banner

রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 605 বার পঠিত

 

ভুল করা কন্যার লাগি মন আনচান করে

ফাতিমা মারিয়াম


সামিনার বাবা দেশের বাইরে থাকেন। দুই বা তিন বছর পরপর দেশে আসেন। ফলে ওর আম্মাই সংসারের সবকিছু দেখাশুনা করেন। সামিনার আরও তিনটি ভাইবোন আছে। সবাই পিঠাপিঠি। ওরা সব ভাইবোনই বেশ সুন্দর। তবে সামিনা সবার চাইতে বেশিই সুন্দর……… বেশ রূপবতী।

সামিনা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন তাকে এবং তার ছোট ভাইবোনদেরকে পড়ানোর জন্য উনার আম্মা একজন শিক্ষকের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করলেন। একসময় উনি উনার পছন্দমত একজনকে পেয়েও গেলেন।

ছেলেটির নাম সবুজ। জগন্নাথ কলেজে অনার্স পড়ে। ওর পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা ভাল না। ফলে ঢাকায় থাকা, খাওয়া এবং পড়াশুনার খরচ তাকেই চালাতে হয়। তাই সে কয়েকটি টিউশনি করে।

সামিনা এবং তার ভাইবোনদেরকে সবুজ পড়ানো শুরু করল। সবুজ বেশ ভাল পড়ায়। সামিনাদের সব ভাইবোনকে সে বেশ যত্ন করেই পড়াত। ফলে সবাই বেশ খুশি।

দিন যেতে থাকে…… সবুজ ও সামিনা উভয়ে উভয়ের প্রতি এক ধরণের আকর্ষণ অনুভব করে। আকর্ষণ থেকে দুর্বলতা, আর দুর্বলতা থেকে প্রেম। মা ও ভাইবোনদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সামিনা সবুজের সাথে প্রায় দুই বছর প্রেম চালিয়ে যায়।

ইতিমধ্যে সামিনা এসএসসি পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়েছে।

এক পর্যায়ে সামিনা ও সবুজ সামিনার মায়ের কাছে ধরা পড়ে যায়। সামিনার মা সবুজকে উনার বাসায় আসতে নিষেধ করে দেন।

সামিনার জন্য এখন আর বাসায় শিক্ষকের প্রয়োজন নেই। তাই ছোটদের জন্য নতুন শিক্ষক নিয়োগ দেন। সবুজ সামিনাদের বাসায় আর আসেনা। কিন্তু ওদের যোগাযোগ বন্ধ হয় না। বান্ধবীদের মাধ্যমে সামিনা সবুজের সাথে যোগাযোগ চালিয়ে যায়।

ইতিমধ্যে সবুজ অনার্স কমপ্লিট করেছে। এবার সে তার পরিবারের হাল ধরার জন্য প্রবাসে পাড়ি জমায়।সামিনার সাথে তার যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। সামিনার বান্ধবীদের মাধ্যমে এই যোগাযোগ চলতে থাকে। এটা যেই সময়ের কথা তখন বাংলাদেশে মোবাইল ফোন আসেনি। বাসার ল্যান্ডফোন সামিনার জন্য নিষিদ্ধ ছিল।

তাই সে চিঠির মাধ্যমেই সব সময় সবুজের সাথে যোগাযোগ রাখত। আর এই চিঠিগুলো আসত বান্ধবীদের ঠিকানায়। মায়ের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে তার প্রেম চালিয়ে যায়।

এর মধ্যে সামিনার এইচএসসি পরীক্ষা কাছাকাছি এসে যায়। সামিনার মা কোনভাবেই সবুজের কাছে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হননি। কারণ এই ছেলের পরিবারের অবস্থা ভালো না। সবুজকেই সব দেখতে হবে। কবে সে ভালভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে আর কবে তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন! এইসব সাতপাঁচ ভেবে মেয়ের তীব্র অমত স্বত্বেও টেস্ট পরীক্ষার কিছুদিন আগে ওর মা ওকে এক ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়ে দিয়ে দেন। পাত্রের পরিবার বেশ ধনি। উভয় পক্ষই মহা ধুমধাম করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সামিনার স্বামীর নাম কামাল।

যথা সময়ে সবুজের কানে বিয়ের খবরটা যায়। তখন সে এক ভয়ানক পরিকল্পনা করে। তার এখনো দেশে আসতে দুই/তিন বছর বাকি। সে সামিনাকে জানায়- তুমি আমার জন্য অপেক্ষা কর। আমি এসেই তোমাকে বিয়ে করব। ততদিন তুমি কামাল ও তার পরিবারের সাথে বসবাস করে যাও। কাউকে কিছু বুঝতে দিও না।

সামিনা মনে মনে স্বপ্ন দেখে একদিন সে আর সবুজ মিলে একটি ছোট সংসারে বাস করবে। এই ভাবনায় তার দিন কাটে…..।

এমন সময় সে অনুভব করে যে সে মা হতে চলেছে। শারীরিক অসুস্থতার ফলে সে আর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারে নি। সুতরাং তার শিক্ষাজীবন ওখানেই শেষ হয়ে যায়।

দুই পরিবারের সবাই তার এই নতুন খবরে বেশ খুশি। কিন্তু সামিনা কোনভাবেই সবুজের কথা ভুলতে পারছেনা। সে শুধু সবুজের আসার অপেক্ষায় দিন গোনে।

যথা সময়ে তার একটি পুত্রসন্তান হয়। এমন কি ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েও সে সবুজকে ভুলতে পারেনা।

