banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 860 বার পঠিত

 

ছোট ছোট বালুকণা – ২


রেহনুমা বিনত আনিস


সামিয়ার বিয়ে হয়ে গেল মাসরুরের সাথে। বিয়ের অনুষ্ঠানে মাসরুরকে দেখে মনে হচ্ছিল সে আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে, কিন্তু সামিয়াকে দেখে মনে হচ্ছিল ওর আকাশের চাঁদটা কোথাও খোয়া গিয়েছে। ব্যাপারটা সবাই নববধূর স্বাভাবিক লজ্জাবোধ মনে করলেও মাসরুরের দৃষ্টি এড়ায়নি। রাতে শ্বশুরবাড়ীতে নিজের রুমে বসে ননদ মারযানের সাথে কথা বলছিল সামিয়া। মারযানের নতুন ভাবীর সম্পর্কে জানার আগ্রহের শেষ নেই। কিন্তু সামিয়াকে প্রচন্ড ক্লান্ত পরিশ্রান্ত দেখাচ্ছিল। ভাইয়াকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে কেটে পড়ল মারযান। সামিয়া সচকিত হয়ে সোজা হয়ে উঠে বসল। মাসরুর ঘরের দরজা বন্ধ করতে গিয়ে সামিয়ার বিচলিত চেহারা দেখে আধখোলা রেখে দিলো। ওর মায়া হোল সামিয়ার জন্য। বেচারী না জানে বাসর রাতের ব্যাপারে কি ভয়ানক সব কথা শুনে এসেছে! সে কাছে এসে বলল, ‘সামিয়া, আমি জানি তুমি খুব ক্লান্ত, আমি নিজেও টায়ার্ড। চল আমরা জামাকাপড় বদলে এশার নামাজটা পড়ে ঘুমিয়ে পড়ি। আর তুমি যদি চাও তাহলে আমরা কিছুক্ষণ গল্প করতে পারি। তুমি তো জানোই আমি গপ্পবাজ মানুষ!’

তারপর একটু ইতস্তত করে বেদনার্ত কন্ঠে বলল, ‘আর শোন, তোমার ভয় পাওয়া চেহারাটা দেখে আমি খুব কষ্ট পাচ্ছি। সামিয়া, আমি কোন হিংস্র পশু নই যে সুযোগ পেয়েই শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ব। তুমি আমার বিবাহিতা স্ত্রী, আমরা সারাজীবন একসাথে থাকব। আমরা একে অপরকে জেনে বুঝে বন্ধু হবার সময় নিই। বাকীটা যখন সময় হবে তখন দেখা যাবে’।

কাপড় বদলাতে বাথরুমে চলে যায় মাসরুর। অবাক হয় সামিয়া। মাসরুরের খোলামেলা স্বভাব দেখে প্রকৃতপক্ষে মনের গোপন কুঠুরীতে এমনই একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল সামিয়ার, কিন্তু ওর প্রকৃত মানসিকতা বুঝতে পেরে মনে মনে লজ্জাই পায় সে।

দু’জনে নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসেই গল্প শুরু করে। মাসরুর দেয়ালে হেলান দিয়ে আরাম করে বসে, সামিয়া দুই হাঁটুর ওপর মুখ গুঁজে বসে। মাসরুর জানায় ওর বাবামা ভাই বোন কি কি পছন্দ করে, কি তাদের অপছন্দ, যেন সামিয়া তাদের বুঝতে পারে। ওর কথাবার্তায় সামিয়ার বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পায়। নিজের কথা শেষ করে মাসরুর সামিয়াকে বলে, ‘এবার তোমার ব্যাপারে কিছু বল যা আমি জানিনা’।

সামিয়া লজ্জা পায়। ওর কথা তো কেউ কখনো জানতে চায়নি! কিন্তু মাসরুরের বন্ধুসুলভ আচরনে ওর মনের কথাগুলো ভুরভুর করে বেরিয়ে আসে যা সে নিজের বাবাকেও বলতে পারেনি, ‘জানেন, আমি না স্বপ্ন দেখতাম আমি কোন দরিদ্র হতভাগা লোককে বিয়ে করব, ধরেন আবদুল্লাহ ভাইয়ের মত। তারপর আমার যত্ন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে তার জীবনের সমস্ত দুঃখ কষ্ট মুছে দেব। কিন্তু আমার তাক্কদীরে ছিলেন আপনি যার কোন অভাবই নেই! আপনার সাথে বিয়ের কথা আমি কোনদিন কল্পনাই করিনি!’

