banner

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1227 বার পঠিত

 

টিনএজ মনের প্রেম ভাবনা

 


আফরোজা হাসান


পরিবার ও পরিবারের একটু বাইরে মিলিয়ে বারো থেকে চৌদ্দ বছর বয়সি এগারোজন টিনএজ কন্যা আছে আমার। সপ্তাহে একদিন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি আমরা। ওরা ওদের চিন্তা-ভাবনা শেয়ার করে। আমিও আমার চিন্তা-ভাবনা বলি। যে কোন প্রসঙ্গ উঠলেই নিজেদের মধ্যেই তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু করে সবাই মিলে। আমি কখনই ওদের মাঝে কথা বলতে যাই না। আমি মূলত রেফারি হিসেবেই থাকতে পছন্দ করি। কথাবার্তা ঝগড়ার দিকে মোড় না নিলে মনোযোগ দিয়ে চুপচাপ শুনতে থাকি ওদের কথা। বুঝতে চেষ্টা করি মোটামুটি একই রকম পরিবেশে বেড়ে উঠার পরও চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা, যাচাই-বাছাইতে কত পার্থক্য বিদ্যমান ওদের মাঝে। একটা ব্যাপারে সবচেয়ে অবুঝ যাকে মনেহয় তাকেই আবার অন্য আরেকটি ব্যাপারে সবচেয়ে বুদ্ধিমতি মনেহয়। সত্যি খুব উপভোগ করি এই বৈচিত্র্যতা।

গত সপ্তাহে ওদের আলোচনা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল ‘প্রেম’। একজন বলল, কেন ইসলামে কেন প্রেমকে হারাম বলা হয়েছে? ছেলে ও মেয়েদের একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ তো আল্লাহই সৃষ্টি। তাহলে সেই আকর্ষণের টানে একে অন্যের দিকে যাওয়া নাজায়েজ হবে কেন? আরেকজন একটু বিজ্ঞের ভঙ্গীতে বলল, ইসলাম আসলে মোটেই প্রেমকে হারাম বলেনি। কেননা বিয়ের পর একটি ছেলে ও একটি মেয়ের সম্পর্ক বিকশিতই তো হয় প্রেম ভালোবাসার দ্বারা। সাথে সাথে আরেকজন বলল, তাহলে বিয়ে না হলে ছেলে-মেয়েরা একে অন্যের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করবে না এমন নিয়ম থাকলেই সবচেয়ে বেশি ভালো হত। অন্যজন বলল, এমন হলে তো আর পরীক্ষা করা হত না কে উত্তম আর কে অধম। আরেকজন প্রতিবাদী কণ্ঠে বলল, কিন্তু কেন? বিয়ের আগে চেনা-জানা ও ভালো লাগা থাকতে সমস্যা কোথায়? এটা বরং ভালো হবার কথা। বিয়ের পর বোঝাপড়াতে অনেক সুবিধা।

সময়াভাবে গত সপ্তাহে আমার আর কথা বলা হয়নি। বিষয়টা নিয়ে আজ আলোচনা করার কথা ছিল। ক্লাসে ঢুকে সবার চেহারা দেখে বুঝতে বাকি রইলো না যে, তাহাদের মন বাগিচায় গুন গুন করিয়া গুঞ্জন করিতেছে ভ্রমর। কুসুম কুসুম ভাবনারা কাশফুলের ন্যায় একবার এইদিকে তো আরেকবার ঐদিকে হেলিয়া দুলিয়া পড়িতেছে। কাহারো কাহারো মুখমন্ডলে লাজুকতার রক্তিম আভাও পরিলক্ষিত হইলো। যাইহোক, আমি কারো মন ও চেহারায় দিকে না তাকিয়ে হাসিমুখে বললাম, অনেকদিন তোমাদেরকে উপহার দেয়া হয় না। আজ আমি সবার জন্য উপহার নিয়ে এসেছি। সবাই এক এক করে আসো আর নিজ নিজ উপহার নিয়ে যাও। তারপর দেখে বলো কেমন লাগলো। উপহারের নাম শুনেই আনন্দ ও খুশিতে ঝিকমিক করতে লাগলো কন্যারা সবাই। এবং আলো বিকিরণ করতে করতে আমার কাছ থেকে নিজ নিজ উপহার নিয়ে গেলো।

একজন বলল, খালামণি তুমি এত সুন্দর করে প্যাক করেছো যে আমার খুলতেই ইচ্ছে করছে না! অন্যজন হাসিতে বিকশিত হয়ে বলল, হুম…দেখেই বোঝা যাচ্ছে খালামণি আমাদের জন্য ভীষণ স্পেশাল কিছু এসেছেন। পন্ডিত একজন বলল, শোন তোমরা কিন্তু একটা প্রবাদ ভুলে যাচ্ছো, উপরে ফিটফাট ভিতরে সদরঘাট। এমন নানারকম মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য আর উচ্ছ্বাস ও আনন্দের মধ্যে দিয়ে সবাই নিজ নিজ উপহারের প্যাকেট খুললো। যার যার উপকার হাতে নিয়ে সবাই যখন আমার দিকে তাকালো মনেহলো বাসন্তি আলো ছড়ানো ঝলমলে পুর্ণিমার চাঁদকে হঠাৎ যেন ঢেকে ফেললো একখন্ড ঘন কালো মেঘ। আমি আগের মতই হাসিমুখে বললাম, কি পছন্দ হয়েছে তোমাদের উপহার? অনেকক্ষণ নীরবতার পর ধীরে ধীরে একজন বলল, খালামণি এই পুরনো ছিঁড়ে যাওয়া ড্রেসটা আমার উপহার? আরেকজন অভিমানী কণ্ঠে বলল, আমার চকলেটের বক্সের সবগুলো চকলেটই একটু একটু করে কে যেন খেয়েছে। এঁটো চকলেট আমার উপহার?

