banner

শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1074 বার পঠিত

 

ও বেলার গল্প

ম নি র মো হা ম্ম দ


গল্পটা তাদের জানা যারা ৯০ দশকে আমাদের সাথে বড় হয়েছেন, তাদের জীবনের জানা অধ্যায়! যা নিজ চোখে আমরা দেখেছি আর আমাদের আগামী প্রজন্ম হয়ত গল্পটা শুনে বলবে, “বাবা আসলেই কি সত্যি?” চলুন গল্পটা শুনে আসি। গল্পটা আবেগ আর ভালোবাসার এক মিশ্রণ।

তখনকার সময় এলাকার বেশিরভাগ বাড়ি ঘরই ছিল মাটির তৈরী। একটু অবস্থাপন্ন গেরস্তদের মাটির ঘরের উপরে টিনের চালা দেওয়া হত। আশে- পাশে কয়েক ক্রোশ এর মধ্যে পাকা বাড়ি চোখে পড়ত না। চোরের উৎপাত ছিল উল্লেখ করার মত। প্রায়ই সন্ধ্যে হলেই কোন না কোন বাড়ি থেকে চিৎকার শুনা যেত। বিশেষ করে গরু চুরির কথা। কেউ কেউ গোয়াল ঘরে মাছা বেঁধে থাকত গরু পাহারা দেওয়ার জন্য। প্রায়শই চোর ধরার খবর শুনা
যেত, দল বেঁধে চোর দেখতে যেতাম। চোরের মার খাওয়া আহত চেহারা দেখে নিজেদেরই তখন খুব খারাপ লাগত।

আমার কিছু বন্ধু ছিল, যারা স্কুল শেষে বাড়ি ফিরেই তাদের বাবার কাজে হেল্প করত। তাদের খেলাগুলোও ছিল অদ্ভুত।‘চারা‘ নামক একটা খেলা ছিল। মাটির কলস এর ভাঙ্গা টুকরা ছিল চারা। মাটিতে একটা ঘর কেটে একজন চারা ছুড়ে মারত। তারপর অন্য জনকে চ্যালেঞ্জ করা হতো ওই চারার
কাছাকাছি অন্য একটা চারা পৌঁছানোর। বাজিও ধরা হতো। বাজির বিভিন্ন উপকরণ ছিল,যেমন ম্যাচের খোসা বা বিভিন্ন সিগারেটের প্যাকেট। কখনো চকলেটের মোড়ক। এই খেলাটা খেলতাম উঁচু নিচু মাটিতে বা মাটির ঢিবিতে। এছাড়াও চারা খেলার বাজি ছিল কাল এক ধরণের গাছের বিচি। (এলাকায় বড়দিরা বা রনা গাছ) নামে পরিচিত।

প্রতি সপ্তাহে অনেককেই দেখেছি ব্যাগ ভরে সেই সব বিচি নিয়ে বাজারে সের হিসেবে বিক্রি করতে। মাঝে মাঝে লুকিয়ে লুকিয়ে চারা খেলা খেলতে যেতাম। প্রায়ই কারোনা কারো কাছে ধরা পড়ে যেতাম। শাস্তি হিসেবে আব্বার হাতে বেতের বাড়ি। আহারে কী মজার খেলাই না ছিল! প্রথমে আমার কিছু বন্ধুদের কথা বলেছিলাম, তাদের কিছু ক্ষমতা দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলতাম। বড় বড় গাছ খুঁজে খুঁজে পাখির বাসা থেকে পাখির ছানা চুরি করাই প্রধান কাজ ছিল তাদের। এদের দেখে দেখে নিজেও একবার চেষ্টা করতে গিয়ে গাছ থেকে পড়ে হাত ভেঙে এক মাস বিছানায় শুয়ে ছিলাম। তাদের অনেকের সাথেই
অনেক দিন দেখা নেই। কিন্তু সেই টানটা আজ সংসারের টানে কোথায় জানি হারিয়ে গেছে?

ধান কাটার মৌসুুমে প্রতিদিন সকাল বেলা কিছু ফেরিওয়ালা আসত। ধানের বিনিময়ে মুড়ির নাড়ু আর সেগারিন দেওয়া আটার রসগোল্লাহ খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতাম। গড়গড় শব্দ করে কটকটি ওয়ালা আসলে ভাঙা কাচের বোতল, বাতিল টিন আর পুরুনো স্যান্ডেলের ফিতা দিয়ে কটকটি খাওয়া, আহারে কী আনন্দ!