ছেলে বড় হতে থাকে। সে মনে মনে ফন্দি করতে থাকে সবুজ দেশে এলে সে এই সংসার ছেড়ে সবুজের কাছে চলে যাবে। তবে তার মনে একান্ত ইচ্ছা সে তার ছেলেকে এদের পরিবারে রেখে যাবে না। তাকে সে সাথে করেই নিয়ে যাবে।

এদিকে সবুজের দেশে আসার দিনও প্রায় এসে গেল। এখন আর সবুজের সাথে তার যোগাযোগ করতে কোন অসুবিধা হয়না। সামিনা যখন তার মায়ের বাসায় বেড়াতে আসে তখন সে সুযোগ বুঝে সবুজকে ফোন করে। আর ওর মা বা অন্য কেউ ওকে এখন আর ফোন ব্যবহার করতে বাধা দেয়না। কারণ সবাই ভাবে বাচ্চা হয়ে গেছে, এখন কি আর ও কোন অঘটন ঘটাবে? কিন্তু ও যে নিয়মিত গোপনে সবুজের সাথে এই কয় বছর যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে তা কেউ বুঝতে পারেনি।

সবুজ দেশে আসে। এসেই সে সামিনার সাথে যোগাযোগ করে। সবুজ সামিনাকে তার সাথে দেখা করতে বলে। সুযোগ বুঝে একদিন সামিনা সবুজের সাথে দেখা করে। তারা দুজনে প্ল্যান করে তারা পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করবে। সবুজের প্ল্যান অনুযায়ী সামিনা বাবার বাসায় বেড়াতে আসে।

এর কয়েকদিন পরের ঘটনা…… সে তার বাচ্চাকে মায়ের বাসায় রেখে সবুজের কাছে চলে যায়। কিভাবে যেন সামিনার শ্বশুরবাড়ির সবাই এই দুঃসংবাদ জেনে যায়। তারা এসে তাদের বাচ্চাটিকে সামিনার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে চলে গেল।

সব কথাই সামিনা জানতে পারে। কিন্তু বাচ্চার জন্য তার আর কিছুই করার থাকে না।

কয়েকদিন কেটে গেছে। কিন্তু সামিনার কাছে সবুজের আচরণ কেমন জানি মনে হয়! সামিনা সবুজকে বলে-চল আমরা বিয়ে করে ফেলি। কিন্তু সবুজ টালবাহানা করে সময় কাটাতে থাকে।

কয়েকদিন পরে সবুজ সামিনাকে বলে যে -‘আমি তোমাকে মোটেও বিশ্বাস করিনা। একবার তুমি আমার সাথে প্রতারণা করে কামালকে বিয়ে করেছ। আবার এখন কামালের সাথে প্রতারণা করে আমার কাছে চলে এসেছ। তোমার একটি সন্তান থাকা সত্ত্বেও তুমি সংসার ত্যাগ করেছ। আবার হয়ত তুমি নতুন কাউকে পেলে আমাকে ছেড়েও চলে যাবে। এ ছাড়া আমার মনে তোমার প্রতি বেশ অনেকটা ক্ষোভ ছিল। তুমি আমার ভালবাসাকে অপমান করে কামালকে বিয়ে করেছ শুনেই আমি মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলাম যে আমি তোমাকে একটা উচিৎ শিক্ষা দেব। সেই জন্যই আমি তোমার সাথে এই আচরণ করেছি। আমি এখন বাড়ি যাব। ওখানে আমার পরিবারের পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করব। তুমি তোমার বাবা মায়ের কাছে চলে যাও। আমার সাথে আর কোনোদিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবে না। এখানেই তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।’

সবুজের কাছে চরমভাবে অপমানিত হয়ে সামিনা বাবা-মায়ের কাছে ফিরে আসে।

দিন যায়…..।

সামিনা এবং তার বাবা-মা মিটমাটের জন্য কামাল ও তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে। কামাল ও তার পরিবার জানিয়ে দেয় এই বউকে তারা কোনদিন তাদের বাড়িতে স্থান দেবে না। বাচ্চাটিকে নিজের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য সামিনা অনেক চেষ্টা করে। কিন্তু কামাল ও তার পরিবার তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। তারা বাচ্চাকেও ফেরত দেয় নি।

আরও কিছু দিন কেটে যায়।

এবার কিভাবে যেন সামিনার সাথে পুরনো ঢাকার এক ধনী ব্যবসায়ীর সাথে পরিচয় হয়। এই ভদ্রলোকের স্ত্রী আছে, ছেলেমেয়ে আছে। এক পর্যায়ে সামিনাকে সেই ভদ্রলোক বিয়ে করে। তবে তার নতুন স্বামী তাকে এই শর্তে বিয়ে করেছে যে,কোনদিনও সামিনা বা তার পরিবার এই বিয়ের কথা উনার পরিবারের নিকট প্রকাশ করতে পারবে না। যেদিন প্রকাশ করবে সেদিন থেকে তিনি আর সামিনার সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবেন না।

সামিনা এই শর্ত মেনে নিয়ে জীবন যাপন করতে থাকে।

তার এই স্বামী তাকে তার মায়ের বাসার কাছে একটি ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছে। এই এলাকাতেই ওকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে। টাকা-পয়সা, শাড়ি-গয়না কোন কিছুরই অভাব নেই।

একে একে সামিনার দুইটি বাচ্চা হয়েছে। বাচ্চা দুইটাও এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। বাচ্চাগুলো সামাজিকভাবে একটু কোণঠাসা হয়েই দিন কাটায়।

নিজের জীবনের কিছু বোকামির মাশুল আজ সামিনা এভাবেই দিয়ে যাচ্ছে………।

Facebook Comments