banner

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1237 বার পঠিত

 

একটি শিশুর নামাজ শেখার গল্প

আফরোজা হাসান


বিভিন্ন সময় বোনদের সাথে যেসব হালাকাতে অংশগ্রহণ করি তাতে প্রায় সবাই যে প্রশ্নটা করেন তা হচ্ছে, সন্তানদের কিভাবে নামাজে অভ্যস্ত করাবেন! আমি সবসময় যে পরামর্শ দিতাম তা হচ্ছে, শিশুদেরকে মুখে বলে করানোর চাইতে, করে দেখিয়ে শেখানোটা অনেক বেশি সহজ। সুতরাং, বাবা-মা যদি নিয়মিত নামাজ আদায় করেন শিশুরা দেখে দেখে সেটা রপ্ত করে ফেলবে ইনশাআল্লাহ। সুতরাং বাবা-মাকে নিয়মিত নামাজ আদায় করতে হবে। এবং সন্তানদেরকেও উৎসাহিত করতে হবে নামাজের ব্যাপারে। ছোটদের ভাষায় ওদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে নামাজ কেন পড়তে হবে, নামাজ পড়লে আল্লাহ অনেক খুশি হবেন ইত্যাদি। তবে এখন কিন্তু আমি এই পরামর্শ ঠিক এমন করে বলি না কাউকেই। কেন?! কারণ আমার পুত্র সেই উপায় রাখেনি। ছোটবেলায় নাকীবও অন্য আর সব বাচ্চাদের মত আমরা যখন নামাজ পড়তাম পাশে এসে দাঁড়িয়ে যেত। আমাদের সাথে রুকু, সিজদাহ দিতো, কখনো ওর বাবার পিঠে উঠে বসে থাকতো, কখনো বা গলা ধরে ঝুলতো নামাজের সময়। এসব কর্মকান্ড করে কিছুক্ষণ পর আবার নিজের খেলায় ফিরে যেত। ছয় বছর পর্যন্ত এমনই চলছে। এরপর হাসানজ্বি বললেন, এখন থেকে আমাদের নামাজের ব্যাপারে সিরিয়াসলি একটু একটু করে তৈরি করানো উচিত নাকীবকে।

আমরা দুজন মিলে ঠিক করলাম যে, বাকি সব ওয়াক্ত নাকীব ওর ইচ্ছে মত নামাজ আদায় করবে শুধু যোহর ছাড়া। যোহরের চার রাকআত ফরজ ওকে পুরোটাই আদায় করাবো আমরা। আগের মত আর দু’এক রাকাত আদায় করেই দৌড় দিতে দেয়া যাবে না। আমরা দুজন মিলে বসে খুব সুন্দর করে নাকীবকে বুঝিয়ে বললাম, নামাজের মাঝখান থেকে ইচ্ছে মত উঠে যাওয়া ঠিক নয়। পুরো নামাজ শেষ করে সালাম ফিরিয়ে এরপর তুমি আবার খেলা করবে। সে নিজে যেহেতু জ্ঞান হবার পর থেকেই যুক্তিবাদী(মাশাআল্লাহ) তাই যুক্তি বোঝে এবং মেনেও নয়। সপ্তাহ খানেক খুবই সোনা বাচ্চা হয়ে আমাদের সাথে যোহরের চার রাকআত ফরজ নামাজ আদায় করলো। এক সপ্তাহ পর থেকে তার উসখুস শুরু হয়ে গেলো। সে হচ্ছে জাম্পিং বেবী। এক মূহুর্ত স্থির থাকে না। সেখানে সাত-আট মিনিট চুপচাপ দাড়িঁয়ে থাকাটা কষ্টসাধ্যই তার জন্য। তো একদিন ঠিক নামাজের আগ মূহুর্তে সে ওয়াশরুমে যেতে চাইলো। দুপুরে তাড়া থাকে আমাদের দুজনেরই। নাকীব দেরি করবে বের হতে তাই ওকে ছাড়াই নামাজ আদায় করে নিলাম। দ্বিতীয় দিনও সে একই সময়ে ওয়াশরুমে যেতে চাইলো। তৃতীয়দিনও যখন একই কথা বললো নামাজের আগে আমাদের দুজনের বুঝতে বাকি রইলো না যে, আমাদের সুপুত্র কেন ওয়াশরুমে গিয়ে বসে থাকেন। সে আসলে নামাজে ফাঁকি দিতে চায়। আমরা দুজন সেদিন নামাজ না পড়ে বসে রইলাম। নাকীব বেড়িয়ে যখন দেখলো আমরা ওর জন্য বসে আসি। সে খুবই আহত (মানসিকভাবে) হয়ে চুপচাপ আমাদের সাথে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো।

