banner

শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 706 বার পঠিত

 

যে গল্পটি কারো বোনের নয়

কুশল ইশতিয়াক


ঘটনার দিন, মন্টু যখন মাগরিব নামাজের প্রস্তুতি নেয়, তখন বাড়িতে খবরটা আসে। এরপর আর তার কিছু খেয়াল থাকে না। দৌড়াতে দৌড়াতে ধানক্ষেতের ভেতর নেমে পড়লে, কাদাপানিতে মাখামাখি হয়ে যাওয়া বোনের নগ্ন শরীরের ওপর চোখ পড়ে তার।

মন্টু ডুকরে কেঁদে ওঠে। আদালত তাকে জিজ্ঞাসা করলো- এরপর কী হল?
স্যার, শুয়ারের বাচ্চারা আমার বইনের ইজ্জত লুটছে পরথম। হেরপর জবাই দিছে।
সে তো আপনার বোন নয়।

লাশটা তার বোনের নয়? মন্টু কিছুটা বিভ্রান্ত হয়। লাশটা তাহলে কার, লিপি কোথায়? মন্টু কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারে না। কিন্তু আদালতকে সে অবিশ্বাসও করতে পারে না। যার কাছে বিচার চাইতে এসেছে সে, তাকে অবিশ্বাস সে কীভাবে করে? যদি অবিশ্বাসই করে, তাহলে তার বিচার চাইতে আসাটাই অর্থহীন। কিন্তু মন্টুর এই বিচার চাইতে আসার প্রয়োজনটুকু আছে। কারণ আদালত ছাড়া মন্টুর অন্য কোথাও যাবার আর জায়গা নেই। কারোই নেই। আদালতের কথা বিশ্বাস করা ছাড়া কীই বা করার আছে, সে ভেবে পায় না।

যান, বাড়ি যান। লাশটা লিপির নয়।

মন্টু কিছুটা ইতস্তত বোধ করে। একবার ভাবে জিজ্ঞাসা করবে, লাশটা আসলে কার? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবে যার আপনজন, সে নিশ্চয়ই লাশটা খুঁজে বের করবে। মন্টু তার জন্য অপেক্ষাও করে। এইবার তার লাশটির জন্য মায়া হয়। কিন্তু পরক্ষণেই লিপির নিখোঁজ হওয়ার ব্যাপারটি এই ভাবনাকে ঢেকে দেয়। লিপি তাহলে কোথায়?

লাশটা যে তার বোনের নয়, এ কথা অনেকেই বলেছিল তাকে। এমনকি পাজামার আর ওড়নার রঙ মিলে যাবার পরও। লাশটার ক্ষতবিক্ষত মুখ কিছুতেই আলাদা করে বোঝা যাচ্ছিল না। যদিও কাঁদাপানিতে নেমে মন্টুর বারবার মনে হচ্ছিল এই মুখ লিপির। বোনের মুখ ভাই কী করে ভোলে?

তর মাথা আউলাইছে। এই মাইয়া আমাগো লিপি? জীবনেও না।

গ্রামবাসী সকলে সায় দেয়। সায় দেয় তারা যারা লিপিকে চেনে। তারাও, যারা কখনো লিপিকে দেখে নি। মন্টুর কাছ থেকে তারা জানতে পারে, বিকেলে লিপি পেয়ারা পাড়তে ক্ষেতের ধারে এসেছিল। এ কথা তারা মেনে নিলেও ধর্ষিত লাশটি আসলে অন্য কোনো তরুণীর বলে তারা মন্টুকে আশ্বস্ত করতে চায়।

মন্টু, বাড়িত যা। গিয়া দ্যাখ, লিপি বাড়িত আইছে নি।

এই লাশটা তাইলে কার? মন্টু যে প্রশ্ন আদালতে করতে পারে নি, ঘটনার দিন সে সবার কাছেই করেছে।

মিয়া, তোমার এত খোঁজের দরকার কী? হইব পাশের গেরামের কেউ। তোমার বইনের না হইলেই তো হয়। লাশ যার হউক, তোমার তো কিছু না। যাও, বাড়িত যাও।

মন্টু ভাবতে থাকে, আসলেই, লাশটা লিপির না হলেই তো হয়। যারই হোক, তার কী আসে যায়? তার তো কিছু না।