বললাম, ভেবে দেখো উপহারের কথা শুনে তোমরা কত্তো খুশি হয়েছিলে! খুব সুন্দর করে প্যাকেট করা উপহারের বক্স দেখে তোমাদের সেই আনন্দ আরো বেড়ে গিয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যেই কত রকমের স্বপ্ন, আশা, ভাবনা তৈরি হয়ে গিয়েছিল তোমাদের মনে উপহারকে ঘিরে। কিন্তু সুন্দর করে মোড়ানো উপহারের বক্স খুলে যখন তোমরা পুরনো ছেঁড়া ড্রেস, আধ খাওয়া চকলেট, উপরে ছত্রাক পড়ে গেছে এমন কেক, ভাঙ্গা চুড়ি ও গহনা দেখলে সাথে সাথে তোমাদের মন খারাপ হয়ে গেলো। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। আমরা কেউই উপহার হিসেবে পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চাই না। কখন যদি এমন কিছু পেয়েও যাই উপহার হিসেবে সেটা আমাদেরকে আনন্দিত করে না। আমরা ভালোবাসা নিয়ে সেটাকে গ্রহণ করতে পারিনা।

দেহের সুন্দর আবরণের ভেতরে যে ছোট্ট মনটা আছে সেটা নারী ও পুরুষের জন্য ঠিক এমনই এক উপহার! তোমরা কেউ কি মনের সাথী হিসেবে এমন কোন মনকে উপহার হিসেবে পেতে চাইবে যেটা আগেই কারো দ্বারা ব্যবহৃত হয়েছে? যেই মনের কোন অংশ ছেঁড়া বা ভাঙা কিংবা যাতে অন্যকারো চিহ্ন লেগে আছে? যাতে ছত্রাক পড়ে গিয়েছে, যা থেকে ভেসে আসছে হালকা দুর্গন্ধ? একসাথে এগারো জন চিৎকার করে উঠলো, কক্ষনো না। কোনদিনও না। ছিঃ, ইয়াক! হেসে বললাম, ইসলাম তো তোমাদের এই ইচ্ছাটাকে সফল করার পথই সুগম করেছে। দেখো আমরা কেউ ভবিষ্যৎ জানি না। তাই এর কোন নিশ্চয়তা নেই যে যার সাথে তুমি প্রেম করছো তার সাথেই তোমার বিয়ে হবে। একজনকে ভালবাসার পর একসময় হয়তো কোন কারণে ভেঙ্গে গেল সম্পর্ক, কিংবা সে এসেছিলই তোমাকে ধোঁকা দিতে, তোমার ক্ষতি করতে। তখন কি করবে তোমাদের এই ভাঙ্গাচোরা মন নিয়ে? আর যে উপহার পাবে এই মন সেকি আনন্দিত হতে পারবে?

ইসলামে প্রেম হারাম নয়। ইসলামে বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক নিষিদ্ধ। এবং এই নিষিদ্ধের পেছনেই আমাদের সবার কল্যাণ নিহিত। তোমাদের দেহ ও মন শুধু তোমাদের একার নয়। এটা তোমাদের যে সাথী হবে তাদের জন্য উপহার। ঠিক তেমনি তোমাদের সাথীদের দেহ ও মন তোমাদের জন্য উপহার স্বরূপ। আর পৃথিবীতে কেউ উপহার হিসেবে পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চায় না। তাই আমাদের কাউকে যাতে সাথী হিসেবে এমন কাউকে উপহার হিসেবে পেতে নাহয় তাই ইসলামে বিয়ের আগে প্রেমকে নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। তোমরা সবাই যাতে তোমাদের মনটাকে নিজ নিজ জীবনসাথীর জন্য সযতনে আগলে রাখতে পারো সেই পথই তো ইসলাম উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যাতে একে অপরকে দেবার সময় তোমাদের উপহার সদ্যফোঁটা গোলাপের ন্যায় সুন্দর ও সজীব থাকে।

নিজ নিজ উপহারের প্যাকেট পাশে সরিয়ে দিয়ে সবাই তখন বলল, ইনশাআল্লাহ আমরা কখনোই বিয়ের আগে প্রেম করবো না। আমরা সবসময় মনে রাখবো আমাদের মন কারো জন্য উপহার হবে একদিন। আর উপহার হিসেবে কেউই পুরনো, ছিঁড়ে যাওয়া, ভেঙ্গে যাওয়া, নষ্ট হয়ে যাওয়া, কারো ব্যবহৃত কিছু পেতে চায় না। আমি জানি আমার কন্যারা এমন উদাহরণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাই থমকে গিয়েছিল কিছুটা। কিন্তু যেহেতু চিন্তার খোঁড়াক পেয়েছে ওদের মন ও মস্তিষ্ক বসে থাকবে না। নতুন নতুন প্রশ্ন ও যুক্তি নিয়ে আবারো হয়তো হাজির হবে আমার কাছে। আমি তখন সেই আলোকে জবাব দিতে চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। অভিভাবকরা প্রায় সময়ই যে ভুলটা করেন তা হচ্ছে, সন্তানদের প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেন না। অথচ অভিভাবকদের উচিত সন্তানদের প্রশ্নের জবাব দেয়া এবং এমন ভাবে দেয়া যা ওদেরকে চিন্তার খোঁড়াক যোগাবে। যারফলে আবেগ দিয়ে না বরং যুক্তি দিয়ে সবকিছুকে যাচাই করতে শিখবে সন্তানরা।

Facebook Comments