সিরিয়াস, একটা সময় ওর সাথে শেয়ার করেছি। বলতাম, ‘লুঙি খুব ক্ষ্যাত’, বলতাম, ‘ নিজের কলিজাটা পিরিচে তুলে দিতে পারবো, কিন্তু পিড়ি-বেলনে ঘষে ঘষে রুটি বানাতে পারবো না’! ও বলতো, ‘লুঙি যে মেয়ে সহ্য করতে পারবে না, তার কপালে বিয়ে নেই! ‘ আর রুটি ছাড়া সকালে নাকি নাস্তাই হয় না। তর্ক করেছি। বিতর্ক করেছি।

ছেলেটা বড় আবেগী। ওর কথা শুনতাম। একটা বউ থাকবে। খুব সাধাসাধি রকমের বউ। একই গ্লাসে পানি খাবে। একই প্লেটে ভাত মাখাবে। লোকমা তুলে খাইয়ে দিবে। মাথায় একটু লজ্জা লজ্জা ঘোমটা থাকবে। মানুষ যখন একসাথে সুইজারল্যান্ড এ ঘুরতে যাওয়াকে চরম রোমান্টিক মনে করে তখন একজন মানুষ এক প্লেটে ভাত খাওয়ার ব্যাপারটায় এতো প্রেম খুঁজে পাচ্ছে, ভাবতেই অবাক লাগতো! ওর এমন সাদাসিধে – অতি সাধারণ স্বপ্নের গল্প যেন মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো আমার!

একবার ক্লাসের অনেকে মিলে বান্দরবান বেড়াতে গেল। অনেকের মধ্যে রাহাতও ছিলো। ফিরে এলে জিজ্ঞেস করলাম, ‘অনুভূতি কি?’ ও বললো, ‘ একই সাথে প্রবল দুঃখ আর প্রচন্ড আনন্দ। জীবনে একবার কাছের মানুষটাকে নিয়ে বান্দরবান যেতে চাই।’ শুনে খুব অন্যরকম লাগছিলো। মানুষ তার জীবনের অসাধারণ স্মৃতিগুলো ভালোবাসার মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে চায়। এতো সাধারণ ছোটখাটো চাওয়া গুলো নিয়েও যে স্বপ্ন দেখা যায়, আমি জানতাম না!

রাহাত একটু বেশীই ভালো ছেলে। ভালোটার হাতে নিশ্চয়ই আরেকটা ভালো মেয়ের হাত পড়বে! যতই সমস্যা হোক আর রাফসান যতই না নিয়ে যাওয়ার ছলচাতুরী খেলুক, আমি রাহাত দম্পতিকে এক পলক দেখার জন্য ঢাকায় উড়ে যাবো! ওদের জন্য আসীমের কাছে প্রার্থনা করবো যাতে মহামহিম তাঁর ভালোবাসার ছায়ার নিচে ওদের জায়গা করে দেন। ওদের জীবন সহজ থেকে সহজতর করে দেন।

 

দীর্ঘশ্বাসই থা‌কে

হাবীবাহ্ নাসরীন


ভল্টে থা‌কেনা স্বর্ণ এবং
চুমুরা থা‌কে না ঠো‌টে,

চুলায় মে‌লে না গ্যা‌সের দেখা দীর্ঘশ্বাসই থা‌কে

‌ভোটার থা‌কে না ভো‌টে!

খ‌নি‌তে থা‌কে না কয়লা, য‌দিও
ময়লা র‌য়ে‌ছে ম‌নে,
মা‌ছেরা থা‌কে না নদী‌তে এবং
গা‌ছেরা থা‌কে না ব‌নে!

ডাক্তার থা‌কে না হাসপাতালে
রাস্তা থা‌কে না খা‌লি,
রডগু‌লো সব বাঁশ হ‌য়ে যায়
‌সিমেন্ট‌ও হয় বা‌লি!

‌খোকন থা‌কে না মা‌য়ের কো‌লে‌তে
আসামী থা‌কে না জে‌লে,
ছা‌ত্রের হা‌তে কলম থা‌কে না-
হাতু‌ড়ির দেখা মে‌লে!

গ‌রি‌বের মধু জমা হয় গি‌য়ে
‌লোভী‌দের মৌচাকে
না থাকার ভি‌ড়ে শুধু বুক চি‌ড়ে
দীর্ঘশ্বাসই থা‌কে!

হাবীবাহ্ নাসরীন
সাংবাদিক :জাগো ২৪।

 

শাহজালাল বিমানবন্দরে বেবি কেয়ার সেবা

নারী সংবাদ


বাংলাদেশে এই প্রথমবারের মতো মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বেবি কেয়ার উদ্বোধন করেছে। এই বেবি কেয়ারে ভ্রমণরত মায়েরা স্বাচ্ছন্দের সাথে তাদের সন্তানের যত্ন নিতে পারবে, ডায়াপার বদলাতে এবং ব্রেষ্টফিডিং করাতে পারবে।

২২শে জুলাই ২০১৮ তারিখে এই সেবাটি উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের মাননীয় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী এ কে এম এম শাজাহান কামাল এমপি। এছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো: মোহিবুল হক, বেসামরিক বিমান চলাচল কতৃপক্ষ এর চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম নাইম হাসান এবংএমজিআই (মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্টিজ )এর মাননীয় চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনাব মোস্তফা কামাল।

 

নুর ই আলিফ হাসানের সাফল্য

বিশেষ সংবাদ


নুর ই আলিফ হাসান, বাংলাদেশের নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে মস্কোর আকাশে। ২০১৮ সালে ‘ALOHA Mental Arithmetic International Competition’ মস্কো তে লেবেল- ৩ তে (সিনিয়র) থেকে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন। বাবা-মা সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করেছেন এমন চমৎকার কার‍্যক্রমে অংশগ্রহণ করার জন্য।

মুলত, রাশিয়ার রাজধানী মস্কোতে
‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র (কংগ্রেস হোল)’ এ ‘ALOHA Mental Arithmetic International Competition ২০১৮’ অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন দেশের ছাত্ররা এই প্রতিযোগিতায় তাদের গতি ও নির্ভুলতা পরীক্ষা করতে অংশগ্রহণ করবে। ALOHA পক্ষ থেকে বাংলাদেশ থেকে ২৫০ জন শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন এই বছর। এবং ‘নুর ই আলিফ হাসান’ লেবেল- ৩ তে (সিনিয়র) থেকে দ্বিতীয় স্থান লাভ করেন।

নুর ই আলিফ হাসান এর সফলতা আমাদের এ প্রজন্মের শিশু কিশোরদেরকে উৎসাহিত করবে। ALOHA আয়োজক বৃন্দ কে আন্তরিক ধন্যবাদ। পুরো বাংলাদেশের পক্ষ থেকে নুর ই আলিফ হাসানকে অভিনন্দন এবং প্রাণঢালা শুভেচ্ছা।

অপরাজিতাবিডির পক্ষ থেকেও আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা।

আন্তর্জাতিক এই প্রতিযোগিতাটি প্রতি বছর সংগঠিত। পূর্ববর্তী বছরে এই প্রতিযোগিতাটি অস্ট্রেলিয়া, চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিনসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

 

নারীর দায়িত্ববোধ (১ম পর্ব)

রেহনুমা বিনত আনিস


ইংরেজিতে একটি প্রবাদ ও রয়েছে, ‘Courage is not the absence of fear, but rather the assessment that something is more important than fear’.
ভয় বা সাহসের অভাব মানুষের জন্মগত দুর্বলতা। কারণ মানুষ দূরদর্শী নয়। অথচ দূরের বস্তুর প্রতি তার আকাঙ্খা অনিবার। না পাওয়ার আশঙ্কা তাকে বিচলিত করে। হারাবার সম্ভাবনা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে। পেয়েও হারাবার ভীতি তাকে তাকে ত্রস্ত করে তোলে।
কিন্তু কোন বস্তুকে মানুষ যখন নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, বন্ধুবান্ধব কিংবা সমাজের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করে; এই লক্ষ্যবস্তু অর্জনকে নিজের দায়িত্ব মনে করে; এই দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেয় – তখন নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানুষ এই দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে পারে।
জীবনের একমাত্র সত্য পরিবর্তন। পরিবর্তন থেমে গেলেই বাসা বাঁধে জড়া ব্যাধি অসত্য। তাই আমাদের সদাসর্বদা সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন আমাদের চারপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি, অবস্থা কাঙ্খিত মানে আছে কি’না। যদি তা না থাকে তবে তাকে কাঙ্খিত মানে পৌঁছনোর দায়িত্ব আমাদের, সে হোক নারী বা পুরুষ।

আমাদের আদি পিতা-মাতা জান্নাতের নিরাপদ আবাস থেকে বহিষ্কৃত হয়ে আকুলভাবে তাঁদের প্রভূর কাছে আবেদন করেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা আমরা নিজেদের প্রতি জুলম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব’ (সুরা আরাফঃ আয়াত ২৩)। এর মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের কৃতকর্মের দায়ভার গ্রহণ করে নেন – অস্বীকার করেননি তাঁরা ভুল করেছেন, অভিযোগ করেননি এই ভার অন্য কারো, অনুরোধ করেননি তাঁদের পরীক্ষা থেকে নিষ্কৃতি দেয়া হোক। বরং এই পৃথিবীতে নির্দিষ্ট সময় অবস্থানকালে নিজেদের কৃতকর্মের সংশোধনে আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের স্বাক্ষর রেখে তাঁরা স্বীয় হৃত মর্যাদা পুণরুদ্ধারের কঠোর সঙ্কল্প গ্রহণ করেন।
তাঁদের না ছিলো শাপদসঙ্কুল নির্জন বিরান প্রান্তরে অবস্থান করার অভিজ্ঞতা, না ছিলো এই প্রতিকুল পরিবেশের সাথে যুদ্ধ করার পরিপক্কতা, আর না ছিলো চিরশত্রু ইবলিসের কাছ থেকে আত্মরক্ষা করার বিজ্ঞতা। সহজেই তাঁরা ভুল করলেন। হারালেন দুই সন্তানকে – একজনকে মৃত্যুর কাছে, আরেকজনকে ইবলিসের কাছে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক পথ প্রদর্শনের দায়িত্ববোধ থেকে তাঁরা গড়ে তুললেন বাকী সন্তানদের, তাদের পথপ্রদর্শক হিসেবে রেখে গেলেন নাবী শিশ (আ)কে।

এই একই দায়িত্ববোধ থেকে ফির’আউনের সকল অত্যাচারের সামনে অবিচল ছিলেন আসিয়া (আ)। সৃষ্টিগতভাবে একজন অবলা নারী হওয়া, বানী ইসরাঈল বংশোদ্ভুত হিসেবে তাঁর সামাজিক অবস্থানগত দুর্বলতা, ফির’আউনের পরিবারে বিবাহক্রমে শত্রুপরিবেষ্টিত পরিমন্ডল – বুদ্ধি এবং ধৈর্য্যের সাথে এই সকল প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি মূসা (আ)কে গড়ে তোলেন সন্তানতূল্য স্নেহমায়ামমতায় যেন এই যুবক একদিন তাঁর সম্প্রদায়কে পথ দেখাতে পারে, যে অজ্ঞতার আবর্তে তারা নিক্ষিপ্ত হয়েছিলো তা থেকে তাদের মুক্তি দিতে পারে। কোন বাঁধাই তাঁকে তাঁর সঙ্কল্প থেকে টলাতে পারেনি। কারণ তিনি তাঁর সম্প্রদায়কে ভালোবাসতেন, তাদের দুরবস্থার জন্য করুণা বোধ করতেন, তাদের অবস্থানের উন্নয়ন নিয়ে ভাবতেন। সাহস দিয়ে যে বিঘ্ন অতিক্রম করা যায়না, দায়িত্ববোধ দিয়ে তা থেকে উত্তরণ করা যায়। তিনি এই পথে শাহীদ হয়ে যান কিন্তু তাঁর গড়ে তোলা নাবী মূসা (আ) তাঁর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেন।

মারইয়াম (আ)কে যখন বলা হোল, ‘হে মারইয়াম!, আল্লাহ তোমাকে পছন্দ করেছেন এবং তোমাকে পবিত্র পরিচ্ছন্ন করে দিয়েছেন। আর তোমাকে বিশ্ব নারী সমাজের উর্ধ্বে মনোনীত করেছেন। হে মারইয়াম! তোমার পালনকর্তার উপাসনা কর এবং রুকুকারীদের সাথে সেজদা ও রুকু কর (সুরা আলে ইমরানঃ আয়াত ৪২-৪৩) – বুদ্ধিমতি এবং নিষ্ঠাবতী মারইয়াম (আ) বুঝতে পারেন এই মর্যাদার বিনিময়ে তাঁকে কোন এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হবে। পরবর্তীতে যখন তাঁকে নির্দেশ দেয়া হোল এই দায়িত্ব এমন এক নাবীকে সন্তান হিসেবে ধারণ এবং প্রতিপালন করার যার জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটুকুই আলৌকিক – তিনি ভড়কে যান। একদিকে মূর্খতার আবর্তে নিমজ্জিত সমাজে একক মাতৃত্ব নিয়ে সামাজিক কলঙ্কের ভয়, তার ওপর কিভাবে একাকী সন্তান ধারণ এবং প্রতিপালন করবেন সেই শঙ্কা। কিন্তু নির্দেশ প্রাপ্তির পর তিনি সব চিন্তা ঝেড়ে ফেলে কেবল দায়িত্বের কথাটিই মাথায় রাখেন, সকল সম্ভাব্য সমস্যা তিনি ধৈর্য্যের সাথে মোকাবেলা করেন এবং আমাদের উপহার দেন ঈসা (আ) এর মত একজন অসাধারন নাবী যার মত কেউ আগেও আসেনি, আসবেও না আর কোনদিন।
রাসূল (সা)কে নবুয়তের দায়িত্বপালনে সহযোগিতা করার জন্য আল্লাহ খাদিজা (রা)র মত একজন সহধর্মীনি মিলিয়ে দেন যিনি রাসূল (সা)কে নবুয়তপ্রাপ্তির আগে থেকেই তাঁর প্রভূর কাছাকাছি আসার সুযোগ করে দেয়ার জন্য পরিবারের অভিভাবকত্বের স্বাভাবিক দায়িত্বগুলো থেকে অব্যাহতি দেন, এবং নবুয়তের পরে যখন তিনি নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকেই বিরোধিতার সম্মুখীন হতে থাকেন তখন সাহস দিয়ে সাহচর্য দিয়ে তাঁর কন্টকাকীর্ণ পথকে যথাসম্ভব ছায়াময় করে তোলার প্রয়াস নেন। তাঁর জীবদ্দশায় একসময় মক্কাবাসীদের প্রিয়পাত্র রাসূল (সা) পথেঘাটে লাঞ্ছিত হোন, খাদিজা (রা)র পূর্বতন বিবাহপ্রসূত সন্তান হারিস রাসূল (সা)কে রক্ষা করতে গিয়ে শাহীদ হয়ে যান, মুসলিমরা দীর্ঘ তিন বছর শিয়াবে আবুতালিবে বন্দী অবস্থায় কাটান। সে সময়ও খাদিজা (রা) বিনাবাক্যব্যায়ে পাশে থেকেছেন। শেষ মূহূর্ত পর্যন্ত তাঁর সামর্থ্যের মাঝে সর্বপ্রকার যোগান দিয়ে গিয়েছেন ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তিনি জানতেন একটি পথকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কিছু ত্যাগের প্রয়োজন হয়। একটি দালান গড়ে তুলতে গেলে কিছু ইট মাটির নীচে চিরকালের মত কবর দিয়ে দিতে হয়। কিন্তু এই দায়িত্ব যারা নিয়ে নেন তাঁরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসার সুযোগ থাকেনা। সেজন্যই রাসূল (সা) খাদিজা (রা)র মৃত্যুর দশ বছর পরেও দিনে একশ বার তাঁকে স্মরণ করতেন, ‘আল্লাহ তাঁর চেয়ে উত্তম নারী আমাকে দান করেননি। মানুষ যখন আমাকে মানতে অস্বীকার করেছে, তখন সে আমার প্রতি ঈমান এনেছে। মানুষ যখন আমাকে বঞ্চিত করেছে, তখন সে তার সম্পদে আমাকে অংশীদার করেছে। আল্লাহ তার সন্তান আমাকে দান করেছেন এবং অন্যদের সন্তান থেকে বঞ্চিত করেছেন’।
এই আদর্শের ধারা অব্যাহত রেখেছিলেন মহিলা সাহাবীরা। তাঁরা জ্ঞানার্জন ও বিতরণ, সাহিত্য, রাজনীতি, চিকিৎসা, ব্যাবসাবাণিজ্য, চাষাবাদ, যুদ্ধ কোন ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিলেন না। কিন্তু তাঁদের সবচেয়ে বড় গুণ ছিলো জ্ঞানের আহরণ, চর্চা এবং প্রচারে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা।
কিন্তু এই সচেতনতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। বর্তমান যুগের নারীসমাজ অবচেতনেও এমন এক সমাজের হাতে বন্দী যা তাকে এক শরীরসর্বস্ব প্রানী হিসেবে প্রতিভাত করতে চায়। অধিকাংশ নারীর এই আবর্ত থেকে সরে আসার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে কারণ আমরা সেই জ্ঞানের চর্চা থেকে সরে এসেছি যা আমাদের নিজেদের মর্যাদা এবং অবস্থানের ভিত তৈরী করে দেয়। আর যে অল্পসংখ্যক নারী আন্তরিকভাবে জ্ঞানার্জনের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাঁদের মাঝেও জ্ঞানার্জনের সঠিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে ধারণার ঘাটতি দেখা যায়। জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য কেবল এক টুকরো কাগজ অর্জন করা নয়, শুধুমাত্র জীবনোপকরণ উপার্জনের জন্য জ্ঞানার্জনে জ্ঞানের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। এই পদ্ধতি জ্ঞানার্জনকে বড় সংকীর্ণ, অপরিপূর্ণ করে ফেলে। জ্ঞান তো সেই উপাদান যা মানুষের জীবনকে আলোকিত করে, অন্ধকারকে বিদূরিত করে, মানুষের চিন্তার সীমারেখাকে প্রসারিত করে এবং মানুষকে কুসংস্কার ও সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্তি দেয়। শুধুমাত্র এজন্যই জ্ঞানের পথে চলা উচিত! বাকী সবটুকুই উপজাত (byproduct)।

আমাদের নারীসমাজ প্রায়ই নিজেদের অবহেলিত অবস্থা এবং নারীদের অবমাননার জন্য শত শত বছর যাবত ইসলামবিচ্যূত পুরুষসমাজের দ্বারা শাসিত এবং শোষিত হওয়াকে দায়ী করে থাকেন। আমার প্রশ্ন, এই পুরুষরা তো নারীদের হাতেই গড়ে উঠেছে। সুতরাং এই প্রজাতির পুরুষদের জন্ম তাদের মায়েদের ব্যার্থতার সাক্ষ্য বহন করে।

চলবে….

 

তাহেরা!

ফাতেমা শাহরিন


তাহেরা রাহমান। ২৭ বছরের একজন মুসলিম আমেরিকান নারী। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন টিভি রিপোর্টার হওয়ার।পথে অনেক বাধাও ছিল। অজস্র বাধার কথা ভেবেই তিনি পথে নামেন। কিন্তু আজ তাহেরা রাহমান তার স্বপ্নের পথে চলমান। বর্তমানে তিনি “রক আইল্যান্ডের WHFP” টিভি অন এয়ারের রিপোর্টার।

ক্যামেরার সামনে কাজ করা সহজ নয়। তাহেরার ক্যামেরার সামনে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বড় বাধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক টুকরো কাপড় ‘হিজাব’।

ছোট বেলা থেকেই অজস্র প্রতিকূল পরিস্থিতির স্বীকার হন তাহেরা,তার মুল কারণ তিনি হিজাব পড়তেন।

সে বলেন, ‘আমার প্রযোজক আমাকে বলছিলেন, যদি তুমি তোমার স্বপ্নকে সত্যে পরিনত করতে চাও, তারা অর্থাৎ সকলে তোমাকে রিপোর্টার হিসাবে নিতে চাইবে হয়ত কিন্তু তারা তোমার হিজাব খুলে ফেলতে বলবে!
-আমি বলেছিলাম, ‘না’।
আমার এ কথা তিনি পছন্দ করেছিলেন’।

তাহেরা কলেজের গ্রাজুয়েশনের পর রেডিও স্টেশনে যোগ দেন। তারপর রেডিও থেকে টেলিভিশনে। সেখানে তিনি প্রথমে ক্যামেরা পিছনে কাজ করেন।(দৃশ্যের পিছনে) কিন্তু ক্যামেরার সামনে কাজ করার ব্যাপারে (on air position) তিনি প্রত্যয়ী ছিলেন।

তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতাম: আমি যদি কোন কিছু করতে চাই, তাহলে তা করব। আমি সাংবাদিক হতে চাই এবং আমি হিজাব পরেই সাংবাদিকতা করতে চাই। যা আগে কখন কোন আমেরিকান রা দেখেননি। আমেরিকান রা হিজাব পরা কোন নারী সাংবাদিক দেখেনি কিন্তু ভবিষ্যতে আমাকে দেখবে’।

তাহেরার স্বপ্ন প্রায়শ ভেঙ্গে যাচ্ছিল, এক সময় সে তার এই স্বপ্ন ত্যাগ করতে চেয়েছিল কিন্তু সেইসময় তার মা তাকে তার স্বপ্ন পুরনের ব্যাপারে উৎসাহ দেন। পাশে থাকেন। তার মা তাকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেন এবং আহ্বান করেন, ‘তুমিও পারবে’। অবশেষে তাহেরা তার প্রথম টিভি রিপোর্টিং কাজ পায় ‘Illions’ নামক প্রতিষ্ঠানে। ‘USA’ তে প্রথম হিজাব পরিহিতা নারী রিপোর্টার হিসাবে তাকে স্বীকৃতি দেন।

তাহেরা বলেন, ‘আমার টিভি স্টেশনের সবাই খুবই সাপোর্টিভ এবং ওনারা আমাকে নিয়ে একটা story করতে চেয়েছিল। আমি খুব খুশি হই ‘wbhf’ এর মত ‘corporate TV’ আমাকে নিয়ে তার সম্প্রচার করতে চায়’।

তাহেরা আরও বলেন, ‘সত্যি, আমি আমার faith নিয়েই বেড়ে উঠেছি, এটা শুধুই faith যা আমার মোরালিটি র মত, যা আমি মেনে চলি। আমেরিকার প্রতিটি লোক কঠিন পরিশ্রমী। আর যারা দৃঢ়চেতা তাদের আমেরিকায় স্বপ্ন পূরণে রাস্তায় কেউ বাধা হয়ে দাড়াতে পারেনা। আমার ভাবনা ছিল কেন মুসলিমরা দ্বন্দের মধ্যে জড়িয়ে আছে, এটা তাদের থাকা উচিত নয়। আমি লম্বা সময় কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছি , এটা আমাকে পরিশোধিত করেছে। কিন্তু দিন শেষে আমার পোষাকই, ‘আমার মুল্যবোধ ও বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাড়িয়েছে’।’

তাহেরাকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তোমাকে যখন ব্যঙ্গ (trolled) করা হয় তখন তোমার কেমন অনুভূতি হয়/হত?
উত্তরে তাহেরা বলেন, ‘আসলে আমি পজিটিভ ফিডব্যাক পাই, আমি কখনো এ ব্যাপারে খুব বেশি কিছু বলি না। বিদ্রুপ গুলো আমি ডাস্টিবিন ছুড়ে ফেলি। আমি ভাবি আমরা যে, আমেরিকাতে বাস করি সেখানে নানা মতের নানা দৃষ্টিকোণের আমেরিকানসহ নানান দেশের মানুষের বাস। সুতরাং এ ধরনের বাক্যবাণ আসতেই পারে এবং এখানে ভিন্নতা থাকবেই, থাকবে বৈচিত্র্যতা’।

তাহেরার মাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল যখন তাহেরা ‘আশাহত’ হয়ে পড়েন তখন আপনি কিভাবে তাকে সাহস যোগাতেন?
মা বলেন, ‘আমি জানি সে অনেক কঠিন পরিশ্রম করে। সে জানে তার লক্ষ্য কি এবং তার লক্ষ্যে তাকেই পৌছাতে হবে। প্রত্যেক পিতামাতার জন্য অবশ্যকরণীয় যে, সন্তানকে সাপোর্ট করা এবং একটা পজিটিভ পরিবেশ তৈরি করা এবং তাদেরকে তুলে ধরতে সহযোগিতা করা। আমি তার প্রয়োজনগুলো জানতাম এবং সে অনুযায়ী তাকে সহায়তা দেবার চেষ্টা করতাম’। সুত্র: ইন্টারনেট।

 

আলো ও আলেয়ার গল্প


এম এস আবু নাছের


শাহবাগ সিগন্যাল পার হতেই কিছু বালক পড়িমরি করে উঠল বাসে। কারো পড়নে পাতলা জরাজীর্ণ জামা, কারও বা স্যান্ড্রো গেঞ্জি; কেউ লুঙ্গি পড়া আর কেউবা সস্তায় পাওয়া কোন প্যান্ট। চেহারার মলিনতা আর গালের ভগ্ন দশা আপনাকে জানিয়ে দিবে এরা এই ঢাকা শহরের পথশিশু। কার্টুনিস্ট রফিকুন্নবী যাদের নাম দিয়েছিলেন টোকাই। সারাদিন রাস্তায় পাওয়া বোতল, প্যাকেট কিংবা খাবার কুড়িয়ে জীবিকার সন্ধানে ব্যস্ত থাকার কারনেই হয়ত তাদের নাম হয়েছে টোকাই। সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এদের ডাকতেন পথকলি বলে। হ্যাঁ, সত্যিই এরা পথকলি। পথের ধারে অজানা কোন পরিচয়ে হয়ত তাদের জন্ম; কিংবা দারিদ্রের নির্মম কষাঘাত আর ভাগ্যের পরিহাসে নাম পরিচয় হারিয়ে তাদের আজ পরিচয় পথকলি। হয় পথে ফোটে, নয় পথে ঝরে পরে।

বেশ কয়েকজন উঠার পর থেকেই বাসে নিজেদের মধ্যে নানারকম কথা বলছে, হাসাহাসি করছে আর আগামিকাল আবার কখন আসবে সেই কথাও জানান দিচ্ছে। আশেপাশের কিছু লোক এরই মাঝে তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ করে চলেছে। যেন দিনান্তে বাড়ি ফেরার সময় একটু বিনোদিত হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন চুপচাপ এক পাশে সিটে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তের-চৌদ্দ বছর বয়স হবে। বেশ গোলগাল চেহারা, ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। টানা চোখ দুটোতে যেন অদৃশ্য কোন মায়া লুকিয়ে আছে। সবাইকথা বলছে, কন্ট্রাক্টরের সাথে ভাড়া নিয়ে চিল্লাপাল্লা করছে আর সে একরকম নির্বাক। কন্ট্রাক্টর ভাড়া চাইতেই পকেট হাতড়িয়ে দুই টাকা বের করে দিল।

– কিরে, কনে যাবি?
– কমলাপুর।
– দুই টাকা দিছস ক্যান। ভাড়া দে। নাইলে নাইম্যা যা। উঠার সময় কইছি না, পুরা ভাড়া দেওন লাগবো।
কন্ট্রাক্টরের তর্জন গর্জনেও তার তেমন ভাবান্তর নেই। আস্তে করে বলল-

– আর টাকা নাই।
– টাকা নাই? না, শালা, ঘাড় ধরে নামায়া দিমু এখনি। বের কর টাকা।
– নাই, সত্যি কইতাছি টাকা নাই।

সিটে বসে চুপচাপ দেখছিল শফিক। সে তাকিয়ে আছে ছেলেটির দিকে। এত কড়া ভাবে বলার পরেও ছেলেটির মাঝে কোন ভাবান্তর নেই। কেমন উদাস ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, চোখদুটো যেন কিছু কথা বলতে চাইছে কিন্তু কে শুনবে তার কথা? আর একটু হলে কেঁদে দিবে হয়ত। হাতে ছোট্ট এক পুটলি ধরে আছে। যা মনে হচ্ছে সত্যিই ওর কাছে কোন টাকা নেই। মানুষ তার মস্তিষ্ক নামক যন্ত্রের সাহায্য নিয়ে কখনও মুখে আসা সত্যটি লুকিয়ে মিথ্যা বলতে পারে, কিন্তু একই সাথে শরীরের অন্যান্য অংগগুলো থেকে প্রকাশিত অভিব্যক্তি লুকোতে পারেনা। তার চোখ, তার কন্ঠের দৃঢতা, তার স্থিরতা সবকিছু মিলিয়ে সে যে মিথ্যা বলছেনা এ ব্যাপারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। আশেপাশের কয়েকজনের ভাড়া উঠিয়ে ফেরার সময় আবারও কন্ট্রাক্টর তার কাছে ভাড়া চাইল-

– কী রে, কী হইল? দে আরও তিন টাকা, বের কর।

এবারে সে সত্যিই নিরূপায়। কিছুই বলতে পারছেনা। রাতেরবেলা রাস্তায় নামিয়ে দিলে ছোট মানুষ যেতেও পারবেনা হয়ত। চোখেমুখে এক ভয় আর শঙ্কা দেখে শফিক ভাড়া মিটিয়ে ছেলেটিকে কাছে ডেকে নিল।

