banner

শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 708 বার পঠিত

 

জুতাচোর

জাহেদ উদ্দীন মোহাম্মদ


নাহিনের বাসায় এখন তুলকালাম অবস্থা। বিকালে বাবা এসেছে। রাতে খাবার পরেই ঘটনার শুরু। নাহিন ভাবছে, সব দোষ তার একার। কেন যে সে বাবাকে আসতে বলল!
এই নিয়ে এখন আফসোসের শেষ নেই।
নাহিনের মা সরকারী চাকুরে। বাবার বেসরকারি । পোস্টিং বরিশাল। নাহিনরা দুই ভাই, এক বোন। সবার বড় নাহিন, তারপর জাহিন, ক্লাস ফাইভে পড়ে। পিচ্ছি বোন অরিন, পড়ে ক্লাস টু’তে। খুবই বাবার ন্যওটা। ওরা সবাই চট্টগ্রামে মা’র নামে বরাদ্ধকৃত সরকারী কোয়ার্টারে থাকে। ।
নাহিনদের একটা হাসিখুশির সংসার। মা’র যা একটু ঝনঝনে মেজাজ। এইটুকু ছাড়া পুরা ঘরটা যেন শান্তির নহরে ভাসে। মাস শেষে বাবা ছুটিতে বাসায় এলেই পিচ্ছিদের কাছে ঈদের আমেজ। অরিন বাবার কাঁধে, জাহিন পিঠে আর নাহিনের হাত ধরে বাবা বাসার ছাদে চক্কর দেয়। তখন খুব মজা। বাবার দখল নিয়ে অরিনের সাথে জাহিনের খুব ঝগড়া। অরিন বলে,
-এটা আমার বাব্বা, কেউ বাব্বার গায়ে হাত দিবে না। বাব্বা শুধু আমার।
ছোট্ট জাহিন মুখ আধাঁর করে ব্যালকানিতে পালিয়ে যায়। লোহার গ্রীল ধরে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে ভেঁউ ভেঁউ করে কাঁদে। এই নিয়ে সবাই হাসাহাসি করে।
মা পিছনে গিয়ে জাহিনের চুলে বিলি কেটে কেটে আদর করে। তারপর জাহিনের যা শান্তি। ভাবখানা এমন-
-সবাই দ্যাখো, মা কিন্তু আমার।
বরিশালে গিয়ে নাহিনের বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে। তখন ছোট অরিনের বয়স মাত্র এক বছর। সবাই বলে মা’টা কি বোকা! বিয়ের দুই বছর পর এই কথা জানতে পারলো! কিন্তু বাবার বিয়ের সাথে মায়ের বোকামীর কি সম্পর্ক, নাহিনের মাথায় আসে না।
দ্বিতীয় বিয়ের পরও বাবা দুই-তিন মাস পর পর চট্টগ্রাম আসতো। সবাইকে খুব আদর করতো। তখন নাহিনের খুব রাগ হতো।, যখন দেখতো মা তুচ্ছ কারনেও বাবার সাথে ঝগড়া করে। একবার এক ফাগুন মাসে মা’র জন্য বাবা একটা লাল টগবগে শাড়ী আনলো। রঙ দেখে মা’র খুব চেছামেছি! সে কি রাগারাগি! তিনি রাগের মাথায় বাবার মুখে শাড়ী ছুড়ে মারে।
ভ্যাগিস, সেদিন কেউ বাবার মুখখানি দেখেনি।
সেদিনের পর হতে বাবা আর কখনো বাসায় আসেননি।
আগামী বিষুধবার নাহিনের জেএসসি পরীক্ষা। তাই ছেলের আবদার রাখতে আজ বাবার এই চলে আসা। রাতে বাবার নতুন কেনা জুতা চুরি হবে, সেই চুরি নিয়ে এতো কিছু ঘটে যাবে, কে জানতো? ঝগড়ার সুত্রপাত এখানে থেকেই। রাতেই বাবা চলে যাবেন তাই জুতা খুলে দরজার বাইরে রেখেছেন। । ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে একসাথে খাওয়া দাওয়া করলেন। মা খেতে বসলেন ন।
ফেরার সময় বাইরে এসে দেখেন নতুন জুতা নাই।
নাই মানে নাই।
একেবারে তাজ্জ্বব ব্যাপার!
প্রথমে কাজের লোককে জেরা করা হলো। তারপর কোয়ার্টার এর দাড়োয়ান। এমনকি ছোট্ট অরিনকেও জিজ্ঞাসা করা হলো।
কেউ কিছু স্বীকার করছে না।
বাবা রাগে গজ গজ করছেন। বারবার বলছিলেন-
– কদিন আগে ৬৯৯০ টাকায় কেনা নতুন জুতা আমার। মাত্র দুইবার পড়েছি।
