banner

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 834 বার পঠিত

 

পানির বোতল, গ্লাস এবং কিছু উপলব্ধি…


আফরোজা হাসান


গতকাল দুপুরের খাবারটা আমাকে একা একাই খেতে হয়েছিল! একা টেবিলে বসে খেতে ভালো লাগে না তাই খাবারের প্লেট নিয়ে নাকীবের কাছে গিয়ে বসেছিলাম! নাকীব কার্টুন দেখছিল আর জাম্পিং জাম্পিং করছিল! খাবার কিছুটা শুকনো ছিল তাই মুখে দেবার পর একটু পানি পান করে নেবার প্রয়োজন অনুভব করলাম! নাকীবকে বললাম যে, বাবা আম্মুতাকে একটু পানি এনে দাও। টেবিলে থাকা পানির বোতলে অল্প একটুখানি পানি ছিল! নাকীবকে বললাম পানি ভরে আনতে! কিন্তু যেহেতু স্পাইডারম্যান কার্টুন চলছিল! যে কার্টুনের এক মূহুর্তও নাকীব মিস করতে নারাজ! তাই যে বোতল উপুড় করে সবটুকু পানি গ্লাসে ঢাললো! কয়েকবার ঝাঁকিও দিলো বোতলে যাতে পানির শেষ বিন্দুটিও গড়িয়ে গ্লাসে এসে পড়ে! এভাবে সবটুকু পানি গ্লাসে ঢেলে আমার কাছে নিয়ে এসে হাসি দিয়ে বলল, দেখেছো গ্লাস প্রায় ভরে গিয়েছে! পানি বড় বোতলে ছিল তো তাই অনেক কম দেখাচ্ছিলো বুঝলে আম্মুতা! কিন্তু দেখো গ্লাসে ঢালার পর কত বেশি দেখাচ্ছে! কথা শেষ করে আমার হাতে গ্লাস দিয়ে নাকীব আবারো নিজের কাজে ফিরে গেলো! কিন্তু আমি একবার বোতল আরেকবার গ্লাসের দিকে তাকালাম! আমার কাছেও মনেহলো বড় বোতলে থাকার কারণেই আসলে মনেহচ্ছিলো খুবই অল্প পানি! অথচ যখন গ্লাসে ঢালা হলো ঠিকই প্রায় পুরো গ্লাসটি ভরিয়ে দিলো সেই অল্প একটু পানিটুকুই।

অনেকগুলো ভাবনা এসে জড়ো হয়েছিল মনের মাঝে! গত পরশু আমার সাথে সংঘটিত আরেকটি ঘটনা মনে পড়লো। নাকীবকে আনতে যাচ্ছিলাম স্কুল থেকে। পথে ছোট্ট একটা বাচ্চাদের পার্ক আছে। প্রায়ই পার্কটির সামনে একজন বয়স্কা মহিলা বসে থাকেন। রাস্তা দিয়ে চলা প্রতিটি পথিকের দিকে তাকিয়ে মুখের কাছে হাত নিয়ে ঈশারায় বলেন, খাওয়ার জন্য তাকে কিছু দিতে। অন্যের দুঃখে দুঃখী এবং অসহায়কে সাহায্য করতে হবে এই বোধ নাকীবের মনে জাগ্রত করার লক্ষ্যে প্রায়ই ঐ মহিলাকে সাহায্য দেয়াই ওকে দিয়ে। তখন দান-সাদাকা বিষয়েও বুঝিয়ে বলি! যাকাতের ব্যাপারে বোঝাতে গিয়ে বলেছিলাম যে, পাঁচ ইউরো আমাদের কাছে হয়তো তেমন একটা ম্যাটার না! কাউকে দিতেও তেমন কষ্ট হয় না যেহেতু আল্লাহ রহমতে আমাদের কাছে আরেকটু বেশি অর্থ আছে! কিন্তু যার কাছে একটি ইউরোও নেই সে এই পাঁচ ইউরো দিয়েই অনেক কিছু করে ফেলতে পারবে ইনশাআল্লাহ! এইজন্যই আল্লাহ যাদের অর্থ আছেন তাদেরকে একদমই অর্থহীন যারা তাদেরকে সাহায্য করতে বলেছেন! যাইহোক, আমাদের বাসা থেকে নাকীবের স্কুলে যাওয়ার পথটুকু বেশ ঢালু। যাবার সময় নীচের দিকে নামতে অনেক সহজ কিন্তু ফেরার পথে উপরের দিকে উঠতে বেশ কষ্ট। গত পরশু আমার শরীরটা সামান্য অসুস্থ্য ছিল। ফেরার পথে তাই বাসে আসার ইচ্ছে ছিল। তাই যাবার পথে সেই মহিলাটি যখন সাহায্য চাইলেন নাকীবকে দিয়ে সাহায্য দেয়ানো সম্ভব হবে না ভেবে আমিই দিতে গেলাম। কিন্তু পার্স খুলে দেখি টাকা না নিয়েই বেড়িয়ে পড়েছি! আর খুচরা পয়সা যা আছে সব মিলিয়ে এক ইউরো পুরো হতেও কয়েক সেন্থ কম। মহিলার দিকে তাকিয়ে, ‘সরি আপনাকে পরে দেব’ বলে পা বাড়াতে যাচ্ছিলাম উনি তখন বলল, তোমার কাছে যা আছে তাই আমাকে দাও।