– তোমার নাম কি?
– আলো।
– কোথায় থাক?
– কমলাপুর বস্তিতে।
– কই গিয়েছিলে?
– শাহবাগ।
– কাজ কর?
– হুম
– কি কাজ?
– ফুল বেচি।
– কখন যাও, কোথায় পাও ফুল?
– সকালে যাই। আমাগো মহাজন আছে। প্রতিদিন অনেক ফুল আসে। পিছনে ঘুরে একে একে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে দিতে বলল- আমি, ভুট্টু, কামাল, আরিফ, জুঁই, হগগলেই ফুল বেচি। একেক দিন একেক জায়গায়। মহাজন ভাগ করে দেয়। যে বেশি ফুল বেচবার পারে হে বেশি ট্যাহা পায়। একশ গোলাপে দশ ট্যাহা, রজনীগন্ধার একশ ডাঁন্টা দশ ট্যাহা অন্য ফুলের থোকা বেচলে দুই ট্যাহা দেয়।
– আজ কত টাকা পেয়েছ?
– ষাট ট্যাহা।
– তাহলে যে বললে ভাড়া নাই।
– হ, সত্যিই ভাড়া নাই স্যার। ষাট ট্যাহার মধ্যে এক সের চাল লইছি, আর ছোট বোনের লাইগ্যা একটা জিলাপি, আর ঔষুধ।
– বোন আছে তোমার?
– হুম।
– কত বড়?
– এই এত বড়-

হাত তুলে ওর কোমরের কাছে পর্যন্ত দেখিয়ে দিল। যা বুঝলাম চার-পাঁচ বছর হবে বড়জোর।

– কে কে আছে তোমার বাড়িতে? কি হয়েছে তোমার বোনের।
– বাড়িত কেউ নাই। আমি আর আমার বোন থাকি।
– তোমার মা-বাবা?
– মা মইরা গেছে ছোট থাকতেই, বোনডা হওনের সময়। কপালপুড়ীডারে আমার কাছে থুইয়া মা চইল্যা গ্যাছে। আর বাপজান, সেই যে মর্জিনা চাচীর কাছে আমাগো থুইয়া গেছে আর ফিরেও আসেনি।

কথা বলতে বলতে কন্ঠ ভারী হয়ে এসেছে আলোর, মাথা হেলে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

– তোমার বোনের নাম কী? কার কাছে রেখে এসেছো?
– বোনের নাম আলেয়া। সকালে আসার সময় মর্জিনা চাচীর কাছে থুইয়া আসি। রাত্তিরে যায়ে আমার সাথে থাকে। সাতদিন থ্যাইকা জ্বর হইছে। টাকা নেই, চাউল কিনমু না ঔষুধ? দোকান থাইক্যা কয়ডা বড়ি আইনা দিছিলাম কিন্তু খাইবার পারেনা। ভাল ঔষুধ কিনবারও পারিনাই। গরীবের আবার জ্বর কীসের? এমনিই ভাল হইয়া যাইব। মর্জিনা চাচী ভালমত তেল ডইল্যা দিলে জ্বর পালায় যাইব। ছোটবেলায় জ্বর হলে মা তেল ডইল্যা, মাথায় একটু ঘইষা দিত। আর কইত, বাজান তাড়াতাড়ি ঘুমায় যা। সকালে উঠে আর জ্বর থাকতনা। কিন্তু আলোর জ্বর ভাল হইতাছেনা। কয়দিন কিছুই খায়না। আজ তাই ভাল ঔষুধ লইছি।

– কাল রাইতে এক থাল ভাত আর ডাল ধার নিছিলাম মর্জিনা চাচীর কাছে।তাও খায় নাই। একবার জিলাপি খাইতে চাইছে। কন স্যার,কোত্থেকে দিমু জিলাপি? ভাতই হয়না আর মুখপুড়ী জিলাপি খাইবার চায়। কথাগুলো বলতে বলতে হঠাত আলোর মুখ শুকিয়ে গেল যেন আড়ষ্ঠ হয়ে এল। চোখের সামনে গতরাতের ঘটনা ভেসে উঠলো-

– আলেয়াকে বড়ি খাওয়ানোর জন্য আলো জোর করছে। আর আলেয়া বারবার বলছে-“ও ভাই, বড়ি খুব তিতা রে, বমি হইবো খাইলে। আমি খাইবার পারুম না, খুব তিতা লাগে ভাই। আমারে মিষ্টি আইনা দিবি? গুঁড় হলেও থেঁতলা করে পানি মিশায়ে খাইয়া লইমু। দে, না ভাই একটু মিষ্টি আইনা।

– মিষ্টি কই পামু? বড়ি ডা খাইয়া ল। জিদ করিস
– ও ভাই, আমার না জিলাপি খাইবার মন চাইতাছে। আজকা বিকালবেলা করিম চাচা মেলাগুলা জিলাপি আনছিল। সাথে সাথে ও বাড়ি পর্যন্ত যাইয়া ঘুইরা আইছি।

এমনিতে হাঁড়িতে চাউল নাই। রাতের ভাতটুকু চেয়ে এনেছে মর্জিনা চাচীর কাছে থেকে। নিজে অভূক্ত থেকে বোনের মুখে একটু খাবার তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এর মধ্যে আবার মিষ্টি খাবার আবদার! সারাদিনের সকল ক্লান্তি, নিজের অক্ষমতা আর আক্ষেপ সব গিয়ে পড়ল আলেয়ার উপরে। সজোরে এক চড় বসিয়ে দিল গালে।

– মুখপুড়ী তুই মরিস না ক্যান। হওনের সময় মা’রে মাইরা ফেলাইছিস। তুই ও মায়ের সাথে চইলা যাইবার পারস নাই? এখন আমার কইলজা পোড়াইতে তোর শান্তি? কাল সকালেই তোরে ট্রেনে করে অনেক দূরে থুইয়া আইমু। আর বেশি বায়না ধরলে জ্যান্ত মাইরা ফ্যালামু।

মা মরা মেয়ে আলেয়া। জন্মের পর থেকে এই ভাইটিই তার বাপ,মা, ভাই সব। হঠাত ভাইয়ের এমন আচরণে সে এক্কেবারে চুপসে গেল। ভয়ে ভয়ে পানি আর বড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ল। রাতের মধ্যে প্রচন্ড জ্বরে আলেয়া মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠছে। মধ্যরাতে আলো একবার ঘুম থেকে জেগে আলেয়ার গায়ে ছেঁড়া কাঁথা তুলে দিল। কিন্তু জ্বরের প্রচন্ডতায় যে কাঁপুনি তা এই পাতলা কাঁথায় কিছুই হচ্ছেনা।

সকালে আলেয়াকে ঘুমিয়ে রেখেই আলো আজ বেড়িয়ে এসেছে কাজে। বিগত ছয় সাত বছরে আলেয়াকে অনেকবারই বকাঝকা করেছে, কখনও দুই চার টা চড় থাপ্পরও দিয়েছে। কিন্তু গতকাল আলেয়াকে মারার পর থেকে আলোর মনে তা খুব পীড়া দিচ্ছে। বড় ভাই হিসেবে শাষন সে করতেই পারে। কিন্তু গতকাল কি শাষন ছিল? আলেয়ার ত কোন ভুল ছিলনা।ছোট মানুষ কিছু খেতে চাইতেই পারে। কার কাছেই বা চাইবে? ভাই ছাড়া। না শাষন নয় বরং আলো তার নিজের অযোগ্যতা, অক্ষমতা আর ছোট বোনের আবদার পূরনের ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ হয়েই সকল আক্রোশ গিয়ে পড়েছে আলেয়ার উপরে।

গুলিস্তান মোড়ে বাস থেমে আছে অনেকক্ষন ধরে। ট্রাফিক সিগন্যালে সবুজ বাতি জ্বলা মাত্রই গাড়ি সামনের দিকে টান দিল। অন্যমনষ্ক থাকার কারনে স্থিতি জড়তার প্রভাবে আলো প্রায় পড়েই যাচ্ছিল। শফিক তার হাত ধরে, আটকালো।

– আলো, কী ব্যাপার একবারে চুপ হয়ে গেলে?

শফিকের ডাকে মাথাটা একটু উপরে তুলল। বাসের হালকা আলোতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ঐ মায়াবী কালো চোখের নীচ দিয়ে শীর্ণ কোন নদীর ধারা বয়ে চলেছে সবার অলক্ষ্যে।

– তোমার বোনের জন্য কী ঔষুধ নিলে?
– আলেয়া বড়ি খেতে পারেনাত, তিতা লাগে তাই দোকানে বইলা একটা মিষ্টি সিরাপ লইছি। আইজকা বোন ঔষুধ খাইতে আর কষ্ট পাইবনা। কাল জিলাপি খাইতে চাইছিল, তাই দশ টাকা দিয়া একটা জিলাপিও লইছি।

কথায় কথায় বাস চলে এল কমলাপুর। হেল্পারের ডাকে উঠে দাঁড়ালো শফিক, পিছে পিছে আলো ও তার বন্ধুরা। বাস থেকে নেমে শফিক সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল সামনের মিষ্টির দোকানে। দোকানীকে বলে দিল সবাইকে একটা সন্দেশ আর কালোজাম দিতে। আর কিছু সন্দেশ ও কালোজাম প্যাকেট করে দিতে। দোকান থেকে বের হবার সময় শফিক মিষ্টির প্যাকেট আলোর হাতে দিয়ে দিল।

-আলো, এইগুলো তোমার। তুমি আর আলেয়া মজা করে খেও।
– স্যার, এইগুলা সব আমার?
– হ্যাঁ, সব তোমার আর আলেয়ার জন্য।

মলিন মুখখানি মূহুর্তেই টিউব লাইটের মত জ্বলে উঠলো, ঠোঁট দুটো প্রসারিত হল দুপাশে। কৃষ্ণকায় চেহারার মাঝে সাদা দাঁতগুলো যেন শাপলা শালুকের ন্যয় সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন এই চেহারা, এই হাসি আচ্ছন্ন করতে পারে দুনিয়ার সবাইকে, মোহাবিষ্ট করতে পারে অন্তরকে, গলাতে পারে পাষান। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে আলোর হাতে ২০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিল।

-আলো, যাও। সবাই সাবধানে চলে যেও। বলে সবাইকে বিদায় জানালো শফিক।

দ্রুতলয়ে বাড়ির দিকে এগোচ্ছে আলো। অজানা কোন এক উচ্ছাস কাজ করছে তার মধ্যে। সারাদিন মনের মধ্যে যত খেদ ছিল, শফিকের সাথে কিছুক্ষণের আলাপে তা উবে গিয়েছে। আজ তার কাছে রাতের খাবার চাউল আছে, অসুস্থ বোনের জন্য ঔষুধ, জিলাপি, মিষ্টি; আর কী চাই! সে জগতের সবচেয়ে সুখী মানুষ, সুখী ভাই। অদূরে মিলিয়ে যাচ্ছে আলো আর তার সঙ্গীরা। শফিক দূর থেকে দেখছে। কী সেলুকাস! সারাজীবন এই পথশিশু আর তাদের জীবনগাঁথা থাকে সোডিয়াম বাল্বের আবছা আলোর মতই আঁধারে। উদ্ভাসিত আলোয় ঝলমলে দুনিয়ার চেহারা তাদের দেখা হয়না কখনই।

দূর থেকে ছোট্ট এক কামরার বাড়ি আলো ও আলেয়ার। আলোর পা আরো দ্রুত চলছে। আলেয়াকে গিয়ে মিষ্টি সিরাপ দিবে, কাছে ডেকে আদর করে বলবে- “তোকে আর বড়ি খাইতে হইবেনা বোন”

মিষ্টি আর জিলাপি লুকিয়ে রেখে আলেয়াকে চোখ বন্ধ করতে বলে হাতে দিবে। এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ির একদম কাছে চলে আসল আলো। ভিতর থেকে কিছু মানুষের হালকা আওয়াজ ভেসে আসছে। আলো দ্রুত ঘরে প্রবেশ করতেই মর্জিনা চাচী বলে উঠলো-

-এতক্ষনে তোর সময় হল আসার? সকাল থাইকা মাইয়াডা ভাই ভাইকইরা মুখে ফ্যনা তুইলা ফ্যালাইলো। জ্বর একবার আসে তো আবার যায়। আয় আয়, তাড়াতাড়িকাছে আইয়া বস।

হাতের পুটলি, মিষ্টির প্যাকেট বিছানার পাশে রেখে হাঁটু গেঁড়ে বসলো আলো।

-আলে, এই আলে। বোন! কী হইছে রে? জ্বর কমেনি? আমি মিষ্টি সিরাপ লইয়া আইছি বোন। ভাল হইয়া যাইব।

ভাইয়ের গলা শুনতে পেয়ে আলেয়া চোখ মেলে তাকালো। একটু হেসে হাত বাড়িয়ে দিল ভাইয়ের দিকে। আলো বোনকে কোলে তুলে নিল। গালে, মুখে, কপালে চুমো দিয়ে যেন সারাদিনের মনের অশান্তি কিছুটা হলেও মিটিয়ে নিল। কোলের মাঝে আলেয়াকে রেখেই আলো মর্জিনা চাচীকে চাউলের পুটলি এগিয়ে দিয়ে রাতের জন্য আলু সেদ্ধ ভাত একটু রান্না করে দিতে বলল। আর মিষ্টি, জিলাপি বের করে আলোকে দেখিয়ে বল, দ্যাখ বোন তোর জন্য কত্ত মিষ্টি লইয়া আইছি, জিলাপিও আছে, দ্যাখ।

আলেয়া একটু হেসে জিলাপি খেতে চাইলে আলো জিলাপি নিয়ে তার মুখের কাছে ধরল। আলেয়া তার হাত থেকে জিলাপি নিয়ে ভাইয়ের মুখের দিকে নিয়ে গেল। কয়দিন তেমন কিছু খায়নি। তার উপরে জ্বরের প্রকোপ। হাত উঠাতেও বেশ কষ্ট হচ্ছে আলেয়ার। আলো বোনের হাত ধরে জিলাপি মুখের কাছে এনে এক কামড় খেয়ে আলোর হাত নামিয়ে আনলো। আলেয়ার হাত ছেড়ে দিতেই তা নীচে পড়ে গেল। আলেয়ার চোখ দুটো শান্ত, স্থির যেন ভাইকে দেখছে কত প্রশান্তিতে।

আলো কিছু না বুঝে বার বার বলে চলেছে, কী রে, জিলাপি খা। বোন, জিলাপী খা। একটা এনেছি বলে রাগ করেছিস?

-পাগলি, এইতো আমি এক কামড় খাইছি। বাকিটা তুই খা। বেশি ক্যামনে কিনমু বোন, বল? যে কয়ডা ট্যাহা কামাই করি তা দিয়ে ত পেটের ভাতই জোটেনা রে। তুই খা, বোন। মন খারাপ করিসনা। এইবার আরো বেশি আইনা দিমুনি। আরে, দ্যাখ কত্তগুলা মিষ্টি, সন্দেশ লইয়া আইছি তোর জন্য। নে, নে তাড়াতাড়ি খাইয়া ল।

আলেয়ার হাত ধরে ওর মুখের কাছে নিয়ে যেতেই আলো ভয় পেল। হাতে কোন শক্তিই নেই। একটু উপরে তুলতে জিলাপিও পড়ে গেল হাত থেকে। আচমকা আলেয়া বার কয়েক হেঁচকি তুলল। আবার চোখ খুলে তাকালো। বিরবির করে আওড়াচ্ছে-

-দে না ভাই, আমায় একটু মিষ্টি আইনা। ঔষুধ খুব তিতা রে ভাই। খু—উ—ব– তি—তা। আমি ট্রেনে যামুনা ভাই। আমায় ফ্যালায়ে যাসনা ভাই। তোকে ছাড়া আমি রাইতে কার কাছে থাকমু ভাই? আমায় ছাইড়া যাসনা ভাই। আর কক্ষনও জিলাপি খাইবার চাইমুনা ভাই।

পাগলের মত আলো আলেয়াকে কোলের সাথে জাপটে ধরে আছে, হাতে মুখে চুমো দিচ্ছে।

-তোকে কোথাও যাইতে দিমুনা বোন, কোথাও ফ্যালায়া যামুনা। আর তিতা ঔষুধ খাওয়ামুনা।

কোলের মাঝে আলেয়া ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে আওড়িয়ে শেষবারের মত বলে চলেছে-

-ভাই, দ্যাখ, মা কত্ত জিলাপি লইয়া আইছে। মা মিষ্টি ঔষুধওআনছে ভাই। আমি মা’র কাছে গেলাম। তুই মন খারাপ করিসনা। আমি মা’র কাছে যা—ই—ই—ই—ই ভা—–।

আলো শক্ত করে বুকের সাথে আলেয়াকে ধরে আছে।

-তোকে কোত্থাও যাইতে দিমুনা আমি, কোত্থাও না। আর বকাও দিমুনা বোন।

মর্জিনা চাচী এসে আলেয়াকে আলোর কাছে থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। পাশের ছেঁড়া কাঁথাটা তুলে দিল মুখ ঢেকে সারা শরীরের উপরে। বিচ্ছিন্ন হল আলো হতে আলেয়া। বিচ্ছিন্ন হল ভাই-বোন, দুটি প্রাণ।

 

একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি

মো: আশরাফুল মজিদ 

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা। গত ১০ বছরে প্র্রতিদিন গড়ে ১১ জন নারী সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশে। নারী ও শিশুর প্র্রতি নির্মমতা ও নির্যাতনে হতবাক ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বিবেকবান মানুষ।

পুলিশের ধারণা, শিশুরা এক শ্রেণীর বিকৃতমনা মানুষের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। নিপীড়ন চালানোর একটা বড় কারণ নৈতিকতাহীন মানসিকতা।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন ও ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ চিত্র থেকে স্পষ্ট, প্র্রতি বছরই শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্র্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৮৬টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৭২৭টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। জরিপ অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও পাশবিক নিপীড়ন আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে সর্বমোট ২২৪টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। পথেঘাটেও দেদার ঘটছে শিশু ধর্ষণের বর্বরোচিত ঘটনা।

সমাজতাত্ত্বিকেরা বলতে পারবেন, একটা সমাজ কতখানি অসুস্থ হলে এ রকম নারকীয় ঘটনা রোজ ঘটতে পারে। শিশুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে, শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে অর্থগৃধনুরা। একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের নিছক ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। অনেক ক্ষেত্রে এতে পর্নোগ্রাফির প্রভাব রয়েছে। গবেষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান হারে শিশু যৌন লালসার শিকার হওয়ার পেছনে রয়েছে কুসংস্কারও। এই যুগেও বহু মানুষ বিশ্বাস করে, শিশু বা কুমারীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে যৌনরোগ নিরাময় হয়।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করতে হবে এবং এক মাস পরপর মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে থানা সেল; কিন্তু গত ১০ মাসেও আদালতের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নারীর প্রতি সহিংসতাও বেড়ে চলেছে। ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ গুম করার ঘটনাও ঘটছে। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। তবু সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফরেনসিক পরীক্ষার ঝামেলা এবং আলামত সংগ্রহ করতেও অভিযুক্তকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য করায় অনেকেই লোকলজ্জায় এসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে চান।

থানায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না অপরাধী। গ্রেফতার হলেও মামলা বেশি দূর এগোয় না। প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনদের হুমকিতে আছেই; তাদের মধ্যস্থতায় কথিত মীমাংসা করতে বাধ্য হন অভিযুক্তরা। মামলা চলাকালে বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচারে দীর্ঘসূত্রতা জনমনে আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কী ভাবছে রাষ্ট্র?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মামলার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর মামলা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিচারকস্বল্পতা এ ক্ষেত্রে একটি সঙ্কট বলে উল্লেখ করেছেন। মামলা ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার’র পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে তিন হাজার ৮৩১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের শিকার দুই হাজার ৩০৮ জন। ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৫ জনের মধ্যে ৪৭৩ জনই শিশু। ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৮১৪ জনের মধ্যে ৪৫২ জন শিশু; ২০১৪ সালে ৬৬৬ জনের ৩৯৩ জন শিশু; ২০১৫ সালে ৭৮৯ জনের মধ্যে ছিল ৪৭৯ জন শিশু। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার ৭৫৭ জনের মধ্যে ৫১১ জনই শিশু। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৩৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ এবং মার্চে ৫৫ জন।

নির্যাতিত নারী ও শিশুদের চিকিৎসার্থে গঠিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের শিকার শিশু ওসিসিতে ভর্তি হয়েছে। বেশির ভাগ শিশুর বয়স ছয় থেকে ১৬ বছরে মধ্যে। ওসিসির সমন্বয়ক ডা: বিলকিস বেগম জানান, শিশুরাই ধর্ষণের সবচেয়ে বড় শিকার। কারণ তারা কিছুই বলতে পারে না, অসহায় থাকে ধর্ষণের সময়। ওরা নরপশু দুর্বৃত্তকে ভয়ও পায়। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিজ ঘরেও, এমনকি নিকটাত্মীয়-স্বজনদের হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে না তারা। এ অবস্থায় তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ওসিসি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী, যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে হত্যা। এর সাথে একই ভাবে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা অথচ এই অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় তেমন আনা যাচ্ছে না বলা চলে। এর কারণ, অনেকেরই আছে ক্ষমতার ‘আশীর্বাদ’, তাই তারা অপ্রতিরোধ্য। কোনো নারীই যেন আজকাল আর নিরাপদ নন।
রাস্তাঘাট, হাট-মাঠ, বাস-ট্রেন, স্কুল-কলেজ, কর্মস্থল কিংবা আপন গৃহস্থল- কোথায় কার কাছে নারী নিরাপদ? বিবেকবান প্রতিটি পুরুষই এসব ঘটনায় লজ্জিত হওয়া উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

সূত্রঃ নয়াদিগন্ত

 

টিনএজ মনের প্রেম ভাবনা

 


আফরোজা হাসান


পরিবার ও পরিবারের একটু বাইরে মিলিয়ে বারো থেকে চৌদ্দ বছর বয়সি এগারোজন টিনএজ কন্যা আছে আমার। সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি আমরা। ওরা ওদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করে। আমিও আমার চিন্তা-ভাবনা বলি। যে কোন প্রসঙ্গ উঠলেই নিজেদের মধ্যেই তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করে সবাই মিলে। আমি কখনই ওদের মাঝে কথা বলতে যাই না। আমি মূলত রেফারি হিসেবেই থাকতে পছন্দ করি। কথাবার্তা ঝগড়ার দিকে মোড় না নিলে মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শুনতে থাকি ওদের কথা। বুঝতে চেষ্টা করি মোটামুটি একই রকম পরিবেশে বেড়ে উঠার পরও চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা, যাচাই-বাছাইতে কত পার্থক্য বিদ্যমান ওদের মাঝে। একটা ব্যাপারে সবচেয়ে অবুঝ যাকে মনেহয় তাকেই আবার অন্য আরেকটি ব্যাপারে সবচেয়ে বুদ্ধিমতি মনেহয়। সত্যি খুব উপভোগ করি এই বৈচিত্র্যতা।

গত সপ্তাহে ওদের আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল ‘প্রেম’। একজন বলল, কেন ইসলামে কেন প্রেমকে হারাম বলা হয়েছে? ছেলে ও মেয়েদের একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ তো আল্লাহই সৃষ্টি। তাহলে সেই আকর্ষণের টানে একে অন্যের দিকে যাওয়া নাজায়েজ হবে কেন? আরেকজন একটু বিজ্ঞের ভঙ্গীতে বলল, ইসলাম আসলে মোটেই প্রেমকে হারাম বলেনি। কেননা বিয়ের পর একটি ছেলে ও একটি মেয়ের সম্পর্ক বিকশিতই তো হয় প্রেম ভালোবাসার দ্বারা। সাথে সাথে আরেকজন বলল, তাহলে বিয়ে না হলে ছেলে-মেয়েরা একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে না এমন নিয়ম থাকলেই সবচেয়ে বেশি ভালো হত। অন্যজন বলল, এমন হলে তো আর পরীক্ষা করা হত না কে উত্তম আর কে অধম। আরেকজন প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল, কিন্তু কেন? বিয়ের আগে চেনা-জানা ও ভালো লাগা থাকতে সমস্যা কোথায়? এটা বরং ভালো হবার কথা। বিয়ের পর বোঝাপড়াতে অনেক সুবিধা।

সময়াভাবে গত সপ্তাহে আমার আর কথা বলা হয়নি। বিষয়টা নিয়ে আজ আলোচনা করার কথা ছিল। ক্লাসে ঢুকে সবার চেহারা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে, তাহাদের মন বাগিচায় গুন গুন করিয়া গুঞ্জন করিতেছে ভ্রমর। কুসুম কুসুম ভাবনারা কাশফুলের ন্যায় একবার এইদিকে তো আরেকবার ঐদিকে হেলিয়া দুলিয়া পড়িতেছে। কাহারো কাহারো মুখমন্ডলে লাজুকতার রক্তিম আভাও পরিলক্ষিত হইলো। যাইহোক, আমি কারো মন ও চেহারায় দিকে না তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, অনেকদিন তোমাদেরকে উপহার দেয়া হয় না। আজ আমি সবার জন্য উপহার নিয়ে এসেছি। সবাই এক এক করে আসো আর নিজ নিজ উপহার নিয়ে যাও। তারপর দেখে বলো কেমন লাগলো। উপহারের নাম শুনেই আনন্দ ও খুশিতে ঝিকমিক করতে লাগলো কন্যারা সবাই। এবং আলো বিকিরণ করতে করতে আমার কাছ থেকে নিজ নিজ উপহার নিয়ে গেলো।

একজন বলল, খালামণি তুমি এত সুন্দর করে প্যাক করেছো যে আমার খুলতেই ইচ্ছে করছে না! অন্যজন হাসিতে বিকশিত হয়ে বলল, হুম…দেখেই বোঝা যাচ্ছে খালামণি আমাদের জন্য ভীষণ স্পেশাল কিছু এসেছেন। পন্ডিত একজন বলল, শোন তোমরা কিন্তু একটা প্রবাদ ভুলে যাচ্ছো, উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। এমন নানারকম মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য আর উচ্ছ্বাস ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে সবাই নিজ নিজ উপহারের প্যাকেট খুললো। যার যার উপকার হাতে নিয়ে সবাই যখন আমার দিকে তাকালো মনেহলো বাসন্তি আলো ছড়ানো ঝলমলে পুর্ণিমার চাঁদকে হঠাৎ যেন ঢেকে ফেললো একখন্ড ঘন কালো মেঘ। আমি আগের মতই হাসিমুখে বললাম, কি পছন্দ হয়েছে তোমাদের উপহার? অনেকক্ষণ নীরবতার পর ধীরে ধীরে একজন বলল, খালামণি এই পুরনো ছিঁড়ে যাওয়া ড্রেসটা আমার উপহার? আরেকজন অভিমানী কণ্ঠে বলল, আমার চকলেটের বক্সের সবগুলো চকলেটই একটু একটু করে কে যেন খেয়েছে। এঁটো চকলেট আমার উপহার?

বললাম, ভেবে দেখো উপহারের কথা শুনে তোমরা কত্তো খুশি হয়েছিলে! খুব সুন্দর করে প্যাকেট করা উপহারের বক্স দেখে তোমাদের সেই আনন্দ আরো বেড়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই কত রকমের স্বপ্ন, আশা, ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তোমাদের মনে উপহারকে ঘিরে। কিন্তু সুন্দর করে মোড়ানো উপহারের বক্স খুলে যখন তোমরা পুরনো ছেঁড়া ড্রেস, আধ খাওয়া চকলেট, উপরে ছত্রাক পড়ে গেছে এমন কেক, ভাঙ্গা চুড়ি ও গহনা দেখলে সাথে সাথে তোমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আমরা কেউই উপহার হিসেবে পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চাই না। কখন যদি এমন কিছু পেয়েও যাই উপহার হিসেবে সেটা আমাদেরকে আনন্দিত করে না। আমরা ভালোবাসা নিয়ে সেটাকে গ্রহণ করতে পারিনা।

দেহের সুন্দর আবরণের ভেতরে যে ছোট্ট মনটা আছে সেটা নারী ও পুরুষের জন্য ঠিক এমনই এক উপহার! তোমরা কেউ কি মনের সাথী হিসেবে এমন কোন মনকে উপহার হিসেবে পেতে চাইবে যেটা আগেই কারো দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে? যেই মনের কোন অংশ ছেঁড়া বা ভাঙা কিংবা যাতে অন্যকারো চিহ্ন লেগে আছে? যাতে ছত্রাক পড়ে গিয়েছে, যা থেকে ভেসে আসছে হালকা দুর্গন্ধ? একসাথে এগারো জন চিৎকার করে উঠলো, কক্ষনো না। কোনদিনও না। ছিঃ, ইয়াক! হেসে বললাম, ইসলাম তো তোমাদের এই ইচ্ছাটাকে সফল করার পথই সুগম করেছে। দেখো আমরা কেউ ভবিষ্যৎ জানি না। তাই এর কোন নিশ্চয়তা নেই যে যার সাথে তুমি প্রেম করছো তার সাথেই তোমার বিয়ে হবে। একজনকে ভালবাসার পর একসময় হয়তো কোন কারণে ভেঙ্গে গেল সম্পর্ক, কিংবা সে এসেছিলই তোমাকে ধোঁকা দিতে, তোমার ক্ষতি করতে। তখন কি করবে তোমাদের এই ভাঙ্গাচোরা মন নিয়ে? আর যে উপহার পাবে এই মন সেকি আনন্দিত হতে পারবে?

