banner

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1202 বার পঠিত

 

মাতৃকথন ৭

ফারিনা মাহমুদ


শুরু করি সত্য ঘটনা দিয়ে । আমার ছেলের বয়স যখন ১৬ মাস, ওকে নিয়ে গেলাম আর্লি চাইল্ডহুড সেন্টারে। বাচ্চা জন্মের পর থেকে ৫ বছর বয়স পর্যন্ত এই সেন্টারে শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ সংক্রান্ত রুটিন চেকাপ করানো যায়, প্রয়োজনে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নার্সদের সাথে বিশেষ সমস্যা নিয়ে কথা বলা যায় মা ও বাচ্চা উভয়ের ব্যাপারে। ওরা পরামর্শ দেবার পাশাপাশি অন্যান্য ক্লিনিকে রেফার করে দিতে পারে। এখানে যেকোনো সমস্যা নিয়েই যাওয়া যায়। যেমন ধরেন বাচ্চার ঘুমের রুটিন ঠিক করতে পারছি না, রাতে কান্না করে, খেতে চায় না, খুব ভয় পায়, সারাক্ষণ মা আঁকড়ে থাকে, বুকের দুধ ছাড়াতে পারছি না … যে কিছু ।
ওরা কিছু ট্রিক্স আর টিপস দেয়, সচরাচর খুব ত্যাঁদড় বাচ্চা না হলে ঐসব ট্রিক্স কাজ করে যদি ঠিকমতো ফলো করা যায় । আর এতে কাজ না হলে ফিডিং ক্লিনিক বা স্লিপ ক্লিনিক এর মতো স্পেশালাইজড জায়গায় পাঠানো হয় ।
আমার সমস্যা ছিলো বাংলাদেশী মায়েদের জাতীয় সমস্যা, বাচ্চা খায় না। আসলে ব্যাপারটা যতটা হালকাভাবে বলছি, ততটা হালকা না । এই ভয়ঙ্কর কষ্ট যেই মা ভোগ করেন, তিনিই শুধু জানেন এটা কতটা পীড়া দায়ক । যে বেলা বাচ্চাটা পেট ভরে খায়, মায়ের যেনো মাথাটা একটু ঠান্ডা থাকে। বাচ্চা খেলো না, ব্যাস, দুনিয়ার কিছুই আর ভালো লাগে না। ঠিক এই অবস্থায় বিদেশ বিভূঁইয়ে কর্মজীবি একজন মায়ের বাচ্চা যখন রীতিমতো খাবার সামনে দেখলে মুখে যমদুয়ারের খিল এঁটে বসে থাকে, তখন লাগে টা ক্যামন?

চোখের সামনে আমার ব্যর্থ মাতৃত্বের স্বাক্ষ্য দিতে তার জামা কাপড় সাইড দিয়ে ঢল ঢল করছে। অফিস থেকে ফিরে আমি বাচ্চার খাবার নিয়ে বসি এমনভাবে যেনো গাজা উপত্যকা নিয়ে ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যে চলমান সংকটের একটা সমাধান করার মরণপণ নিয়ে জাতিসংঘ শান্তি চুক্তিতে জেনেভায় বসছে। প্রতিরাতে সেই চুক্তি ব্যর্থ হয়, ডিপ্লোম্যাট হিসাবে আমি ফেল মারি এবং সংকট প্রকটতর হতে থাকে! বাচ্চার ঘাউড়ামি বাড়ে পাল্লা দিয়ে।

শেষ চেষ্টা হিসাবে পেন্টাগনে এপয়েন্টমেন্ট নিলাম, অর্থাৎ আর্লি চাইল্ডহুড সেন্টারে নিয়ে গেলাম ওকে। নার্স আমার সব কথা শুনলো, ওর ওজন উচ্চতা মাপলো। ওর বয়স অনুযায়ী ডেভেলপমেন্ট মাইলস্টোন গুলো কতটুকু ও এচিভ করেছে সেই ব্যাপারে আমাকে ধারাবাহিক প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হলো । বাসায় যতক্ষণ থাকে ওকে কয়বার এবং কি ধরণের খাবার দেয়া হয় তার একটা বিবরণ দিতে হলো। এরপর আমাকে যেই প্রশ্নটা মহিলা করলো, তা শুনে আমি ভিমরি খেলাম!