মাঝে মাঝে গলা উচিয়ে কেউ আওয়াজ করে রাস্তা দিয়ে গেলে বুঝে নিতাম গরুর চিকিৎসা করার জন্য কেউ যাচ্ছে। সেই আওয়াজ এর মাঝেও একটা ভিন্ন সুর ছিল, ছিল একটা আবেগ।

প্রতি বৃহ:পতিবার আমরা পাঁচজন নামে একটা ফকির গ্রুফ ছিল,যারা “মায়াগো আমরা পাঁচ জন” হাঁক ছেড়ে ভিক্ষা করত। বাড়িতে বাড়িতে মাটির হাড়ির পসরা সাজিয়ে আসত কুমাররা। কিছু মহিলা বিক্রেতা ছিল মসলা বিক্রিই ছিল তাদের প্রধান কাজ। মাঝে মাঝে সোয়া সের চালের বিনিময়ে মুডি ভাজার হাঁড়ি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরত তারা। আজ তাদের কাউকেই দেখিনা। কিন্তু তাদের কথাগুলো কেন জানি মনের আঙিনায় আলো ছড়ায় আজও। কলা গাছের গেইট আর মই দিয়ে নতুন জামাই আটকে সেলামী নেওয়া হত। সেলামী বাবাদথালা ভর্তি লাল চিনি আর বাতাসা দেওয়া হত। অনেকেই গেইট ফাঁকি দেওয়ার জন্য কাক ভোরেই নতুুন শ্বশুর বাড়ি চলে যেত।

কিছু কিছু ছেলেপুলে সিরিঞ্জের ভিতর লাল রং ঢুকিয়ে সাদা কাপড় নষ্ট করে দিয়ে দাঁত বের করে হাসত। মারামারি ঝগড়া ছিল বিয়ে বাড়ির নিত্য ঘটনা। সামান্য কারনে বিয়ে ভেঙে পর্যন্ত যেত। যাই হোক সবি ওবেলার
গল্প। আহারে আজ সবই শুধু স্নৃতি! প্রায়ই সাইকেলের সাথে টেপ রেকর্ডার বেঁধে পিছনে ব্যাটারি লাগিয়ে নতুন জামাই শ্বশুর বাড়িতে আসত। জামাইয়ের পিছনে পিছনে বাচ্ছাদের লাইন লেগে যেত আর টেপরেকর্ড এ বাজতো মামু-ভাইগন্নার কিচ্ছা। কী ভালোইনা লাগতো!

ঈদের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই বন্ধুদের সাথে পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়তাম। গোসল শেষ করার পর আম্মা আবার ঢলে ঢলে গোসল করাতেন। আগের দিন এক টাকা দিয়ে কিনে আনা রঙীন কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে নতুন জামা কাপড় পরে সেমাই খাওয়া,দাদার হাত ধরে ঈদের নামাজে যাওয়া কী যে আনন্দ ! আজ সবই আছে কিন্তু শৈশবের সেই ঈদের দিনের আনন্দগুলো জীবনের পরতে হাতরে বেড়াই জানি আর পাবোনা, সব যেন হারিয়ে গেছে কালের দহনে।

একদিন চাচা বিরাট এক টেপ রেকর্ডার কিনে আনলেন। বাড়িতে বিনোদনের নতুন মাত্রা যোগ হল। কয়েক মাইল দূর থেকে ব্যাটারি চার্জ করে আনা হত। বিকাল হতেই সেই টেপ রেকর্ডার শুনার জন্য আশে-পাশের লোকজন ছুটে আসত। বিভিন্ন ধরণের ভান্ডারি আর বাংলা ছায়া ছবির গানই ছিল তখনকার জীবনের এক মাত্র আনন্দ! কেউ কেউ গান শুনে বলত আহারে কী আজব যন্ত্র! মানুষের মাথাত কত বুদ্ধি! কেউ কেউ বলত, “শেষ, শেষ দুনিয়া আর বেশি দিন নাই, কেয়ামতের আলামত।”

আহারে তাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। কিন্তু তাদের কথাগুলো ছন্দের তালের মত আজও কানে বাজে।

তরুন কথা সাহিত্যিক,
মনির মোহাম্মদ।

Facebook Comments