ইসলামে প্রেম হারাম নয়। ইসলামে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক নিষিদ্ধ। এবং এই নিষিদ্ধের পেছনেই আমাদের সবার কল্যাণ নিহিত। তোমাদের দেহ ও মন শুধু তোমাদের একার নয়। এটা তোমাদের যে সাথী হবে তাদের জন্য উপহার। ঠিক তেমনি তোমাদের সাথীদের দেহ ও মন তোমাদের জন্য উপহার স্বরূপ। আর পৃথিবীতে কেউ উপহার হিসেবে পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চায় না। তাই আমাদের কাউকে যাতে সাথী হিসেবে এমন কাউকে উপহার হিসেবে পেতে নাহয় তাই ইসলামে বিয়ের আগে প্রেমকে নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। তোমরা সবাই যাতে তোমাদের মনটাকে নিজ নিজ জীবনসাথীর জন্য সযতনে আগলে রাখতে পারো সেই পথই তো ইসলাম উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যাতে একে অপরকে দেবার সময় তোমাদের উপহার সদ্যফোঁটা গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও সজীব থাকে।

নিজ নিজ উপহারের প্যাকেট পাশে সরিয়ে দিয়ে সবাই তখন বলল, ইনশাআল্লাহ আমরা কখনোই বিয়ের আগে প্রেম করবো না। আমরা সবসময় মনে রাখবো আমাদের মন কারো জন্য উপহার হবে একদিন। আর উপহার হিসেবে কেউই পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চায় না। আমি জানি আমার কন্যারা এমন উদাহরণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাই থমকে গিয়েছিল কিছুটা। কিন্তু যেহেতু চিন্তার খোঁড়াক পেয়েছে ওদের মন ও মস্তিষ্ক বসে থাকবে না। নতুন নতুন প্রশ্ন ও যুক্তি নিয়ে আবারো হয়তো হাজির হবে আমার কাছে। আমি তখন সেই আলোকে জবাব দিতে চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। অভিভাবকরা প্রায় সময়ই যে ভুলটা করেন তা হচ্ছে, সন্তানদের প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেন না। অথচ অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের প্রশ্নের জবাব দেয়া এবং এমন ভাবে দেয়া যা ওদেরকে চিন্তার খোঁড়াক যোগাবে। যারফলে আবেগ দিয়ে না বরং যুক্তি দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করতে শিখবে সন্তানরা।

 

মায়াবী কাক

মনির মোহাম্মদ


ছোট্টবন্ধুরা তোমরা কেমন আছ? অনেক দিন পরে আজ একটা গল্প বলব তোমাদের। আমার নামটা মনে আছে? আমি টুনি, চল আমরা গল্পটা শুনে আসি। আমাদের বাড়িটা একটা বনের পাশে। প্রতিদিন পাখিদের কিচির মিচির শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। আচ্ছা তোমার পাখিদের গান কেমন লাগে? আমার কিন্তু খুব ভালো লাগে। তাই বলে পাখিদের খাঁচায় বন্দী করে রেখোনা। একদিন এক পাখি আমায় তার দুঃখের অনেক কথা বলেছে। এই পাখিটাই আমাকে সাদা ঘোড়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে।
একদিন আমি মন খারাপ করে আমাদের বাড়ির বারান্দায় বসে বসে মাটিতে কাটা কুটি খেলছি। তখন দেখলাম…দাঁড়াও দাঁড়াও, আর একটা কথা তোমায় বলা হয়নি। আমাদের এখানে অনেক রকম ফুলের গাছ আছে। তোমার, প্রিয় ফুল কি? আমার প্রিয় ফুল জবা,লাল টকটকে জবা। লাল টকটকে জবা ফুল,কী ভালোই না লাগে দেখতে! চল গল্পটা শেষ করে আসি।
একদিন রাত্রে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির সাথে ছিল প্রছন্ড দমকা হাওয়া।
এত ঝড় ছিল যে অনেক গাছেরই ডাল পালা ভেঙে পড়েছিল সেদিন।
আমার বন্ধু বকুলদের একটা মাটির ঘর ছিল। জানো তাদের সেই ঘরের একটা দেয়াল ভেঙে পড়েছিলো সেদিন। আমার বন্ধু বকুলের অনেক মজার মজার গল্প আর ছড়ার বই ছিল। বেচারার সবগুলো বই ভিজে গিয়েছিল। তার কী যে মন খারাপ! আমি বকুলকে দেখতে বকুলদের বাড়িতে গেলাম।
বকুলের দাদু আমরা যাকে নিতাই দাদু ডাকি। আমি দেখলাম তারও অনেক মন খারাপ। নিতাই দাদু আমাকে অনেক আদর করেন। জানো গতবার মেলায় দাদু আমাকে আর বকুলকে অনেক খেলনা কিনে দিয়েছিলো। আমি চকলেট খুব পছন্দ করি। তুমি কি চকলেট খাও? জানো বেশি চকলেট খেলেনা দাঁতে পোকা হয়। আমার একবার দাঁতে পোকা হয়েছিল, দাঁতে কী যে ব্যাথা! নিতাই দাদু বলেছে চকলেট কম খেতে, তাই আমি চকলেট কম খাই। তুমিও চকলেট কম খাবে, না হলে কিন্তু দাঁতে পোকা হবে।
নিতাই দাদু মন খারাপ করে উঠুনে বসে আছে। বকুল আমাকে দেখতে পেয়ে দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। আমার হাতটা ধরে বনের কাছে নিয়ে গেল। বনের গাছগুলোকে দেখে খুব খারাপ লাগলো। এত সুন্দর সবুজ গাছপালা ঝড়ে সব ভেঙে দিলো।আমার কী যে মন খারাপ হল সেদিন!
হঠাৎ দেখলাম একটা ভাঙা গাছের নিচে একটা পাখির বাসা পড়ে আছে। আমি পাখির বাসার কাছে গিয়ে বাসাটা দেখলাম। আমি দেখি তার ভিতরে একটা ছানা। ছানার অদূরে একটা গাছের ডালে একটা কাক বসে বসে কা কা কা করছে। ছানাটার এখনও চোখ ফুটেনি। আমরা নিতাই দাদুকে ডাকলাম। নিতাই দাদু বললেন এটা কাকের ছানা না। এটা কোকিলের ছানা।
আমি আর বকুল দাদুর কথা শুনে মুখ হা করে রইলাম। দাদু আমাদের একে একে সব বললেন। দাদু বললেন কোকিলরা একটু অলস পাখি, মা কোকিল কাকের চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাকের বাসায় ডিম দিয়ে যায়। বোকা কাক এটাকে নিজের ডিম ভেবে ডিমে তা দেয় আর তা থেকে কোকিলের বাচ্ছা ফুটে বের হয়। পালকবিহীন বাচ্ছাকে নিজের বাচ্ছা ভেবে পরম আদরে বড় করে তুলে কাক। কাক কালো হলেও কিন্তু অনেক মায়াবী একটা পাখি।
আস্তে আস্তে যখন কোকিলের ছানা বড় হয় তখন সে তার দলের লোকের কাছে ফিরে যায়। আর বোকা কাক বসে বসে কাঁদে আর কা কা করে।
কথাটা শুনে আমার খুব মায়া হলো। আমি আর বকুল দুজন মিলে কাকের বাসাটা ঠিক করলাম। কিন্তু কোথায় রাখবো? নিতাই দাদু বাসাটাকে একটা বড় আম গাছের উপরে রেখে আসলেন। কাকটা আমার দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে ছিল। আহারে অন্যের বাচ্ছার জন্য এত মায়া দেখে ভাবতে ভাবতে আমি আর বকুলের দুচোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।তখন আমরা বুঝলাম আসলে কাক কালো হলেও অনেক মায়াবী একটি পাখি!

মনির মোহাম্মদ
মায়াবী কাক
শিশু ও কিশোরদের জন্যঃ একটি শিক্ষণীয় গল্প!

 

কাঠ পেন্সিল অথবা সবুজ পাতা

সামিয়া কালাম


নিঃসঙ্গতার অনেক বড় সঙ্গ আছে। আর সে সঙ্গ টা হল নিজের মন। নিজেকে বই এর মতো,অথবা নতুন কেনা শাড়ির মতো আবার উল্টে পাল্টে দেখা যায়। আজ একটা সন্ধ্যা নামলো। নিজের মত করে আমি ব্যলকনিতে একলাটি বসে রইলাম। মাগরিবের আজানের পর ছেলেরা খেলা শেষে বাড়ি ফিরল। ওদের একসাথে নিয়ে নামাজ পড়লাম, সেটা আমি সব সময় চেষ্টা করি। সুখদেব সানা দা মেসেজ দিয়েছিলেন, লেখা চেয়েছেন, তার পাশা পাশি লিখেছেন “আপনার একটি ম্যাসেজ খুব ভালো লাগলো। নিয়মিত নামাজ পড়েন। বিষয়টা প্রত্যেকটা মুসলমানের অনুভব করা উচিত। আমার মতে, নামাজ আল্লাহ্ সৃষ্ট এমন এক শ্রেষ্ঠ ধর্মাচার, যা মানুষের মন-মেজাজ এবং শারীরিক সুস্থতা বজায় রাখার উত্তম পন্থা।”
আমি নিজেকে ভালবাসি, সবচেয়ে বেশী। সবাই তাই বাসে, কেউ স্বীকার করে কেউ করে না।
মনকে স্থির করার জন্য দুটো পথ আছে… এক, নিজের মাঝে আয়ত্ত হওয়া।
দুই, বৃত্তের বাইরে যেয়ে, নিজের কষ্ট গুলোকে অন্যের সাথে ভাগাভাগি করে নেওয়া।
দ্বিতীয় টি খানিকটা রিস্কি। এখানে ভুল বোঝা বুঝির সম্ভাবনা অনেকটা বেশী। প্রত্যাশাও বেশী। কারণ, মানুষ বড্ড ভুল বোঝে, মানুষ বড্ড নিষ্ঠুর…।

“বলো কি তোমার ক্ষতি, জীবনের অথৈ নদী, পার হয় তোমাকে ধরে দুর্বল মানুষ যদি? ”
এই কথাগুল ভুপেন হাজারিকার গানের সিডি তেই বেশ মানায়, জীবনে পালন করতে গেলেই বিপত্তি…। ফ্রেন্ড হয়ে যাবে আন ফ্রেন্ড, বান্ধবি হয়ে যাবে ব্লক। তাই নিজের মতোই থাকা ভালো।
আজ “ভালো আছি ভালো থেকো” অনুষ্ঠানটি চৈতি ভাবির অনুরোধে দেখলাম। মানুষের যে কত রকমের কষ্ট থাকে!! নিজের দু এক দিনের অপ্রাপ্তি সেখানে নস্যি। কল্লাণ মন্ডল, গড়িয়া থেকে ফোনে বল্লেন, “ আমার ছেলে মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে পড়ে। পরীক্ষা চলছিল, একটাই ছেলে, হলের খাওয়া ভালো লাগে না, তাই বাইরে খেতে গেলো বাইকে করে। বাড়ি ফিরল লাশ হয়ে। আজ এক মাস ৬ দিন, আমি এখন নিজেকে সামলাই নাকি স্ত্রী কে। আমার বয়স ৫২ আর ওর ৪৮। কি করবো কিছুই বুঝে পাচ্ছি না!”

আর তাই আমি মনে মনে নিজের মনের গণ্ডি টাকে বড় করতে থাকি। ভাবতে থাকি, যে সকাল গুলোতে শ্রাবনের ধারার মতো পড়ুক ঝরে। পড়ুক ঝরে এই গান টা গাইতাম, ছেলেরা বলতো “ সক্কাল বেলা চিক্কুর দিতেসো ক্যান? ”

এতো খারাপ লাগতো নিজের কাছে, একটা গানই তো গাই। কিন্তু যে সকাল গুলোতে প্রতিদিনের নিয়মে সূর্য উঠবে, সান বার্ড টা যেয়ে বসবে কোন ডালে, কিন্তু আমার ছেলেরা আমার কাছে থাকবে না! হয়তো ওরা থাকবে কোন দূর দেশে, অথবা হোস্টেলে, সেদিনও কি আমার ইচ্ছে হবে গান গাইতে। শীত কিংবা গ্রীষ্মে? এসব ভাবতে ভাবতে সময় কেটে যায়।
আজ খুব সুন্দর একটা দিন ছিল। স্কুল ছুটির পর ওয়াফিক দাঁড়িয়ে ছিল কালো রং এর একটা কাঠ পেন্সিল হাতে।

“মা জানো, আজ ম্যাথ স্যার একটা সারপ্রাইজ টেস্ট নিলো, এত্তগুল প্রশ্ন, আমি সব গুলো এটেন্ড করতে পারিনি। কেউই পারেনি, কিন্তু আমি সব্বার মাঝে থার্ড হলাম, ম্যাথ স্যার প্রথম তিন জন কে একটা গিফট দিল… এই পেন্সিল টা কি জোসসস না দেখো মা???”

নিতান্ত সাধারণ একটা কাঠ পেন্সিল, সে তার প্রাপ্তির মহিমায় কতটা অসাধারণ হয়ে গেলো! কতটা আনন্দ অশ্রু এনে দিল, তা লিখে শেষ করা যাবে না। আর তাই আমি আবার আমার গণ্ডিতে ফিরে আসতে চাইলাম। পারলামও হয়ত। সন্ধ্যায় যখন ছেলেদের নিয়ে পড়াতে বসেছি, দেখি উসমানের ব্যাগ এ দুটো কালার করা পেইজ। দুটোতেই স্টার। ভালো কালার গুলো মিস রা বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। এক সময় দেয়াল জুড়ে লাগিয়ে রাখতাম। এখন আর রাখি না। অন্তত ছবি তুলে রাখি।
মনে থাকুক আমারও দুটি ছেলে ছিল। ওরা বড় হবে একদিন, চড়বে গাড়ি, আর তখন আমি কাটব ঘাস।

 

আজও আমি তারা গুনি

আব্দুস সামাদ


বলেছিলে আসবে তুমি
জোসনা হাতে
পুকুর পাড়ে সবুজ ঘাসের
বারান্দাতে!

আসবে তুমি ছোট পায়ে
ঘোমটা খুলে
করবো বরণ হাজার চরণ
পদ্মফুলে।

বসবে তুমি এলোকেশে
নগ্ন পায়ে
কাটবো সাঁতার অকূল-পাথার
ভগ্ন নায়ে!

জলকেলিতে ভিজবো দু’জন
জলভোমরা
গুনবো তারা আকাশ ভরা
জোড়া জোড়া।

আজও আমি তারা গুনি
একলা রাতে
হয়নি ভেজা জলকেলিতে
জোসনা রাতে!

 

প্রশংসা

রেহনুমা বিনত আনিস


সুযোগ হলেই যে কাজগুলো আমি করতে পছন্দ করি তার একটি হল স্বামীর কাছে স্ত্রীর এবং স্ত্রীর কাছে স্বামীর প্রশংসা, বিশেষ করে যখন তারা পরস্পরের প্রতি রাগান্বিত থাকে। প্রাত্যহিক জীবনের একঘেঁয়েমি এবং টানাপোড়েনের ঘর্ষনে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক প্রায় সময়ই ক্ষয় হতে হতে এমন স্তরে পৌঁছে যায় যে তারা পরস্পরের ব্যপারে অনেকখানি নির্লিপ্ত হয়ে পড়ে। তখন দেখা যায়, এক সময় পরস্পরের যে উত্তম গুণাবলী তাদের মোহিত করত সেগুলো তখন তারা আর দেখেও দেখেনা। অথচ একই গুণাবলী অপর কোন ব্যক্তির মাঝে খুঁজে পেলে তারা আন্দোলিত হয়। অর্থাৎ, ঐ গুণাবলীর প্রতি আকর্ষণের সমাপ্তি নয়, বরং পরস্পরের ব্যাপারে অভ্যস্ততাই স্বামী/স্ত্রীর মাঝে এগুলোর উপস্থিতি লক্ষ্য করতে ব্যর্থ হবার কারণ। আবার অনেক সময় দেখা যায় একে অপরের যে ত্রুটিবিচ্যুতি একসময় তারা খেয়ালই করত না তাতে চরমভাবে বিরক্ত বোধ করছে। সেক্ষেত্রে বিরক্তির সূত্রপাত হয়ত অন্য জায়গায় – অফিসে সহকর্মীর ওপর, ঘরে কাজের লোকের ওপর, অভাবের প্রতি, নিজের ব্যর্থতার প্রতি, শারীরিক অসুস্থতার প্রতি – কিন্তু সেটা প্রতিফলিত হয় এই বিষয়ে একেবারেই অনবহিত স্বামী বা স্ত্রীর ওপর, যে বেচারা বুঝে পায় না সে কি অন্যায় করে বসল!
এসব ক্ষেত্রে কেউ যদি তাদের নতুন করে মনে করিয়ে দেয় তাদের সঙ্গীটি কতখানি উত্তম তবে তা পুরনো পাঁচিলে নতুন করে সিমেন্ট দেয়ার মত করে কাজ করতে পারে। এটি তাদের মনে করিয়ে দিতে পারে সঙ্গী/সঙ্গীনীর কোন গুনগুলো একসময় তাদের মুগ্ধ করত যা তাদের একত্রে পথ চলাকে সাবলীল করেছিল। হয়ত তাদের স্মরণ হতে পারে সেই সময়ের কথা যখন তাদের সঙ্গীটি তাদের কোন সীমাবদ্ধতাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছিল। অথবা সঙ্গীটির দীর্ঘকালীন কোন ত্যাগ স্বীকার যা অভ্যস্ততার কারণে তাদের দৃষ্টির অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছিল। একটি গুনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন হয়ত তাদের একটি ত্রুটি থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারে। সর্বোপরি তাদের পুণর্বার অনুধাবন হতে পারে তারা প্রকৃতপক্ষে একে অপরকে পেয়ে কতখানি ভাগ্যবান। যে সংসার তাদের কাছে মনে হচ্ছিল এক কন্টকাকীর্ণ অরণ্য সেটা যে আসলে এক পুষ্পোদ্যান, এই উপলব্ধি সৃষ্টি করতে পারা এক অপার আনন্দের উৎস হতে পারে সুদীর্ঘ সময়ের জন্য যা থেকে থেকে পুলকিত করে অন্তরকে। সুতরাং, এই কাজের পেছনে আমার উদ্দেশ্য একেবারে নিঃস্বার্থ নয়।
তবে দুটো পরিস্থিতিতে এই পদ্ধতি কার্যকর করা মুশকিল। এর একটি আপনার প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে, আরেকটি ব্যর্থ।
মানুষ বড় অদ্ভুত প্রাণী। মানুষকে দেয়া হয়েছে আবেগ এবং বিবেক। আবেগ মানুষকে বিশ্বাস করতে এবং ভালবাসতে শেখায়; বিবেক মানুষকে সাবধান হতে। কিন্তু আবেগের আধিক্য এবং বিবেকের স্বল্পতা অনেক সময় মানুষের মাঝে এমন এক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে যেখানে এই দুটি বৈশিষ্ট্য পরস্পর পরিবর্তিত হয়ে বিপরীত ভূমিকা গ্রহণ করে। যার যা কাজ তা সে ভালই করে যেতে পারে। কিন্তু একে অপরের কাজ করতে গেলেই লেগে যায় বাগড়া। তাই আবেগ যখন বিবেকের কাজ করতে যায়, তখন গণ্ডগোল লাগবে এটাই তো স্বাভাবিক! কার্যত হয়ও তাই। উল্টোপাল্টা লাগছে? ব্যাপারটা উল্টোই বটে!
চলুন, একটা উদাহরণ দেয়া যাক। তাহলে হয়ত বুঝতে সুবিধা হবে। ধরুন, আপনি আপনার আবেগী বন্ধুকে বুঝাতে গেলেন এবারের ঝগড়ায় তার স্ত্রীর কোন দোষ নেই। কিন্তু আবেগের আধিক্যে তিনি বিবেকের গলা কেটে দিলেন। আবেগ বিবেকের স্থান দখল করে নিলো বটে কিন্তু বিবেকের কার্যপ্রণালী ভালভাবে বুঝতে না পেরে বিশ্বাসের পরিবর্তে অহেতুক সন্দেহ উৎপাদন করতে শুরু করে দিল। বন্ধু আপনার সুপরামর্শ গ্রহণ করার পরিবর্তে সন্দেহ করতে শুরু করলেন, আপনি আসলে কার পক্ষে। এই আবেগ আপনার পক্ষে ছিল যতদিন আপনি তার সমস্ত দোষত্রুটি, অন্যায়, আবদার মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু আপনি যখন তার সংসার বাঁচানোর তাগিদে তাকে সংশোধিত হতে বললেন সাথে সাথে সেই আবেগ চলে গেল আপনার বিপক্ষে। আপনার এত বছরের বন্ধুত্ব, সাহচর্য, বিশ্বাস, ভালবাসা সব শূন্যে পর্যবসিত হল। আবেগ বিবেকের স্থান দখল করে নিয়ে তাকে বিশ্বাসীর পরিবর্তে সাবধানী না বানিয়ে বরং বানিয়ে দিল সন্দেহবাদী!
এই ধরণের মানুষগুলো ভাবে বেশি, বুঝে কম। এদের নিয়ে মুশকিল হল, এরা নিজেরাই নিজেদের সুখের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। একই বিষয় নিয়ে পুনঃ পুনঃ পুঙ্খানুপুঙ্খ চিন্তা গবেষণা বিশ্লেষণ করতে করতে তারা বুঝে উঠতে পারেনা, আপনি এপক্ষ বা ওপক্ষ হতে যাবেন কেন? স্বামী স্ত্রী মিলে একই তো পক্ষ! তার সুখের জন্য, তার সংসার রক্ষা করার তাগিদেই তো নিজের সময় ব্যয় করে তাকে পরামর্শ দেয়া! নিজের কিছু অহম বিসর্জন দিয়ে যদি উভয়ের সুখ নিশ্চিত করা যায়, সন্তানদের জন্য একটি নিরাপদ পারিবারিক পরিবেশ গড়ে তোলা যায় তবে উভয়ের মাঝে বাঁধার প্রাচীর গড়ে তোলার প্রয়োজনটা কি? কিন্তু সন্দেহ বড় জটিল রোগ। এই রোগ কোন ওষুধে সারে না।
এই রোগের চিকিৎসার জন্য বিশ্বাসের কোন বিকল্প নেই। কিন্তু আবেগ যখন বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাণ্ডব চালায় তখন আর সেই বিশ্বাস নিজের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায়না।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এই আবেগের কাছে পরাজিত মানুষগুলোর অধিকাংশই নারী। অনেকের কাছেই এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকের কাছেই এটা হাসির খোরাক। কিন্তু বিশদভাবে চিন্তা করলে এটা একটা ভয়াবহ দুর্বলতা এবং যেকোন দুর্বলতাই অতিক্রম করার চেষ্টা করা উচিত। কারণ এর প্রভাবে যে শুধু মানুষের পার্থিব জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাই নয় বরং আখিরাত বিনষ্ট হয়।
কিভাবে? মানুষ যদি স্বয়ংসম্পূর্ন হত তাহলে সমাজবদ্ধ জীবনের প্রয়োজন হত না। সেক্ষেত্রে মানুষে মানুষে সম্পর্ক, আদানপ্রদান আমাদের পার্থিব পরীক্ষার অন্তর্ভুক্ত হত না। অতিরিক্ত আবেগ মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। এর ফলে মানুষ বন্ধু এবং শত্রু চিনতে ভুল করে, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ক্ষতিটা হয় নিজেরই। কারণ সকলকে অবিশ্বাস করতে করতে সে সকলের সাথে দূরত্ব রচনা করে একসময় একা হয়ে যায়। ক্ষতিটা আখিরাতে আরও মারাত্মক। কারণ নারী পুরুষের পুরস্কার নির্ধারণের ক্ষেত্রে যেমন বিভেদ করা হবেনা, তাদের শাস্তি নির্ধারণ করার ক্ষেত্রেও তারতম্য করা হবেনা। প্রত্যেকেই তাদের নিজেদের কথা, কাজ ও সিদ্ধান্তের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আমাদের কথা, কাজ ও সিদ্ধান্ত যাতে ন্যায় ও সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে সেটা নিশ্চিত করার জন্যই মানুষকে বিবেক দেয়া হয়েছে। কিন্তু বিবেকের স্থান আবেগ দখল করে নিলে মস্তিষ্কের সঠিক কার্যপরিচালনায় ব্যাঘাত ঘটে। ফলে কথা, কাজ ও সিদ্ধান্তে ভুল হয়ে যায়। সুতরাং, এটাই স্বাভাবিক নারীপ্রকৃতি বলে নিজেদের জাহান্নামের খোরাক না বানিয়ে এর থেকে উত্তরণ করার চেষ্টার মাঝেই প্রকৃত কল্যাণ রয়েছে।
নানাবিধ ঘটনা, দুর্ঘটনা, অভিজ্ঞতা কিংবা জ্ঞানের রাজ্যে আলোড়ন সঞ্চারের ফলে একজন মানুষ এতখানি পরিবর্তিত হয়ে যেতে পারে যার ফলে তাঁর সাথীর মনে হতে পারে এই মানুষটিকে তিনি আর চেনেন না। দীর্ঘ সহযাত্রার মাঝপথে কোথাও তাঁর পরিচিত মানুষটি অন্য কারো দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে আপনি কি প্রশংসা দিয়ে তাঁর সঙ্গীটির মনের শঙ্কা দূর করবেন? বরং কিছু বলতে গেলে আপনার নিজের কাছেই নিজেকে ভণ্ড মনে হবে। এই পরিবর্তন যে সবসময় নেগেটিভ হয় তা নয়, পজিটিভ পরিবর্তনও অনেক সময় নেগেটিভ রূপ ধারণ করতে পারে। আমার পরিচিতা একজন বলেছিলেন তাদের বাবা অত্যন্ত ধার্মিক (তাঁর ভাষায়) ছিলেন। কিন্তু তিনি ধর্ম নিয়ে এতখানি মগ্ন হয়ে যান যে ধীরে ধীরে তাঁর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। তিনি যাদের নিজের পর্যায়ে ধার্মিক গণ্য করতেন না তাদের প্রতি তাঁর আচরণ এতখানি রূঢ় ছিল যে এমনকি তাঁর সন্তানদের মন কেবল তাঁর প্রতিই নয়, ইসলামের প্রতিও বিরূপ হয়ে যায়। এ সকল ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে সম্পর্কোন্নয় প্রচেষ্টায় ব্যর্থতা স্বীকার করে নেয়া ব্যতীত খুব একটা কোন উপায় থাকে না।
আল্লাহ জানিয়েছেন তাঁর সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজগুলোর একটি হল, স্বামী স্ত্রীর মাঝে বিভেদ তৈরী করা। এটা শাইত্বানের কাজ। কিন্তু এই কাজটি আমরা অনেকেই করে থাকি, হয়ত না বুঝেই। সরল মনেই হয়ত আমরা পরিচিতজনদের সম্পর্কে এমন অনেক মন্তব্য করি যাতে তাদের সঙ্গীদের হৃদয়ে চারাগাছ আকারে বিদ্যমান সন্দেহ সংশয়গুলো সার পানি পেয়ে বটবৃক্ষের আকার ধারণ করে। আমরা কেউ জানিনা অপরের মনে কি আছে। সুতরাং, আমাদের কথাবার্তা সর্বাবস্থায় নেগেটিভের পরিবর্তে পজিটিভ হওয়া সবদিক থেকে নিরাপদ। সুতরাং, অপরের উপকারার্থে না হোক, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য হলেও আমার পদ্ধতিটি আমার কাছে শ্রেয় মনে হয়। আপনি কি বলেন?

