banner

রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 3239 বার পঠিত

 

ধর্ষণ এবং প্যাভলভ তত্ত্ব

ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস


৬ বছরের শিশু, আপাদমস্তক বোরখাবৃতা কিংবা ৬০ বছরের বৃদ্ধারা ধর্ষিত হওয়ার ১৩৮ বছরের পুরানো মেডিকেলীয় ব্যাখ্যা

অবিশ্বাস্য ব্যাপার হলেও সত্য ১৩৮ বছর আগে রাশিয়ান বিজ্ঞানী পাভলভ এই ব্যাখ্যাটা দিয়ে গেছেন। বিজ্ঞানী পাভলভের এই কনসেপ্ট প্রত্যেক ডাক্তারকে তাঁর মেডিকেল লাইফের সেকেন্ড ইয়ারে পড়তে হয়।

সহজভাবে বলার চেষ্টা করি – নন মেডিকেলদের জন্য দেখি বলতে পারি কিনা।

বিজ্ঞানী পাভলভ একদল কুকুরকে ল্যাবে বেঁধে রেখে দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছিলেন। তিনি প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে তাদের খাবার দিতেন। কুকুরের সামনে থাকত খাবারের বাটি এবং আয়না। সেখানে পাভলভ কুকুরের আচরণ পর্যবেক্ষণ করতেন। প্রতিদিন ঠিক একই সময়গুলিতে কুকুর গুলিকে খাবার দেওয়া হত। পাভলভের সাথে থাকতেন তাঁর ল্যাব সহকারী। খাবার গ্রহণের সময় কুকুরের কী পরিমাণ লালা ঝরত সেটি একটি কন্টেইনারে মাপা হত।
ব্রেইনের স্বাভাবিক রিফ্লেক্স হল খাবার গ্রহণের সময় লালা ঝরা।
কিন্তু পাভলভ দেখলেন যে – খাবার গ্রহণ নয়, খাবার দেখেও এবার কুকুরের লালা ঝরতে শুরু করেছে। পাভলভ খাবার দেখে কুকুরের কী পরিমাণ লালা ঝরত সেটি ও কন্টেইনারে মাপার ব্যবস্থা করলেন।

বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর পাভলভ দেখলেন তিনি ল্যাবে ঢুকলেই কুকুরের লালা বের হচ্ছে।
সাথে খাবার থাক আর না থাক।

পাভলভ এবার নিজে ল্যাবে না গিয়ে খাবার বিহীন অবস্থায় তাঁর ল্যাব সহকারীকে ল্যাবে পাঠালেন। ল্যাব সহকারী অবাক হয়ে দেখলেন তাকে দেখে ও (ল্যাব সহকারী) দেখেও কুকুরের লালা ঝরছে।
পাভলভ এবার ভিন্ন কিছু করলেন।

তিনি কুকুরকে খাবার দেওয়ার সাথে সাথে একই সময়ে একটি ঘণ্টি বাজাতে থাকলেন।
খাবার দেওয়া হচ্ছে এবং ঘন্টি বাজানো হচ্ছে।

এরপর পাভলভ এবং সহকারী একদিন খাবার ছাড়াই ল্যাবে আসলেন এবং ঘন্টি বাজাতে শুরু করলেন।

দেখলেন খাবার না দেওয়া সত্ত্বেও কুকুরগুলোর একই পরিমাণ লালা ক্ষরণ হচ্ছে।

পাভলভ সিদ্ধান্তে আসলেন – খাবারের প্যাকেট, ল্যাব এসিস্টেন্ট, ঘন্টির শব্দ – এগুলি সব নিউট্রাল স্টিমুলেশন। এগুলির সাথে লালা ক্ষরণের সম্পর্ক নেই। কিন্তু কুকুর তার লার্নিং বিহেভিয়ারে খাবারের সাথে খাবারের প্যাকেট, পাভলভ, ল্যাব সহকারী বা ঘণ্টার শব্দকে কো রিলেট করে ফেলেছে। এবং খাবারের সাথে যা যা ঘটে সব কিছুকেই লালা ক্ষরণের উপাদান হিসেবে তার ব্রেইন ডিটেক্ট করছে।

ব্রেইনের এই লার্নিং মেথডকে তিনি “কন্ডিশনিং” এবং ‘কন্ডিশান্ড রিফ্লেক্স’ বলেছেন।

অর্থাৎ ব্রেইন এমন একটি স্টিমুলেশনের প্রতি সাড়া দিচ্ছে, যেটিতে ব্রেইনের আদৌ রেস্পন্স করা উচিত না, কিন্তু করার কারন হচ্ছে ব্রেইন এই স্টিমুলেশনকে আরেকটি স্টিমুলেশানের সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলেছে।

মানুষ কুকুর নয় যে, মেয়ে দেখলেই তাকে ধর্ষণ করবে।

তবে মানুষের মধ্যে পশুত্ব আছে।

বিখ্যাত নিউরোলোজিস্ট এবং পরবর্তীতে সাইকিয়াট্রিস্ট ফ্রয়েড বলেছিলেন, যাকে আমরা মন বলি সেটি মূলত তিনটি সত্ত্বার সম্নবয়ে গঠিত – ইড, ইগো এবং সুপার ইগো।
অর্থাৎ মানব মন এই তিনটি গাঠনিক উপাদানে তৈরি –

“ইড” মূলত মানুষের জৈবিক সত্ত্বা।

মানব মনের স্বভাবজাত চাহিদা পুরণ করে ইড।

এটিকে “মন যা চায় তাই” এর সাথে তুলনা করা যায়।

“ইড” মানুষ এবং পশু সবার মাঝেই সমানভাবে বিরাজমান। এর কোন মানবিক দিক বা বিকাশ নেই। “ইড” এর পুরোটাই লোভ লালসা ও কাম চিন্তায় ভরপুর। “ইড” এমন ভাবে মানুষ কে প্ররোচিত করে যে, প্ররোচনায় মানুষ যে কোন অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে, খুন-ধর্ষণ পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করে না। এক কথায়, “ইড” হচ্ছে আমাদের ভিতরের সুপ্ত পশু।