খুব সংকোচ হচ্ছিলো এত কম সাহায্য দিতে। কিন্তু আবার নাও বলতে পারলাম না। উনাকে তখন পার্স থেকে সবগুলা খুচরা পয়সা বের করে দিলাম। মহিলার চোখে মুখের সেই আনন্দের কথা কোন বাক্যে প্রকাশ করবো বুঝতে পারছি না। কোন কিছু পেয়ে হারিয়ে ফেলার পর, আবারো ফিরে পাবার আনন্দ বোধকরি এমনই হয়। ফেরার পথে বাসের জানালা দিয়ে দেখলাম মহিলাটি বসে রুটি খাচ্ছেন। উনার মুখের কাছে হাত নিয়ে ক্ষুধার অনুভূতি প্রকাশের কথাটি মনে পড়ে গেলো। মনে পড়লো পঞ্চাশ সেন্থ দিয়ে নরম্যল মানের একটি রুটি কিনতে পাওয়া যায়, সত্তর সেন্থ দিয়ে অনেক মজার ডোনাট কেনা সম্ভব, চল্লিশ সেন্থ দিয়ে ছোট এক বোতল জ্যুস পাওয়া যায়। এমন আরো কিছু খাবার আছে যা খুব সহজেই কিনে খাওয়া সম্ভব ঐ পয়সা দিয়ে যা দিতে আমি লজ্জিত ও সংকোচ বোধ করছিলাম। সেদিন সারাটা দিনই আমার মাথায় এই চিন্তাটা ঘুরপাক খেয়েছে যে, কেন আমি একদম কিছু না দেবার চেয়ে কিছু অন্তত দেয়া থেকে বিরত থাকতে চেয়েছিলাম?! আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে শেখানো হয়েছে দানের পরিমাণ কোন ম্যাটার না। তোমার কাছে যা বিন্দু একজন অসহায়ের কাছে সেটাই হয়তো সিন্ধু হয়ে ধরা দেবে! অথচ তারপরও কেন আমি সংকোচ করেছিলাম এই ভাবনাটা খোঁচাতে লাগলো থেকে থেকে! “অল্প দান করতে লজ্জাবোধ করো না! কেননা বিমুখ করা অপেক্ষায় অল্প দান অনেক ভালো!” আমার সবচেয়ে প্রিয় বাণীর মধ্যে তো হযরত আলী(রা)বলা এই বাণীটাও আছে। তাহলে কেন এই অনুভূতিটা ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল আমার?!