 

চট্টগ্রামে রিজার্ভ ট্যাংকে মা-মেয়ের লাশ

নারী সংবাদ


চট্টগ্রামের এক বাড়িতে বৃদ্ধা মা-মেয়েকে হত্যা করে রিজার্ভ ট্যাংকে লাশ ফেলে রাখা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের শিকার মেহেরুন্নেসা বেগম (৬৭) রূপালী ব্যাংকের সাবেক প্রিন্সিপাল অফিসার। ৯৪ বছর বয়সী মা মনোয়ারা বেগমকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতেই থাকতেন তিনি।

পুলিশ জানায়, আত্মীয়দের কাছ থেকে খবর পেয়ে রোববার দুপুরে খুশলী থানার আমবাগান এলাকায় মেহের মঞ্জিল নামের ওই ভবন থেকে লাশ দুটি উদ্ধার করা হয়। চার তলা ভবনটির নিচতলায় মেহেরুন্নেসারা থাকতেন।

অবিবাহিত মেহেরুন্নেসার চার ভাই ও চার বোনের দেশে ও দেশের বাইরে থাকেন। মা-মেয়ে ছাড়া আর কেউ ওই বাসায় থাকতেন না।

সকালে একজন আত্মীয় এসে খোলা বাসায় তাদের না পেয়ে থানায় খবর দেয়। পরে পুলিশ গিয়ে রিজার্ভ ট্যাংকে লাশ দেখতে পায়।
পুলিশ বলছে, তাদের হত্যা করে লাশ পানির ট্যাংকে ফেলে রাখা হয়েছে বলে তাদের ধারণা। সূত্র : নয়াদিগন্ত।

 

বিয়ে ও পরিবার সমকালীন জিজ্ঞাসা ৭

কানিজ ফাতিমা


গত পর্বে আমরা গর্ভকালীন নারীর মানসিক অবস্থা সম্পর্কে জেনেছি। এ পর্বে আমি আলোচনা করবো মেনোপজ (Menopause) নিয়ে। তার আগে গত পর্বের রেশ ধরে দু’একটি কথা বলে নেই। আমরা অনেক সময়ই লক্ষ্য করি আমাদের সমাজে স্ত্রীর সেবা করাকে ভালো চোখে দেখা হয় না। এটা অনেকটা পৌরুষ হানিকর কাজ মনে করা হয়। অনেকে আরও একটু আগ বাড়িয়ে একে অনৈসলামিক কাজও মনে করেন। এটি সম্পূর্ণ ভুল একটি ধারণা। ইসলামে অসুস্থ স্ত্রীর দেখাশোনাকে স্বামীর গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর দৃষ্টান্ত আমরা ইসলামের ইতিহাসে দেখতে পাই। বদর যুদ্ধের সময় মুসলমানগণ সংখ্যায় কম ছিলেন। সেসময় মদীনাতে মাত্র ৭৭ জন সমর্থ মোহাজির পুরুষ ছিলেন। তিনজন বাদে এদের সবাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তালহা ও সা’দ (রাঃ) সেই মুহূর্তে সংবাদ সংগ্রহের কাজে মদীনার বাইরে ছিলেন বলে বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি। তার তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মদীনাতে উপস্থিত থেকেও বাহিনীতে যোগ দেননি তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সারির সাহাবী উসমান (রাঃ)। যদিও সে সময় মুসলিম বাহিনীতে বেশী সংখ্যক যোদ্ধার দরকার ছিল তথাপি রাসূল (সাঃ) নিজেই উসমান (রাঃ) কে মদীনায় থাকতে নির্দেশ দেন কারণ তখন তার স্ত্রী রোকাইয়া (রাসূল সাঃ এর কন্যা) অসুস্থ ছিলেন। “The Prophet told his son-in-law ‘Uthman’ to stay at home and tend his sick wife.” (Muhammad his life based on the earliest sources by Martin Lings, পৃষ্ঠা ১৩৮)। আমরা এখানে সুস্পষ্ট দেখতে পাই শুধুমাত্র অসুস্থ স্ত্রীর দেখাশোনার জন্য তিনি বদর যুদ্ধের বাহিনীতে যোগদান থেকে বিরত থাকলেন স্বয়ং রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশে। অথচ সে সময় মদীনাতে অন্যান্য নারীগণ উপস্থিত ছিলেন যারা সহজেই রোকাইয়ার সেবা করতে পারতেন। সাওদা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর স্ত্রী; ফাতেমা (রাঃ) ও উম্মে কুলসুম (রাঃ)- রোকাইয়া দু’বোন; উম্মে আয়মান ও খাওলাসহ অনেকেই রোকাইয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তদুপরী রাসূল (সাঃ) স্ত্রীর সেবার জন্য স্বামীকেই দায়িত্ব দিলেন।
এবার আসা যাক মেনোপজ সম্পর্কে। অনেক সময় স্ত্রীদের অভিযোগ থাকে তাদের শাশুড়িদের বিরুদ্ধে যে তারা খিটখিটে, ভুলো মনা হয় এবং ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে বকবক করতে থাকে। এই সমস্যাগুলোর পেছনে একটা বড় কারণ সাধারণত মেনোপজ। মেনোপজ হল মহিলাদের মাসিক স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়া। সাধারণত গড়ে ৫০ এর পরে নারীর মেনোপজে যায়। তবে ৪০ থেকে ৫৯ বয়সের মধ্যে যেকোন সময়ে এটা ঘটতে পারে। এ সময়ে মহিলাদের ডিম্বাশয়গুলো (Overies) কম পরিমাণে এসট্রোজেন ও প্রাজেসটেরন (Estrogen and Progesterone) হরমোন তৈরি করে। মূলত: এই হরমোন দু’টিই নারীদেহে মাসিক চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। সাধারণত নারীরা এই বয়সেই শাশুড়ি হয়ে থাকে। ফলে অন্যান্য কারণের পাশাপাশি এ কারণটিও তার আচরণকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করে। একজন স্ত্রীর যদি Menopause-এর লক্ষণগুলো জানা থাকে তবে শাশুড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী অনেকটা সহজ হয়। নীচে মেনোপজ এর লণগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলঃ
১. Hot flashes:
গরম ঝাটকা লাগা মেনোপজের একটি সাধারণ লক্ষণ। এসময় বুক-মাথা গরম হয়ে যায়, অনেক সময় চামড়া লাল হয়ে যায় এবং অনেকে ঘামতে শুরু করে। এসময় অস্বস্তি ও অসুস্থ বোধ হয়ে থাকে। অনেক সময় মাথা ঘুরায়, মানসিকভাবে বিহ্বল ও হতবুদ্ধি লাগে। অনেক সময় বুক ধড়ফড় করে।
২. মাথা ব্যথা, রাতে ঘামানো, ঘুমের ব্যাঘাত ও কান্তিবোধঃ
ঘুমের সমস্যা ও ঘুমের মধ্যে হঠাৎ ঘেমে গিয়ে উঠে পরা প্রভৃতি কারণে এ সময় মেজাজ খিটখিটে ও সবকিছুতে বিরক্তিভাব তৈরি হয়। যার থেকে অল্পতেই রেগে যাওয়া বা ঘ্যানঘ্যানে স্বভাবের হয়ে যাওয়া স্বাভাবিক।
মূলত: মেনোপজের শারীরিক লক্ষণগুলো একেকজনের জন্য একেক রকম ও একেক মাত্রার হয়। যেমন পশ্চিমা দেশগুলোতে ১৪% মহিলা খুব তীব্র শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় পড়ে এ সময়ে।
মেনোপজে যে মানসিক সমস্যাগুলো হয় তাও শারীরিক সমস্যাগুলোর মতই একেক জনের একেক রকম হয়। সব থেকে প্রচলিত যে মানসিক সমস্যার কথা বেশি শোনা যায় তা হলো-
১. Sadness বা দুঃখবোধ/বিষন্নভাব
২. Anxiet বা দুশ্চিন্তা
৩. Mood Swings বা অস্থিরতা
এসব সমস্যাগুলো নারীর কর্মদক্ষতা ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। আজ এ পর্যন্তই। এ সম্পর্কিত আরও আলোচনা থাকবে পরবর্তী সংখ্যায়।

পর্ব-৬

 

মেয়েদের ফেসবুকে নিরাপত্তা

লাইফ স্টাইল


নারীদের ছবি ডাউনলোড করে সেই ছবিকে বিকৃত করা বা সেই ছবি দিয়ে ফেক অ্যাকাউন্ট তৈরি করার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।

এসব প্রতিরোধ করার মতো তেমন শক্তিশালী ফিচার এতদিন ফেসবুকের কাছে ছিল না।

ছবি ডাউনলোড করা না গেলেও সেই ছবির স্ক্রিনশট দিয়ে তৈরি হয়ে যেত ফেক অ্যাকাউন্ট।

নারীদের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এবার ফেসবুক নিয়ে এল নতুন দুটি টুল।
ফটো গার্ড : নারীদের বাঁচাতে ফেসবুক নিয়ে এসেছে নতুন দুটি ফিচার। প্রথম ফিচারটি হল ‘ফটো গার্ড’। এই টুলটি ব্যবহার করলে কেউ এই ছবিটি ডাউনলোড, শেয়ার বা মেসেঞ্জারেও কাউকে পাঠাতে পারবের না।

অ্যানড্রয়েড ফোনগুলোতে ফেসবুকের অ্যাপে কেউ এই ফটোগুলোর স্ক্রিনশটও নিতে পারবেন না। যখনই আপনি প্রোফাইল পিকচারে ‘ফটো গার্ড’ ব্যবহার করবেন, তখনই ফটোগুলোর চার দিকে নীল বর্ডার চলে আসবে এবং একটি নীল রঙের শিল্ড থাকবে। ফেসবুক এই শিল্ডের নাম দিয়েছে ‘সোমান’।

এই নীল শিল্ডের মাধ্যমেই বোঝা যাবে এই ছবিটিতে ‘ফটো গার্ড’ ব্যবহার করা রয়েছে।

ফটো ফিল্টার : ফেসবুকের দ্বিতীয় ফিচারটি হল এক ধরনের ‘ফটো ফিল্টার’। এই ফিল্টারের মাধ্যমে ছবিগুলোতে বিভিন্ন জায়গার শিল্পের ডিজাইন ব্যবহার করা যাবে। ছবিতে এই ফিল্টার লাগালে, সেই ছবি ডাউনলোড করার প্রবণতা অনেকটাই কমে যায়।

এতদিন ধরে বহু নারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেন। দুটি ফিচারই ফেসবুকের নিউজ ফিডে প্রোমোট করা হবে। ফিচার দুটি পুরোপুরি চালু হয়ে যাবে আগামী ২৭ জুনের মধ্যে।

সূত্রঃ যুগান্তর

 

বই ও বেপরোয়া আমি ২

তাহেরা সুলতানা


আমি বরাবরি ডিটেক্টিভ থ্রিলার ধরনের বইয়ের বেশী ভক্ত ছিলাম। ছিচকাদুনে টাইপ প্রেমের গল্প উপন্যাস কখনোই খুব একটা ভালো লাগতো না। তবে আজ আর বাইরের বই না, আজ আমার গল্পের সঙ্গী পাঠ্যপুস্তক। আমার কাছে বই মানেই শুধু বই। পাঠ্যপুস্তক না বাইরের বই, সেটা কখনোই আলাদা করতে পারতাম না! ‘পড়তে বস’, এই কথাটা আমাকে আল্লাহর রহমতে কোনদিন বলতে হয়নি। পড়াই যেন ছিল আমার জীবনের সবকিছু! নতুন ক্লাসে ওঠার অনেক আগেই পুরনো বই সংগ্রহ করে রাখতাম। ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই প্রায় সব বই পড়া হয়ে যেত। এখনো আমার হাতে যেকোন বই আসলেই আফিমের নেশা ধরে যায়! শুনলে অবাক হবে, আমি এখনো স্কুলের সিলেবাসভুক্ত বইগুলো পড়ি! আর বাংলাদেশে আমার ৭/৮ বছরের শিক্ষকতা পাঠ্যবইয়ের সাথে নতুন করে সখ্যতা তৈরী করেছে। তবে বইয়ের প্রতি বেপরোয়া ভাব আমাকে যে শুধু বিপদেই ফেলেছে, তা কিন্তু নয়! অনেক কঠিন সময় থেকে উৎরাতেও সাহায্য করেছে!
যখন ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙল, সেই সময়টাতে বাংলাদেশেও উত্তাল অবস্থা বিজার করছিল। আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে প্রায় ৫০ ভাগ লোকই হিন্দু ছিল। আব্বা তখন টানা ৩ রাত বাসায় ছিলেন না। আমি বাসার বড়, তাই আম্মার সাথে প্রায় সারারাতই জেগে থাকতে হতো, কখন আব্বা ফিরেন! আমার কাছে কৌতুহল ছিল, আব্বা কোথায় যেতেন! পরে জেনেছিলাম, আব্বা তার ২/৩ জন কলিগসহ সারারাত গ্রামের কালিমন্দির পাহারা দিতেন। বলতেন, “অনেক মুসলমান খেপে গিয়ে মন্দির ভাঙছে। এটা তো ঠিক না। এই দেশের সাধারণ হিন্দুরা তো কোন দোষ করেনি।”
তখন একমাত্র বইই ছিল আমার আমার রাত জাগার সঙ্গী!
পানি সবার আগে ঢুকে। আমরা যে বাসাটায় থাকতাম, সেটায় বন্যার পানি ঢুকতো না, কিন্তু চারপাশে হাটু পানি থাকতো। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ! কোন কাজ নেই! স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ার জন্য যতটা না মন খারাপ হতো, অনেক বই পড়তে পারবো, সেই আনন্দই বেশী কাজ করতো। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়িতে বেশ সাপের উপদ্রব হতো। আব্বা আম্মা খুব সজাগ থাকতেন।

একদিন রাতের বেলা, আমার ভাইবোনরা সবাই ঘুমিয়ে গেছি। তখন হালকা শীত পড়েছে। আমি একা মেঝেতে পাটি পেতে বসে বই পড়ছিলাম। গল্পের বই না, পাঠ্যপুস্তক। আম্মার একটা লাল চাঁদর ছিল, ওইটা ছড়িয়ে দিয়ে সারা গা, মাথা, পা ঢেকে পড়ছি। আমি আগেই বলেছি, বই হাতে থাকলে দুনিয়ার কিচ্ছু মাথায় থাকে না! তাই আমি খেয়ালই করিনি, কখন যে একটা সাঁপ এসে আমার চাঁদরের উপর কুণ্ডলী পাকিয়ে বসেছে! আমার স্পষ্ট মনে আছে! হঠাৎ করে মনে হলো ঠান্ডাটা একটু বেশীই লাগছে! বাম দিকে ফিরেই আমার মুখ দিয়ে শুধু একটা আওয়াজ বের হলো, “আব্বা!” এরপর মুখ দিয়ে শুধু আ! আ! বেরুচ্ছে। কোন আওয়াজ নেই! আব্বা আম্মা বারান্দায় আধো আধো চাঁদের আলোয় বসে গল্প করছিলেন (আব্বা আম্মা ২ জনই অসম্ভব রোমান্টিক মানুষ! এখনো তারা একজন আর একজনকে ছাড়া কিছুই বুঝেন না)।

‘আব্বা’ ডাক শোনার সাথে সাথে ২ জনই ছুটে আসেন। আম্মার সিক্স সেন্স অসম্ভব প্রখর! আর উনি অনেক বেশী সাহসী আর ধৈর্যশীল একজন মানুষ। আম্মার এই বিশেষ ৩ টা গুনের জন্য আমরা সবাই আল্লাহর রহমতে বহুবার বহু বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছি। সে গল্প না হয় আর একদিন করা যাবে! আম্মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, তাই একটা বড় লাঠি নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। তারপর যে ঘটনাটা হয়, সেটা আমার পরে আম্মার কাছ থেকে শোনা। আম্মা নাকি দেখেন, সোডিয়াম আলো আর চাঁদরের লাল রং এর প্রতিক্রিয়ায় সাঁপটা আর তাকাতে পারছিলো না, তাই ওই চাঁদরের উপরই কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে ছিল! আব্বা আমাকে দ্রুত কোলে করে খাটে তোলেন আর আম্মা সাঁপটা মারেন। আমি তো চোখ বন্ধ করে মটকা মেড়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে আছি! আব্বা আমাকে সাহস দেয়ার জন্য সাঁপের গুষ্টি উদ্ধার করছেন আর এদের সবচেয়ে কম ক্ষমতাসপন্ন প্রজাতির জীব হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন! অবশেষে আমি চক্ষু মেলিয়া তাহাকে দেখিলাম! প্রায় ৫ হাত লম্বা একটি ঢোড়া সাঁপ! ততক্ষণে মরে ভূত! পরেরদিনই আব্বা আমাদের জন্য পড়ার টেবিল আর চেয়ারের ওর্ডার দেন। পরে জেনেছিলাম, আম্মা নাকি আব্বাকে বারান্দায় টেবিলের কথাই বলেছিলেন! আমার এতো পড়ার নেশা! এভাবে মেঝেতে বসে পড়ি! সাঁপ পোকামাকড় আসে কিনা! আমি আজও সাঁপ ভীষণ ভয় পাই! আজও সাঁপের কোন মুভি তো দেখতে পারিই না, কোন মুভিতে সাঁপ থাকলে হয় টেনে দেই, নয়তো চোখ কান বন্ধ করে রাখি।

আর একটা ঘটনা এখনো মনে খুব নাড়া দেয়! ১৯৯৮ সালের ৫ মার্চ। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা। খাবার টেবিলে পড়ে আছে। আর আমি পড়েই যাচ্ছি। আম্মা বারবার ঘুম ভেঙে উঠে বলছেন, দ্রুত খেয়ে শুয়ে পড়তে, নইলে শরীর খারাপ করবে। আমার মনে হচ্ছিল, আম্মা জেগেই আছে, ঘুমাচ্ছে না। আমি শুধু “উঠছি আম্মা” বলেই যাচ্ছি, কিন্তু উঠার নাম নেই! তখন অনেক রাত পর্যন্ত পড়া ছিল নিয়মিত ব্যাপার।

রাত ১টার দিকে আমাদের পোষা বিড়ালটা খুব দাপাদাপি করে! আমরা ওর নাম রেখেছিলাম চুমকি! আমি বিরক্ত হচ্ছি আর বারবার চুমকিকে ধমক দিচ্ছি! ও আরও বেশি করে দাপাদাপি শুরু করলো! হঠাৎ আমি জানালার ফাক দিয়ে বাইরে আগুন দেখতে পাই! আমাদের রান্নাঘরটা পুড়ছে। আম্মা কখন যে দরজা খুলে টিউবওয়েলের পাড়ে পানি ঢালতে চলে গেছেন, খেয়ালই করিনি! আব্বা আমাকে শুধু চিৎকার করে বলছেন, আমি যেন উনার সার্টিফিকেটের ফাইলটা হাতে নিয়ে সবাইকে নিয়ে বের হয়ে যাই। আশেপাশের সবাই ততক্ষণে চলে আসে। আব্বার অনেক ছাত্ররা আশেপাশে মেসে থাকতো। সবাই আসে। কিন্তু আগুন কিছুতেই নিভছে না! আমাদের ঘরের গা ঘেসে দাঁড়ানো আমগাছটাতেও আগুন ধরে গেছে! বড়ই গাছটা জলছে! আমার ছোট ছোট ভাইবোনরা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। আব্বা অস্থির হয়ে গেছেন! কি করবেন, বুঝতে পারছেন না! আম্মা কিছুতেই কাউকে টিউবওয়েল পাড়ে যেতে দিচ্ছেন না! মধ্যবিত্ত সংসারে একটা সুই কিনলেও খুব হিসাব করে কিনতে হয়! এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে! বইগুলো পুড়লে কি করে কিনবো! কি করে পরীক্ষা দিবো! তবে সেদিন আমার কি যেন হয়েছিল! বারবার মনে হচ্ছিল, আমিই তো এখন অভিভাবক! আমাকে অস্থির হলে চলবে না! সেটাও কিন্তু ডিটেক্টিভ গল্প পড়ার সুফল!

আমি দ্রুত একটা ব্যাগে করে আব্বার সার্টিফিকেট আর আমাদের সবার পড়ার বইগুলো পাশের বাসায় রেখে আসলাম আর আব্বা পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম! আব্বার ছাত্র আর আশেপাশের চাচারা আব্বাকে শান্ত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে! আশেপাশের খালাম্মা, আপু আর ভাবীরা ততক্ষণে আমার ভাই বোনদের কোলে করে বের করে আনলো!

হযরত ইব্রাহিম (আ)কে আগুনে ফেলে দেয়া হলে মহান আল্লাহপাক উনাকে যে দোয়া পড়তে বলেন, তার বদৌলতে আগুন ইব্রাহীম (আ) এর জন্য শীতল হয়ে যায়। এই গল্প প্রায় সবার জানা। সেদিন আমিও এক অলৌকিক ঘটনার সাক্ষীও হয়েছিলাম! কিছুতেই যখন আগুন নিভানো যাচ্ছে না, তখন আব্বা তার এক ছাত্রকে এক বাটি পরিষ্কার বালু আনতে বললেন। আব্বা বালু হাতে নিয়ে ওই একই দোয়া পড়ছিলেন, আর আগুনের দিকে ছুড়ে মারছিলেন। কিছুক্ষণ পড় দেখা গেলো, আগুনের কুণ্ডলী বিভিন্ন জায়গায় গোল গোল চাকতির মতো হয়ে গেছে! যেখানে যেখানে দোয়াযুক্ত বালি পড়ছে, সেখানেই এ রকম হয়ে যাচ্ছে! একটা সময় আগুন একদম শান্ত হয়ে গেল! আল্লাহর রহমতে আমাদের ঘরের কোন জিনিস সেদিন নষ্ট হয়নি। শুধু রান্নাঘর, বড়ইগাছ আর আমগাছ পুড়েছিল। আর আগুনের আঁচে আম্মার মুখের একটা পাশ লাল হয়ে গিয়েছিল!

পরে থানা থেকে পুলিশ আসে। তদন্তে বের হয়, আমাদের বাসার রান্নাঘরের ঠিক পিছনেই একটা ছনের ঘর ছিল। কেউ থাকতো না। ওখান থেকেই আগুনটা লাগে। ওই ঘরের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা বাজারের দিকে চলে গেছে। হরদম লোক যাতায়াত করতো। হয়তো কেউ সিগারেট খেয়ে ওই ঘরের চালে ফেলেছিল! সেদিন যদি রাতজেগে বই না পড়তাম, তাহলে কি যে হতো, আল্লাহ মালুম! এতো বছর পরও মনে হলে শরীর শিউড়ে ওঠে! ওই ঘটনার পর আমরা বহুদিন ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না! খেতে পারতাম না! তোমাদের হয়তো মনে হতে পারে, আমি কোন গাঁজাখুরি গল্প বলছি।

চলবে…

পর্ব-১

 

লাভ ম্যারেজেই ডিভোর্স বেশি?

জান্নাতুন নুর দিশা


অনেক বছর প্রেম করে বিয়ে করেছে। বছর না গড়াতেই ডিভোর্স। এরকম ঘটনাগুলো আজকাল অহরহ দেখা যাচ্ছে আমাদের শহুরে সমাজে।

এতগুলো বছর যে দুটো মানুষ পারস্পরিক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে একটা সম্পর্ককে গড়ে, এক ছাদের নিচে আসতেই সে সম্পর্কের ভিত কেন নড়বড়ে হয়ে যায়? অদ্ভুত নয়? ভালোবাসার ঘাটতি থাকলে নিশ্চয়ই এতগুলো বছর প্রেম করা যেতো না?

ভালোবাসায় আসলে ঘাটতি নেই। ঘাটতিটা অন্য জায়গায়। বিয়ের আগে প্রেমিক এবং প্রেমিকা উভয়েই চেষ্টা করে নিজের সব চমৎকার দিকগুলো একে অপরের সামনে উপস্থাপন করতে।
একটা মানুষ কখনোই কি পারফেক্ট হয়?
না, ভালো খারাপ মিলিয়েই মানুষ। আপনার ভালোবাসার মানুষটিরও ঘাটতি আছে, ত্রুটি আছে, খারাপ দিক আছে, সীমাবদ্ধতা আছে।
এই সত্যটুকু মেনে নিয়েই ভালোবাসুন, সম্পর্কে আসুন।

নিজের ভালোবাসার মানুষটির সামনে পারফেক্ট হবার অভিনয় করবেন না বিয়ের আগে। আপনি যা, তার সামনে তাই থাকুন, স্বাভাবিক থাকুন। জানিয়ে দিন আপনার আচরণের, চিন্তার সীমাবদ্ধতাটুকু। সবটুকু জেনেই তিনি ঘর বাঁধতে আসুক। ঘর বাঁধার পর যদি আপনার ইমপারফেকশন প্রকাশ পায়, ঘর ভেঙে পড়বে তাসের ঘরের মতই।

“বিয়ের পর ও আর আগের মত আমার কেয়ার করে না।”
প্রেমিকা থেকে সদ্য স্ত্রী হওয়া নারীদের কমন ডায়ালগ। এই ভুল বুঝার মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সদ্য বিবাহিত পুরুষ হুট করেই প্রচন্ড দায়িত্বের চাপে পড়ে। উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে ভবঘুরে জীবনে অভ্যস্ত ছেলেটার মাথার উপর হুট করে চলে আসে আস্ত একটা সংসার নামক ভার, ভবিষ্যতের একরাশ স্বপ্ন আর চিন্তা। ক্যারিয়ার নিয়ে তুমুল ব্যস্ত হয়ে পড়া ছেলেটি দিনরাত এক করে কাজ করে কার জন্য? নিজ স্ত্রী, অনাগত সন্তান আর সুন্দর এক টুকরো ভবিষ্যতের জন্য। আপনার জন্যই নিজের ঘামের দামে সুখ কিনতে চাওয়া বরটি নাহয় আগের মত নিয়ম করে আপনাকে কল করে জিজ্ঞেস করতে পারছে না আপনি খেয়েছেন কিনা। তারমানে কি তিনি আর কেয়ার করছেন না?
আপনাকে নিয়ে যিনি ঘর বেঁধেছেন, আপনাকে নিয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ সাজাবার স্বপ্নে যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন তার এই কেয়ারের চেয়ে বড় কেয়ার আর কিছু হয় না।
“খেয়েছো, ভালো আছো, কী করছো” জানতে চেয়ে কেয়ার দেখানো মানুষের অভাব নেই পৃথিবীতে, আপনার জন্য, আপনাকে নিয়ে ভবিষ্যৎ সাজাতে চাওয়া বরটিকে সাপোর্ট দিন। তার ব্যস্ততায় মিথ্যে অভিমানে দূরে সরে যাওয়া আপনারই বড় ভুল।

“ও আর আগের মত নেই। আগের মত আমাকে আর বোঝে না। এত এত চাহিদা ওর আজকাল, ভালো লাগে না।”

প্রেমিক থেকে সদ্য স্বামী হওয়া ছেলেটির কমন ডায়ালগ।
আসলেই কি তিনি অনেক কিছু চান? হয়তো বরের একটু সাপোর্ট, একটু যত্ন ছাড়া তিনি আর কিছুই চান না। অন্য একটা সংসার থেকে এসে আপনার সংসারে মেয়েটি কিছুটা হলেও একা হয়ে পড়ে নি? বাবা মায়ের রাজকন্যা মেয়েটি হয়তো না চাইতেই সবটা পেয়েছে নিজের ঘরে, আপনার কাছে তাকে চাইতে হবে এটাই উচিত নয়। তার ছোট ছোট আক্ষেপগুলোই একদিন বড় শূন্যতায় রূপ নেয়। তার চোখ, চুল, ঠোঁট নিয়ে পাতার পর পাতা কবিতা লেখা আপনি যেন এতখানিও ব্যস্ত হয়ে যাবেন না যে তার কপালে হাত রেখে মাঝেমাঝে এটুকু জিজ্ঞেস করার সময়ও না থাকে, “তুমি ভালো আছো তো?”
ভালোবেসে বিয়ে করেছে বলেই আপনার কাছে এক্সপেকটেশনটা একটু বেশিই থাকে স্ত্রীর। কাড়ি কাড়ি টাকার চেয়ে একটু যত্মের মূল্য অনেক বেশি।

হুট করে দুজন দুজনকে ভুল না বোঝে ধীরেধীরে মানিয়ে নিতে হয়। প্রেমের ফ্যান্টাসি জগতটা আর বাস্তবের সংসার জীবনে যোজন যোজন ফারাক। এখানে প্রতি মুহূর্তে সংগ্রাম, প্রতি ধাপে অসংখ্য অগ্নিপরীক্ষা। তাই দুটো ভুবনের পার্থক্য বুঝবার আগেই দূরত্ব বাড়াবেন না, আলাদা হয়ে যাবেন না। কাছে আসতে সময় লাগে অনেক, দূরে যেতে বেশি সময় লাগে না। অভিমান ভালো সম্পর্কে, অতি অভিমান নয়। অভিমান জমতে দিতে হয় না। জমাতে হয় ভালোবাসা।

 

রেসিপি: খোসা-নামা

সামিয়া কালাম


এটা আমি শিখেছি নগর চাষী শাওন মাহামুদ আপার কাছ থেকে। নিজের যা আছে সেই টুকু নিয়েই তাঁর সন্তুষ্টি। মাঝে মাঝে মাসের শেষের দিকে আমাদের মত অনেকেরই সূতোয় টান খায়। কিন্তু আদি-অকৃত্রিম মধ্যবিত্তের মত আমরা সেটাকে সফল ভাবে গোপন করি। ভালো কোনো রেস্তোরাঁ গেলে চেক-ইন দেই। কিন্তু যেদিন খুব মামুলি রান্না গুলো দিয়ে কাজ চালিয়ে নিতে হয়! সেদিনের পোষ্ট অন্তত আমি কখনো দেইনি। সেই অবস্থান থেকে আজ সরে এলাম।

এটা একটা ভর্তার প্রিপারেশান। কচি লাউ এর খোসা, পাকা পটল এবং খোসা, খোসা সহ কচি মিষ্টি কুমড়ো, আস্ত রসুন, লবন আর কাঁচা মরিচ। সব কিছু দিয়ে সেধ্য বসিয়ে দেই। আমরা হয়তো জানি সবজি অনেক টুকু পুষ্টি রয়ে যায় খোসায়। এই খোসা গুলো আমার ফেলে দিতে ইচ্ছে করেনা। মাসের শেষ কিংবা শুরু বলে কথা নয়। আমি চাই কিছুটা ভিন্নতা এবং উপযোগ সৃষ্টি করতে।

হয়তো বাটাবাটির ঝামেলায় অনেকেই যেতে চান না। তাহলে মিক্সি তো আছেই। সেধ্য হওয়া খোসা গুলো মিক্সিতে মিক্স করে নিতে হবে। তারপর পেঁয়াজ কুচি, রসুন কুচি এক চিমটি কালো জিরে, দু একটা শুকনো মরিচ দিয়ে তেলে বাগার দিতে হবে। খোসার ভর্তা আমার বাসায় মাঝে মাঝেই তৈরি করা হয়। এর স্বাদ বৃদ্ধির জন্য সেধ্য করা খোসা বাটার সময় চিংড়ি মাছ যোগ করা যেতে পারে।
আজ দুপুরে এই খোসা সেধ্য যখন উনুনে চাপিয়েছি, একটু পর আগুনের তাপে সবুজের উজ্জ্বলতা বেড়ে গেল। ঝক ঝকে সবুজ সে রঙ প্রশান্তি দেয়, অন্তত আমায়।

 