‘আমার কথা তোমার কল্পনায়ও আসেনি! কেন সামিয়া?’

সামিয়া খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল, ‘নাহ! ভাবিইনি কোনদিন। আপনার জন্য বুঝি মেয়ের অভাব হত? তাছাড়া আপনারা অনেক বড়লোক, আমরা গরীব; আপনি দেখতে ভাল, আমি খুবই সাধারন; আপনার ঝোঁক টাকার প্রতি, আমার পড়ার প্রতি- সব মিলেই ভাবিনি আমাদের বিয়ে হবার কোন সম্ভাবনা থাকতে পারে’।

মাসরুর আর কথা বাড়ালোনা, বলল, ‘অনেক রাত হয়েছে, চল শুয়ে পড়ি’।

সামিয়া জায়নামাজ ভাঁজ করে টেবিলের ওপর রেখে পেছন ফিরে দেখে মাসরুর কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও মাসরুরের দেখা নেই। একসময় সে বসা অবস্থাতেই ঘুমের কোলে ঢলে পড়ল।

ঘুম ভাঙ্গলো ফজরের আজান শুনে। তখনও মাসরুরের হদিস নেই। সামিয়া বুঝে পায়না একটা লোক বিয়ের রাতে বৌকে কিছু না বলে কোথায় হাওয়া হয়ে যেতে পারে? নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ কুর’আন তিলাওয়াত করে সামিয়া। মনটা একটু শান্ত হয়ে আসে, যদিও সে জানেনা ওর বিবাহিত জীবনের প্রথম লগ্নেই এমন অদ্ভুত ঘটনা কেন ঘটছে। এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে মাসরুর, চোখেমুখে গভীর ঘুমের চিহ্ন। ওর দিকে তাকিয়ে আছে সামিয়া, কিন্তু সে মনে হোলনা খেয়াল করল। বাথরুমে ওজু করে এসে নামাজে দাঁড়াল সে। সামিয়া ভাবল নামাজ শেষ হলে কথা বলবে, মনকে শান্ত রাখার জন্য আবার কুর’আন পড়ায় মনোযোগ দিল সে। একটু পর চোখ তুলে দেখে আবার মাসরুর উধাও!

ঘুম আর নির্ঘুমের মাঝে এক অদ্ভুত অবস্থায় কাটল সামিয়ার পরবর্তী কয়েক ঘন্টা। সাতটার সময় মাসরুরের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো সামিয়ার, ‘সামিয়া, আমি জানি গত রাতে নিশ্চয়ই তোমার ভাল ঘুম হয়নি। নতুন জায়গায় গেলে প্রথম প্রথম ঘুমোতে একটু কষ্ট হয়। তবু অনুরোধ করব উঠে রান্নাঘরে যাও। মা নাস্তা বানাচ্ছেন। তোমার কিছু করতে হবেনা, মা তোমাকে কিছু করতে দেবেনও না। তুমি শুধু পাশে দাঁড়িয়ে ওনার সাথে কথাবার্তা বল। এটা তোমাদের মাঝে গুড আন্ডারস্ট্যান্ডিং তৈরী করার একটা ভাল সুযোগ। এখন সবাই ঘুম। তোমাদের কথাবার্তায় কেউ ডিস্টার্ব করবেনা’।

সামিয়া ভালভাবে চোখ খোলার আগেই আবার মাসরুর উধাও। লোকটা বার বার যায় কোথায়?

চলবে……

Facebook Comments