banner

বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 969 বার পঠিত

 

শিশুদের মনে সৃষ্টিকর্তার অবস্থান

আফরোজা হাসান


নাকীবের যখন ছয় বছর বয়স তখন একদিন ওকে গেমস খেলতে দিয়ে আমি রান্না করতে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর শুনলাম জোড়ে জোড়ে বলছে, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। কিছুক্ষণ পর শুনি আবারো বলছে একই কথা। আরো দু’বার শুনে আমি রান্নাঘর থেকে ওর রুমে গিয়ে বললাম, কি হয়েছে বাবা তুমি বার বার ‘বিসমিল্লাহ’ বলছো কেন? নাকীব বলল, আম্মু তুমি না বলেছে আল্লাহর নামে কিছু শুরু করলে তাতে বরকত হয়। আমি গেমসের প্রতিটা লেবেল পার করার সময় সেজন্য বিসমিল্লাহ পড়ে নিচ্ছি। দেখো সব লেভেলে সেজন্য হাই স্কোর হচ্ছে আমার। আমি হেসে ওকে খেলতে বলে আমার কাজে ফিরে গিয়েছিলাম।

এর কিছুদিন পরের কথা। তখন নাকীবকে আমি যা কিছু চাওয়ার আল্লাহর কাছে চাইতে হবে এই বিষয়টা মাত্র বোঝাতে শুরু করেছি। একদিন ওর প্রিয় একটা খেলনা খুঁজে পাচ্ছিলো না আমাকে এসে বললে আমি বললাম আগে নিজে খুঁজে দেবো একান্তই না পেলে আম্মু সাহায্য করবো খুঁজতে। সে মুখটা বাদলা আকাশের মত করে চলে গেলো। একটু পর শুনি চিৎকার করছে ‘গ্রাসিয়াস আল্লাহ’ ‘গ্রাসিয়াস আল্লাহ’ (ধন্যবাদ আল্লাহ)। জানতে চাইলাম কি হয়েছে? বেশ একটা মুড নিয়ে বলল, তুমি তো আমাকে খেলনা খুঁজে দিলে না। আমি আল্লাহকে বলেছি, হে আল্লাহ আমার খেলনাটা খুঁজে দাও। আল্লাহ তখন আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছেন আমি তো বন্ধুদের দেখানোর জন্য স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলাম খেলনাটা। তাই খেলনাটা আমার স্কুল ব্যাগের মধ্যে।

নাকীবের স্কুলে এই মাসে প্রথম সপ্তাহে বেশ বাজে একটা ঘটনা ঘটেছে। যখন রিলিজিয়ন ক্লাস হয় তখন মুসলিম বাচ্চাদের জন্য এডুকেশনাল গেমসের একটা আলাদা ক্লাসের ব্যবস্থা আছে স্কুলে। নাকীবদের ক্লাসে যে ছয়জন মুসলিম বাচ্চা আছে ওরা রিলিজিয়ন ক্লাসের সময় ওদের জন্য নির্ধারিত ক্লাসে গিয়ে খেলা করছিলো। ওদের প্রফ এসে কথা প্রসঙ্গে ওদেরকে বললো যে, সৃষ্টিকর্তা বলে আসলে কিছুই নেই। এসব মানুষের বানানো ধারণা। এসব বিশ্বাস করা বোকামো ছাড়া আর কিছুই নয়। বাচ্চারা সবাই প্রফের এই কথার তীব্র প্রতিবাদ করলো। নাকীব বলেছে, তুমি সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস না করতে পারো কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি যে আমাদের আল্লাহ আছেন। এই কথা শেষ করেই নাকীব সূরা ইখলাস তিলাওয়াত করতে শুরু করে দিয়েছিলো প্রফের সামনেই।

ঘটনাটা নিয়ে মুসলিম অভিভাবকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। স্কুলের টিচার কখনোই বাচ্চাদেরকে এই কথা বলার রাইট রাখেন না যে, সৃষ্টিকর্তা বলে আসলে কিছুই নেই। এই ধরণের কথা টিচারদের বলারও কথা নয় বাচ্চাদেরকে। উনি কেন বলেছেন সেটা নিয়ে আলোচনা করার জন্য গতকাল আমরা অভিভাবকরা একসাথে হয়েছিলাম। আলোচনার সময় আমাদের সাথে বাচ্চারাও ছিলো। আমার এই পোস্টি লিখতে বসার কারণ আসলে বাচ্চারাই। ‘আল্লাহ নেই’ প্রফ কেন এই কথা বলেছে সেজন্য বাচ্চারা ভয়ংকর রকম রাগান্বিত প্রফের উপর। একটা ছেলে আছে নাম নোমান। মরক্কোর অধিবাসী। নোমানের সেই ক্ষোভ ভরা কণ্ঠ, রাগে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ, প্রতিবাদী অঙ্গভঙ্গি থেকেই আমার এই লেখার সূত্রপাত।

আমি অবাক হয়েছি নোমানের আল্লাহর অস্তিত্বের উপর দৃঢ় বিশ্বাস এবং সেই বিশ্বাসের প্রকাশ দেখে। আট বছর বয়সী একটা বাচ্চা, যুক্তির প্রয়োগ সে জানে না। কিন্তু প্রতিবাদী কণ্ঠে বলছিল, এটা কি কখনো সম্ভব নাকি যে আল্লাহ নেই? আল্লাহ না থাকলে আমরা এলাম কি করে? পৃথিবী সৃষ্টি হলো কি করে? প্রফ একটা বোকা তাই এমন কথা বলেছে। অভিভাবকদের মধ্যেও নোমানের আম্মুই সবচেয়ে বেশি রাগান্বিত ছিলো। তিনিই সব গার্জিয়ানদের সাথে কথা বলে সবাইকে একত্রিত করার পুরো উদ্যোগটি নিয়েছিলেন। রাগে লাল হয়ে গিয়েছিলেন ভদ্রমহিলা। বলছিলেন, কোন সাহসে এই কথা প্রফ বললেন আমাদের বাচ্চাকে। আমরা স্কুলে পড়াশোনা শিখাতে পাঠিয়েছি তাদের কাজ শুধু সেটা শিখানো। আল্লাহ আছেন কি নাই সেটা আমরা শিখাবো আমাদের বাচ্চাকে। আমরা সবাই অভিযোগ করলে স্কুল কতৃপক্ষ ঐ প্রফকে জব থেকে বের করে দিতে বাধ্য। ইত্যাদি ইত্যাদি!