– ফারিনা, তুমি কি ওভারওয়েট?
আমি আমতা আমতা করে বললাম হ্যাঁ আইডিয়াল বডি ওয়েটের চেয়ে বেশ অনেকটাই বেশী ওজন আমার ।
– ডু ইউ নো হোয়াই?
মানে কি? তুই কি কইতে চাস ছেলের খাওয়া আমি খাই? আমার ওজন ক্যানো বেশী এইটা তোর কাছ থেকে আমার জানা লাগবো? আল্লাহ গো তুমি দড়ি ফালাও, তোমার দোহাই লাগে! আমার রাগ তখন চরমে, তারপরেও মুখে হাসি ধরে বললাম – হোয়াই ?
– বিকজ ইউ ডোন্ট নো হোয়েন টু স্টপ ইটিং !
আমি তব্দা খেয়ে বসে আছি!
মহিলা বলে যাচ্ছে – সুস্থ স্বাভাবিক জীব মাত্রই তার যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু খাবার খাবে। যেখানে থামা প্রয়োজন সেখানে থামবে। মানুষই সম্ভবত একমাত্র জীব যে চোখের ক্ষুধায় খায়। পেট ভরা একটা বাঘের সামনে দিয়ে একটা হরিণ হেঁটে গেলে বাঘ লোভে পড়ে লাফ দিয়ে হরিনের পশ্চাৎদেশ থেকে এক খাবলা মাংস খেয়ে নেয় না। কিন্তু পেট ভরা অবস্থায় লোভনীয় একটা ডেজার্ট দেখলে আমরা মানুষরা হামলে পড়ি! বিপত্তিটা ঘটে তখনি, ওজন বেড়ে যায় ওভার ইটিং এর জন্য বাচ্চার এই স্টার্ট স্টপ সিগন্যালকে ইগ্নোর করে তুমি যদি ওকে জোর করে বা ট্রিক্স করে বাড়তি খাবার খাওয়াও, ওর ব্রেইন স্টার্ট স্টপ সিগন্যাল দেয়ায় গোলমাল করবে, ওর স্টমাক ক্যাপাসিটি প্রয়োজনের চেয়ে বেড়ে যাবে এবং আর্লি এইজে এটা সমস্যা না হলেও একটা বয়সে গিয়ে ও সাফার করবে – ঠিক তোমার মতো! নিজের পয়সায় খাবার খাবে আবার নিজেই পয়সা খরচ করে জিমে গিয়ে ওজন ঝরাতে স্ট্রাগল করবে! বর্তমানে তোমার ছেলের ব্রেইন জানে কখন থামতে হয়, তোমার ব্রেইন জানে না, আর এজন্যই তুমি ওভারওয়েট আর ও পারফেক্ট। ইউ শুড প্রবাব্লি লার্ন ফ্রম হিম হোয়েন টু স্টপ!

ডাহা বেইজ্জতি কারে বলে !! আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার মায়ের দ্বারা অতি ভালোবাসা মাখা শৈশব ! অপরিসীম ধৈর্য্য নিয়ে ২ ঘন্টা ধরে আমাকে একটা ডিম্ খাওয়ানো, চোখের জলে মাখামাখি হয়ে নাক চেপে ধরে গ্লাস ভরা দুধ শেষ করা, ভাতের কথা নাই বা বললাম ! আহারে ! ওই যে ব্রেইনের সিগন্যাল ম্যান ইন্তেকাল করলো, এখন তার কবরে ফুল দেই আর জামাকাপড় ফেলি, গায়ে লাগেনা তাই!

আমি প্রশ্ন করলাম, ওর ব্যাপারে তাহলে তোমার সাজেশন কি ? বাচ্চা আমার প্রপারলি একটা ডিনার করে না, ওজনের পার্সেন্টাইল বলছে ওর গ্রাফ ১৮ থেকে ২৫ এর মধ্যে, তুমি বলছো আমি ওর ব্রেইনের সিগন্যালকে রেস্পেক্ট করে ওরে না খাওয়ায়ে ঘুম পড়াবো ?

