banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 681 বার পঠিত

 

প্রতিবেশিনী….৬


আফরোজা হাসান


“একরাশ অভিযোগ ভরা কন্ঠে কাঠকে উদ্দেশ্যে করে পেরেক বলল, তুমি আমাকে অনেক ব্যথা দিচ্ছো, আমাকে আহত করছো। জবাবে পেরেক বলল, তুমি যদি আমার মাথায় হাতুড়ির আঘাত দেখতে তবে আমাকে ক্ষমা করতে।” রুপক হলেও এই উক্তিটিতে পেরেক আর কাঠের কথোপকথনটুকু ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ। অনেক সময়ই প্রিয়জন, কাছের বা দূরের কারো কথা, কাজ ও আচরণ আমাদেরকে কষ্ট দেয়, ব্যথিত করে। তাদের উপর অভিযোগ, অভিমান করার আগে একবার অন্তত তাদের পরিস্থিতি দেখা ও বোঝার চেষ্টা করা উচিত। আমার অভিজ্ঞতা বলে সম্পর্ক কাছের হোক কিংবা দূরের কাউকে কোন ব্যাপারে দোষারোপ কিংবা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ করার আগে একবার অন্তত তার অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করা উচিত। এই চেষ্টা বেশিরভাগ সময়ই সম্পর্কের মাঝে অকারণ কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কারণে দুরুত্ব ও তিক্ততা তৈরির পথকে রুদ্ধ করে। তোমার কি মনেহয়?

আমার মনেহয় আপনি সারাক্ষণ আমাকে অনুসরণ করেন, চোখে চোখে রাখেন।

মাহামের জবাব শুনে হেসে ফেললো আয়ান। হাসতে হাসতে বলল, মেয়েদের এই আরেক সমস্যা। হাজবেন্ড চোখ না রাখলে অভিযোগের শেষ থাকে না। আবার চোখে চোখে রাখলেও সীমাহীন বিরক্তির উদ্রেক হয়।

ভারসাম্য বলেও তো জগতে একটা জিনিস আছে। মধ্যমাবস্থা যাকে বলে। ছেলেদেরও আরেক সমস্যা হলো তাদের মাঝে এই মধ্যমাবস্থা নেই। কেউ কেউ আছে বৌয়ের দিকে চোখ ই রাখেনা। আর কেউ কেউ চোখ মোটে সরায় ই না।

তাহলে এখন করণীয় কি?

করণীয় হচ্ছে চোখ রাখতে হবে, পলক ফেলতে হবে এবং ভাবুক চোখ আকাশ-বাতাস, চাঁদ-তারা, ফুল-পাখী ইত্যাদিও দেখতে হবে।

কিন্তু কেউ কেউ যদি আকাশ-বাতাস, চাঁদ-তারা, ফুল-পাখী সবকিছুই তার স্ত্রীর ভেতর দেখতে পায়। তাহলে?

হেসে ফেললো মাহাম। জবাব না দিয়ে হাসতে হাসতে রান্নাঘরে রওনা দিলো।রান্নাঘরে ঢুকে বাটিতে অনেকগুলো পেঁয়াজ মাঝখান থেকে কেটে ভিজিয়ে রাখা দেখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তার পেছন পেছন এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো আয়ানের দিকে তাকালো।

রান্নাঘরের ভেততে ঢুকতে ঢুকতে আয়ান বলল, অনেক করেছি কিন্তু আর সম্ভব না পেঁয়াজের সাথে তোমাকে শেয়ার করা।

মানে?

মানে আমার জীবনের সবচেয়ে বিমুগ্ধকর মূহুর্তগুলোর একটি যখন আমার ভালোবাসাকে তোমার চোখে প্রাপ্তির অশ্রু রুপে ঝরতে দেখি। তোমাকে কাঁদাতে চাই না কখনোই। কিন্তু যখন আমার কোন কথা বা কাজের ফলশ্রুতিতে তোমার চোখে আনন্দাশ্রু দেখি তখন নিজের প্রাপ্তির ভান্ডারকে আরো সমৃদ্ধ মনেহয়। তোমার চোখের আনন্দাশ্রু শুধু আমার একার। এতে আর কারো কোন অধিকার নেই।

মাহাম হেসে বলল, কিন্তু এরসাথে পেঁয়াজের কি সম্পর্ক?