অভিজ্ঞতা প্রসূত ধারণা অতঃপর সন্দেহ

আফরোজা হাসান


পরিচিত এক বোন বলছিলেন তিনি প্রায় রাতেই স্বামীকে নিয়ে উল্টা পাল্টা স্বপ্ন দেখেন। যেমন, কখনো দেখেন স্বামী তার মেয়ে কলিগের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখনো দেখেন স্বামী আরেকটা বিয়ে করেছেন। এই ধরণেরই আরো অনেক স্বপ্ন দেখেন। খুবই চিন্তিত এটা নিয়ে তিনি। কি করবেন না করবেন ভেবে দিশেহারা। স্বপ্ন নিয়ে কয়েকদিন আগে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। সেখান থেকে জেনেছিলাম বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন যে, রাতের দেখা স্বপ্নের প্রভাব পড়তে পারে বাস্তবে জীবনেও। গবেষকরাও বলেছেন, অনেক সময় রাতের স্বপ্ন প্রভাবিত করে আমাদের আচার-আচরণকে। যারফলে দিনের বেলায় মেজাজ থাকতে পারে বিক্ষিপ্ত ও চিড়চিড়ে। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর প্রতি বাড়িয়ে দিতে পারে সন্দেহ। আবার এমন দেখা যায় যে, দিনের বেলায় যা কিছু দেখি , শুনি বা ভাবি, রাতে ঘুমের মধ্যে সেসবই স্বপ্নে দেখি।
আমার জানা মতে পরিচিত সেই বোনটি টিভি সিরিয়ালের খুব ভক্ত। তাদের কয়েকজনের একটা গ্রুপ আছে যারা নিজ নিজ বাচ্চাদেরকে স্কুলে দিয়ে সিরিয়ালের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেন। আর বর্তমান টিভি সিরিয়াল গুলোতে যেহেতু পরকীয়ার ছড়াছড়ি। সুতরাং, স্বামীকে নিয়ে ঐ ধরনের স্বপ্ন দেখা মোটেই অস্বাভাবিক নয় উনার জন্য। উনাকে বুঝিয়ে বললাম যে আসলে আপনি সারাদিন যা দেখেন, ভাবেন সেটার প্রভাবই পড়ছে আপনার স্বপ্নে। মানুষ খুব সহজেই সেসব জিনিস দ্বারা প্রভাবিত হয় যা তার মনকে আন্দোলিত করে। ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, সন্দেহ কিংবা বেদনা অনুভূতি যেটাই হোক না কেন মনকে যা স্পর্শ করবে তার রেশ রয়ে যাবে মনের কোণে। যার ফলে তা চেতন, অবচেতন, অচেতন সব মনেই নিজ নিজ জায়গা দখল করে নেয়। এবং খেলা করে সমস্ত সত্ত্বা জুড়েই।
আরেক বোন বলছিলেন তার সারাক্ষণই মনেহয় যে তার মেয়ে তাকে মিথ্যা বলছে। যেমন,মেয়ে পেট ব্যথার কথা বললে উনার মনেহয় স্কুলে না যাবার বাহানা এটা। হোমওয়ার্ক নেই বললেও বার বার তিনি ব্যাগ চেক করেন। মেয়ে স্কুল থেকে এসে কিছু বললে উনি ক্লাসের অন্যান্য বাচ্চাদের ফোন করে নিশ্চিত হন সঠিক কিনা ইত্যাদি। আমি জানতে চেয়েছিলাম আচ্ছা আপনি কি ছোটবেলায় নানা বাহানা করে স্কুল ফাঁকি দিতেন? হোমওয়ার্ক করতে ইচ্ছে হতো না বলে কি লুকিয়ে রাখতেন? স্কুলের ব্যাপারে মিথ্যা বলে কি বাবা-মার কাছ থেকে কিছু হাসিল করতেন? উনি বিস্ময় ও লজ্জা মেশানো কণ্ঠে বললেন, আপনি কিভাবে জানলেন আপু? হেসে জবাব দিয়েছিলাম, আন্দাজ করেছি কারণ আমি জানা আছে অন্যেকে যাচাই মানুষ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকেই করে বেশির ভাগ সময়।
নব বিবাহিত এক দম্পতির সাথে পরিচয় হয়েছিলো। সাজানো গোছানো ছোট্ট টুনাটুনির সংসার যেন একদম। কিন্তু মেয়েটির মনে শান্তি ছিল না একদমই। স্বামীর সাথে তার অফিসে গিয়ে মেয়ে কলিগদেরকে দেখার পর থেকে সারাক্ষণ মনে এই ভাবনা কাজ করতো বিয়ের পর তাকে দেশ থেকে প্রবাসে নিয়ে আসতে যে দশমাস লেগেছিল তখন অন্যকোন মেয়ের সাথে স্বামীর অবৈধ কোন সম্পর্ক তৈরি হয়নি তো? স্বামী অনৈতিক কিছু করেনি তো তার অবর্তমানে? তার স্বামী পবিত্র তো সম্পুর্ণ রূপে? আমি যেদিন ওর মনের ভাবনা জানতে পেরেছিলাম জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি এমন কিছু দেখেছো যাতে এমন ধারণার জন্ম হয়েছে তোমার মনে? জবাব দিলো, না। তবে আমার দাদী বলেছেন পুরুষ মানুষের পক্ষে নাকি কখনোই সম্ভব না স্ত্রীর সঙ্গ ছাড়া বেশিদিন থাকা। দাদার এমন অনেক ঘটনা দাদী বলেছেন আমাকে। তখন বুঝিয়ে বললাম অন্যের অভিজ্ঞতার দ্বারা নিজের সুখী ও সুন্দর জীবনকে নিজ হাতে নষ্ট করো না। তোমার দাদী-নানী, মা-খালা, চাচী-ফুপির অভিজ্ঞতা দিয়ে কেন তুমি তোমার স্বামীকে যাচাই করবে? এটা কি স্বামীর প্রতি অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে না? মেয়েটা বুঝেছিল এবং নিজেকে সংশোধন করেছিল।
ছোটবেলায় খাওয়ার ব্যাপারে আমি প্রচণ্ড পরিমাণে যন্ত্রণা করেছি মামণিকে। খাবার দিয়ে আমার সামনে থেকে সরলেই আমি সেই খাবার খাটের নীচে, সোফার পেছনে, ফোম উঁচু করে তার নীচে, কোমডে আরো কত জায়গায় যে লুকাতাম খাওয়ার ভয়ে। বাবার পাঞ্জাবীর পকেট, কাগজ-পত্র রাখার ব্রিফকেস পর্যন্ত পৌছে যেত আমার খাদ্যরা। আরো চার বছর আগে কোন কারণে নাকীবকে সামনে বসিয়ে না খাওয়ালে আমার মনের মধ্যে খুঁতখুঁত লাগতো যে খাবার খেয়েছে নাকি ফেলে দিয়েছে? আমি সত্যি সত্যি সোফার পেছনে, ওর খেলনা বাক্সের পিছনে খুঁজে দেখতাম খাবার ফেলেছে কিনা। এই কাজটা আমি করতাম আমার অবচেতন মনে বসে থাকা নিজ অভিজ্ঞতার মানদণ্ডে। আমি যেহেতু দুষ্টু কাজ করেছি, আমার ছেলেও করতে পারে এই ধারণার আলোকে। (আমার পুত্র অবশ্য তার মায়ের চেয়ে অনেক বেশি স্মার্ট ছিল। সে চারতলার বারান্দা দিয়ে খাবার নীচে ফেলে দিয়ে প্রমাণও ধুয়ে মুছে দিত)
আসলে হচ্ছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে গঠিত হয় আমাদের ভাবনার জগত। পরিস্থিতির আলোকে না আমরা বেশির ভাগ সময়ই ধারণা করি আমাদের মনে জমে থাকা অভিজ্ঞতার আলোকে। হতে পারে সেই অভিজ্ঞতাটা নিজের বা অন্যের থেকে শোনা কিংবা নাটক-সিনেমাতে দেখা। গল্প উপন্যাস থেকে পড়ে অর্জিত অভিজ্ঞতাও অনেক সময় প্রভাবিত করে আমাদের চিন্তাকে। সেই আলোকে আমরা ধারণা করতে শুরু করি চারপাশের মানুষদের সম্পর্কে। আবার কখনো একজনের গুণাবলী দিয়ে যাচাই করি আরেকজনকে। নিজের ধারণার সাথে কারো স্বভাব মিলে গেলে হাসি তৃপ্তির হাসি। গর্ব করে বলি আমি মানুষকে দেখে, কথা বলেই তার সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝে ফেলি। মানুষকে বোঝার ব্যাপারে আমার অভিজ্ঞতা অনেক। কথায় বলে যে, ঝড়ে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে। আসলেই ব্যাপারটা তাই। প্রতিটা মানুষ আলাদা হলেও তাদের অনুভূতির প্রকাশ কিন্তু মোটামুটি একই। যেমন কষ্ট পেলে মানুষ কান্না করে, প্রিয়জন আঘাত দিলে বিমর্ষ হয়, ব্যর্থতা এলে হতাশ হয় ইত্যাদি। আর এটা দেখেই কেউ কেউ ভেবে নেয় মানুষকে বুঝতে তার কোন তুলনা নেই।
তবে মনের কোন জমে থাকা এইসব ধারণা প্রায়ই সন্দেহে রূপ নিয়ে নষ্ট করে দেউ অনেক সুন্দর সম্পর্ক। এমন অযৌক্তিক অভিজ্ঞতারা মনে ঝরিয়ে যায় সংশয়ের অঝোর শ্রাবণ। সন্দেহ তখন মনকে করে দেয় বিক্ষিপ্ত, এলোমেলো। আর সন্দেহ যেখানে থাকে, শত ভালোবাসা থাকলেও সেখানে সম্পর্ককে মুখোমুখি হতে হয় নানান জটিলতার। অনেক সময় বলা হয় যে সন্দেহ ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। অনেকে বলে সন্দেহের উৎস ভালোবাসার সাগরেই। কিন্তু সন্দেহের উৎস আসলে কি? অবিশ্বাস+আস্থাহীনতা+অনিশ্চয়তা+দ্বিধাদ্বন্দ্ব+উদ্বেগ+দুশ্চিন্তা+আশঙ্কা+ব্যাকুলতা,+সংশয়+অপ্রত্যয়+অনুমান+ খুঁতখুঁত+ভয়। আর এই সবগুলোই থাকে অভিজ্ঞতার রঙে রাঙানো। যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয় বিভিন্ন মাধ্যমে। যা ধারণার রূপে সুপ্ত থাকে মনে কোণে এবং যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সন্দেহে।
তবে এটা ঠিক যে সন্দেহ মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট্য। সন্দেহবিহীন কোন মানুষ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যেহেতু আমাদের চিন্তার জগত টইটুম্বুর নানান ধরণের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাই কোন ঘটনা বা ব্যক্তিকে সেই আলোকে যাচাই করবে এটাই স্বাভাবিক। তাই কোন কারণে বা কারো প্রতি মনে সন্দেহ হানা দিলে ঘাবড়ে যাবার বা হতাশ হয়ে যাবার কিছু নেই। তবে ভালোমত যাচাই করে দেখতে হবে এর পেছনে আসলে মনের কোন অনুভূতি কাজ করছে এবং কিসের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে এই সন্দেহ। সন্দেহকে যদি আমরা যাচাই করে না দেখি, মনের মধ্যে খুব সহজেই জায়গা করে নিতে দেই তাহলে তা জীবনকে করে তুলবে জটিল থেকে জটিলতর।
নিজের ধারণাকে মূল্য দিতে গিয়ে বেশির ভাগ সময়ই আমরা একথা ভুলে যাই যে, কাউকে সন্দেহ করা মানে তাকে অবিশ্বাস করা, তার প্রতি ভরসার দোদুল্যমনতা। অথচ বিশ্বাস ও ভরসা ভালবাসার মূল ভিত্তি। ভিত্তিই যদি নড়বড়ে হয় তাহলে যে কোন ভালবাসার বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া কেবলমাত্র সময়ের ব্যাপার। বলা হয় সম্পর্ক গড়া অনেক সহজ। সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলা তারচেয়েও সহজ। কঠিন হচ্ছে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা। আসলেই কিন্তু তাই। অনেক সময় দেখা যায় সন্দেহ-সংশয় বা অবিশ্বাসের ছোট্ট একটা চিড় ধসিয়ে দেয় সম্পর্কের বিশাল দেয়ালকে। অনেক সুন্দর ও পবিত্র সম্পর্ক ঢাকা পড়ে যায় সন্দেহের কুৎসিত কালিমায়। ছড়িয়ে যায় সম্পর্কের মোতিগুলো কারণ সন্দেহ আঘাত হানে বিশ্বাসের সুতোয়। কঠিন এই পৃথিবীর চলার পথকে সন্দেহ করে তোলে কন্টকাকীর্ণ। সন্দেহের ফলে অবনতি ঘটে আপনজনদের সাথে বন্ধনের। হযরত আলী (রা.) বলেছেন, “সন্দেহপ্রবণ ব্যক্তি, বন্ধু ও প্রিয়জনের সঙ্গেও শান্তিতে থাকতে পারে না।”
রাসূল(সা.) বলেছেন-“ এক মুসলমানের জীবন, রক্ত ও সম্পদ অন্য মুসলমানের কাছে পবিত্র। এক মুসলমানকে অন্য মুসলমান সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা করা থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” পবিত্র কোরআনেও আল্লাহ তায়ালা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে অনুমান ও কুচিন্তাকে পাপ ও মন্দকাজ হিসেবে অভিহিত করেছে এবং মুসলমানদের পরস্পরের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করা সম্পর্কে সতর্ক করেছে। আল্লাহ বলেছেন- “হে বিশ্বাসীগণ ! [ যতদূর সম্ভব ] সন্দেহ সংশয় থেকে দূরে থাক । কারণ কোন কোন ক্ষেত্রে সন্দেহ পাপের কারণ হয়। এবং একে অপরের উপরে গোয়েন্দাগিরি করো না, একে অপরের অসাক্ষাতে নিন্দা করো না।(সূরা হুজরাত-১২)
আমাদের সবার তাই চেষ্টা থাকা উচিত নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা-সংশয় ও সন্দেহ করা থেকে দূরে থাকার। কারণ এসবের দ্বারা আমরা নিজেরাই আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পর্কগুলোতে জমতে দেই দুরুত্বের আস্তর। কাউকে যদি যাচাই করতেই হয় সেটা যেন করি তাকে দিয়েই। অন্যের রঙে না রাঙাই থাকে। হলুদ আর সবুজকে মিলালে দুটি রঙই হারিয়ে ফেলে নিজ নিজ স্বকীয়তা। রুপান্তরিত হয় নতুন এক রঙে। দুজন মানুষকে মিলাতেও গেলেও কিন্তু এমনটাই হয়। এই ভুল না করি আমরা। ফিকে হতে না দেই সম্পর্কের বন্ধনগুলোকে। বুলিয়ে দেই তাতে ভালোবাসার তুলিতে বিশ্বাসের রঙ।

 

বদলে ফেলুন নিজেকে

জান্নাতুন নুর দিশা


মানলাম আপনি একজন মেয়ে। আপনি তো শিক্ষিত হয়েছেন। হ্যাঁ, আমি শিক্ষিত বাঙালি নারীদেরকেই বলছি। আপনাদের মধ্যে বেশিরভাগেরই শিক্ষিত হলেও অজ্ঞদের সাথে কোনো পার্থক্য করা যাবে না। একজন মেয়ে হয়ে এই কথা কেন বলছি? আসুন, আলোচনা করা যাক। আপনাদের ফেসবুক একটিভিটি দেখলেও আপনাদের মানসিক দৈন্য সম্পর্কে একটা মোটামুটি আইডিয়া পাওয়া যায়।

ফেসবুকে আপনাদের সারাদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু,
১/ শপিং
২/ রূপচর্চা
৩/ রান্না
৪/ বিএফ/জামাই

কোন ক্রিম ব্যবহার করলে মুখের কালো চামড়া সাদা হবে, ব্রণ যাবে, চুল পড়া কমাতে, চুলকে আলকাতরার মত কালো করতে কোন কোন উপাদান ব্যবহার করতে হবে, কোন জামার কোন চুমকি কত টাকা দিয়ে কেনা, কোন জামার হাতা কতটুকু হলে ট্যান্ড মানা হবে, কোন মাটি মুখে মেখে বসে থাকলে ক্যাটরিনা কাইফ হয়ে যাওয়া যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

সিরিয়াসলি?! কিভাবে পারেন এসব নিয়ে দিনরাত পড়ে থাকতে? এসব নিয়ে আলোচনা করা যাবে না তা বলছি না। কিন্তু চব্বিশটা ঘন্টা?

দেশ যদি রসাতলেও যায় এই আপুরা হাতে আয়না ধরে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাবেন, বাহারি ডিজাইনের হিজাব খুঁজবেন অনলাইনে, আর একে অপরের সাথে গসিপ করবেন নিজেদের বিএফ নিয়ে।

বেশিরভাগ গার্ল কমিউনিটিতে এসব আলোচনাই থাকে সারা বছর।

বিশ্বের কোনো বিষয় নিয়ে এমনকি কোনো মানবিক বিপর্যয় হলেও দেখা যায় খুব কম মেয়েদেরই সেসব নিয়ে চিন্তা থাকে, মেয়েরা ঠিক উপরে উল্লেখিত বিষয়গুলো নিয়ে পড়ে থাকে।

আমি খুব কম মেয়েকেই দেখেছি যারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ে, চাকরির দুষ্প্রাপ্যতা নিয়ে দুশ্চিন্তা করে কিছু লিখছে। খুব কম মেয়েই দেশ নিয়ে, সাম্প্রতিক বিশ্ব ভূ-রাজনীতি নিয়ে ভাবে, দেশের অর্থনীতি, শিল্পসাহিত্য নিয়ে ভাবে। এমনকি ধর্মীয় বিষয়ে মেয়েদের জ্ঞানও ভীষণ সীমাবদ্ধ। কোনো মেয়েকে যদি ইসলামের ইতিহাস, হাদিস, ইসলামের যুদ্ধসমূহ, খলিফাদের শাসন এসব বিষয়ে প্রশ্ন করেন বেশির ভাগই উত্তর দিতে পারবে না। ওনারা মনে করেন মাথায় বাঁধাকপির মত ফুলিয়ে বাহারি ডিজাইনের হিজাব পরলেই ধর্মচর্চা হয়ে যায়!

অথচ ইসলামও মূর্খের প্রার্থনার চেয়ে জ্ঞানীর ঘুমকে উত্তম বলে।

এবার আসা যাক মেয়েদের সামাজিক অবস্থা নিয়ে মেয়েরা কতটা সচেতন সেই বিষয়ে। কোথাও কোনো মেয়ে হ্যারেজ হলে ছেলেরা যতটা উদ্বেগ প্রকাশ করে, মেয়েরা ততটাও প্রতিবাদ করে না।
মেয়েদেরকে আমি কখনো দেখি নি কোনো হ্যারেসমেন্টের সম্মিলিত প্রতিবাদ করতে। ফেসবুকে এত এত সাধারণ মেয়েদের বিশাল প্লার্টফর্মের গার্লস কমিউনিটি, কোনো হ্যারেসমেন্টের প্রতিবাদে এইসব কমিউনিটি একটা মানববন্ধন করে না। বরং তখনো মেয়েরা সেই সাজগোজ, ফ্যাস্টিভাল নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

আজ অন্য একটা মেয়ে হ্যারেস হলে আপনি শপিং, সাজসজ্জা আর ফেস্টিভাল নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। কালকের মেয়েটি আপনি নয় তো?

মাঝেমাঝে এদেশের শিক্ষিত মেয়েদের বৃহৎ একটা অংশকে আমার এলিয়েন মনে হয়! কোনো কিছু নিয়ে কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই, সস্তা আলাপে দিনরাত মজে থাকাই যেন ওনাদের কাজ!

আমি কেন এসব বলছি আজ? আমি সবসময় মেয়েদের জন্য লিখে এসেছি। মেয়েদের সামাজিক যে নড়বড়ে অবস্থান তার পেছনে সব দায় ছেলেদের নয়। শিক্ষিত মেয়েরাই যখন মেয়েদের নেতৃত্ব দেবার অযোগ্য হয়, শিক্ষিত হয়েও যখন মূর্খের ন্যায় আচরণ করে, তখন অসচেতন অংশের অগ্রযাত্রার পথ আসলেই অনেক কঠিন হয়ে যায়।
বিশাল প্লাটফর্মে একসাথে দাঁড়িয়ে এদেশের শিক্ষিত মেয়েরা “সস্তা মেয়েলি বিষয়” নামে পরিচিত বিষয়গুলো নিয়ে সারাক্ষণ মেতে না থেকে সামাজিক একতা গড়ে তুললেই কেবল নারীদের এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। নতুবা ব্যক্তিগতভাবে অনেক মেয়ে সমাজের উঁচু আসনে প্রতিষ্ঠিত হলে একত্রে নারী সমাজের উন্নতি সম্ভব নয়।

জান্নাতুন নুর দিশা
০৭/০৬/২০১৮

 

চিঠি

ফাতিমা খান


বান্ধবী,

কেমন আছ? আমার চিঠি দেখে খুব অবাক হচ্ছো, তাই না? আমি কিন্তু একদম চিঠি লিখতে পারিনা। সেই যে স্কুল জীবনে শিখেছিলাম, ও-ই শেষ।

কেমন কাটছে তোমার দিন সুদূর আমেরিকায়? তুমি চলে যাওয়ার পর তো আর তোমার সাথে মন খুলে কথা বলা হয় না! আমিও চলে আসলাম এই আরবে। এখানে আসার পর মনে হল যুগ শেষে আমি আবার আমার ঘরে ফিরে এসেছি! কে যেন আমাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল, মেয়াদ পুরা হলে আমি যেন মুক্তির উৎসবে মেতেছি !! এখানে বদলে গিয়েছে অনেক কিছু… শুধু বদলায়নি আমার প্রিয়জনেরা! এখানকার আলো, বাতাস, প্রকৃতি বহুদিন থেকে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল, আমিও ছুটে এসেছি, কিন্তু অ-নে-ক দিন পর….। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়েছি কিছুদিন।

সময়ে অসময়ে তোমার কথা খুব বেশী মনে পড়ে। আমাদের প্রজাপতি রঙ্গিন দিনগুলো তো আর ফিরে আসবে না….. বেলা শেষে রঙ ধুয়ে যাওয়া সাদা-কালো ছবিগুলো হৃদয়পটে এখনও ঝলমল করে। আমি স্মৃতির আ্যলবামটা খুলে বসি! কোথা থেকে যেন এক দমকা বাতাস আমাকে জানিয়ে দেয় তার দুরন্ত অস্তিত্বের কথা। আমি পেছন ফিরে তাকাই। আরবের লু হাওয়া মাঝে মাঝে আমাকে খুব বিষণ্ণ করে দেয়। পরিষ্কার আকাশটা হঠাৎ হলদেটে হয়ে গেলে মনটা খারাপ হয়ে যায়! একাকী বসে চোখ বুঁজে কত কি যে ভাবি……..! তোমার কি সেই পুরানো দিনগুলোর কথা মনে পড়ে? আমার কিন্তু স্মৃতি রোমন্থন করতে ভাল লাগে। গিফট বক্সের মোড়কটা একটানে ছিঁড়ে না ফেলে আস্তে আস্তে খুলতে যেমন আনন্দ, ঠিক তেমন স্মৃতির পাতাগুলো ও ধীরে ধীরে উল্টে দেখতেই বেশী ভাল লাগে। তুমি চলে যাওয়ার পর আমার পৃথিবীর ছোট্ট জানালাটা হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে গেল। এই জানালা দিয়েই তো দুজন বিশাল আকাশটাকে দেখতাম, কত গল্প করতাম , কথার মালা গাঁথতাম!!

আমাদের দিনগুলো কিন্তু খারাপ কাটেনি। তৃপ্তি ছিল, তুষ্টি ছিল, ছিল ভাবনাহীন এক জীবন। কে জানে, এখন থেকে কয়েক বছর পর হয়তো মনে হবে আজকের দিনগুলোর কথা… আর মনে মনে বলব… ভালই তো ছিলাম! এই হল মানুষের মন………! আমরা অতীতের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করি, একরকম বলতে পারো ‘দুঃখ বিলাসিতা’ করি! ‘আজ’কের মাঝে আমরা সুখ খুঁজি না। এই ‘আজ’ যখন ‘কাল’ হয়ে যায়, তখন একে আমরা স্মৃতির জাদুঘরে বন্দী করে সময়ে-অসময়ে স্মরণ করি। দূর হয়ে যাওয়া অতীতের অনেক স্মৃতি বারবার আমাদের পিছু ডাকে। ছোটবেলার দিনগুলি কখনও কি কেউ ভুলেছে বল? আমার গম্ভীর আব্বা যখন সেই বিশাল বৃক্ষশূণ্য মাঠ, তার একপাশে স্ব-গর্বে দাঁড়িয়ে থাকা কেওড়া গাছ, পাশে কপোতাক্ষ নদের বুকে পাল তোলা নৌকা আর ভাটিয়ালী গানের গল্প করেন, তখন আমি অবাক হয়ে শুনি! মানুষের জীবন কত ছোট্ট , কিন্তু কত দীঘল তার স্মৃতিচারণ! জ়ীবন যেখানে শেষ সেখানে নাকি স্মরণের সূচনা। জীবনসায়াহ্নে এসে মানুষ তার ছেলেবেলায় ফিরে যায়, বারবার স্মরণ করে অনাবিল সুখের দিনগুলোকে!

এখানে আসার পর আমার সারাদিন কাটে বাবুকে নিয়ে আর ঘর-কন্নার কাজ করে। বহুদিন পর গিন্নীপনা করতে একেবারে খারাপ লাগছে না। খাঁটি বাঙ্গালী বধূর পাট বলতে পারো এদেশে এসেই শুরু। বাবুকে স্কুলে দিয়ে এখন আবার নতুন করে আরেকটু ব্যস্ত হয়েছি। মাঝে মাঝে relax হতে বাবার বাড়ি , মার্কেট বা পার্কে ঘুরে আসি। তোমার ভাইয়ার দিনের বেশীটুকু সময় কাটে রোগীদের সাথে। রোগ আর রোগীদের মাঝে যে কি অনাবিল আনন্দ, তা ওকে না দেখলে বুঝবে না।

বাবুকে নিয়ে যখন স্কুলে যাই, তখন এখানকার প্রখর রোদের ঝাঁঝালো আঁচটুকু খুব বেশী টের পাই। এখানে সারা বছর রোদের তীব্রতা অনেক বেশী, সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা নিমগাছের ছায়াগুলোও এর কাছে রীতিমত হার মানে। গাছগুলোর অসহায় চাহনীর দিকে তাকিয়ে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি। এত প্রখর রৌদ্র থেকে অনেকদিন দূরে ছিলাম। এখানে এক পশলা বৃষ্টির জন্য মসজিদ গুলোতে নামায হয়… তারপর ও রোদের তেজ কমে না। মনে পড়ে, বৃষ্টির দিনে তোমার সাথে কলেজে যাওয়ার কথা ! বৃষ্টির স্রোতে ধুয়ে যাওয়া পরিষ্কার পিচঢালা রাস্তায় দুজন গল্প করতে করতে বাসায় ফিরতাম। আমাদের গল্প যেন আর ফুরাতো না। এভাবেই তো শেষ হল চারটি বছর! তোমার কি মনে আছে …….বাহারী হ্যাট মাথায় মাস্তানা স্যারের চিকন দুইটা বেণী দুলিয়ে চমৎকার সেই পড়ানোর স্টাইল, জাকির স্যার এর Osazone test, বনিক স্যারের দুর্বোধ্য ভাষার Pharmacology পড়ানো, এন আই খান স্যারের Lub-Dub bhroosh (heart sound) , Oral pathology আর জোয়ারদার স্যারের বিভীষিকা… বাপরে ! এখনও ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখি!! একেকবার ফাইনাল পরীক্ষার সময় আমাদের কি অবস্থা হতো তোমার মনে পড়ে? মনে হত আমরা Bermuda Triangle পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি !!!! সব ঝঞ্জাই তো আমরা একসাথে পাড়ী দিলাম হাতে হাত ধরে, ওই বৃষ্টির পানি উপচে পড়া রাস্তাগুলো পার হওয়ার মত ! মাঝে মাঝে মনে হয়, তুমি না থাকলে আমার কি হত কে জানে। এখন বই এর পাতাগুলো উল্টানোর সময় তোমাকে খুব বেশি মিস করি! প্রতিটা পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে কিছু সাদা-কালো গল্প, আমি তাতে ইচ্ছেমত রঙ মিশাই, তারপর মনের চোখ মেলে তাকিয়ে থাকি অনেকক্ষণ!