বাবার প্লান ছিলো,ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করে নাইটকোচে রাতে ঢাকা চলে যাবেন। পরদিন অফিসের বার্ষিক সাধারন সভায় যোগ দেবেন। কিন্তু এখন উপায়!
তিনি অরিনকে আদর করে কাছে ডেকে মোলায়েম স্বরে বললেন-
-দেখো মা, জুতাগুলো তুমি নিয়ে থাকলে, দিয়ে দাও। কথা দিচ্ছি, আমি আবার আসবো। তোমাদের সাথে অনেকদিন থাকবো। লক্ষী মা আমার!
-না, বাব্বা আমি জুতা নিই নাই তো!
উপায় না দেখে হঠাৎ চোখ-মুখ গরম করে মেয়েকে ধমক দিতেই, সে হাউমাউ কেদেঁ উঠলো।
আর এই নিয়ে শুরু হলো স্বামী-স্ত্রী মধ্যে তুমুল ঝগড়া। বাবা পইপই করে পুরা বাসা খুঁজে দেখলো। কিন্তু জুতার কোন হদিস নাই।
নাহিন কিছু একটা বলতে চাইলেই ঘেউ ঘেউ করে উঠলো।
-চুপ! একদম চুপ, হারামজাদা কোথাকার! বলেই থামিয়ে দিলো।
পাশের ফ্লাটের লোকজন বেরিয়ে আসাতেই এই ঝগড়ার ঘুর্নি থামে।
বাবা নাহিনের স্পন্জ সেন্ডেল পা গলিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলো।
এই জুতাচুরি নিয়ে আবাসিক এলাকায় নানা রকম আলোচনা।
কেউ কেউ নিশ্চিত দাঁড়োয়ান নিয়ে গেছে। এগুলো এরাই করে বা করাই।
কেউ বললো, কাজের মেয়ে ময়লার ঝুড়িতে করে বাহিরে নিয়ে গেছে।
তবে বেশীর ভাগের ধারনা, কুকুর নিয়ে গেছে। নতুন জুতার গন্ধে কুকুর মাতাল হয়ে যায়। আগে এভাবে অনেকের জুতা হারিয়েছে। সবার কথা শুনে নাইট গার্ড বলল, নাহিনের বাবার পিছপিছ একটা কুকুর এসেছিল। তবে দোতলা পর্যন্ত উঠেছে কিনা নিশ্চিত নন। কিছু লোক মা’র দিকে অশ্লীল ইঙ্গিত করে।
জুতা চুরির পর হতে নাহিনের বাবা পরিবারের কোন খোঁজ খবর নেন না।
তিন বছর পর….
নাহিন এসএসসি দিলো। জাহিন জেএসসি। অরিন পিএসসি দিলো।
নাহিনের বাবা এক ছুটির বিকালে বরিশালে নিজের বাসার বারান্দায় বসে আয়েশ করে চা খাচ্ছিলেন। এমন সময় তার তিন বছরের মেয়ে একটি হলুদ খাম দিয়ে বলল,
-বাপ্পা, এইতা মা ডিলো।
ছোট্ট একটি চিঠি। খামের উপর শুধু চট্টগ্রাম লেখা।
বাবা,
সালাম নিও। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। বাবা, সেদিন তোমার জুতা আমিই চুরি করেছি। জানতাম, তুমি চলে যাবে কিন্তু পরদিন আমার যে পরীক্ষা! সবাই বাবাকে সালাম করে পরীক্ষার হলে যাবে। আমি কাকে সালাম করবো? তাই জুতা সরিয়েছি। প্রতিদিন পরীক্ষার হলে যাবার আগে লুকিয়ে তোমার জুতা জোড়া সালাম করতাম।
তুমি কিছুই টের পাওনি, বাবা?
বাবা, তুমি কি কখনো বাবাহীন ছিলে?
তুমি কি জানো, বাবাছাড়া সন্তানেরা কিভাবে বড় হয়?
জানো বাবা, এইবছর আমরা তিনজনেই পরীক্ষার্থী ছিলাম । গোপনে আমরা তোমার জুতা জোড়ায় সালাম করে, তারপর পরীক্ষার হলে যেতাম। আমাদের পরীক্ষার শেষদিন মা ঠিকই ধরে ফেললো।
যত ঝামেলার মুল তোমার মেয়ে ঐ অরিন। সে তোমার জুতা ধরে অনেকক্ষন কাঁদছিল আর বলছিল,
-বাবা, দোয়া করো। অ-নে-ক দোয়া!
-আচ্ছা বাবা, জুতা কি কখনো দোয়া করতে পারে? জুতা কি কখনো বাবা হয়? অথচ দেখো, কি বোকা মেয়ে অরিন! তোমার জুতাকেই বাবা ডাকে।
ইতি,
নাহিন।
চিঠি পড়াশেষে বাবা খানিক চোখ বন্ধ করে করে রইলেন।
ছলছল করে উঠে চোখ।
নিজের উপর প্রবল ঘৃনা আর তাচ্ছিল্যে কুকড়ে রইলেন।
আবার হঠাৎ দাড়িয়ে গেলেন…..
মনে হলো দুনিয়ায় এখনি গজব নাজিল হবে।

Facebook Comments