এ কথা ভাবতে ভাবতে মন্টু বাড়ি ফেরে। কিন্তু লিপি বাড়ি ফেরে না। মন্টুর মাগরিবের নামাজ, এশার নামাজ ক্বাজা হয়ে যায়। রাতের বেলা অস্থির হয়ে তার বোনকে খুঁজতে বের হয় সে। তখন তার আযহার মাষ্টারের কথা মনে হয়।

লাশটি ততক্ষণে নিয়ে যাওয়া হয়েছে থানায়। উলঙ্গ। ওড়না আর পাজামা পড়ে ছিল ধানক্ষেতে, খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

আযহার মাষ্টারকে মন্টু তার সন্দেহের কথা বলতেই মাষ্টার তাকে একটা রামধমক দেয়। মন্টু এবার ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করে।

চাচা, লিপিরে তো পাইতেছি না।
বকাঝকা করছিলি নি? আযহার মাষ্টার জিজ্ঞাসা করে।
কেউই কিছু কয় নাই।
কারো লগে প্রেম পীরিত ছিল? পলাইছে?

আযহার মাষ্টারের এই সব প্রশ্ন মন্টুর কাছে এই সময় খুব বেমানান লাগে। কিন্তু আযহার মাষ্টারকে সে কিছু বলতে পারে না। এরকম করে সে নিজেও একবার ভাবার চেষ্টা করে। তার মনে পড়ে লিপির সাথে গ্রামের ছোটভাই রফিকের হাসাহাসির একটা দৃশ্য। কিন্তু এই ভাবনা বেশিদূর এগোতে পারে না। বারবার অন্য একটি ভয়, প্রেতাত্মার মতো তার সামনে ঘোমটা দিয়ে এসে দাঁড়ায়।

তখন মন্টু বিষয়টা অন্যভাবে সমাধানের চেষ্টা করে। মনে মনে। লাশের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেলে বা অন্য কারো ভাই এসে দাবী করলে সে নিশ্চিন্ত হতো, যে লাশটা মন্টুর বোনের নয়।

চাচা,মাইয়াডার কোনো খোঁজ পাওয়া গেছে?
কার?

আযহার যদিও পাল্টা প্রশ্ন করে থতমত খায়, অন্ধকারে মন্টুর মুখের অভিব্যক্তি বুঝতে তার তেমন একটা সমস্যা হয় না। সে তাই বলে, যা সে জানে। সে বলে যে, সে জানে না।

চাচা লন, একবার থানাত যাই।

মন্টুর এই এত রাত বিরাতে থানায় যাবার প্রস্তাব আযহার মাষ্টারের ঠিক পছন্দ হয় না। তবু এমন দুঃসময়ে মন্টুর এই সরাসরি অনুরোধ পুরোপুরিভাবে এড়ানোও তার পক্ষে সম্ভব হয় না। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বলে- ঠিকাছে, চল যাই।

লাশটিকে একটু আগে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে। এখনও মর্গে চালান করা হয় নি। ত্থানার বারান্দায় লাশটাকে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে হোগল পাটিতে। কিছু ধাড়ি ইঁদুর দৌড়াদৌড়ি করছে বারান্দার কোনায়, এরা কি জেলের ভাত খেয়ে এরকম হয় নাকি অন্য কিছু খেয়ে, কে জানে। এরই মধ্যে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে লাশটা থেকে, একটা মানুষ মারা গেলেই সুগন্ধি ছড়াবার বদলে সাথে সাথে কী করে দুর্গন্ধ ছড়ায়, এই বিষয়টা মন্টুর ঠিক বোধগম্য হয় না। সে তড়িঘড়ি করে একবার লাশের দিকে তাকায়, তারপর দ্রুত মুড়িয়ে রাখা হোগলা সরিয়ে মুখটা দেখতে উদ্যত হয়।

এই খবরদার, হাত দিবি না।

মন্টুর চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। ওর মনে হয়, একটা বড়সড় ইটের আঘাতে কনস্টেবলের মাথাটা থেতলে দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলায়। লাশটা দেখার জন্য কী বলবে, সে ঠিক মনঃস্থির করতে পারে না।