সুপার ইগো হচ্ছে মানুষের বিবেক।

ইড যখন জৈবিক কামনা বাসনা পুরণ করতে উদ্দীপ্ত করে, তখন সুপার ইগো একে বাধা দেয়।

সুপার ইগো মানুষকে সব সময় মানবিক দুর্বলতার উর্ধে উঠে ভাল কাজ করার জন্য মানুষকে উদ্দপ্ত করে।

এই বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নির্ভর করে ব্যক্তির নৈতিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক শিক্ষা এবং মুল্যবোধের উপর।

অন্যদিকে ইগো হচ্ছে এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী একটি অবস্থা।

ইগো এবং সুপার ইগো র মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলা ই এর কাজ।

ইড বলবে – I need to get it.

সুপার ইগো বলবে – You have no right to get it

ইগো বলবে – I need some plan to get it. অর্থাৎ ইগো ইডের ইচ্ছাটা বাস্তবায়ন করবে একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে।

পশু রা ইড চালিত।

তাই তারা কেবল জৈবিক চাহিদা (খাবার এবং যৌনতা) পুরণেই ব্যস্ত।
আবার মানুষের মধ্যে যখন “ইড” ডমিনেন্ট হয়ে যায়, তখন সে উন্মাদ ও অমানুষ হয়ে যায়।
আর যখন কেবল সুপার ইগো কাজ করে – তখন সে সাধু সন্যাসী পবিত্র হয়ে যায়।
ইগো এই দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে।

যেমন মানুষের মধ্যে যখন সুপার ইগো ডমিনেন্ট হয়, তখন অনেক সময় তাদের মধ্যে ডিপ্রেশন চলে আসে। ইগো তখন ব্যালেন্স করে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা সুপার ইগোকে মানতে গিয়ে আমরা আমাদের বিভিন্ন চাহিদা পুরণ করতে পারি না। আমাদের এই অপূরণীয় চাহিদায় মন তখন বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তখন বিক্ষিপ্ত মনকে শান্ত করতে ইগো কাজ করে।
জীব হিসেবে মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর তেমন বেশি ডিফারেন্স নেই।
উভয়েরই ইড আছে।
কিন্তু মানুষের এর সাথে দুইটা জিনিস আছে ইগো এবং সুপার ইগো।

কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি

পর্ণ মুভি দেখতে চমৎকার, অতএব পর্ণ দেখ (ইড)

পর্ণ মুভি দেখা নৈতিকতা বিরোধী, মানুষ এটাকে খারাপ বলবে, অতএব দেখা যাবে না (সুপার ইগো)

লুকিয়ে পর্ণ মুভি দেখ, অসুবিধা কী? মানুষ তো জানবে না, আর মনের চাহিদা ও মিটল (ইগো, ব্যালেন্স করতেছে দুই দিক)

মেয়েটি সুন্দরী, অতএব ওকে ইভটিজিং বা রেইপ করো (ইড)

রেইপ, ইভটিজিং অপরাধ, অতএব করা যাবে না (সুপার ইগো)

মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করো, সম্ভব হলে প্রেমের প্রস্তাব দাও, মন পাওয়ার চেষ্টা করো, মন পেলে শরীর কোন এক সময় পাবে (ইগো)

ইড, ইগো এবং সুপার ইগো র আপেক্ষিক তীব্রতা স্থিতিশীল নয়, বরং পারিপার্শিকতার সাথে পরিবর্তনশীল।

যেমন সুপার ইগো তথা বিবেক অসুস্থ হয়ে গেলে তখন সে তার কাজ অর্থাৎ অন্যায় কাজে বাধা দিতে পারে না।

দেহের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – খাবার না খেলে/পেটে খাবার না থাকলে ক্ষিদের অনুভূতি সৃষ্টি করে সেটি জানিয়ে দেওয়া। কিন্তু ক্রমাগত না খেয়ে থাকলে, দেহের দাবী অস্বীকার করলে দেহ অসুস্থ হয়ে যায় তখন সে স্বাভাবিক ক্ষিদের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না।

তেমনি সুপার ইগো তথা বিবেকের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে – সে খারাপ কাজে আপনাকে বাধা দিবে, কিন্তু যখন আপনি কন্টিনিউয়াসলি সুপার ইগোকে অস্বীকার করবেন, অমান্য করবেন – তখন এটি দুর্বল হয়ে যাবে এবং অন্যায় কাজে কার্যকর বাধা দিতে পারে না।

একজন মাদকাসক্ত প্রথম যে দিন মাদক সেবন করে, তখন “সুপার ইগো”র জন্য তার মধ্যে কিন্তু প্রচন্ড অনুশোচনাবোধ হয়। কিন্তু ধারাবাহিকভাবে মাদক সেবন তার এই অনুশোচনা র তীব্রতা কমিয়ে দেয়।

প্রথম যে ব্যক্তি পর্ণ দেখে, “সুপার ইগো”র জন্য তার মধ্যে কিন্তু প্রচন্ড অনুশোচনাবোধ হয়। কিন্তু সে যখন আসক্ত হয়ে যায়, তখন ধারাবাহিকভাবে অনুশোচনাবোধ কমে আসে।

সুতরাং মানুষ যদিও ইগো এবং সুপার ইগো দিয়ে অন্য প্রাণী থেকে আলাদা, কিন্তু সুপার ইগো দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পশুত্ব জেগে উঠে।

চলবে…

Facebook Comments