সম্পর্ক হচ্ছে প্রায় দিনই আমরা দুজন গল্প করতে করতে রান্না করি। তুমি তখন মোটেই ব্যথিত থাকো না। বরং অনেক আনন্দে থাকো। সেইসব আনন্দের মূহুর্তে তোমার চোখ থেকে অশ্রু আমার কারণে ঝরে না। ঝরে পেঁয়াজ কাটতে গিয়ে। এটা আমার পক্ষে কিছুতেই মেনে নেয়া সম্ভব না। আমার অধিকারহরণের শাস্তি স্বরুপ তাই মাথা কেটে দুই ফালি করে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে পেঁয়াজকে।

মাঝেমাঝে কিছু কর্মকাণ্ড দেখলে তোমাকে ছোট্ট বাবু মনেহয়। হাসতে হাসতে বললো মাহাম।

মাহামকে কাছে টেনে নিতে নিতে আয়ান বলল, যেসব কর্মকাণ্ড দেখতে আমার বৌ মন খারাপ ভাব ছেড়ে এমন মনের আনন্দে হাসবে। সেসব কর্মকাণ্ড করার জন্য ছোট্ট বাবু হতে আমার কোন আপত্তি নেই।

শাবাবের বাসা থেকে আসার পর থেকেই দেখছি নানান কথা বলে তুমি মন ভালো করার চেষ্টা করছো। আমার মন খারাপ কে বললো?

সে কি তুমি জানো না কে বলেছে? মাহামের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বিস্ময় মাখা কন্ঠে উল্টো প্রশ্ন করলো আয়ান।

শাবাব বলেছে? কিন্তু বাবা মামণির কথা ভেবে হঠাৎ আমার খুব মনখারাপ লাগছে সেকথা তো শাবাবকে বলিনি আমি। বললে শাবাবেরও মন খারাপ হতো।

আমাকেও শাবাব বলেনি।

তাহলে?

তুমি আর আমি ছাড়াও এই ফ্ল্যাটে যার অস্তিত্ব বিদ্যমান সে বলেছে।

তুমি আর আমি ছাড়া এই ফ্ল্যাটে তো আর কেউই থাকে না।

থাকে থাকে। তুমি হয়তো খেয়াল করোনি।

থাকে? কে থাকে? আমি খেয়াল করিনি মানে? আমার অজ্ঞাতে আমার বাসায় কেউ কিভাবে থাকবে? বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলো মাহাম।

তোমার অজ্ঞাতে তোমার বাসায় কারো থাকাটা অসম্ভব হলেও, সে সম্ভব করে নিয়েছে।

কিন্তু সে কে?

তোমার আচরণ।

এতক্ষণের বিস্ময়, উত্তেজনা মূহুর্তেই মিলিয়ে গেলো মাহামের। হেসে ফেললো। আয়ানও হেসে বলল, কি তুমি আর আমি ছাড়া তার আলাদা অস্তিত্ব নিয়ে এখন নিশ্চয়ই আর দ্বিমত নেই?

দ্বিমতের তো প্রশ্নই আসে না। একইসাথে তোমার রসবোধের অস্তিত্বেও দ্বিমত নেই।

দাম্পত্য জীবনে রসবোধের প্রয়োজনীয়তা কিন্তু অপরিসীম। অনেক কঠিন বিষয়কেও রসে কোট করে সহজ করে তোলা যায়। এটাও একটা আর্ট। লাল মোহন মিষ্টির কথাই ধরো। তেলে ভাজার পর কেমন কালচে আর শক্ত থাকে। অথচ রসে দেয়া মাত্রই কি চমৎকার নরম ও সুস্বাদু হয়ে যায়। দেখতেও কত লোভনীয় লাগে। শুকনো, বিমর্ষ সম্পর্ককেও এমন ভালোবাসা, সমঝদারির রসে ভিজিয়ে আকর্ষণীয় করে তোলা সম্ভব।

আমার বাবা এই শিল্পে খুবই দক্ষ একজন শিল্পী। এই শিল্পে আমার গুরু কিংবা আইডলও বলতে পারো।

সেজন্যই মনেহয় বাবার ছেলেও মাশাআল্লাহ বিরাট দক্ষ এই শিল্পে। হাসতে হাসতে বললো মাহাম।

আয়ানও হেসে বলল, মার রাগ, বিরক্তি, ক্লান্তিকর মূহুর্তগুলোকে বাবা এত চমৎকার করে রাঙিয়ে দিতেন। সেসব দেখে তখন থেকেই আমার শখ ছিল আমিও ওমন সঙ্গী হবো আমার স্ত্রীর তরে।