সব মিলিয়ে একসময় মনেহলো দান-সাদাকা বিষয়ে অনেকদিন কোন আলোচনা শোনা হয়নি, নিজেরও করা হয়নি! বেশ কিছুদিন এই বিষয়ে কোন চর্চা হয়নি বলেই কি তবে অল্প কিছু দান করতে আমি লজ্জিত বোধ করেছিলাম?! একটা গল্পের কথা মনে পড়লো তখন। এক যুবক ইসলামী আলোচনার মজলিসে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল ঘুরে ফিরে রোজ প্রায় একই ধরণের কথা শুনতে হয় সেজন্য। সেই মজলিস যিনি পরিচালনা করতেন তিনি একদিন যুবকের বাড়ি এলেন। কেন মজলিসে যায় না সেটা শোনার পর উনি মুখে কিছুই বললেন না। শুধু চলে যাওয়ার সময় ফায়ার প্লেস থেকে একটা কয়লার টুকরো লাঠি দিয়ে বের করে আনলেন। কিছুক্ষণ জ্বলে থাকলো ঠিকই কিন্তু এরপর ধীরে ধীরে কয়লার টুকরোটি উত্তাপহীন হয়ে গেলো। যুবকও উপলব্ধি করলো সে কি ভুল করতে বসেছিল। ইসলামি মজলিস থেকে দূরে থাকার ফলে তার ঈমানের দীপ্ততাও তো এমনি করে মিলিয়ে যেত এক সময়! অথচ নিয়মিত মজলিসে গেলে ঈমানের উজ্জ্বলতা হ্রাস পাবার সম্ভাবনা কম এবং বৃদ্ধি পাওয়াটাই স্বাভাবিক! আমি নিজেও আবারো উপলব্ধি করলাম যে, শরীয়তের বিষয়সমূহকে যত বেশি চর্চা করা হয় ব্যবহারিক জ্ঞান ততই শানিত থাকে। কর্মের আগে নিয়্যাত নির্ধারণ হয়ে যায়, নিয়্যাতে খুলুসিয়াত বৃদ্ধি পায়। অন্তরও অনেক বেশি তৃপ্ত ও প্রফুল্ল থাকে।

ভেবে দেখলাম ঐ মহিলাকে দান করার মূল উদ্দেশ্যেটা আসলে নাকীবকে দান করে দেখানো ও শেখানোতেই পরিণত হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে! একজন অসহায় মানুষকে আমি সাহায্য করতে পারছি! এই যে ক্ষমতাটা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাকে দিয়েছেন সেজন্য শুকরিয়া আদায় করার কথা তাই স্মরণে আসেনি আমার! ঐ মহিলার জায়গায় আজ আমিও থাকতে পারতাম! এই উপলব্ধি থেকে কৃতজ্ঞ হতেও ভুলে গিয়েছিলাম! শুধু ভাবছি আমার এই অকৃতজ্ঞ দান থেকে কি সত্যিই আমার ছেলে কোন শিক্ষা নিতে পেরেছে গত দুই মাসে?! আমলের প্রতিদান দেয়া হবে নিয়্যাতের ভিত্তিতে! আমার নিয়্যাত কি ছিল? যতই ভাবছি, নিজেকে বিবেকের আয়নায় দেখার চেষ্টা করছি, ততই লজ্জিত বোধ করছি! কাজের পেছনে আসলে নিয়্যাতটা কি সেটা চিন্তা করতে অনেক সময় আমরা ভুলেই যাই। অভ্যাস বশত, বা করতে হবে তাই করে ফেলি। এরফলে হয়তো আমাদের অনেক ভালো কাজ প্রকৃত এবং কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনতে ব্যর্থ হয় আমাদের জন্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা আমাদের হৃদয়ে লুকায়িত আমলের ভিত্তিতে আমাদেরকে পুরষ্কৃত করবেন! কোন কাজ করার আগে তাই পুনঃপুন নিয়্যাত বিবেচনা করে দেখা উচিত আমাদের। কেননা নিয়্যাতের স্বচ্ছতার অভাবে আমাদের অনেক কল্যাণমূলক কাজ হয়তো বিফলে চলে যাবে! রবের কাছে তাই আজ আকূল হয়ে প্রার্থনা করছি, প্রবাহমান দীনতার স্রোতে অন্তরের আলো মোর নিভু নিভু, তাওফীক দিও নিয়্যাতের খুলুসিয়াত অর্জনে হে দয়াময়, পরম করুণাময় প্রভু……..।

Facebook Comments