কতক্ষণ চুপ থেকে সে বলে, একবার দেখতাম চাই।

কনস্টেবল অজ্ঞাত কারণে তাকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করে না। অথচ প্রশ্ন করাটা স্বাভাবিক ছিল। সে জিজ্ঞাসা করতেই পারতো, কেন সে লাশটা দেখতে চায়, লাশের সাথে তার সম্পর্ক কী? যেমন আযহার মাস্টারও তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল লিপি কারো সাথে পালিয়ে গেছে কি না। কনস্টেবল তাকে ইশারায় ওসির টেবিলের দিক নির্দেশ করে। মন্টু এবং আযহার পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আর ইঁদুরগুলিও তাদের মুখের দিকে। আযহার মাষ্টার দুই পা এগিয়ে এসে গলা খাঁকারি দেয়।

মন্টুর তখন মনে হয়, সে অনেক বড় একটা বেকুব। থানায় তার মা’কে অথবা ফজলুটাকে নিয়ে আসার প্রয়োজন ছিল। তারা দেখে নিশ্চিত হতে পারতো লাশটা লিপির কি না। এই লাশতো এখানে থাকবে না, রাতের মধ্যেই চালান করা হবে মর্গে।

আবার এও হতে পারে, বাড়ি ফিরে মন্টু দেখবে লিপি ফিরে এসেছে। গতরাতের মতো কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার কাছে গতরাত, কিংবা তার আগের রাত, বা তার আগের রাত, আরব্য রজনীর রাতের মতোই অপার্থিব সুন্দর মনে হতে থাকে। মনে হতে থাকে কোনো উপায় জানা থাকলে সে গতরাতেই ফিরে যেত।

এ্যাই, দেখা।

মন্টু, আযহার মাষ্টার এবং কনস্টেবল, অনন্তকাল ধরে লাশের দিকে আগায়। লাশের মুখ দেখে। কিন্তু মনে রাখতে পারে না। মন্টুর মনে হয় এটা লিপিরই মুখ। যদিও আযহার মাষ্টার প্রবল অসমর্থন যোগায় কিন্তু মন্টু ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে শুরু করে, এই মুখ দেখে সে ধর্ষকদের মুখগুলিও খুঁজে বের করতে পারবে। সে আর আগের মতো অস্থির হয়ে ওঠে না, সে খুব ক্লান্ত এবং নির্জীব বোধ করে। ফিরে আসার পথে সে আযহারের সাথে একটি কথাও বলে না।

পরদিন সকালে মন্টু থানায় একটা হত্যা মামলা করে।

লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্টে পাওয়া যায়, উপর্যুপরি ধর্ষণের পর ধারালো অস্ত্র দিয়ে গলা কেটে হত্যা। একটা দুধও কাটা ছিল। মন্টু আগে সেটা খেয়াল করে নি।

এরপর কী হলো? আদালত তাকে জিজ্ঞাসা করে।
ওরা আমার বইনডার ইজ্জত লুটছে পরথম। হেরপর জবাই দিছে।
বাড়ি যান। এই লাশটি আপনার বোনের নয়।
আমার বইনের।
আপনার বোন, লিপি। তিন বছর আগে মারা গেছে।

মন্টুর সবকিছু অদ্ভুত লাগে। সে আদালতকে অবিশ্বাস করতে পারে না, কিন্তু একইসাথে এটাও বিশ্বাস করে যে, তার বোন ঘরে ফেরে না আজ একমাস চারদিন হলো। তাহলে তিন বছর আগে লিপি কীভাবে মারা যায়? আদালত থেকে সে বের হতে হতে ভাবে, আদালত কি তার সাথে মশকরা করে?

কি রে মন্টু। বইনের খোঁজ পাইলি?

ইঁদুরগুলি তখনও মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মন্টু তাকিয়ে দেখে আদালতের সামনে গাছতলায় শফিক বসা। শফিক পাগলা। মন্টুর সেই বন্ধু শফিক। মন্টুর মনে পড়ে, শফিকের একটা বড় বোন ছিল। রাবু আপা। তিন বছর আগে একদিন লাশ পাটক্ষেতে পাওয়া গেলো। কেউ এগিয়ে এল না। মন্টু তখন কোথায় ছিল? সবাই বলল- রাবু না। শফিক বললো- রাবু।

মন্টুরও মনে হয় রাবু না। ও আসলে লিপি। তিন বছর আগে পাটক্ষেতে মারা গেছে। রাবু আপা হয়তো তারও অনেক আগে। শফিক জানত না।

Facebook Comments