মা-ছেলের প্রতিবাদে গমগম করছিলো মাহফিল। একজন গার্জিয়ান বললেন, ভুল করে হয়তো বলে ফেলছে এটাকে এত বড় ইস্যু করার কোন প্রয়োজন দেখছি না। লক্ষ্য করলাম উনার বাচ্চাটাও বেশ নির্লিপ্ত এই ব্যাপারে। ওর কাছে ঘটনাটা জানতে চাওয়া হলে ঠিকমতো বলতেও পারলো না। কারণ বিষয়টা ওর মনে তেমন কোন প্রভাব রাখেনি। নাকীব বলল, প্রফ বলেছে তো কি হয়েছে? প্রফের বলাতে কি এসে যায়? আমি তো জানি যে আল্লাহ আছেন। (নাকীবের বাবা-মা দুজনই আসলে একটু ড্যাম কেয়ার স্বভাবের। মানুষের অপ্রয়োজনীয় বা অযৌক্তিক কথা যে কান দিয়ে শোনে সেই কান দিয়েই বের করে দেয় দু’জন ) দেখা গেলো পুত্রও বাবা-মার রঙে রঙিন।

আমি আরেকবার অনুভব করলাম কোন ঘটনাতে একটি শিশু কিভাবে রিঅ্যাক্ট করবে সেটা আসলে নির্ভর করে বাবা-মা তথা বেড়ে উঠার পরিবেশের উপর। চাইল্ড সাইকোলজিস্টরা যেমন বলেন যে, মা-বাবা হয়তো বুঝতে পারেন না কিন্তু এটা সত্যি সন্তানরা সার্বক্ষণিক সিসি ক্যামেরার মতো তাদের অবলোকন করে এবং তাদের দেখে শিখতে থাকে। মাঝেমধ্যে কিছু কিছু আচরণ বাচ্চারা কপি করে নেয় এবং মা-বাবার রোল মডেল হয়ে অভিনয় করে দেখায়। তাই আমরা যদি চাই আমাদের সন্তান একজন আদর্শ মুসলিম হোক এর সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হচ্ছে নিজেরা চর্চার মাধ্যমে তাদের সামনে আদর্শ মুসলিমের গুণাবলী তুলে ধরা।

বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে জেনেছিলাম ইসলামের বিধান মেনে চলাটা জীবন ধারণের অন্যান্য জিনিসের মতোই। ক্ষুধা লাগলে যেমন আমরা খাবার খাই, ঘুম পেলে ঘুমোতে যাই, ঠিক তেমনি আযান শুনলে নামাজ পড়তে যেতে হবে। কারণ জীবন ধারণের বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে নামাজও একটি। এটা মোটেই বাড়তি কোন দায়িত্ব না বরং জীবন যাপনের অংশ। দেহকে যেমন আমরা পোশাক ও বিভিন্ন প্রসাধন সামগ্রী দিয়ে সাজাই, মনেরও তেমন প্রসাধনী প্রয়োজন। আর মনের প্রসাধনী হচ্ছে কুরআন ও হাদীসের চর্চা। শরীর যেমন খাদ্যর দ্বারা সুস্থ্য থেকে, মন সুস্থ্য থাকে কুরআন তেলাওয়াত দ্বারা। ভিন্ন ভাষা ইংরেজির অর্থ না জানলে বা বুঝলে যেমন পরীক্ষার খাতায় সঠিক উত্তর লিখতে পারবো না। ঠিক তেমনি কুরআনের অর্থ না জানলে আখিরাতের পরীক্ষায় পাশ করা সুকঠিন হয়ে যাবে।

আমার মধ্যে এই চিন্তাগুলোই বদ্ধমূল এখনো পর্যন্ত। আমি যখন কাউকে দেখি নামাজ পড়ে না মেনে নিতে প্রচণ্ড কষ্ট হয়। একজন মুসলিম নামাজ পড়বে না চিন্তাই করতে পারি না আমি! অনেক অনেক কষ্ট পাই তাই পরিচিত কাউকে নামাজ ছেড়ে দিতে দেখলে। এর কারণ বাবা-মামণিকে দেখে এভাবেই চিন্তা করতে শিখেছি আমি। আসলে আমাদের সন্তানদের মনে সৃষ্টিকর্তার অবস্থান কেমন হবে সেটা নির্ভর করে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে কিভাবে পেশ করছি তাদের সামনে তার উপর।

সুতরাং সন্তানের মনে সৃষ্টিকর্তার অবস্থানকে নিশ্চিত করতে হলে আগে আমাদের মনের সৃষ্টিকর্তার অবস্থান কোথায় ও কেমন সেটা যাচাই করে দেখতে হবে। তাই চলুন আমরা নিজেরা সৃষ্টিকর্তাকে আমাদের মনে দৃঢ় ভাবে স্থাপন করি, তাহলে আমাদের সন্তানদের মনেও সৃষ্টিকর্তার অবস্থান নিশ্চিত হয়ে যাবে (ইনশাআল্লাহ)।

Facebook Comments