banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 819 বার পঠিত

 

‘ব্যাকবেঞ্চার সবুজ -১’


মেহেদী আরিফ


আমি আর সবুজ, আমরা একই ক্লাসে পড়তাম। সবুজ খুব দুরন্ত ছিল, তেমন পড়া পারতো না। ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্ট ছেলে হিসেবে ওর সুনাম ছিল। মেধাবী ছিল সে, কিন্তু পড়া করে ক্লাসে আসতো না। ওকে দেখলেই ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিতো, কেউ পাশে বসতে নিত না। এতে ওর অবশ্য মন খারাপ হতো না, সয়েই গিয়েছিল একরকম। আমি ক্লাসে ফাস্ট বয় ছিলাম। বোধকরি সব শিক্ষকরা আমাকে অনেক বেশি আদর করতেন। কিন্তু সবুজের সাথে সখ্যতা তারা মেনে নিতে পারেন নি। আমাকে সবসময় হেড স্যার কাদের মিয়া সংকেত করে দিতেন যাতে আমি সবুজের সাথে না মিশি। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
আমার সাথে সবুজের সখ্যতা কিভাবে হয়েছিল তার একটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। আমি তখন ফাইভে পড়ি। সাধারণত স্কুল ছুটির পর স্কুলের পাশের কালভার্টের পাশে দাঁড়িয়ে অন্যদের মাছ ধরা দেখতাম। কত মাছ! পুটি, টেংরা, শোল, বাইন, চিংড়ি, কৈ। আমরা তন্ময় হয়ে দেখতাম। হঠাৎ একদিন আমার স্কুল ব্যাগ কালভার্টের উপর থেকে পড়ে গেল পানিতে। আমি চিৎকার করে উঠলাম। তখন পুরো বর্ষার মৌসুম চলছে। পানি দুকূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যেন। যে খালে ব্যাগ পড়েছে ওখানে পানির স্রোত খুব বেশি। আমার ব্যাগ ভেসে যাচ্ছে, অথচ কেউ পানিতে নামার কোন ইচ্ছায় পোষণ করছে না। আমি সম্পূর্ণ নিরুপায়। দুচোখ বেয়ে আমার অশ্রুর ফোয়ারা নেমেছে। হঠাৎ দেখি একজন পানিতে লাফ দিয়েছে। এ কারণে শোরগোল পড়ে গেলো। এত পানিতে যে কেউ ডুবে যাবে, তাই আগে কেউ সাহস করে নামেনি। কিয়ৎক্ষণ পরে উপলব্ধি করলাম এতো আর কেউ নয়, ক্লাসের দুরন্ত ছেলে সবুজ। প্রায় আধা কিলোমিটার দূর থেকে সাঁতরিয়ে আমার ব্যাগ উদ্ধার করেছিল সে। আমার ব্যাগের ভিতরের বইগুলি অনেক ভিজে গিয়েছিল বটে কিন্তু আমি সবকিছু পেয়েছিলাম। এরপর থেকে সবুজের সাথে আমার বন্ধুত্ব। মিতুল নামে আমার এক ক্লাসমেট ছিল যে একদিন আমার একটি কলম চুরি করেছিল। আমি খুব মন খারাপ করে বসে আছি। মিতুল যে কলম চুরি করেছিল তা আমি পরে জেনেছিলাম। সে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ছেলে হওয়াতে কোন বড় ধরনের অপরাধ করেও প্রায়ই মুক্তি পেত। আবার ক্লাসে তার রোল নম্বরও ছিল দুই। কিভাবে তার রোল দুই হতো বারেবারে তার গাণিতিক হিসাব করার মত ক্ষমতা আমার ঐ ক্ষুদ্র বয়সে হয় নি। যাইহোক, কলম চুরির ঘটনা সবুজ জেনেছিলো। মিতুলের কাছে সবুজ ঐ কলম দেখার পর ওকে বলেছিল, ” কিরে, লালমিয়া! কলম পাইলি কই?” মিতুলকে সবুজ লাল মিয়া বলে ডাকতো হরহামেশাই। এর জন্য স্যারদের কাছে কত বকাই না খেয়েছে সে। মিতুল ঢং করে বলল, “আমার কি কওয়া লাগবে নাই তোর?” এই কথা শোনামাত্র মিতুলের কানের নিচে সশব্দে দুইটি চড় বসিয়ে দিল সে। মিতুলের তীব্র কান্নার চিৎকারে হেডস্যার সহ অন্যান্য স্যারেরা দৌঁড়ায়ে আসলেন। কান্নার হেতু আবিষ্কারে তারা অপারেশন সার্চলাইট শুরু করলেন। অবশেষে যখন জানতে পারলেন যে, সবুজই নাটের গুরু তখন হেডস্যার জোড়া বেত দিয়ে তার পিঠে পাঁচটি কসিয়ে দিলেন। সবুজ কাঁতরাচ্ছে মার খেয়ে, অন্যদিকে মিতুল কান্না থামিয়ে পুতুলের মত বসে আছে।