প্রথম প্রথম আমরা নাকীবকে নামাদের ভেতরের সূরা, তাসবীহ কিছুই পড়াইনি। ও শুধু আমাদের সাথে উঠ-বোস করতো। বেশ কিছু সূরা তার মুখস্ত ছিল। আর আমি প্রতিদিন ঘুমোতে যাবার সময় দু’তিন বার নামাজের ভেতরের সব দোয়া সমূহ ওকে পড়াতাম। আমরা চাইনি নামাজের ব্যাপারে বাড়তি কোন চাপ দিতে ওর উপর। কিংবা এভাবে বললে ভালো যে, ওকে বুঝতে দিতে চাইনি বাড়তি কিছু করানো হচ্ছে ওকে দিয়ে। ওয়াশরুমের আইডিয়া ফেল করার পর তিন-চার দিন পুত্র আমাদের চুপচাপই রইলো। এরপর একদিন ঠিক নামাজের আগে প্রচন্ড পেটব্যথা শুরু হলো তার। নড়তেই পারে না ব্যথার প্রচন্ডতায়। ওকে শুইয়ে দিয়ে আমরা দুজন নামাজ আদায় করে নিলাম। আমাদের নামাজ শেষ আর পুত্রের ব্যথা ভালো হয়ে জাম্পিং জাম্পিং শুরু। পরদিন যখন আবারো পেটব্যথা শুরু হলো হাসানজ্বি ছেলেকে আদর করে হেসে বললেন, কোন সমস্যা নেই বাবা তুমি শুয়ে থাকো। বাবা আর আম্মুতা নামাজ শেষ করে তোমাকে শিখিয়ে দেব শুয়ে শুয়ে কিভাবে নামাজ আদায় করতে হয়। নাকীব চোখ বড় বড় করে বলল, শুয়ে শুয়েও নামাজ পড়া যায়? হাসানজ্বি হেসে বলল, হুম যায় তো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এত বেশি ভালোবাসেন যে, যদি আমাদের কষ্ট হয় তাহলে যাতে বসে বা শুয়েও নামাজ পড়তে পারি সেই সুযোগও দিয়ে দিয়েছেন। নাকীব তখন উঠে বসে বলল, বাবা ব্যথা কমে গিয়েছে তোমাদের সাথেই নামাজ পড়বো। আলহামদুলিল্লাহ এরপর আর কোনদিনও নামাজ ফাঁকি দেবার নতুন কোন বুদ্ধি বের করেনি নাকীব।

আমরা যখন দেখলাম যোহরের চার রাকআত ফরজ নামাজ পড়াতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে নাকীব। তখন আসরের নামাজেও ওকে সাথে নিতে শুরু করলাম। যোহর ও আসর নামাজ বেশ কিছুদিন নিয়মিত আদায় করার পর মাগবীবের সময় ওকে সাথে রাখলাম। যখন দেখলাম যে নামাজের সময় হবার পর ডাকলেই নাকীব চলে আসছে। তখন আমরা ওকে বোঝালাম নামাজের সময় শুধু উঠ বোস করলেই হবে না। সূরা ও দোয়াও পড়তে হবে। ততদিনে সবকিছু ওর মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। আমরা তখন ওকে আমাদের সাথে নামাজ না পড়িয়ে একা একা পড়ালাম কয়েকদিন। জোড়ে জোড়ে পড়তো নাকীব সবকিছু তাই ভুল হলে ধরিয়ে দিতাম।

এর মাস খানেক পর আমরা ওকে ঈশার ফরজ নামাজ পড়ানো শুরু করেছিলাম। ছয় বছর বয়স থেকে নাকীবকে নামাজের ব্যাপারে উৎসাহিত করতে শুরু করেছিলাম আমরা। মোটামুটি পুরো এক বছর লেগেছিল নাকীবকে খুশি মনে নামাজ আদায়ে অভ্যস্ত করতে। এর মাঝে আমরা কখনোই ওর সাথে রাগ করিনি। ফাঁকি দেয়ার যেসব পন্থা বের করেছিল সেসব যে আমরা বুঝতে পেরেছি সেটাও ওকে বুঝতে দেইনি। পেট ব্যথার মিথ্যা বাহানা করছে সেজন্য কোন ভৎর্সনাও দেইনি। আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল ধীরে সুস্থে নাকীবের মধ্যে নামাজের অভ্যাস তৈরি করার। তাই হুট করে কোন কিছু চাপিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়েনি।