তোমার কি খবর বল? আমি শুধু নিজের কথাই বলে যাচ্ছি। আমার বকবক করার অভ্যাসটা এখনও গেল না। তুমি কাছে থাকলে কান দুটোকে নির্ঘাত ঝালাপালা করে দিতাম। তোমার ছোট্ট দুই গোলাপপরী কেমন আছে? ওদের ছবি দেখলে মনটা ভরে যায়। ওরা কি জানে যে ওদের একটা খালামণি আছে যে ওদেরকে গালের সাথে মিশিয়ে আদর করতে চায়? আরেকটু বড় হলে না হয় বলে দিও। এখন আমার হয়ে তুমি ওদের একটু আদর করে দিও ।

আমার এলোমেলো চিঠি পড়ে হেসো না কিন্তু! গুছিয়ে লিখতে পারি না যে, কি করবো? মন যা বলতে চায়, লিখে ফেললাম। তোমার সাথে আবার ফরমালিটি কিসের? কিন্তু নির্ঘাৎ আমার স্কুলের ব্যাকারণ টিচার এ চিঠি দেখলে মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকতেন।

আজ আসি।
বুকভরা শুভেচ্ছা নিও, আর আরবের তীব্র উত্তাপের সহনীয় মিষ্ট উষ্ণতাটুকু তোমাকে দিলাম। আল্লাহ তোমাদের সবাইকে ভালো রাখুন !!
৫ই মে, ২০১০।

 

“স্বাতীর রঙধনু” (শিশুদের মনোজগত ভ্রমণ) পর্ব -৪


আফরোজা হাসান


উমায়ের, নুবাইদ, আয়াত আর নাযীবের জন্য একই রুমের চারকোণায় চারটা বিছানা থাকলেও নাযীব নিজের বিছানায় খুব কমই ঘুমায়। একেকদিন একেক ভাইয়ের সাথে ঘুমায়। কখনো কখনো আবার বড় দুই ভাইয়া কিংবা আপ্পির সাথেও ঘুমোতে চলে যায় নাযীব। দুষ্টু-মিষ্টি কথা আর কর্মকান্ডের জন্য ভাইবোনদের সবার কাছেই অতি প্রিয়, অতি আদরের নাযীব। অবশ্য একইরকম অতি আদরের আর অতি প্রিয় বাড়ির বড়দের কাছেও নাযীব। তাই তো স্বাতীর বেনিআসহকলা’র ‘লা’ অর্থাৎ, লাল রঙ টা হচ্ছে নাযীব। নাযীবের স্পর্শে রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। লাল রঙের বৈশিষ্ট্যও তাই। আরো উজ্জ্বল, আরো মনোহর করে তোলে চারিপাশ। রুমে ঢুকে উমায়েরকে জড়িয়ে ধরে নাযীবকে ঘুমোতে দেখে হাসি বিস্তৃত হলো স্বাতীর চেহারায়। ঘুমের যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই খুব সাবধানে মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে কপালে আদর এঁকে দিলো দুই ছেলেরই। নাযীবের উপর থেকে চোখ সরিয়ে উমায়ের এর দিকে তাকাতেই একরাশ স্বিগ্ধতার ঢেউ খেলে গেলো স্বাতীর মনে। বেনিআসহকলা’র প্রথম এবং স্বাতীর ভীষণ প্রিয় রঙধারী উমায়ের। বেগুনি রঙটা উমায়ের কে দেবার পেছনে আরভের যুক্তি ছিল উমায়ের এর স্বভাবগত স্বিগ্ধতা। উমায়ের মানেই ছোট থেকে ছোট অনুভূতিগুলোকেও খুব যত্ন করে নিজ মনে লালন করা। ভীষণ ইমোশনাল উমায়ের। একটুতেই খুশি হয় আবার একটুতেই অভিমান করে। ওর ব্যাপারে তাই বাড়তি খেয়াল ও মনোযোগ রাখতে হয় সর্বদাই। আসমানি রঙটা আয়াতকে স্বাতীই দিয়েছিল। আসমানি শুদ্ধতার রঙ। জগতের প্রতিটি শিশুই শুদ্ধ। কিন্তু কেউ কেউ সেই শুদ্ধতার প্রতীক থাকে। আয়াত ঠিক তেমন একটি শিশু। মাত্র সাড়ে সাত বছর বয়সেই নিজের প্রতিটি কাজের ব্যাপারে খুবই সচেতন আয়াত। বিশাল উদারতা নিয়ে সবকিছুর সাথে মানিয়ে নেবার জন্য সদা প্রস্তুত থাকে। অনেকটা আয়াতের মতোই নুবাইদ। অবশ্য হতেই হবে দুজন জমজ বলে কথা। সেজন্যই নীল রঙটা নুবাইদের দখলে। নীল বিশালত্বের রঙ, গভীরত্বের রঙ। প্রিয়জনদের তরে ভালোবাসার টলটলা গভীর সরোবর প্রবাহিত ছোট্ট নুবাইদের বিশাল অন্তরে। সাবধানে আয়াত আর নুবাইদকেও আদর করে দিয়ে ড্রয়ার থেকে সেলফোন নিয়ে বড় তিন সন্তানের রুমের দিকে পা বাড়ালো স্বাতী।
একই রুমের একপাশে বড় ছেলে মুসআব আর অন্যপাশে মেঝ ছেলে নাহিবের বিছানা। তবে রুম একটা হলেও দুইপাশের জগত ভিন্ন। মুসআব যতটা গোছানো স্বভাবের নাহিব ঠিক ততটাই এলোমেলো স্বভাবের। রুমে ঢুকে মুসআবের দিকে তাকাতেই শান্তি শান্তি আবহ ঘিরে ধরলো স্বাতীকে। এক টুকরো সজীব প্রকৃতি মনেহয় মুসআবকে। স্বভাবেও ভীষণ শান্ত, বয়সের তুলনায় অনেক সমঝদার। তাই তো স্বাতীর কাছে মুসআব সবুজের আহবায়ক। আর নাহিব মানেই একদন্ড স্থিরতা নেই যার মাঝে। মাথাভর্তি নিত্যনতুন আইডিয়া আর মনের মাঝে থইথই আবেগ। যুক্তি প্রদর্শনে জুড়ি নেই নাহিবের। একই সাথে আবার অন্যের যুক্তি যে কান দিয়ে শোনে সে কান দিয়েই বের করে দেয়ায়েও জুড়ি নেই নাহিবের। অস্থির, পাগলাটে ছেলেটার জন্য তাই হলুদ রঙটাকেই বেছে নিয়েছিল স্বাতী। তবে স্বভাবে যতই অমিল থাক না কেন দুই ভাইয়ের ঘুমের ধরণ একদম অভিন্ন। এই প্রচণ্ড ঠান্ডার রাতেও মুসআব আর নাহিব দুজনই কম্বল ফেলে ঘুমোচ্ছে বেঘোরে। দুই ছেলের গায়ে কম্বল ঠিক করে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে কন্যার রুমে রওনা করলো। মিসেস রাবেয়া নাতনীকে আদর করে ডাকেন বাসন্তী পরী। নানুমণির দেয়া নামটা ভীষণ পছন্দ মহিমার। কন্যার জন্য নামটা ভীষণ পছন্দ স্বাতীরও। বাবা-মার জীবনে কন্যারা তো বসন্তেরই প্রতীক। আরভ স্বাতীর জীবনেও বারোমাসি বসন্ত মহিমা। চঞ্চল, মায়াবী, বর্ণিল এক প্রজাপতি মনেহয় মহিমাকে। যায় উপস্থিতিই যথেষ্ট মনকে খুশির রঙে রাঙিয়ে দেবার জন্য। মহিমার রুমের দরজায় আরভকে দাঁড়ানো দেখে হাসি মুখে সালাম দিলো স্বাতী।
সালামের জবাব দিয়ে আরভ বলল, কন্যা তো ঘুমোয়নি এখনো। গল্পের বই পড়ছে নিমগ্ন হয়ে। একদম মায়ের আত্মমগ্নতার গুণে গুণানিত্বা কন্যা। মায়ের যেমন কোন কাজে ডুবলে চারপাশের কোনকিছুর খবর থাকে না। একই অবস্থা মায়ের কন্যারও। পাঁচমিনিট ধরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। কন্যার কোন খেয়ালই নেই।
বই হাতে আত্মমগ্ন বাসন্তী পরীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দরজা চাপিয়ে দিয়ে স্বাতী বলল, যদি পথে পাওয়া কোন পাবলিসিটিতেও চোখ বুলাও গভীর মনোযোগের সাথে বুলাবে। তাহলে দেখবে তারমধ্যেও কোন না কোন শিক্ষা পেয়ে যাবে। এই বাণী কন্যার মায়ের না, কন্যার পিতার। তাই মনোযোগের সাথে অধ্যায়নরত হইয়া কন্যা মূলত পিতৃ পরামর্শকেই সম্মান প্রদর্শন করছেন।
হেসে ফেললো আরভ। হাসতে হাসতে বলল, তা কিছুক্ষণ আগে কন্যার মাতা কার পরামর্শকে সম্মান প্রদর্শন করছিলেন লেখনীতে নিমগ্ন থেকে? কন্যার আগে তার মাতার দরজাতেও পাঁচমিনিট দাঁড়িয়ে থেকে এসেছি। একটা সময় ছিল যখন বাড়িতে আসার আগেই কন্যার মাতা টের পেয়ে দরজা ধরে অপেক্ষা করতো। আর এখন বাড়িতে পৌঁছে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও তার মনোযোগ আকর্ষণ করা সম্ভব হয়না।
জ্বি পরিবর্তনশীলতাই জীবনের ধরণ, না করে আহাজারি করে নিন একে বরণ। তাহলে অকারণ বাড়বে না মনের ওজন, সুখানন্দ তুলবে প্রতিক্ষণে জোনাক জোনাক গুঞ্জন। হাসতে হাসতে বললো স্বাতী।

চলবে….

পর্ব-৩

 

নারীর নির্যাতনের আরেক রূপ

নারী সংবাদ


ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠানগরের উত্তর হরিপুর গ্রাম থেকে অর্ধবস্ত্রহীন হাতে-পায়ে শিকল বাঁধা নির্যাতনের শিকার এক গৃহবধুকে রোববার সন্ধায় উদ্ধার করেছে পুলিশ । ওই গৃহবধুর কেটে ফেলা হয়েছে মাথার চুল । চার দিন ধরে বাঁধা তাহেরা আক্তার রিনা নামের ওই গৃহবধুকে বোতলে ভরে জোরপূর্বক স্বামীর প্রসাব পান করান সহ সাংবাদিকদের কাছে নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ করেছেন ওই গৃহবধূ।

জানা গেছে, ফেনী সদর উপজেলার কাতালিয়া গ্রামের মৃত আমিনুল আহছান বাবুলের দশম শ্রেণি পড়ুয়া এতিম মেয়ে তাহেরা আক্তার রিনাকে (২০) ছাগলনাইয়া উপজেলার পাঠাননগর ইউনিয়নের উত্তর হরিপুর গ্রামের হাজারী বাড়ির দুই সন্তানের জনক মনজুরুল আলম বাদল হাজারীর (৫৪) সঙ্গে গত বছরের মার্চ মাসে বিয়ে হয়। মেয়ের মা বিবি ফাতেমা পারুল ও তার মামারা মিলে এক আত্মীয়ের বাড়িতে নিয়ে রিনাকে বাদল হাজারীর কাছে বিয়ে দিলেও বিয়েতে রিনার মত ছিল না।

বিয়ের পর রিনা জানতে পারে এর আগে বাদল হাজারীর আরো দুইটি স্ত্রী ছিল। তাদেরকে সে নির্যাতন করে তাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা। বিয়ের পর থেকে বাদল চৌধুরী ও মেয়ের মাসহ স্বজনদের চেষ্টার পরও রিনা বাদল হাজারীকে স্বামী হিসেবে মেনে না নিয়ে পালিয়ে যায়।

গত কয়েকদিন আগে রিনা ঢাকা থেকে কুমিল্লার ছিওয়াড়ায় তার নানীর বাড়িতে যায়। সেখান থেকে তাকে মামা, মা ও ছোট ভাই ধরে স্বামীর হাতে তুলে দেয়। গত চার দিন ধরে বাদল চৌধুরী তার বাড়িতে রিনাকে হাত-পায়ে শিকল পরিয়ে নির্জন কক্ষে আটকে রাখে।

পালিয়ে যাওয়া ঠেকাতে তার মাথার চুল কেটে ফেলা হয়েছে। পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে তার কাপড়-ছোপড়। স্বামীর কথা মানতে অস্বীকার করায় শরীর থেকে জোরপূর্বক বেশিরভাগ কাপড় খুলে অর্ধবিবস্ত্র করে রাখা হয় তাকে। রিনার সামনে প্রস্রাব করে বোতলে ভরে জোরপূর্বক প্রসাব পান করানোসহ কয়েক দিন ধরে তার ওপর চালানো হয় শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন। এ কথাগুল থানায় বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন রিনা ।

নির্যাতনের ফলে তোড় শোর চিৎকার করে সাহায্য চাইলেও তার স্বামীর ভয়ে বাড়ির কেউ এগিয়ে আসেননি বলে অভিযোগ এতিম রিনার।

এলাকা থেকে গোপনে সংবাদ পেয়ে রোববার বিকেলে ছাগলনাইয়া থানা পুলিশের এসআই নাঈম উদ্দিনের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক পুলিশ সদস্য বাড়ি ঘেরাও করে গতকাল সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘরের তালা ভেঙ্গে শিকলসহ রিনাকে উদ্ধার করে । পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে স্বামী বাদল চৌধুরী পালিয়ে যায়। নির্যাতিতা গৃহবধু তাহেরা আক্তার রিনা তাকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি করেছেন।

ছাগলনাইয়া থানার ওসি এমএম মুর্শেদ পিপিএম উদ্ধারের সত্যতা নিশ্চিত করে নয়া দিগন্তকে জানান, গৃহবধূকে আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনায় মামলার প্রস্তুতি চলছে ।

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন বাড়ছে : বিবিসি বাংলা

বাংলাদেশের একটি বেসরকারী সংস্থার পরিচালিত গবেষণায় বলা হয়েছে যে দেশটিতে নারী নির্যাতন বাড়ছে এবং গত তিন বছরে পনের বছরের কম বয়সী কিশোরীরা বেশী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারী সংস্থা, ব্র্যাক, বুধবার ঢাকায় গবেষণাটির ফলাফল প্রকাশ করে বলেছে যে বিভিন্ন জেলা থেকে তারা নারী নির্যাতন সংক্রান্ত যেসব তথ্য পেয়েছেন তাতে দেখা গেছে এসময়ে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ কিশোরী ধর্ষনের শিকার হয়েছেন এবং ৫৯ শতাংশের ওপর ধর্ষনের চেষ্টা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের একশ’ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ঐ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়।

ব্র্যাকের গবেষকরা বলছেন যে ২০০৬ সালের জুন থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নারী নির্যাতনের প্রায় তিন হাজার তথ্য সংস্থাটির ঢাকা সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছিলো। ব্র্যাকের মাঠ পর্যায়ের নিজস্ব কর্মীরাই এসব তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন।

এসব তথ্য বিশ্লেষন করেই নারী নির্যাতন সম্পর্কিত ব্র্যাকের গবেষণা রিপোর্টটি তৈরী করা হয়েছে বলে জানান সংস্থাটির গবেষণা ও মূল্যায়ন বিভাগের উর্ধতন গবেষক ড. ফজলুল করিম।

তিনি বলেন যে ৫০ শতাংশ কিশোরী ধর্ষিতা হলেও ২৫-৩০ বছরের মহিলাদের মধ্যে ধর্ষনের শিকার হয়েছেন ৩৮ শতাংশ।

অ্যাসিড সন্ত্রাসের যারা শিকার তাদের যেমন পূনর্বাসনের ব্যবস্থা আছে, ধর্ষনের শিকার যারা তাদের বেলায তেমনটি নেই
ড. করিম
এটা দেখা গেছে যে বয়স যত বেড়েছে ধর্ষনের ঘটনা তত কমেছে, আর ধর্ষনের শিকার বেশী হচ্ছেন স্কুলগামী মেয়েরা।

ড. করিম বলেন যে অ্যাসিড সন্ত্রাসের যারা শিকার তাদের যেমন পূনর্বাসনের ব্যবস্থা আছে, ধর্ষনের শিকার যারা তাদের বেলায তেমনটি নেই।

আর তাই গবেষণায় দেখা গেছে যে আদালতের দ্বারস্থ না হয়ে ধর্ষনের শিকার অনেক কিশোরীই হয় নিরবে তা সহ্য করেছেন কিংবা আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।

তিনি বলেন বাংলাদেশের আইন-কানুন এমন যে অনেক সময় ধর্ষনের ঘটনা আদালতে প্রমান করার ক্ষেত্রে ধর্ষনের শিকার মেয়েদেরকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। সূত্র: নয়াদিগন্ত

 

মাতৃকথন (মূল সমস্যা বাচ্চা খায় না) ৯

ফারিনা মাহমুদ


মূল সমস্যা – বাচ্চা খায় না ।­

১) প্রথমত, জয় গুরু শেক্সপিয়ার! আই মাস্ট বি ক্রূয়েল, অনলি টু বি কাইন্ড। পরিবারের সবার সাথে বসে আগে আলোচনা করে একমত হন, খাওয়া নিয়ে এই নাটকের অবসান সবাই চান কি না। এরপর মাথায় রাখবেন এপ্রোচ কখনো কখনো আপাত দৃষ্টি তে রুড হতে পারে। দুর্গম গিরি কান্তার মরু পার হতে গিয়ে গেইম প্ল্যানে কচ্ছপ কামড় দিয়ে পড়ে থাকুন। নিজেদের মধ্যে মাঝপথে মারামারি করে রণে ভঙ্গ দিলে মিশন ইম্পসিবল। শত্রু পক্ষ অর্থাৎ আপনার অর্থাৎ আপনার ঘাউড়া বাচ্চা এই সুযোগ ষোলো আনা নিবে।

২) একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাচ্চার খাবার শেষ করবেন। ঘন্টার পর ঘন্টা খাবার নিয়ে সামনে মা মুখে খাবার নিয়ে বাচ্চার বসে থাকা চলবে না। স্কুলের টিফিনের ঘন্টার মতো একটা সময় বেঁধে নেবেন। এর মধ্যে খাইলে খা, না খাইলে যা কেইস। এই ট্রিক্স বিফলে মূল্য ফেরত ট্রিক্স। ৭ দিন কষ্ট করে এই ট্রিক্স পালন করে দেখেন। আলো আসবেই। এইখানেই মূলত বাবা মায়ের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়, বাচ্চাটা খাচ্ছে না, এই নাটকের কোনো মানে হয়… কোথাকার কোন ফারিনা মাহমুদ ফেসবুকে কি লিখলো, তা নিয়ে আমার সংসারে আগুন… ব্যাস, একজন ব্যাকফায়ার করে বসে! পরিকল্পনার পরী ডানা মেলে উড়ে যায়, কল্পনা পড়ে থাকে!

৩) বাচ্চা খায় না খায় না করে ঘন ঘন খাবার সাধবেন না। সকালের নাস্তা ঠিক মতো খাক না খাক, ঠিক স্ন্যাক টাইমেই তাকে আবার খাবার দেবেন। দিনে ৫ বার রুটিন ধরে খাবার দিলে বাচ্চা আপনা থেকেই বুঝে যাবে খাবার যখন সামনে আসে, তখন তা খেতে হবে, নাইলে বিপদ, কপালে খাবার নাই আগামী ৩ ঘন্টা !

৪) বাচ্চাকে চেয়ে খাওয়ার সুযোগ দিন। অর্থাৎ তার ক্ষুধা লাগার সুযোগ তৈরী করুন। তাকে পর্যাপ্ত খেলতে দিন। একসময় সে নিজেই খেতে চাইবে। এইটা জীবের ধর্ম। বাকি জীবন খাবারের পেছনেই সে ছুটবে, খাবার তার পিছে ছুটবে না!

৫) যত বড় বাচ্চা তত বড় ঘাউড়া। সাধারণত বলা হয় যত বছর বয়স, তত মাস লাগে অভ্যাস চেঞ্জ হতে। তাই ছোট থাকতেই লাইনে আনেন। আর অলরেডি যদি বেলাইনে নিয়েই থাকেন তো এখনই ধৈর্য ধরে শুরু করে দিন।

৬) শুরু করাটা খুব মুশকিল। একদিনে সব সম্ভব না। শুরু করবেন এক বেলার খাবার দিয়ে। আস্তে আস্তে অন্যবেলা গুলিতেও জোরাজুরি বন্ধ করে স্বাভাবিক ভাবে খাবার অভ্যাস করবেন।

৭) সুস্থ্যতার মাপকাঠি কখনোই গাপলু গুপলু মোটাসোটা হওয়া না। বরং বাচ্চাদের ক্ষেত্রে ওবেসিটি একটা ভয়ঙ্কর জিনিস। আমি ওভারওয়েট বাচ্চার মা কে চোখের পানি ফেলতে দেখেছি এই বলে যে ওকে ওর কোনো ফ্রেন্ডের বার্থডে তে যেতে দেই না, কেক মিষ্টি বার্গার খেয়ে ফেলবে, তাই!

আর উপরের কোনো তরিকাই যদি কাজ না করে, তো আয়নার সামনে চলে যান । নিজের দিকে ভালো করে দেখুন, এরপর মনে মনে বলুন – তু চীজ বাড়ি হ্যায় মাস্ত মাস্ত …. ! আমার ঘরে আমার মতোই আরেকটা চীজ হয়েছে! নো ওন্ডার! নিশ্চই আমিও বাপ মা কে কম প্যারা দেই নাই! হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ ! আমার ধারণা ইংরেজী প্যারেন্টহুড শব্দটার উৎপত্তি বাংলা প্যারা শব্দটা থেকে ।
প্যারেন্ট হবেন প্যারা খাবেন না, তা হবেনা তা হবেনা !

হ্যাপি প্যারেন্টহুড অল !

চলবে  Continue reading

 

বিয়ে ও পরিবার সমকালীন জিজ্ঞাসা – ৬

কানিজ ফাতিমা


গত দু’টি পর্বে মাসিককালীন ও এর পূর্বে নারীর শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছি। এ পর্বে আলোচনা করবো গর্ভকালীন সময়ে একজন নারীর মানসিক অবস্থা নিয়ে।

মূলতঃ গর্ভকালীন সময়ে নারীর শারীরিক পরিবর্তন ও কষ্টগুলো সম্পর্কে কমবেশী আমরা সবাই অবগত। কিন্তু এ সময়ে নারীকে যে বিরাট মানসিক পরিবর্তন ও চাপ সহ্য করতে হয় সে ব্যাপারে বেশীরভাগ মানুষই সচেতন নন। এ সময়টি মূলতঃ স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের জন্যই একটি সংকট মুহূর্ত। একদিকে সুখ ও আশা অন্যদিকে নানা রকম ভয় ও শঙ্কা এ সময়টিকে উভয়ের জন্য কঠিন করে তোলে। বিশেষ করে একজন নারী এ অবস্থায় প্রতিটা মুহূর্তে নানা রকম চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে। ফলে তার জন্য আশেপাশের মানুষগুলো বিশেষ করে স্বামীর সার্বক্ষনিক সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে। সব থেকে বেশী দরকার স্বামীর পক্ষ থেকে তাকে আশা ও নির্ভরতার গ্যারান্টি দেয়া। আমি অবাক হয়েছি এটা জেনে যে, এ সময় অনেক পুরুষ স্ত্রীর কাছ থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রাখতে সচেষ্ট হন এই ভয়ে যে তার আশেপাশের লোকজন বা আত্মীয়রা তাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে বা বলবে “ কেমন পুরুষ মানুষ, বউয়ের সেবা করে…”। আমি এটাও শুনেছি গর্ভকালীন শারীরিক কষ্ট বিশেষ করে সকাল বেলার দুর্বলতা (Morning Sickness) এর কারণে গর্ভবতী বিছানায় শুয়ে থাকলে তাকে অনেক সময় শাশুড়ী- ননদরা বলেন, “ দেখে মনে হয় তোমার একলারই বাচ্চা হবে। ছেলে-পুলে তো আমাদেরও হয়েছে…”। এ সকল পরিস্থিতিতে স্বামীর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বামীর মনে রাখতে হবে যে, স্ত্রীর সেবা করায় দোষের কিছু নেই। এটা কোন দুর্বলতার লক্ষণ না, বরং ‘পাছে লোকে কিছু বলে’- এই সংকোচ ঝেড়ে ফেলে নিজ দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকতে পারা সবল মানসিকতা সম্পন্নদের পক্ষেই সম্ভব।
তাছাড়া হাদিসেও এর পক্ষে সবল দৃষ্টান্ত রয়েছে ৷ বদর যুদ্ধের সময় সংখ্যায় মুসলমানরা কম ছিলেন ৷ সেসময় মদীনাতে মাত্র ৭৭ জন সমর্থ মোহাজির পুরুষ ছিলেন ৷ তিনজন বাদে এদের সবাই যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন ৷ তালহা ও সা’দ (রা:) সেই মুহুর্তে সংবাদ সংগ্রহের কাজে মদীনার বাহিরে ছিলেন বলে বাহিনীতে যোগ দিতে পারেননি ৷ আর তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মদীনাতে উপস্থিত থেকেও বাহিনীতে যোগ দেননি তিনি হলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম সারির সাহাবী উসমান (রা:) ৷ যদিও সে সময় মুসলিম বাহিনীতে বেশী সংখ্যক যোদ্ধার দরকার ছিল তথাপি রাসুল (সা:) নিজেই উসমান (রা:) কে মদীনায় থাকতে নির্দেশ দেন কারণ সেই সময় তার স্ত্রী রোকাইয়া (রাসুল সা: এর কন্যা) অসুস্থ ছিলেন ৷ ” the Prophet had told his son-in-law ‘Uthman’ to stay at home and tend his sick wife” ( MUHAMMAD –his life based on the earliest sources by Martin Lings, পৃষ্ঠা: ১৩৮ ) আমরা এখানে স্পষ্ট দেখতে পাই শুধুমাত্র অসুস্থ স্ত্রীর দেখাশোনার জন্য তিনি বদর যুদ্ধের বাহিনীতে যোগদান থেকে বিরত থাকলেন স্বয়ং রাসুল (সা:) এর নির্দেশে ৷ অথচ সে সময় মদীনাতে অন্যান্য নারীগণ উপস্থিত ছিলেন যারা সহজেই তার সেবা করতে পারতেন ৷ সাওদা (রা:) ( রাসুল সা: এর স্ত্রী); ফাতেমা রা: ও উম্মে কুলসুম রা: (রোকাইয়ার দু’ বোন); উম্মে আয়মান ও খাওলা সহ অনেকেই রোকাইয়ার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ৷ তদুপরী রাসুল (সা:) স্ত্রীর সেবার জন্য স্বামীকেই দ্বায়িত্ব দিলেন। আমরা সবাই জানি গর্ভকালীন সময়ে যে সমস্যাগুলো হয় তা একেক জনের একেক মাত্রায় হয়। বিশেষ করে প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে মায়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় একদিকে তার ভীতির পরিমাণ অনেক বেশি থাকে, অন্যদিকে সমস্যাগুলো মোকাবেলার পদ্ধতিগুলো অজানা থাকে। ফলে এ পরিস্থিতিটি তার কাছে কঠিন থেকে কঠিনতর আকার ধারণ করে। এজন্য স্বামী ও স্ত্রীর উভয়েরই যদি আগে থেকেই এই সময়কার নারীর শরীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো জানা থাকে তবে এ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
যেহেতু গর্ভকালীন সময়ে নারীর শারীরিক কষ্ট ও পরিবর্তনগুলো চিকিৎসক দ্বারা নির্ণিত হয় সেহেতু আমি ঐদিকে না গিয়ে, নারীর মানসিক অবস্থা ও পরিবর্তন, যা অনেক সময়ই আলোচনার বা নজরের বাইরে থাকে, সেদিকে আলোকপাত করবো। তবে আগে বলে রাখা ভালো যে কোন কোন নারীর ক্ষেত্রে মানসিক সমস্যাগুলো মারাত্মক হতে পারে। সে অবশ্যই চিকিত্সকের পরামর্শ নিতে হবে। আমি কেবল মাত্র সাধারণ পরিবর্তনগুলো (Common changes) নিয়ে আলোচনা করবো। গর্ভকালীন পুরো সময়টাকে আমরা তিনভাগে ভাগ করতে পারি।
১. First Trimester : ১ম সপ্তাহ থেকে ১২ সপ্তাহ পর্যন্ত ১ম একতৃতীয়াংশ বা First Trimester ধরা হয়।
২. Second Trimester : ১৩তম সপ্তাহ থেকে ২৭তম সপ্তাহ পর্যন্ত দ্বিতীয় একতৃতীয়াংশ বা Second Trimester: ধরা হয়।
৩. Third Trimester : ২৮তম সপ্তাহ থেকে ৪২তম সপ্তাহ পর্যন্ত তৃতীয় একতৃতীয়াংশ বা Third Trimester ধরা হয়।
অনেকে কিভাবে সপ্তাহ গণনা করতে হয় সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। সর্বশেষ মাসিক যেদিন শুরু হয়েছিল সেদিন থেকেই সপ্তাহ গণনা শুরু হয় (মাসিক শেষের দিন নয়)।
যদিও গর্ভকালীন সময়ের পরিবর্তনগুলো কমবেশী একই রকম তবুও প্রত্যেকটি কেসই কোন না কোন দিক দিয়ে স্বতন্ত্র। শরীরের আকারের পরিবর্তন, হরমোনের পরিবর্তন, Culture বা সাংস্কৃতিক অবস্থা, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ধরন, মানসিক প্রস্তুতি এসব কিছুর সংমিশ্রনেই গর্ভকালীন অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। যেমন ধরুন কোন স্বামী-স্ত্রী যদি সন্তান আশা করে এবং সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে তবে গর্ভধারনের সংবাদ দু’জনই আনন্দের সঙ্গে নিবে। অন্যদিকে তারা যে সময়ে এটা চাচ্ছিল না তখন যদি এ সংবাদ পায় তবে তাদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। তারা আনন্দ ও দুঃশ্চিন্তা এ দু’য়ের মাঝামাঝি দুলতে থাকবে।
ভাবী মায়ের মানসিক অবস্থা তার শারীরিক অবস্থা ও সন্তানের বিকাশে সরাসরি প্রভাব ফেলে। যা পরিণামে পরিবারের অন্যান্যদের সাথে সম্পর্ককেও প্রভাবিত করে। যেমন কোন গর্ভবতী যদি মানসিক চাপে ভোগে তবে তার বমিভাব ও দুর্বলতা বেশী হবার সম্ভাবনা থাকে। তার এই শারীরিক কষ্ট তার মানসিক চাপকে বাড়িয়ে দেবে। ফলে সে পরিবারের অন্যান্যদের সঙ্গে বিশেষ করে স্বামীর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম হবে না। যা পরিণামে তার মানসিক চাপ আরও বাড়াবে। এভাবে প্রক্রিয়াটি চক্রের আকারে চলতে থাকবে।
এবার দেখা যাক প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় Trimester এ গর্ভবতীর অবস্থা কেমন হয়:
First Trimester : যে মুহূর্তে একজন নারী জানতে পারে যে সে মা হতে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তেই তার চিন্তা ও অনুভূতিতে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটে। এ সময় অনেকেরই Emotional Swing খুব দ্রুত ঘটতে তাকে। খুব অল্পতেই তারা হতাশ অনুভব করে, রাগান্বিত হয় বা আনন্দিত হয়। সব নারীরই কম বেশী Emotional Swing হয় তবে তার পরিণাম নির্ভর করে নারীর Personality Type (ব্যক্তিত্বের ধরন) এর উপর। অনেক সহিষ্ণু ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারীকেও এ সময় অল্পতেই কান্না-কাটি করতে দেখা যেতে পারে। স্বামী ও পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা এ অবস্থাকে মোকাবিলা করতে সহযোগিতা করে।
এই সময়ই গর্ভপাতের আশংকা থাকে। ফলে এই ভয় বা অনিশ্চয়তা নারীর উপর বাড়তি চাপ তৈরি করে, অনেককে দেখা যায় যে তারা হাঁটতেও ভয় পায়। বিশেষ করে Miscarriage এর পূর্ব অভিজ্ঞতা যাদের থাকে তাদের উপর এ চাপের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে অনেকেক্ষেত্রে তারা স্বাভাবিক জীবন যাপনেও ভয় পেতে পারে। এই দুশ্চিন্তা ও চাপের মাত্রা আরও বেড়ে যায় যদি ঐ নারীর মনে হয় যে গর্ভপাত হলে স্বামী বা শশুর বাড়ীর লোকজন তাকেই এর জন্য দায়ী করবে। এ পরিস্থিতিতে স্বামীর পক্ষ থেকে মানসিক সান্ত্বনা নারীর একান্ত প্রয়োজন। সফল গর্ভধারণ বা গর্ভপাত যাই ঘটুক নারী তার স্বামীর সহমর্মিতা থেকে বঞ্চিত হবে না- স্বামীকে এই নিশ্চয়তা দিতে হবে। এই নিশ্চয়তা নারীকে সংকট কাটিয়ে উঠতে অনেকটাই সাহায্য করে।
এক্ষেত্রে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যনীয়। এ সময় স্বামী স্ত্রীর দৈহিক মিলনেও অনেক স্ত্রী ভয় পায়। এবং মিলনের পরের দু’এক দিনের মধ্যে যদি গর্ভপাত ঘটে তবে স্ত্রীর মনে স্বামীকে দায়ী করার প্রবণতা তৈরি হয়। স্ত্রীদের জানা থাকা দরকার এর কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। অন্যদিকে স্বামীর জানা প্রয়োজন স্ত্রী গর্ভজনিত মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছে। কাজেই স্ত্রীকে কোন কিছুতে বাধ্য করা বা বাড়তি চাপ প্রয়োগ করা ঠিক নয়।

পর্ব-৫

 

বই এবং বেপরোয়া আমি ১

তাহেরা সুলতানা


বইপড়ার প্রতি পাগলামি আমাকে অনেকবার বিব্রত অবস্থায় ফেলেছে। বিপদেও পড়েছি বহুবার। ক্লাস ফাইভে স্কুল, স্কলারশিপ এবং সেন্টার পরীক্ষা শেষে অনেকটা সময় পেয়েছিলাম। তখন সারাক্ষণ হাতে ‘তিন গোয়েন্দা’ থাকতো। বাড়িতে ডাইনিং টেবিল ছিলনা। মেঝেতে পাটি পেতে পড়তাম। বিদ্যুৎ চলে গেলে হারিকেন অথবা মোমবাতিই ভরসা ছিল। একটা কথা না বললেই নয়। কোন বই পড়ার আগে আব্বা সবসময় বলতেন,

“যখন কোন ঐতিহাসিক বা কাহিনীমূ্লক লেখা পড়বে, তখন নিজেকে ওই জায়গায় গিয়ে এমনভাবে দাঁড় করাবে, যেন তুমি চোখের সামনে দৃশ্যগুলো দেখতে পাও। তাহলেই পড়ে মজা পাবে।”

একদিন সন্ধ্যার সময় বিদ্যুৎ ছিলনা, মোমের আলোয় ‘তিন গোয়েন্দা’ পড়ছিলাম। চুল হাতাচ্ছি, আর পড়ছি। কি যে মনোযোগ! কখন যে চুলে আগুন ধরে যায়, টেরই পাইনি। আম্মা রান্নাঘর থেকে গন্ধ পেয়ে ছুটে আসে। তারপর তো পুরা ইতিহাস! আম্মা সেদিন যে মারটাই না দিছিলেন! অনেকদিন গল্পের বই আর হাতেই নিতে দেননি! আম্মা সব বই আলমারীতে তালা মেরে রেখে চাবি আঁচলে নিয়ে ঘুরতেন। বইয়ের বিরহ যে কি জিনিস, সেদিন বুঝেছিলাম!