মহিলা উত্তর দিলো –

এক নম্বর– তুমি যা করবে তা হচ্ছে ও “কম খায়” এই জাজমেন্ট বন্ধ করবে। তুমি ঠিক কিসের ভিত্তিতে বলছো ও কম খায়? তোমার বয়সী কেউ হয়তো এক বসায় ৪০০ গ্রামের দুইটা স্টেক শেষ করে ফেলতে পারবে, আর কেউ হয়তো আড়াইশ গ্রামের একটা স্টেক শেষ না করেই বলবে আই এম ডান! এখন দ্বিতীয়জনকে যদি আমরা ৪০০ গ্রামের দুই স্টেক দিয়ে বলি, এইটাই তোমার সঠিক পরিমান এবং এইটাই তোমাকে শেষ করতে হবে, ব্যাপারটা কি দাঁড়ায়? অত্যাচার হয় কি হয় না? সুতরাং ওর খাওয়ার পরিমান তুমি নির্ধারণ করতে পারো না, ও কম খায় এই স্টেটমেন্ট তুমি দিতে পারো না। ওর বয়সী একটা বাচ্চার স্টমাক ক্যাপাসিটির একটা উদাহরণ হচ্ছে ওর নিজের এক হাতের এক মুঠি খাবার হবে ওর বিকালের স্ন্যাক্স? মানে বুঝতে পারছো? এক টুকরো পনির ই কিন্তু যথেষ্ট, অথবা অর্ধেকটা গাঁজর বা একটা ক্র্যাকার !

দুই নম্বর– ওর গ্রোথ গ্রাফ কি বলছে তা খুব ইম্পরট্যান্ট। এই যে তুমি বললে ওর ওজনের গ্রাফে ওর অবস্থান ১৮ থেকে ২৫ পার্সেন্টাইলে, ও তো জন্মের সময় থেকেই তাই! আমরা যেইটা দেখবো সেটা হচ্ছে কার্ভটা লিনিয়ার (সরলরেখায় ও মোটামুটি সমানুপাতে ) যাচ্ছে কিনা বয়সের সাথে। আমি তো দেখছি ওর ওজন ১৮ থেকে ২৫ পার্সেন্টাইলের মধ্যেই এগুচ্ছে, যদি ১৮ এর নীচে নেমে যেতো, আমরা হায়ার লেভেলে এক্সামিন করতাম। একই ভাবে এই রেঞ্জ থেকে হটাৎ বেড়ে বেশি উপরে গেলেও আমরা ওভারওয়েট নিয়ে কনসার্ন হতাম এবং দুই ক্ষেত্রেই ডায়েটিশিয়ানের সাথে বসতে হতো তোমাকে। হাইটওয়াইজ ওর পার্সেন্টাইল হাই, ৮০ এর উপরে, জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত ঐটাও সরলরেখায়ই আছে। কাজেই তোমার বাচ্চা বড় হচ্ছে কোনো সন্দেহ নেই !

তিন নম্বর– ওর মানসিক বিকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তরগুলো বলে দিচ্ছে ওর বিকাশ স্বাভাবিক।

চার নম্বর– ও যথেষ্ট একটিভ, আমি দেখতেই পাচ্ছি, এটাও একটা পজিটিভ দিক।

পাঁচ নম্বরে – তোমাকে তোমার বাচ্চার হেলদি ফুড হ্যাবিটের দিকে খেয়াল রাখতে হবে, এমফাসাইজ মোর অন কোয়ালিটি, কোয়ান্টিটি কামস লেটার । খায়না বলে অতিরিক্ত চিনি, চর্বিজাতীয় খাবার, জাঙ্ক ফুড, সস ড্রিঙ্কস এসবের লোভ দেখানো যাবেনা।

ছয় নম্বর – তোমাকে তোমার নিজের জাজমেন্ট দিয়ে ওর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে ওভার পাওয়ার করা বন্ধ করতে হবে। এইটুকু তোমাকে শেষ করতেই হবে, খাও , হা করো .. এইসব ধমক বাচ্চাকে খাবার নিয়ে একটা ট্রমার মধ্যে ফেলে। মিল টাইম কখনোই ব্যাটেল টাইম হওয়া উচিত না। মিল টাইম হওয়া উচিত আনন্দময় ।

চলবে…

মাতৃকথন ৬

Facebook Comments