আর প্রথম মাসখানেক ছাড়া নাকীবও কখনোই বিরক্ত বা দুঃখী মন নিয়ে নামাজ আদায় করেনি। আমরা খেয়াল রেখেছি ওর ইচ্ছার দিকে। হয়তো বা আমাদের তাড়া ছিল বাইরে যাবার। কিন্তু তখন নাকীবের পছন্দের কার্টুন চলছিল টিভিতে। আমরা ওকে বলেছি ঠিক আছে তুমি এখন কার্টুন দেখো পরে একা নামাজ আদায় করে নিয়ো। কার্টুন শেষ হবার সাথে সাথে নিজেই জায়নামাজ বিছিয়ে খুশি মনে নামাজে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আমাকে বলতেও হয়নি। কোথাও বেড়াতে গিয়ে দু’একদিন যদি নামাজ পড়বে না এমন বলেছে, আমরা জোড় করে বাধ্য করিনি যেহেতু ওর উপর নামাজ ফরজ নয়। কিন্তু পড়ে অন্য সময় আদর করে বুঝিয়ে বলেছি কখনোই নামাজ ছেড়ে দেয়া ঠিক নয়। হিসাব করে দেখেছি পুরো আড়াই বছর লেগেছে আমাদের নাকীবকে মোটামুটি নামাজের বিষয়ে শেখাতে এবং খুশি মনে আদায় করতে অভ্যস্ত করতে।
এখন আলহামদুলিল্লাহ বলাও লাগে না। সে নিজেই নামাজের ব্যাপারে অনেক সতর্ক ও আগ্রহী। গত বছর প্রচন্ড জ্বর করেছিল নাকীবের। এত অসুস্থ্য বাচ্চাকে উঠিয়ে নামাজে ডাকতে ইচ্ছে করেনি তাই একাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম নাকীব বিছানা থেকে উঠে এসে পাশে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। সেদিন আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতায় আনন্দ ও প্রাপ্তির অশ্রু গড়িয়ে পড়েছিল চোখ দিয়ে। যখন নাকীবকে বসে থাকতে দেখি কখন তার বাবা বাসায় ফিরবে এবং সে বাবার সাথে জামায়াতে নামাজ আদায় করবে! কিংবা বার বার ফোন করে ওর বাবাকে তাগাদা দেয় যখন যে, বাসায় এসো একসাথে নামাজ আদায় করবো! আলহামদুলিল্লাহ প্রশান্তিতে ভরে যায় মন।
আসলে আমরা চেষ্টা করলেই বিন্দু বিন্দু করে শরীয়তের ভালোবাসার সিন্ধু গড়ে তুলতে পারি আমাদের সন্তানদের মনের ভেতরে। সেজন্য আমাদেরকে শুধু একটু কৌশলী এবং কিছুটা ধৈর্য্যশীল হতে হবে। তাড়াহুড়া করা চলবে না একদমই। শরীয়তের বিধান সারাজীবন মেনে চলতে হবে আমাদের সন্তানদেরকে। তাই সতর্ক থাকতে হবে গোড়ায় যেন গলদ থেকে না যায়। ভিত্তি যেন মজবুত হয়। সন্তানদের উপর শরীয়তের বিধান কখনোই চাপিয়ে দেয়া উচিত নয়। কেননা চাপিয়ে দিলে সেটা বোঝাতে পরিণত হবে, কখনোই ভালোবাসাতে নয়। সুযোগ পাওয়া মাত্রই নিজের উপর থেকে সেই বোঝা সরিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকবে। তাই শরীয়তের প্রতিটা বিধান নিজেরা মেনে চলতে হবে, কেন মেনে চলছি সেটা সন্তানদেরকে বুঝিয়ে বলতে হবে। এবং সন্তানরাও যাতে মেনে চলতে পারে সেজন্য ধীরে ধীরে ওদেরকে সেই ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলতে হবে। ফজরের নামাজ আমরা নাকীবকে পড়াতে শুরু করেছিলাম ওর আট বছর হবার পর। তাও ঘুম থেকে উঠার পর পড়ে নিতো। এখনো ঘুম থেকে উঠার পরই ফজরের নামাজ পড়ে। কেননা এখন আমাদের এখানে সূর্যোদয় হয় সাড়ে আটটায়। নাকীব আটটায় ঘুম থেকে উঠে ওয়াক্ত থাকতে থাকতেই নামাজ আদায় করে নিতে পারে। যেহেতু খুব শিঘ্রীই নাকীবের দশ বছর হয়ে যাবে। ইনশাআল্লাহ ইচ্ছে আছে এখন থেকেই ছুটির দিনগুলোতে ওকে উঠিয়ে ধীরে ধীরে ফজরের আযানের পরপরই নামাজ আদায়ের অভ্যস্ত করে তোলার।

Facebook Comments