সন্তানদের উপর বাবা-মার দাম্পত্যজীবনের প্রভাব অনেক বেশি তাই না? সুখী, সমঝদার দম্পতিদের সন্তানরা স্বভাবগত ভাবেই অনেক সমঝদার, হাসিখুশি হয়। অন্যকে সম্মান দিতে জানে, আন্তরিকতা, সহমর্মিতা নিয়ে পাশে এসে দাঁড়াতে জানে অসহায় মূহুর্তে। ভালোবাসতে জানে ভালোবাসার মতো করে। অপরদিকে বাবা-মার নিত্য কলহ দেখতে দেখতে যেসব ছেলেমেয়েরা বড় হয়, তারা নিজেদের অজান্তেই ঐ সমস্ত নেতিবাচক গুণ নিজ চরিত্রে ধারণ করে ফেলে। নাজমুল ভাইয়ের সাথে মনেহয় এমনটাই ঘটেছে। ইলমা একদিন বলেছিল ওর শ্বশুর নাকি এখনো সামান্য কারণেই ওর শ্বাশুড়ির গায়ে হাত তোলেন। নাজমুল ভাই বাবা-মায়ের এসব দ্বন্দ্ব-সংঘাত দেখতে দেখতেই বড় হয়েছে। স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা, অসম্মানজনক কথা বলা, মানুষের সামনে স্ত্রীকে হেয় করা ইত্যাদি তাই স্বাভাবিক অবস্থায় উনার কাছে খারাপ কিছু মনেহলেও, রাগের সময় খুব স্বাভাবিক ভাবে নিজেই এই কাজগুলো করতে পারে।

তুমি এখনো ইলমা আর নাজমুলকে নিয়েই ভাবছো? কারো সমস্যা শুনে নিজেই যদি মন খারাপের চাদর জড়িয়ে বসে যাও, তাহলে সমস্যার সমাধানে ভূমিকা রাখবে কি করে? আগামীকাল তো ইনশাআল্লাহ দেখা হচ্ছেই আমাদের সবার। তখন আলোচনা করা যাবে এই বিষয়ে। এখন তাই ইলমা আর নাজমুলের ভাবনা ছেড়ে এমন কিছু ভাবো যাতে তোমার মনে ভালো লাগা গুঞ্জন তুলবে। অনেকদিন তোমার গল্প লেখার বিষয়ে কিছুই বলছো না। নাকি অবসর অন্য কোন ভালো লাগা খুঁজে নিয়েছে লেখালেখির বদলে?

মাহাম হেসে বলল, না অন্য কোন ভালো লাগা খুঁজে নেয়নি অবসর। তাছাড়া নিজের ভাবনাদের শব্দের ফ্রেমে বেঁধে রাখাটা আমার কোন শখ কিংবা শুধুই ভালো লাগা না। লিখতে আমি ভালোবাসি। ঠিক যেমন করে বৃষ্টি ভালোবাসি, জোছনা ভালোবাসি, প্রকৃতির সান্নিধ্য ভালোবাসি। তবে আমিও অনেকদিন থেকেই ভাবছিলাম নতুন কোন গল্প লেখার কথা। জীবনের গল্প। পরিবারের গল্প। পরিবারের সাথে জড়িয়ে থাকা মায়াময় বন্ধনের গল্প। সেইসব মায়াবী বন্ধনের ভাঁজে ভাঁজে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট ঢেউ, চড়াই-উৎরাই, আশা-নিরাশা, তিক্ততা-মিষ্টতার গল্প। যে গল্পে থাকবে জীবনের সমস্ত রঙ, রুপ, আলো-ছায়ায় সংমিশ্রণ। যে গল্প চিন্তার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে, সরলতা, কোমলতা, স্বিগ্ধতায় ফুল ফোটাবে মন বাগিচায়। যে গল্প অজানতেই ঠোঁটের কোণে ফুটিয়ে তুলবে এক চিলতে হাসি, কখনো ঝরে পড়বে দু’ফোঁটা অশ্রু রূপে। অমাবস্যার ঘোর আঁধার পেরিয়ে, সুবহে সাদিকের সন্ধানে অক্লান্ত পথ চলে সুহাসিনী ভোরের স্বপ্ন দেখাবে যে গল্প। যে গল্প আশা জাগানিয়া গান শুনিয়ে উন্মুক্ত করবে রুদ্ধ মনের আলোকিত বাতায়ন।

তাহলে আর দেরি কেন যতদ্রুত সম্ভব শুরু করে দাও তোমার গল্প লেখা।

ইনশাআল্লাহ শুরু করবো। কিন্তু তারআগে আগামীকাল মেহমান আপ্যায়নের আয়োজন শুরু করি। শাবাবের বাসা থেকে ফোন দিয়েছিলাম ইলমাকে। বলেছে রাত পোহালেই নাকি হাজির হয়ে যাবে। সকালের নাস্তা করবে আমাদের সাথে, দুপুরে খাবে, বিকেলে আবারো নাস্তা করবে, এরপর রাতের খাবার খেয়ে তবেই যাবে। অবশ্য বিকেলের নাস্তা আর রাতের খাবারের আয়োজন শাবাব আর আরিফী ভাইয়া করবে বলেছে। আমাদেরকে শুধু সকাল আর দুপুরের আয়োজন করতে হবে।

ঠিকআছে। চলো তোমাকে সাহায্য করি।

এরপর দুজন মিলে গল্প করতে করতে মেহমান আপ্যায়নের আয়োজনে মনোযোগ দিলো।

পর্ব-৫

Facebook Comments