স্কুল ছুটির পর সবাই বাড়িতে চলে গেল, গেল সবুজও। প্রায় এক সপ্তাহ তার কোন হদিস মিলল না। আমাদের বাড়ি আরেক পাড়ায় হওয়াতে তাদের বাড়িতে যাওয়া কষ্টকর হলো। ক্লাসের ফাস্ট বয় হওয়াতে আমাকে অনেক নিয়মনীতি মেনে চলতে হতো পরিবারে। সবার আশা ছিল আমি দেশের সবচেয়ে সেরা মানুষ হই। তাই সবুজদের মত বখাটে ছেলের সাথে আমি মিশি এটা পরিবার কখনও চাইতো না। তারপরও স্কুলের ক্লাস শেষ করে অপুকে নিয়ে চলে গেলাম সবুজদের বাড়িতে। একটা বিশাল বাঁশ বাগানের পর দিঘি, তারপর সবুজদের বাড়ি। বাঁশ বাগানের মধ্য দিয়ে খস খস আওয়াজ করে হেঁটে চলেছি আমি আর অপু। সবুজদের বাসায় কখনও যাই নি আমি। অনেক সময় লাগলো ওর বাসায় পৌঁছাতে। বিছানায় সবুজ কাতরাচ্ছে! দূর থেকে কাতরানোর আওয়াজ অনুসরণ করে তার বাসায় পৌঁছালাম। আহ্ কত ব্যথা পেয়েছে বেচারা ছেলেটা! আমরা যাওয়ার সাথে সাথে ওর মা পিড়ি ঠেলে দিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে বসলাম কিন্তু অপু ভীতুর ডিমটা বসলোই না। ও কাঁপছিলো যেন। হঠাৎ করে সবুজ চিৎকার করে অপুকে বলল, “বস্! ভীতুর ডিম, তা না হলি তোরে ভেজি খেয়ি ফ্যালবো।” এ কথা শুনে অপু পালিয়ে চলে যাওয়ার উপক্রম। অমনি আমি আমার ছোট হাত দিয়ে ওর ব্যাগ টেনে ধরলাম, কোনো মতে ওকে বসালাম পিড়িতে। সবুজ বকবক করেই চলেছে, আর ওর মা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি আন্টিকে স্বান্তনা দিয়ে বিদায় নিলাম। ঐ দিন বাড়ি ফেরার পর আমার উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে গেল যেন। ঠিক কি ঘটেছিল তা না জানলেও চলবে। তবে এতটুকু বলে রাখি, আমার নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়েছিল।
প্রতিদিন স্কুলে গিয়ে আমি আগে খুঁজতাম সবুজকে। দিন পনেরো পর ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে একটা ছেলেকে হাঁটতে হাঁটতে স্কুল অভিমুখে আসতে দেখলাম। সে আর কেউ নয়, সবুজ! অন্য দিনের মত তার মাঝে চঞ্চলতার কোনো চিহ্ন পেলাম না আজ। হেতু না খুঁজে পেয়ে বেশ অবাক হলাম। ক্লাসে সবার পিছনে বসলো সে। বাংলা ক্লাসে হেডস্যার প্রবেশ করেই সবুজের খোঁজ নেওয়া শুরু করলেন। তিনি বললেন,”সেই জানোয়ারটা কোথায়?” সবুজ কোনো উত্তর না করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে গেল। হেডস্যার কটাক্ষ করে বললেন,”বসে পড়ো শুদ্ধোধন!” সবুজ একবারও স্যারের দিকে তাকালো না। ওর মনটা খুব খারাপ দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হল। কারণ সবুজ যতই দুষ্টামি করুক অন্যদের সাথে, ও আমার খুব প্রিয় বন্ধু। ক্লাস শেষে বাড়ি ফেরার পথে সবুজকে আস্তে আস্তে বললাম,”সবুজ! তোর মন খারাপ?” সবুজ যা শোনালো তাতে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সবুজের মাকে ওর বাবা খুব মারধোর করে যা সবুজের মোটেও সহ্য হয় না। নিজের বাবা তো, তাই বাবার গায়ে হাত তোলে না ও। কিন্তু ওর হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়, মাথায় খুন চাপে কিন্তু মায়ের দিকে তাকিয়ে ও কিছুই করতে পারে না। সবুজ আমাকে বলল,” দোস্ত, তুই আমার হেল্প করবি? আমাকে তে কেউ ভালবাসে না! তুই আমার পড়ালিখায় হেল্প করবি? আমি বড় হয়ি একজন পুলিশ হবো, আমার আব্বার ধরি নে থানায় বন্দি করি রাখবো”। এ কথা বলে ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ওকে হেল্প করার আশ্বাস দিলাম।

চলবে……

Facebook Comments