আরও সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছিল, যেটা আজও কাউকে বলা হয়নি। ক্লাস এইট এর স্কলারশিপ পরীক্ষার পর আমরা ৩ বোন ট্রেনে করে ছোটমামার সাথে নানুবাড়ি যাচ্ছিলাম। ছোটমামা তখন সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে বিকম পড়ছিলেন এবং আমরা খুব ভালো বন্ধুও ছিলাম। কারণ মামা তখন আমাদের একজন বড়ধরনের বই আর ক্যাসেট এর যোগানদাতা। ‘প্রিয় বন্ধু’ নামে শ্রুতিনাটকের ক্যাসেটটা মামাই প্রথম আমাদের উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন। মামা খুব ভালো লিখতেন। একটা করে কবিতা লিখতেন আর আমাদের পড়ে শুনাতেন। খুব ভালো গানও গাইতেন।

যাইহোক, আব্বা কিছুতেই মামার সাথে একা ছাড়বেন না। আর উনি কখনোই আম্মাকে ছাড়া আমাদের একা ছাড়েননি। সেবারই এর ব্যতিক্রম ঘটে। মামা কিছুতেই মানতে নারাজ, তাই জোড় করেই নিয়ে যান। বাসেই যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমরা বোনেরা ট্রেনে যাব বলে জিদ ধরলাম। তখন সিরাজগঞ্জ থেকে দিনাজপুর যাওয়ার জন্য সরাসরি কোন ট্রেন ছিলনা। ভেংগে ভেংগে যেতে হতো। তাই অনেক সময় লাগতো। পার্বতীপুর গিয়ে যখন চিরিরবন্দরের উদ্দেশ্যে আবার ট্রেনে চড়ি, তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমাদের ৩ বোনের হাতেই ট্রেনে চড়ার পর থেকেই কিন্তু বই ছিলো! স্পষ্ট মনে আছে, আমি মাসুদরানার কোন একটা সিরিজ পড়ছিলাম। আমার ছোট ২ বোন মামার কাছে বসেছিল। ওখানে আর সিট খালি না থাকায় আমি ঠিক বিপরীতদিকে জানালার পাশে বসেছিলাম। বোনদের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করেই সিটটা নিয়েছিলাম। ওপাশে জানালার ধারে চাচার বয়সী একজন মানুষ বসে ছিল এবং আমাকে মা বলেই সম্মোধন করছিল। আমি বরাবরি একটু বোকা টাইপ ছিলাম! তাই সমাজের নোংরা চেহারাটা সবসময় চোখ এড়িয়ে যেতো! তখনকার যুগটা তো আর এখনকার মতো এতোটা খারাপ ছিল না! রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও চাচা তো চাচাই ছিল! আর মা বলে ডাকলে তো কথাই নেই! আমার গায়ে লম্বা গাউন আর মাথায় হিজাব ছিল। অবশেষে ওই চাচার পাশেই একটু দূরত্ব রেখে জানালার সাথে সেটে বসলাম। এরপর তো পুরোপুরি বইয়ে ডুবে গেলাম! ততক্ষণে রাতের আধার ফুটতে শুরু করেছে। হঠাৎ মনে হলো, ওই চাচা আমার গা ঘেসে বসার জন্য বারবার এগিয়ে আসছে। আমি বইয়ে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে প্রথমদিকে খেয়ালই করিনি! তারপর যখন বুঝতে পারলাম, তখন মামাকে ইশারা করে বোঝাতে চাইলাম। মামা উল্টো ধমক দিয়ে বসিয়ে দিলেন। কারন আমি নিজেই ওইপাশে বসতে চেয়েছি, মামা নিষেধ করেছিলেন। মামাও হয়তো এতোটা সাংঘাতিক কিছু আঁচ করতে পারেননি! ততক্ষণে ভয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছি! এরপর মামা পুরোপুরি বুঝে যায়, কি সমস্যা হচ্ছে! তখন মামা নিজে সিটটা চেঞ্জ করে ওইপাশে বসেন। মামা চাইলেই একটা হেস্তনেস্ত করতে পারতেন। কিন্তু আমাদের কথা ভেবে চুপ করে গেছেন।

আব্বা আমাদের ৩ বোনকে এভাবে পাঠিয়ে সে রাতে কিছুতেই ঘুমাতে পারেননি। পরের দিনই আম্মাকে নানাবাড়ির উদ্দেশ্যে বাসে তুলে দেন। ছোটমামা আব্বার কাছে বকা খাওয়ার ভয়ে আমাকে হাওয়াই মিঠাই কিনে দিয়ে বশ করেছিলেন। তাই আর কোনদিনই এই ঘটনা তাদের কান পর্যন্ত পৌছায়নি।

(চলবে)

 

“স্বাতীর রঙধনু” (শিশুদের মনোজগত ভ্রমণ) পর্ব-৩

আফরোজা হাসান


এই পর্যন্ত লিখে থামলো স্বাতী। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হলো ভ্রু দ্বয়। রাত পনে একটা বাজে। বারোটার মধ্যেই চলে আসার কথা ছিল আরভের। ফিরতে কখনো দেরি হলে সবসময়ই ফোন করে জানিয়ে দেয়। আজ সেটাও করেনি।

নিজেই ফোন করার জন্য সেলফোনের সন্ধানে আশেপাশে খোঁজ করতেই মনে পড়লো নুবাইদ, উমায়ের আর নাযীব কে ঘুম পাড়ানোর সময় একবার এক ফ্রেন্ডের, আরেকবার ছোটমামার ফোন এসেছিল। তিন পুত্র মিলে তখন স্বাতীর কাছ থেকেও সেলফোন ছিনিয়ে নিয়ে বন্ধ করে রেখে দিয়েছিল ওদের টেবিলের ড্রয়ারে। মাকে কিছু সময় ওরা কারো সাথে শেয়ার করতে চায়না। ঘুমের সময়টা তারমধ্যে অন্যতম।

নাযীবের কথা মনে পড়তেই হেসে ফেললো স্বাতী। বয়স ছয় বছর হয়ে গেলেও এখনো কিছু কিছু শব্দ সঠিক ভাবে উচ্চারণ করতে পারে না নাযীব। এই যেমন “র” কে সবসময়ই “ল” উচ্চারণ করে। পরাপর দু’বার ফোন আসাতে ভয় দেখানো সূচক কন্ঠে বড় বড় চোখ করে স্বাতীকে উদ্দেশ্যে করে নাযীব বলেছিল, এক্ষুণি তোমাল মোবাইল বন্ধ কলে আমাল কাছে দাও। নয়তো কিন্তু তোমাল মোবাইল কমোডে ফেলে ফ্ল্যাশ কলে দেবো। স্বাতী সাথে সাথে বাধ্য মাতার মতো সেলফোন বন্ধ করে দিয়ে দিয়েছিল পুত্রদের কাছে। কিন্তু ওদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রুমে আসার সময় সেলফোনের কথা মনেই ছিল না। আরভ নিশ্চয়ই ফোন করেছে। সেলফোন বন্ধ থাকার কারণে যোগাযোগ সম্ভব হয়নি। বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত আছে ভেবে হয়তো ল্যান্ড লাইনেও কল দেয়নি। আজকের মতো লেখাতে সমাপ্তি টেনে ল্যাপটপ বন্ধ করে বাচ্চাদের রুমে রওনা দিলো স্বাতী।

দূর থেকে হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে গেলো স্বাতী। এতরাতে শ্বশুর সাহেবের এমন প্রাণখোলা হাসির কারণ একটাই হতে পারে। শ্বশুর সাহেব তাঁর প্রাণপ্রিয় বড় পুত্রের সাথে গল্প করছেন। তারমানে আরভ বাড়িতে ফিরে বাবার সাথে গল্পে মশগুল হয়েছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। একবার নাতী-নাতনীদের আসরে পৌঁছে গেলে পুত্রকে যে আর কাছে পাওয়া যাবে না এতদিনে খুব ভালো করেই বোঝা হয়ে গিয়েছে রায়হান সাহেবের। তাই গল্পের ইচ্ছে থাকলে আরভ বাড়িতে ফেরার সময় হলেই বাগানে গিয়ে বসে থাকেন। তা না হলে ছেলের সাথে কথা বলতে চাইলেও নাতীদের হাজারটা প্রশ্নের জবাব দিতে হয় তাকে। বিশেষ করে নাযীবের। চোখ বড় বড় করে ব্যারিস্টার সাহেব স্টাইলে নাযীব একের পর প্রশ্ন করতেই থাকে। কেন তুমি আমাল পাপাল সাথে কথা বলবে? তুমি দেখছো না পাপা আমাদেল সাথে খেলা কলছে? কেন আমাদেল কে বিলক্ত কলছো? আমাল পাপাল সাথে তোমালে কথা বলতে দেবো না। কথা বললে তোমালে কামল দেবো। দুইটা কামল দেবো। কামড় দেবার হুমকিটা নাযীবের একমাত্র অস্ত্র। এই অস্ত্রবলে নিজের মরজি প্রতিষ্ঠিত করে বাড়ির সবার উপরে। বাড়ির সবাই তাই সম্মিলিত ভাবে নাযীবের নাম রেখেছে “কামল বাবা”। কামল বাবার দুষ্টু-মিষ্টি কথা ও কর্মের স্মরণে অন্য আর সব ভাবনা বিস্মৃত হয়ে গেলো স্বাতীর মন থেকে। ঘুমন্ত বাব্বুটাকে দেখার ও আদর করার জন্য বাচ্চাদের রুমের দিকে ছুটলো।

চলবে…

পর্ব-২

 

নারীদের মলদ্বারের রোগঃ এনাল ফিসার, পাইলস, ফিস্টুল

ডা. মিথিলা ফেরদৌস


এক, দুই তারিখ ব্যাক্তিগত কাজে ছুটি নিয়েছিলাম। তিন তারিখে অফিসে গিয়ে দেখি দরজার সামনে কয়জন মহিলা দাঁড়ায় আছে। আমি অফিস গিয়ে নাস্তা করে রুগী দেখতে বসি। কিন্তু এটেন্ডেন্ট বলল ম্যাডাম এই কয়জনকে একটু দেখে দেন। এরা কয়েকদিন হলো ঘুরতেছে। কি আর করা।
প্রথমজনকে ডাকলাম। পুরান রুগী।গাজিপুর থেকে কয়দিন এসে ঘুরে গেছে।আমি অবাক বললাম ‘কেনো অন্য ডাক্তার ছিলো তো? ‘বলে ‘না,আপনার চিকিৎসায় আমার ব্রেস্টের সমস্যাটা ভালো হইছে, তাই আপনাকেই দেখাবো বলে আসছি। ‘এরপর আর কি বলবো। মন ভাল হয় এমন শুনলে। অন্য সমস্যা শুনে চিকিৎসা দিয়ে বিদায় দিলাম। পরেরজনকে পাঠাইছে আরেকজন রুগী। সেই রুগীর যে সমস্যা ছিল, একই সমস্যা তাই সে আমার নাম ধাম দিয়ে আমার হাসপাতালে আমার কাছে পাঠাইছে। সেও দূর থেকেই আসা।পর পর এমন কয় টা রুগী দেখলাম।প্রথমেই মন ভাল হয়ে গেলো। সবাই যে আমাকে পছন্দ করে তা না। সবার মন রক্ষা করা সম্ভবও হয় না। এত রুগী থাকে। তাদের অনেক গল্প থাকে। তারা তা বলতে চায়। কিন্তু শোনার সময় থাকেনা।তাই বাইরে গিয়ে কিছু শুনায় দিয়েও যায়।সরকারী হাসপাতালের ডাক্তারের ব্যবহার খারাপ কমন কথা। তবে ১০% ও যদি খুশি হয় তাহলেও মন ভালো হয়ে যায়।

আমার রুগী বেশির ভাগ মহিলা। তাদের ৪০% ব্রেস্ট এর,৪০% পায়খানার রাস্তার সমস্যা। আর ২০% অন্যান্য। ব্রেস্ট নিয়ে কিছু বলেছি আজ বলবো পায়খানার রাস্তার মেয়েদের সমস্যা।

যদিও পায়খানার রাস্তার সমস্যা দেখার জন্যে আলাদা জায়গা আছে, সেখানে পরিক্ষা নিরীক্ষা করে চিকিৎসা দেয়া হয়।তারপর ও প্রাথমিক যেসব চিকিৎসা দেয়া যায় সেই গুলা আমি দিয়ে থাকি।

তবে যেহেতু সার্জারিতে চার বছরের ট্রেনিং আছে এ সম্পর্কে আমার প্রচুর অভিজ্ঞতা। বিশেষ করে আমি যে স্যারের ট্রেনি ছিলাম। উনি ব্রেস্ট আর পাইলস ফিসচুলা মেয়েদের ছেড়ে দিতেন। ‘তোদের তো এইগুলা করেই খেতে হবে’ এই বলে। তাই প্রচুর ব্রেস্ট আর এনাল কেস অপারেশান করার সুযোগ হয়েছে।আর তাদের অনেক দুক্ষের কথাও জেনেছি। এই জন্যে আমি শ্রদ্ধেয় স্যারের কাছে কৃতজ্ঞ।

তাই এ ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই।মেয়েদের মুল যে সমস্যা, তা হলো কন্সটিপেসান। আর বেশি লজ্জার কারণে প্রাথমিক অবস্থায় তারা ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। ফলে রোগ গাড়ায় নিয়ে আসে। হাসপাতালে এসেও খোঁজে মহিলা ডাক্তার আছে কিনা? না হলে কবিরাজি।এই কবিরাজি যে কি ভয়ংকর তা আমি অনেক দেখেছি।

আমার মনে আছে, একবার এক মহিলার অপারেশান করার সময় তার পায়খানার রাস্তার মাংস খুলে খুলে আসতেছিলো।পুরা পায়খানার রাস্তায় দগদগে ঘা।পায়খানার রাস্তায় যন্ত্র কেন একটা আঙুল দিতে পারতেছিলাম না। অনেক কষ্টে তার পায়খানার রাস্তা বড় করে নতুন করে তৈরি করে দিয়ে আসতে হইছে। এই মহিলা আমার কাছে অনেকদিন পর অনেকদুর থেকে দেখা করতে এসে আমাকে টাকা দিচ্ছিলো, আমি রেগে গিয়েছিলাম ‘টাকা কেনো? ‘সে বলে ‘মা তুমি আমার মেয়ের মত আমি অনেকদুর থেকে আসছি তোমাকে বলতে আমি খুব কষ্টে ছিলাম, এখন আরাম পাইছি’। আমি বললাম ‘দোয়া করেন মা। ‘আমার এখনও মনে আছে মহিলা কাঁদতে কাঁদতে সূরা পড়ছিলো আর মাথায় গায়ে হাত দিয়ে ফু দিয়েছিলো। আমি অভিভুত,আপ্লুত। মাঝে মাঝে এইসবের জন্যে মনে হয় ডাক্তার হওয়া স্বার্থক।

জীবনে এমন অনেক সুখের স্মৃতি আছে আমার। সেইসব বলে বিরক্ত করবোনা।

পায়খানার রাস্তার সমস্যার উপসর্গ হলোঃ

শক্ত পায়খানা,
ফলে রক্তপরা,ব্যাথা, চুলকানো,বাড়তি চামড়া ঝুলে থাকা, কিছু বের হয়ে আসা ইত্যাদি। এছাড়া পায়খানার রাস্তার আসে পাশে ফোঁড়া হয়ে ফেটে যায়, অপরিচ্ছন্নতার কারনে। তারপর তারা কোন ডাক্তারে শরনাপন্ন হয় না, যার ফলে এই ফোঁড়া অনেক ভিতরে চলে যায়। একে বলে ফিস্টুলা। কখনও কখনও অনেক বড় অপারেশান লাগে এই জন্যে।

এছাড়া হিমোরয়েড বা পাইলস একটি কমন সমস্যা। এতেও যদি প্রাথমিক অবস্থায় কেউ আসে। ডায়েট, ড্রাগ দিয়ে সারানো সম্ভব।

সবচেয়ে কমন যে সমস্যা, তাহলো ফিসার বা পায়খানার রাস্তা ফেটে যাওয়া, এইটা খুব পেইনফুল। সাধারণত বাচ্চা হবার পর অনেক মেয়ের এই সমস্যা হয়।প্রাথমিক অবস্থায় চিকিৎসা করলে ভাল হয়ে যায়। না হলে ঘা হতে হতে একসময় পায়খানার রাস্তা ছোট হয়ে যায়। তখন অপারেশান ছাড়া এর চিকিৎসা করা সম্ভব হয় না। আমি বেশির ভাগ রুগীর পায়খানার রাস্তা ছোট করে নিয়ে আসা দেখেছি। কারণ ইনডোরে কাজ করলে এইসব বেশি দেখা যায়।

এছাড়া পায়খানার রাস্তা বের হয়ে যাওয়া বা প্রোলাপ্স, ক্যান্সার, পলিপ(বংশগত ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রুপ নেয়), পায়খানার রাস্তা প্রস্রাবের রাস্তার সঙ্গে লেগে যাওয়া(দাই দিয়ে বাচ্চা হবার ক্ষেত্রে টানা হেচড়ায়)। অনেকে সিজারের বিপক্ষে অনেক কথা বললেও আমি বলবো আমি এ ক্ষেত্রে সিজারের পক্ষেই অবস্থান নিতে চাই।

পায়খানার রাস্তার সমস্যা মেয়েদের বেশি হয় কারণ, তাদের লজ্জার জন্যে রোগের বারোটা বাজায় তারপর ডাক্তাদের কাছে যায়। সবচেয়ে বড় কথা সচেতনতা।

ডাক্তারদের ক্ষেত্রে কেনো ছেলে মেয়ে বিচার করতে হবে? এইটা,শরীরের একটা অংশ। এতে লজ্জার কিছু নাই। তবুও যদি লজ্জাই পান তাহলে বলবো দেশে এখন মোটামুটি সব জেলায় মহিলা সার্জন আছে। খোঁজ নিয়ে তাকে দেখান। তবুও রোগ নিয়ে বসে থাকবেন না বা কবিরাজি করবেন না। আরও আশার কথা দেশে খুব কম হলেও কলোরেক্টাল মহিলা সার্জন আছেন। অদূর ভবিষ্যতে আরও অনেকেই আসবেন ইনশাআল্লাহ।

বেশি করে পানি খাবেন, শাক সবজি খাবেন। পায়খানা নরম রাখবেন আর পায়খানার রাস্তার কোন সমস্যা হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিবেন।আপনাদের সুস্থতাই আমার কাম্য।

 

নি‌জের জানটা আগলা

হাবীবাহ্ নাসরীন


 

সব দেখেশুনে চুপ হয়ে যা, কথা কস না ‌রে পাগলা
যে মরে মরুক, তুই বেঁচে থাক, নিজের জানটা আগলা!

ভাই লাথি খাক, বোন ঘুষি খাক, তুই খাবি মাছ গোশতো
ছোটাছুটি বাদ, মরিবার সাধ? চুপ হয়ে তুই বোস তো!

একটা সাধের প্রাণ পেয়েছিস বেঁচে থাকবার সম্বল
সেটিও খোয়ালে তুই ভেবে বল কার তাতে হবে মঙ্গল!

তিনবেলা খাস, চুল আঁচড়াস, ভদ্রলোকের কারবার
দ্যাখ ফুটবল, গা বাঁচিয়ে চল, দেশ পুড়ে হোক ছাড়খার!

জেগে থেকে আর লাভ কী রে বল, ঘুমালে তবেই হবে ভোর,
গুম হয়ে যাবি নাকি রে ঘুমিয়ে- সিদ্ধান্তটা শুধু তোর।

 

“স্বাতীর রঙধনু” (শিশুদের মনোজগত ভ্রমণ) পর্ব-২

আফরোজা  হাসান


নিজ জীবনের আলোকে, আমার বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে বুঝেছি শরীয়তের বিধান সমূহকে জীবন ধারণের অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মতোই দেখতে হবে। অর্থাৎ, ক্ষুধা লাগলে যেমন খাদ্যের সন্ধানে যাই, ঘুম পেলে যেমন ঘুমোতে যাই, আযান শুনলে তেমন নামায পড়তে যাবো। এখানে স্পেশাল বলে কিছু নেই। খাদ্য আর ঘুমের অভাবে যেমন আমার শরীর ঝিমিয়ে যাবে, নামাযের অভাবে ঝিমিয়ে যাবে আত্মা। আর সুস্থ জীবন যাপনের জন্য শরীর ও আত্মা দুটোই চনমনে থাকা প্রয়োজন।

আমার প্রতিটা সন্তানেরই নিজস্ব একটা করে স্বপ্ন আছে তাদের নিজ নিজ জীবনকে ঘিরে। যে কোন কাজই ওদেরকে দিয়ে করিয়ে নেয়া যায় শুধুমাত্র তাদের স্বপ্নটা মনে করিয়ে দিলে। আমি আর ওদের বাবা শুধু ভালোবাসা আর আদর দিয়ে ওদের মনে আরেকটা স্বপ্ন গেঁথে দিয়েছি। তবে শুধু মুখে বলে না স্বপ্নটা গেঁথে দিয়েছি আমাদের কথা, কাজ, আচার-ব্যবহার দ্বারা। মুখে সারাক্ষন উপদেশ পরামর্শ দিতে আমরা নারাজ। এতে বাচ্চারা বিরক্তও হয় মনে মনে। আমরা তাই করে দেখানোতে বিশ্বাসী। বাচ্চাদের ঘুম থেকে উঠানোর সময় জড়িয়ে ধরে আদর আর শুভ সকাল বলার আগে সালাম দিতে কখনই ভুল করিনা আমরা। আস্তে আস্তে ওরা বুঝে নিয়েছে ঘুম থেকে উঠার পর সালাম দেয়াটাই ওদের প্রথম করণীয়।

আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের পরিবারের সবার জীবনের প্রতিটা সকাল একে অপরের কল্যাণ কামনার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়। ঠিক একই ভাবে খাবার আগে বিসমিল্লাহ বলে, খাবার শেষে আলহামদুলিল্লাহ বলে, কোন কাজ করার চিন্তা করলে ইনশাআল্লাহ বলে, বিস্ময় বা মুগ্ধতা প্রকাশে সুবহানাল্লাহ বলে বলেই আমরা বাচ্চাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছি ওদের করণীয়। বার বার বলার চেয়ে আসলে নিজে করে দেখানোটাই অনেক বেশি সহজ। আর বাচ্চারা যেহেতু স্বভাবতই অনুকরণ প্রিয় তাই এভাবে শেখালে নতুন কিছু শিখছে ভেবে আরেকটা বোঝা ভাবারও সুযোগ থাকে না। এভাবেই আমরা অনেক কিছু শিখিয়ে ফেলতে পারি বাচ্চাদের খুব সহজেই। নিত্য প্রয়োজনীয় দোয়া গুলোও এভাবে শিখিয়ে ফেলা যায়। খুব অল্প সময়েই আমার বাচ্চারা নিত্য প্রয়োজনীয় সব গুলো দোয়া মুখস্থ করে নিয়েছিল। অথচ টেরই পায়নি আমরা ওদেরকে দিয়ে স্পেশ্যাল কিছু করিয়ে নিচ্ছি।

শিশুর আয়না বা রোল মডেল হল তার বাবা-মা। শিশু তার বাবা-মাকে দেখতে দেখতে এবং অনুকরণ করে বেড়ে ওঠে। তাই আমরা নিজেরা ভালো মানুষ না হলে আমাদের বাচ্চারাও ভালো মানুষ হবেনা। সৌভাগ্য গুনে যদি হয়েও যায় প্রতিকূল পরিবেশে গেলেই তার মধ্যের প্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। যেহেতু গড়ে ওঠার পথটা ইতিবাচক ছিলনা তাই নেতিবাচক চিন্তাটাই তাদের মনে আগে দোলা দেয়। চাঁদ দেখলে মুগ্ধ হবার বদলে নিজের অজান্তেই তারা চাঁদের দাগ খুঁজতে শুরু করে। কারন চলার পথে তারা শেখেনি যে পৃথিবীতে নিখুঁত বলে যেহেতু কিছু নেই, কেউ নেই সেহেতু জীবনের সার্থকতা দাগকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা ক্ষমা করে দেবার মধ্যেই। শিশুর আত্মিক বিকাশে মুখ্য ভূমিকা পরিবার -কেই পালন করতে হয়।
পরিবার যদি আত্মিক বিকাশের পথকে সুগম করে দিতে পারে, তাহলেই সম্ভব হয় শিশুর আত্মার বিকাশ। তবে এর সাথে সাথে ছোটবেলা থেকেই শিশুকে দায়িত্বশীল ও সচেতন হিসেবেও গড়ে তুলতে হবে। কেননা আত্মিক বিকাশের মূল দায়িত্ব ব্যক্তিকেই পালন করতে হয়। যেমন, কোন একটি বাগানের মালী পানি দিয়ে সার দিয়ে যত্ন করে বাগানের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করতে পারে, কিন্তু মালী চাইলেই ফুল ফোটাতে পারেনা। তাই ভালো-মন্দ, কল্যাণ-অকল্যাণ, দোষ-গুণের মধ্যে যাতে পার্থক্য নির্নয় করতে পারে সে শিক্ষাও ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে শিশুকে। যাতে জীবনে চলার পথে নিজ বিবেচনার দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। শিশু তার আশেপাশের প্রতিটা ঘটনা থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। শুধু তার সাথে অন্যদের সম্পর্ক বা আচরণ থেকেই নয় বরং তার আশেপাশের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক থেকেও সে শেখে। তাই বাবা-মা ছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্য, আশেপাশের মানুষজন, এমনকি স্কুলের পরিবেশও শিশুর চাল-চলন, আচার-আচরণ, কথাবার্তাকে প্রভাবিত করে। প্রভাবিত করে তার গ্রহণ-বর্জন ক্ষমতাকেও।

চলবে….

