banner

রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 4383 বার পঠিত

 

আসুন “জরায়ু ক্যান্সার’ সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই


ফাতেমা শাহরিন


জরায়ু মুলত কি?

জরায়ু বা uterus হল, স্ত্রী প্রজনন তন্ত্রের একটি অন্যতম প্রধান অঙ্গ। জরায়ু একটি হরমোন প্রতিক্রিয়াশীল অঙ্গ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন হরমোন ক্ষরণের দ্বারা এর কার্যপ্রণালী নিয়ন্ত্রিত হয়। গর্ভধারণ কালে ফিটাস (শিশু) জরায়ুর অভ্যন্তরে বড়ো ও বিকশিত হয়। – উইকিপিডিয়া

জরায়ু ক্যান্সার কি?

হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচ. পি. ভি) এর দীর্ঘমেয়াদী সংক্রমণ জরায়ু-মুখ ক্যান্সারের প্রধান কারণ। জরায়ু ক্যান্সারকে মৃত্যুর মুল কারণ মুলত সাইলেন্ট কিলার অর্থাৎ এই অসুখ দেখা দিলে অনেক সময় নারীরাই কোন লক্ষণ বুঝতে পারেন না। ফলে রোগ সনাক্ত করায় বিলম্বিত হয়।

জরায়ু ক্যান্সার কয় ধরনের হয়?

জরায়ুর ক্যান্সার বা যা গর্ভাশয় ক্যান্সার মুলত জরায়ু কলা থেকে উদ্ভূত। তা অনেক ধরনের ক্যান্সারকেই বোঝায়।

এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যান্সার এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ুর ভেতরের আবরণ) গ্রন্থিগুলোর কোষ থেকে এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমাসের সৃষ্টি হয়। যার মাঝে সহজে চিকিৎসাযোগ্য এন্ডোমেট্রোয়েড এডেনোকার্সিনোমা, ছাড়াও ইউটেরিন প্যাপিলারি সেরোস কার্সিনোমা এবং ইউটেরিন ক্লিয়ার-সেল কার্সিনোমার মত ভয়াবহ ক্যান্সার অন্তর্ভুক্ত।’ এন্ডোমেট্রিয়াল স্ট্রোমাল সারকোমার উৎপত্তি এন্ডোমেট্রিয়াম (জরায়ুর ভেতরের আবরণ) সংযোজক কলা থেকে, তবে এন্ডোমেট্রিয়াল কার্সিনোমাসের তুলনায় এর বিস্তার অনেক কম।’ ম্যালিগন্যান্ট মিক্সড মুলেরিয়ান টিউমার অত্যন্ত বিরল এন্ডোমেট্রিয়াল টিউমার যেখানে গ্ল্যান্ডুলার (কার্সিনোমাটাস) এবং স্ট্রোমাল (সার্কোম্যাটাস) উভয় বিভাজন লক্ষ্য করা যায়- কার্সিনোসারকোমা উচ্চতর কার্সিনোমার মতো আচরণ করে।’

সার্ভিকাল ক্যান্সার  জরায়ুর নীচের অংশের সাথে যোনির উপরের অংশের সাথে সংযোগ সৃষ্টিকারি জরায়ুমুখের ক্যান্সার।

ইউটেরিন সারকোমা মায়োমেট্রিয়ামের সারকোমা, বা জরায়ুর পেশী স্তর, সাধারণত লেইওমায়োসারকোমাস।

গর্ভকালীন ট্রফোব্লাস্ট রোগ গর্ভাবস্থার কলা থেকে উদ্ভূত নিউপ্লাস্টিক প্রক্রিয়াগুলির সাথে সম্পর্কিত যা প্রায়শই জরায়ুতে অবস্থিত।

কোন বয়সে নারীদের বেশি হয়?

জরায়ু মুখের ক্যান্সার প্রাপ্ত বয়স্ক হলে হওয়ার কথা বলে কেউ কেউ ভাবতে পারেন, এটি ভুল ধারণা । যেকোন বয়সেই নারীদের জরায়ু ক্যান্সার হতে পারে। জরায়ুর ক্যান্সার সাধারনত ৩০ থেকে ৫৫ বছর বয়সী মহিলাদের মধ্যে বেশী হয়ে থাকে। এবং আরও বলা হয় যে, যৌন সঙ্গম এর পরবর্তীকালীন সময়ে রোগটি হয়ে থাকে।

জরায়ু ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ার স্তরসমুহ

চারটি স্তর রয়েছে। রোগীর চিকিৎসা পদ্ধতিও নির্ভর করে এই চারটি স্তরের উপর। মূলত ক্যান্সার কতটা ছড়িয়ে পড়েছে, তার উপর নির্ভর করে স্তরের বিন্যাস।