পর্ব -১

 

আমার বই পড়া (শেষ পর্ব)

রায়হান আতাহার


ছোটবেলা থেকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ ছিল। পড়তে ভালোবাসতাম। নতুন বই পেলেই পড়ার জন্য উশখুশ করতাম। সেই আমি হঠাৎ করে বইয়ের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার সময় এত পড়ার চাপ ছিল যে, এরপর থেকে বই দেখলেই কেন যেন অভক্তি কাজ করতো। একেবারে না পড়লে নয়, ওটুকুই পড়তাম পরীক্ষা পাশের জন্য। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই বলতে গেলে পড়াই হত না। এই সময়টাতে যা পড়েছি তার একটা বড় অংশজুড়ে ছিল স্যার হেনরি রাইডার হ্যাগার্ডের বই। টানা বেশ কয়েকটা বই পড়েছি তাঁর। লেখাগুলো ভালো লাগতো। কিন্তু নেশা তৈরি করতে পারেনি।

ফেসবুকিং আর মুভি দেখে সময় পার করে দিচ্ছিলাম। এমন সময় বইপড়ুয়া কিছু মানুষের সান্নিধ্য পেলাম। তাদের বই পড়া, বই নিয়ে আলোচনা, ফেসবুকে পোস্ট দেখে বই পড়ার আগ্রহ আবার ফেরত আসলো। আমি বিশ্বাস করি, বই পড়তে দেখলে ও বই পড়ুয়াদের সান্নিধ্যে থাকলে বই পড়ার স্পৃহা তৈরি হয়। আমার মাঝেও তাই হয়েছিলো।

নতুন করে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ জন্মানোর পর বইয়ের প্রতি আমি বলতে গেলে সর্বভুক হয়ে গেলাম। সবার লেখাই পড়তে ভালো লাগতো। এর মাঝে পরিচয় হয়ে গেল আহমদ ছফার সাথে। বাংলাদেশের সবচেয়ে আন্ডাররেটেড লেখকদের তালিকা তৈরি করলে আহমদ ছফার নাম প্রথমে থাকবে। তাঁর লেখা প্রথম যে বইটি পড়েছি, তা হলো ‘যদ্যপি আমার গুরু’। ছফা ও প্রফেসর আবদুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয় হবার পর নিজের মাঝে পরিবর্তন আবিষ্কার করতে লাগলাম। ছফার আরো কিছু বই পড়েছি এবং এখনো পড়ছি। প্রতিটি লেখাতেই মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন প্রিয় এই লেখক।

আহমদ ছফার লেখার প্রতি ভালোলাগার পাশাপাশি আরো কিছু লেখকদের বই পড়েছি এবং এখনো পড়ছি। বই পড়ার ক্ষেত্রে আমার প্রাথমিক লক্ষ্য হলো, সেরা লেখকদের সেরা বইগুলো পড়ে ফেলা। নতুন-পুরাতন সবার সেরা বইগুলোর নাম দিয়ে একটি ‘বাকেট লিস্ট’ বানানো আছে আমার। ভালো কোন বইয়ের সন্ধান পেলেই ঐ লিস্টে যোগ করে রাখি। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘কবি’ উপন্যাসে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, “হায়, জীবন এত ছোট কেনে?” বই পড়ার ক্ষেত্রে এ কথাটি আরো বেশি প্রযোজ্য। জানি না, তালিকার কত ভাগ বই পড়তে পারবো।
তবে জীবনের শেষভাগে এটুকু তৃপ্তি পেতে চাই যে ভালো কিছু বই সংগ্রহ করেছি ও পড়েছি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বই পড়ার নেশা ধরিয়ে দিয়ে যেতে পারলে জীবনের চাওয়া-পাওয়ার একটি বড় অংশ পূরণ হবে। সৃষ্টিকর্তা মনের ইচ্ছা পূরণ করুন।

Raihan Atahar
Postgraduate Researcher at Bernal Institute
Material and Metallurgical Engineering at BUET

 

ফাল্গুন

নিবরাজ জাহান হুজায়রা


বিসমিললাহ্ হির রহমানির রহিম, আসসালামুয়ালাইকুম সন্মানিত ভাই ও বোনেরা যাত্রা পথে আপনারা নিরাপদ ভাবে বাড়ীতে পৌঁছে যান এই কামনায় শুরু করছি। এই যে দেখছেন আমার কাছে একটা কলম এটা যে সে কলম নয় এর এক দিকে কালো কালি অন্যদিকে লাল কালি, এই একটি কলম বাইরে থেকে কিনলে দাম পড়বে ৫০ টাকা, কোমপানি দিবে ৩০ টাকা আর আমার থেকে কিনলে দাম পড়বে মাত্র ১০ টাকা,১০ টাকা !!আপনার সোনামণির জন্য একটা কিনে নিয়ে যান” এই কথা গুলো নিত্য শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে সুষমার,সুষমা ভাবে এরা প্রতিদিন কত টাকার কলম বিক্রি করে?
সুষমার ভাবনার মধ্যে ছেদ পরে পাশের খালাম্মা গোছের এক মহিলা দাঁড়িয়ে থাকতে ব্যালানস করতে অসুবিধা হচেছ তাই উনার কুনুইয়ের গুতো খেয়ে সুষমা বাস্তবে ফিরে এল খালাম্মা ওর দিকে তাকিয়ে একটা ফিকে হাসি দিলেন। সুষমা লক্ষ্য করল ওদের সামনেই দুই হাতের কর ভরে লাল মেহেদি দিয়ে এক তামাটে রং এর যুবক ৩২টা দাঁত বের করে জনৈক মেয়ের সাথে বাজে রসিকতা করছে অথচ এক বারের জন্য ভাবছে না মার বয়সী এই মহিলাকে বসতে দেয়া ওর সামাজিক দায়িত্ব। সুষমা বাসের ভেতরেই একটা টিপ্পনিও শুনতে পেল, একটা অল্প বয়সী মেয়ে বেশ বুঝা যাচেছ বাসে উঠার পূর্ব অভিজ্ঞতা তার নেই, তাই ইচ্ছাকৃত বিশেষ অজ্ঞের খোঁচার থেকে বাঁচতে একটা আর্তনাদ করে উঠেছিল,ব্যাস আর যায় কোথায়,অমনি ২জন সম-স্বরের চেঁচিয়ি উঠল, এত বড়লোকি তো বাসে কেন পেরাইভেটে চড়লেই তো হয়, ২ জনেই এই কথা বলে সেকি বীভৎস হাসি, বেচারা অপমানে লাল হয়ে চোখের পানি সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সুষমা শাহবাগ থেকে রামপুরা যাবে মোঘোল আমলে বাসে চড়েছে এখনও ৭১ সালেই এসে পৌছায়নি কখন ২০১৮ তে আসবে তার হিসাব খোদ ড্রাইভার সাহেবও বলতে পারেননা…… আর সিট তো সোনার হরিণ, সুষমাতো মাকে বলেছিল নামায পড়ে ওর জন্য দোয়া করতে একটা সিট যেন ও পায় কিন্তু বিধি বাম, যখন বাসে উঠেও দেখতে পায় কোন জনৈক সৌভাগ্যবান জানালার ধারে বসে মহা সুখে ঘুমাতে ঘুমাতে পরে যাচেছ তখন সত্যি সুষমার রাগ, হিংসা কান্না সব এক সাথে পায়।
জোরে ব্রেক করে বাস এসে থামল কাকরাইল স্টপেজে, ওমনি হুরমুর করে অনেকের সাথে সুষমাও নিজেকে সামলে নিল পরে যাবার থেকে। কেউ ধাক্কা দিতে দিতে এবং ধাক্কা খেতে খেতে নামল, উঠল। এই ফাঁকেই শুরু হয়ে গেল মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা এবার সুষমা জিতে গেল, বসতে পারল সোনার হরিণ নামক সিটে, ওখানে আগে থেকেই একজন বসে ছিল এবার আরেক যাত্রী উঠল (বয়স আনুমানিক ৩৫/৩৭ হবে) পাশেই হেল্পপারের সাথে এক কলেজ ড্রেস পরা ছেলের সাথে বেশ গরম কথাবার্তা চলছে হাফ পাশ আছে কি নেই তা নিয়ে। ২০ টাকা ভাড়া ৮ টাকায় রফা হলো, এবার এলো সুষমাদের দিকে নতুন যাত্রীকে হেলপার বলল আনটি বাড়াডা……
বোমটা ফাটল এখন, উনি ২৫ টাকার ভাড়া মেটালেন ৫ টাকা দিয়ে, হেল্পার তেড়ে প্রশ্ন করল কই যাবেন,;উনি তার চাইতে ক্ষিপ্র গতিতে উত্তর দিলেন কি মনে করছ আমরা হিসটুডেনট(student)।হেল্পার বেচারা খুবই কমজোরি গলায় বলল “এ্যাঁ!!” উনি আবার বলে উঠলেন হ্যাঁ, আমরা হিসটুডেনট আমাদের বাড়া এডাই। হেল্পার কোন কথা না বলে ওই ৫ টাকা নিয়ে ওই স্থান ত্যাগ করল। এবার মৌচাক থেকে একজন মেয়ে উঠল, উঠেই সুষমার পাশে বসে থাকা যাত্রীকে খুবই করুণ স্বরে অনুরোধ করল, আপু আমার মোবাইলে কোন ব্যালানস নেই একটা ইমার্জেনসি কল করা যাবে? মহিলা সাথে সাথে ফোনটাএগিয়ে দিল মেয়েটাকে। সে ফোনে বলে উঠল” আসসালামুয়ালাইকুম হ্যাঁ, আব্বা আইসেননি বাসায়, হুনেন আমি মাছ রান্না করচি আপনের কিছু করন লাগব না শুধু বাতটা বসাই দেন, ইছ মিষ্টি কোমবা(কুমড়া) আমি খাই না আননে খাইলে রানদেন, আমি আসি খাট্টা(টক)রান্না করি দিব” ইমার্জেনসি কলের নামে বাপ-মেয়েতে এমন আলাপ চারিতায় জনৈক ভদ্রমহিলা রীতিমত কাঁদো কাঁদো চেহারা করে সুষমার দিকে চাইল………।
এগুলো সুষমা প্রতিদিনই দেখে
যখন বাসে চড়ত না তখন ফাল্গুন নামটা দেখে সুষমা আপন মনে গুনগুনি উঠত,’
কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস……।
আমার সর্বানাশ…’এখন সুষমা মিলিয়ে দেখে আসলেই তো সর্বনাশ, না সর্বনাশও ঠিক ক না এই ফাল্গুন বাসে না উঠলে জীবনের এই দিকটা সম্পর্কে, এত বিচিত্র মানসিকতা সম্পর্কে একদম অজানা থেকে যেত। জীবনের সব কষ্ট থেকেও শেখার আছে।

নিবরাজ জাহান হুজায়রা
কাউন্সিলিং সাইকোলজিষ্ট

 

“স্বাতীর রঙধনু”-(শিশুদের মনোজগত ভ্রমণ)পর্ব-১

আফরোজা হাসান


বাচ্চাদের মধ্যে মূল্যবোধ থেকে নিয়ে শুরু করে ধর্মবোধ সবকিছু ঢোকানো ই অনেক বেশি সহজ। কারন বাচ্চারা একটা কথা শুনেই বিচার করতে বসে যায়না। যুক্তি-তর্ক বা অভিজ্ঞতার আলোকে যাচাই করতে চায়না। দোষ-গুনও মাপতে বসেনা। শুধু একটু কষ্ট করে ওদের বুঝিয়ে বলতে পারলেই ওরা মেনে নেয় এবং সর্বাত্মক চেষ্টা করে সে মতো কাজ করার। কখনোই বড়দের মত জাজমেন্টাল হয়ে সব কথার পেছনে “কিন্তু” খোঁজে না। সুন্দর করে কিছু বললে ওরা মুগ্ধ হয়, কখনোই ভাবেনা যে এত সুন্দর করে কথা বলছে “রহস্যটা” কি? যে কথা শুনে একটা শিশু চোখ বড় বড় করে আগ্রহ নিয়ে তাকায়, একই কথা বয়স্ক কাউকে বলতে গেলে চোখ সরু করে তাকায়। বাচ্চারা অতিরিক্ত আন্তরিকতা দেখলে খুশি হয় আর বড়রা সন্দেহে পরে যায় আন্তরিকতার পেছনে কোন “উদ্দেশ্য” আছে কিনা ভেবে। সুন্দর কোন পরামর্শ দিলে ছোটরা মুখভরা হাসি দিয়ে ধন্যবাদ জানায় আর বড়রা ভাবে নিজের “জ্ঞান” জাহির করতে এসেছে। না আমি ছোটদের প্রশংসা আর বড়দের সমালোচনা করতে লিখছিনা। বাচ্চাদের সাথে প্রচুর সময় কাটানোর ফলে এই পার্থক্য গুলো নজরে পড়েছে। আমাকে একজন পরামর্শ দিয়েছিলেন-“ ঘরে বসে কেউ যদি শুদ্ধ মানুষ হতে চায় তার উচিত বাচ্চাদের সাথে সময় কাটানো। সমাজকে পরিবর্তন করতে চাইলে তার উচিত বাচ্চাদের নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা। কারো জীবনের স্বপ্ন যদি থাকে একজন মানুষকে হলেও আলোকিত করবে তার উচিত একটা বাচ্চাকেই বেছে নেয়া। কারন বাচ্চারা জার্জ হয়ে বিচার করতে বসবেনা, সমালোচক হয়ে সমালোচনা করবেনা। বাচ্চাদের মন যেহেতু পবিত্র নিন্দা, গীবত বা অপবাদের স্বীকারও হতে হবেনা।” এখন বড় হয়ে তো আর কেউ জন্মগ্রহন করেনা। এরঅর্থ হচ্ছে বাচ্চা থেকে বড় হবার পথে হাঁটতে হাঁটতে শুদ্ধতা হারায় একজন মানুষ।

একটি শিশু যাতে বড় হয়ে একজন আদর্শ মানুষ হতে পারে তারজন্য সবচেয়ে জরুরি সঠিক অভিভাবকত্ব। একমাত্র সঠিক অভিভাবকত্বই পারে একটি শিশুকে সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে তাকে সুখী সুন্দর এবং উন্নত জীবনবোধ দিতে। শিশুকে গড়ে তোলার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ জীবনের প্রথম ৫-৬টি বছর। গবেষণার দ্বারা এটা প্রমাণিত যে ৪-৬ বছর বয়সে একটি শিশু নিজেকে নিয়ন্ত্রণের যে দক্ষতা অর্জন করে তাঁর উপর নির্ভর করেই পরবর্তিতে পরিচালিত হয় তাঁর জীবনের গতিপথ। শিশুর জন্মের প্রথম ৫-৬টি বছর যেহেতু বাবা-মাই থাকে তার সব। সুতরাং তারাই পারেন তাদের শিশুকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে এবং এই মূল্যায়নটুকুই শিশু সারাজীবন বহন করবে। সাধারণত এতো ছোট বয়সে শিশুদের পরিকল্পনা মাফিক কিছু শেখানো হয়না। অথচ এই বয়সেই শিশুরা শেখে সবচেয়ে বেশি। আবার যারা পরিকল্পনা মাফিক শেখাতে চেষ্টা করেন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের পরিকল্পনাটা বাচ্চাদের জন্য খুব বেশি কষ্টকর হয়ে যায়। যার ফলে পরিকল্পনা থাকলেও তা থেকে শিশু বা অভিভাবক কেউই তেমন উপকৃত হতে পারেননা। তাই বুদ্ধিমান অভিভাবক হচ্ছেন তারাই যারা বাচ্চার ধারণ ক্ষমতার কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন কৌশলে প্রয়োজনীয় শিক্ষার মাধ্যমে বাচ্চাকে গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করে। আমি খুব বেশি জানিনা। আমার জীবনের গণ্ডিটাও খুব ছোট। কিন্তু একজন আদর্শ মা হতে চাই। এমন সন্তানের মা বিচার দিবসে যার কাছ থেকে আমাকে পালাতে হবেনা। কি কষ্ট একটা শিশুকে অচেনা অজানা একটা জগত থেকে পৃথিবীতে নিয়ে আসা তা বাবা-মা দুজনেই জানেন। আমি একজনকে ক্রেডিট দিতে চাইনা। কারন আমাদের প্রতিটা সন্তানের জন্মের পর আমার মতোই কষ্ট স্বীকার করতে ওদের বাবাকেও দেখেছি। কত আদর কত ভালোবাসায় কত যত্নে আমরা গড়ে তুলি একটি সন্তানকে। যে সন্তানের সামান্য একটু জ্বর হলে সারারাত ঘুমোতে পারিনা। তাকে আগুনে জ্বলতে কিভাবে দেখবো আমি? পরকালে নিজের চিন্তায় নাহয় ভুলে যাব মাতৃত্বকে কিন্তু এখন?

আমার সন্তানরা যাতে ছোট থেকে বড় হবার পথে নিজের শুদ্ধতাকে হারিয়ে না ফেলে তার খেয়াল রাখার দায়িত্ব তো আমার। এখন তো “অবুঝ” ভেবে আমরা বাচ্চাদের গড়ার সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ন সময়টাকে হেলায় খেলায় চলে যেতে দেই। নিজেকে দিয়েই ভাবি বিশ বছর আগে বাবার কথা কত সুন্দর মনে হতো আর মেনেও নিতাম বিনা দ্বিধায়। মেনে চলতে চেষ্টা করতাম আপ্রাণ। কিন্তু এখন বাবা কিছু বললে যাচাই করতে লেগে যাই। দুই বছর আগে আমার পাঁচ বছর বয়সি ছেলেটাকে নতুন কিছু শেখানো যতটা সহজ ছিল এখন আর তা নেই। সাত বছরের ছেলেটার যুক্তি শুনে অবাক না হয়ে পারিনা মাঝে মাঝে। একেকটা দম্পতি তাদের সন্তানকে একেক ভাবে একেক আদর্শে গড়ে তুলতে চান। নিজে মুসলিম হবার কারনে আমি চাই আমার সন্তানকে ইসলামের আলোকে গড়ে তুলতে। আর এরজন্য খুব বেশি কিছু করিনি আমি। আসলে একটু সতর্ক হলে বেশি কিছু করার প্রয়োজনও পড়ে না।

চলবে…

 

মনে হচ্ছে, আমি আর বাঁচবোনা (২)

 প্রবাসী মজুমদার


ফাহিম তাসনিয়া গাড়ির পেছনে নিশ্চুপ বসে আছে। কোন শব্দ নেই। অন্য দিনের মত ভাই বোনের মাঝে আজ ঝগড়া নেই। চিমটি কাটা কাটি নেই। অভিযোগের সুরে তাসনিয়া বলছেনা

– এ মাম্মি দ্যাখ। ভাইয়া আমাকে মুখ ভেংচী দিচ্ছে।

– এ ফাহিম.. ধমক দিতে, মাম্মি আমি কি করিছি। ও খালি খালি আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে।

– তাসু। ও তোমার বড় ভাই না।

– তোমরা খালি আমাকে বকা দাও। রাগ করে তাসনিয়া চুপ মেরে গেছে।

আজ তাদের মাম্মি অসুস্থ। কারো মুখে কোন শব্দ নেই। দুষ্টমি ও নেই।

আগামী কাল সকালে তাদের স্কুলের ক্লাস টেষ্ট। কিন্তু মায়ের অসুস্থতায় পরীক্ষার কথা ভুলে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। নিষ্পাপ শিশু দুটি গাড়ির জানালা দিয়ে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে মিছে প্রকৃতি দেখার ভান করছে।

রাস্তায় চলতে চলতে হাজারো কথা মনে উকি দিলেও বার বার এড়িয়ে যাচ্ছি। নাজুকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছি। ও বলেই যাচ্ছে, আমার কেন এমন হল। ও তো সব কিছুই কন্ট্রোল করে চলে। আবার বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলে কতগুলো কষ্টের কথা মুখ থেকে বের হয়ে আসতেই আমি পাশ কাটানোর চেষ্টা করছি।

ও খুব নরম মনের। জীবনে কাউকে কষ্ট দিয়েছে কিনা তার জানা নেই। তাই আজ তার নিজের কাছে প্রশ্ন, আমার এমনটি হবে কেন? আমিতো কারো ক্ষতি করিনি। সব পরীক্ষা আমার জন্য হবে কেন?

…এতক্ষণে হাসপাতালে গেটে এসে পৌছে গেছি। রাত আনুমানিক পৌনে বারোটা। হাসপাতালের বাহিরে নীরব নিস্তব্ধতা। গাড়ি টা পার্কিং করে বের হতেই দুর থেকে দেখছি, ডাক্তার সিহাব উদ্দীন আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। তার এ আগ্রহ আর সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসার ঢং দেখে মনটা ভরে গেল।

আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে সোজা রিসিপশনে নিয়ে গেল। আমার পকেটের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন

– আপনার ইকামাটা দিন।

– নেই।

– মানে?

– এক বছর হল মেয়াদোত্তীর্ন হয়ে গেছে। স্পন্সার সমস্যা।

– আরে…তাহলে এখন কি করা যায়। মাথায় চুল খোঁচাতে খোঁচাতে ডাক্তার সিহাব উদ্দীন উপায় খুঁজছেন। কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে নিজের পকেট হতে মানি ব্যাগটা বের করে বলল,

– ভাবী, আপনি ভেতরে বসুন। ভাই, আপনি অপেক্ষা করুন। আমি আসছি – বলে সোজা ভেতরে চলে গেলেন।

অজানা ভয় নিয়ে এক পাশে দাড়িয়ে আছি। স্ত্রীকে বুঝতে দিচ্ছিনা যে আমি খুব চিন্তিত। শুধু বলছি, দুত্তরি। এটা কোন রোগই নয়। হয়তবা মাসল ব্যথা। কোন বিষয়ে ফাইনাল জানা ছাড়া এত ভয় করা উচিত নয়। তাহলে মনের বাঘেই তোমাকে কাবু করে ফেলবে। কিন্তু মন যতই অভয় দিক না কেন, রোগীর মন যে মানে না।

এতক্ষণে ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে দ্রুত গতিতে ভেতর থেকে আসতে দেখে মনে হল, কিছু একটা করে এসেছে। রিসিপশনের পেছনের গেট দিয়েই সোজা ভেতরে চলে গেলেন। কর্তব্যরত ডাক্তারের সাথে ফিস ফিস করে কি যেন বললেন। তার পর একটা কাগজ নিয়ে বের হয়ে এসে বললেন

– চলুন। কাজ হয়ে গেছে।

– মানে?

– আমার ইকামা দিয়ে ইমারজেন্সী ডিপার্টমেন্ট এর হেডকে বলেছি, আমার বন্ধুর স্ত্রীর সমস্যা। ইকামা নবায়ন করতে দিয়েছে। ভাবীর অবস্থা খুব খারাপ। এমতাবস্থায় আমার ইকামা দেয়া ছাড়া উপায় নেই। ভাগ্যিস ডাক্তার ভ্রু না কুচকিয়েই অনুমতিটা দিয়ে দিল। হাসপাতালের যে অবস্থা, সৌদিরাও এখন ট্রিটমেন্ট নিতে হিমশিম খেতে হয়।

ইমারজেন্সীতে গিয়েই দুতিনটা নার্সকে এক করে নাজুকে আপন লোক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিলেন। দুর থেকে দাড়িয়ে দেখলাম, নার্সগুলো নাজুকে দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। মুহুর্তেই কয়েকটা টেষ্ট করে ফেলল। টেষ্ট গুলো ফলাফল আসতে যাতে বিলম্ব না হয়, তাই ডাঃ সিহাব উদ্দীন নিজেই সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টে গিয়ে রিপোর্টের অনুমোদন নিয়ে কম্পিউটারাইজড করে ফেললেন।

কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, আমাকে ফলো করুন। বিশাল হাসপাতালের আঁকা বাকা গলি দিয়ে হেটে কখনো ডানে, কখনো বামে, আবার কখনো লিফট বেড়ে চার তলায় নিয়ে গেলেন। বললেন, এখন যার কাছে যাবো, তিনি এ হাসপাতালের সব চেয়ে বড় হার্ট স্পেশালিষ্ট। সব চেকআপ সেরে সিরিয়ালে তার কাছে আসতে তিন দিন লাগে। তাই আপনাদের সরাসরি নিয়ে আসলাম।

সালাম দিয়ে ডাক্তারের রুমে ঢুকেই আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। বিস্তারিত খুলে বলে ফাইল নাম্বারটা দিলেন কম্পিউটারে সব রিপোর্ট দেখার জন্য। ডাক্তার এক নজর দেখে চেয়ার থেকে উঠে আমাদের নিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসলেন। নার্সকে বললেন একটি সীট খালি করে দিতে। কিছুক্ষণ পর নাজুর প্রেসার মাপতে মাপতে জানতে চাইলেন

– আপনার ব্যথাটা কোন দিকে?

– বা দিকে।

– এটি কি প্রথম?

– জ্বী।

– অন্য কোন রোগ আছে?

– আছে। ডায়াবেটিকস।

– সুগার কি কন্ট্রোলে?

– জ্বী।

– সিড়ি বেড়ে উঠতে কি ব্যাথা করে?

– না।

– জোরে হাটলে?

– না।

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন, ইকো টেষ্ট করতে হবে। এটি ছাড়া হার্টের গতিবিধি হুবহু বুঝা যায়না। আর হার্ট বিষয়ে অনুমান নির্ভর কোন সিদ্ধান্ত দেয়া বিপদজনকও বটে।

ডাক্তার সিহাব উদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য
ডাক্তার সিহাবউদ্দীন পাশেই ছিলেন। বললেন, ইকো টেষ্টের জন্য তুমি যদি একটা অনুমোদন দিয়ে দাও, তাহলে ভাল হয়।

ডাক্তার রিসিপশনের একটি কম্পিউটারে নিজস্ব পাসওয়ার্ড দিয়ে ঢুকে অনুমতি দিয়ে দিলেন। এ হাসপাতালে যত রুগী ইমারজেন্সীতে এসেছে, সবার রিপোর্ট গুলো রিসিপশনে ডিসপ্লেতে রাখা কম্পিউটার স্ক্রীনে স্ক্রলিং হচ্ছে। তাকিয়ে দেখলাম ৯০% রোগীর হার্টের সমস্যা।

ডাঃ সিহাব উদ্দীন হতে বিদায় নিতে রাত একটা বেজে গেল। ধন্যবাদ দিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা হলাম। বাসায় গিয়ে খাবার তেমন কিছু নেই। চুলোয় রাখা আধা পাকা তরকারী গরম করে খাওয়াই একমাত্র পথ। নাজু সন্তান দুটোর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে বলছে

– ওমারে মা। আল্লাহ় এমন রোগ দিয়েছে যে, আমার বাচ্চাগুলোকে পর্যন্ত কষ্ট করতে হয়েছে।

– ওকে মাম্মি। কিচ্ছু হবেনা, ওরা সমস্বরে জবাব দিল।

ব্যাবাচ্যাকা ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, নাজুর বুকের ব্যথা এখনও কমেনি।

গত রাতে আমার ঘুমটা বেশী ভাল হয়নি। কোন এক অজানা কারণে বার বার জেগে উঠেছি। মানসিক অস্থিরতার কারণে নাক ডেকে গভীর ঘুমে অভ্যস্ত আমার ঘুম যেন অনেক পাতলা হয়ে গেছে। রাতে জেগে উঠতেই দেখছি – নাজু ঠিক আছে কিনা। ওর কোন কিছু হয়নি, এমনটি নিশ্চিত করতেই খুব সতর্কতার সাথে ডান হাতের আঙ্গুলটা ওর নাকের ডগার সামনে ধরে অনুমান করছি – নিঃশ্বাস ঠিক আছে কিনা?

– না। মন মানে না। ভাবছি আর কি টেষ্ট করা যায়? হুম। পাইছি। ইশারায় নিজের হাতটা ওর হাতের শিরার উপর রেখে বোদ্ধা ডাক্তারের মত চোখ দুটো বন্ধ করে রক্তের গতিবিধি অনুভব করছি। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারছি হার্ট থেকে ছুটে আসা রক্তগুলো টিক টিক করে প্রবাহিত হচ্ছে।

আশ্বস্ত হলাম, ও ঠিক আছে। কিন্তু বুকের ব্যথাটার কি অবস্থা জানা হল না। থাক। জেগে উঠলে জানা যাবে। এভাবেই বার বার উঠে প্রতি রাতে ওকে দেখছি।

ইকো টেস্টের আরও তিনদিন বাকী। ইস। এর ভেতর যদি কোন অঘটন ঘটে যায়। দুত্তরী। আল্লা ভরসা। কিচ্ছু হবেনা। না। কিছুক্ষণ পরেই আবার মনে পড়ছে নিজের চোখের সামনে হার্ট এ্যাটার্ক করে মরে যাওয়া মানুষগুলোর কথা। দুশ্চিন্তা এড়ানোর জন্য নিজেকে বার বার অভয় দিচ্ছি।

যাক, সময় অনেকটা ঘনিয়ে এসেছে। আগামীকাল টেষ্ট। প্রতিটি মিনিট আর ঘন্টা গুনে গুনে আগামীকাল আজ হয়ে গেল।

আজ ইকো টেস্টের দিন। দুপুর একটায় গিয়ে পৌছাল হবে। রাস্তায় জ্যাম জনিত অনাকাঙ্খিত সমস্যা এড়ানোর জন্য বারোটায় গিয়েই উপস্থিত। পার্কিং এ কিছুক্ষণ বসে থাকলাম। তার পর নির্দিষ্ট সময়ে সংশ্লিষ্ট ইকো টেস্টের ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করলাম। ইকো টেষ্টে বেশী সময় লাগেনি। কিন্তু ইকো টেষ্টের পর ডাক্তারের বক্তব্য শুনে মনে হল, সামনে কোন এক অশনি সংকেত অপেক্ষা করছে। ডাঃ সিহাব উদ্দীনকে ফোন করে বিস্তারিত জানালাম। তিনি আশ্বস্ত করলেন, চিন্তা করবেন না। আমি দেখছি কি করা যায়। আপনারা বাসায় চলে যান। ইকো টেষ্ট নিয়ে আমি বড় ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত দেবো কি ভাবে কি করা যায়।

(চলবে)

পর্ব -১