স্তর-১: প্রাথমিক পর্যায়, ক্যান্সার শুধুমাত্র জরায়ু মুখে সীমাবদ্ধ রয়েছে।

স্তর-২: ক্যান্সার জরায়ু মুখের পাশে যোনীপথে কিছুটা ছড়িয়েছে।

স্তর-৩: ক্যান্সার যোনীপথের নিচের দিকে অথবা পাশে ছড়িয়েছে

স্তর-৪: ক্যান্সার সামনে মূত্রথলি, পেছনে অন্ত্রথলি অথবা দূরে যেমন ফুসফুস বা মস্তিষ্কে ছড়িয়েছে।

স্তর অনুসারে চিকিৎসার নিয়ম

অপারেশন এখানে স্তর (১ ও ২) এর প্রাথমিক অবস্থা পর্যন্ত সাধারণত ডাক্তার অপারেশন ও ঔষধ সেবন করতে বলেন। তবে এটি জরায়ুর অনেক বড় একটি অপারেশন।

রেডিওথেরাপী বাকী স্তর (৩ ও ৪) এর জন্য রশ্মি চিকিৎসা (রেডিওথেরাপী) অথবা ক্যান্সার নির্মূল ওষুধ (কেমোথেরাপি) দেওয়া হয়।

সর্তকতা ও সন্তান

রোগী গর্ভবতী থাকাবস্থায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার ধরা পড়লে, তখন গর্ভের শিশুর জীবনের নিশ্চয়তা না দিয়ে রোগীকে বাঁচানোর জন্য রশ্মি চিকিৎসা অথবা অপারেশন করা জরুরী হয়।

জরায়ু ক্যান্সারের সাধারণ কারণ

-বাল্য বিবাহ।
-অল্প বয়সে সন্তান হওয়া।
-ঘন ঘন সন্তান হওয়া।
-ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতা।
-দীর্ঘদিন সময় জন্ম নিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন।
-একাধিক সেক্স সঙ্গী।

জরায়ু ক্যান্সারের হওয়ার পূর্ববর্তী কিছু লক্ষণ

-তলপেট ও কোমরে ব্যথা
-ঘন ঘন মূত্রত্যাগ করা ।
-গ্যাস , বদহজম , কোষ্ঠকাঠিন্য।
-হালকা খাবারের পর পেট ভর্তি লাগা , পেটে অস্বস্তি লাগা , ইত্যাদি পেটের কোন সমস্যা খুব বেশি হলে তা জরায়ু ক্যানসারের লক্ষণ হতে পারে ।
-পেটে অতিরিক্ত ব্যথা কিংবা পেট ফুলে থাকা ।
-বমি বমি ভাব কিংবা বার বার বমি হওয়া।
-ক্ষুধা কমে যাওয়া ।
-অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পাওয়া।
-ওজন অনেক বেশি কমে যাওয়া।
-সেক্স করার সময় রক্তপাত।
-সেক্স করার সময় ব্যথা পাওয়া।
-অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ করা ।
-নারীদের মেনোপজ হওয়ার পরেও ব্লিডিং হওয়া ।
-দুর্গন্ধযুক্ত সাদা স্রাব।

বাংলাদেশে এই রোগের অবস্থা

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ১১ হাজার নারী জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আর এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি নারী। এর মধ্যে নিরক্ষর ও যৌনকর্মীদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

“লজ্জা” কি সমস্যা বাংলাদেশের নারীদের

আন্তর্জাতিক ক্যান্সার গবেষণা এজেন্সি সাম্প্রতিক এক জরীপে বলছে, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ছয় হাজারের বেশি নারী জরায়ু মুখের ক্যান্সারে মারা যাচ্ছে। প্রতি বছর নতুন করে ১২ হাজারের মতো নারীর শরীরে এই ক্যান্সার সনাক্ত হচ্ছে। অথচ অন্য ধরনের ক্যান্সারের তুলনায় জরায়ু মুখের ক্যান্সার খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। বাংলাদেশের নারীরা শুধুমাত্র লজ্জার কারণে তাদের সমস্যার কথা বলতে চান না।

জরায়ু ক্যান্সারের সরকারী স্বাস্থ্যসেবা

সরকারি হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও জরায়ু মুখের ক্যান্সার নির্ণয়ের প্রাথমিক ধাপটি বিনামূল্যে দেওয়া হয়।

পরীক্ষার মাধ্যমে জরায়ু ক্যান্সার সনাক্ত

– সাধারনত DNA অথবা Pap Test এর মাধ্যমে সম্ভাব্য জরায়ু ক্যান্সার বা Dysplasia সনাক্ত করা হয়
– DNA পরীক্ষার মাধ্যমে HPV সংক্রমণের ঝুঁকি নির্ধারণ করা হয়
– বায়পসির মাধ্যমে Pre-cencer বা ক্যান্সার কোষ নিশ্চিত করা হয়।

a. Paps smear test.
b. Ultasonography.
c. Biopsy.
d. CT Scan.

জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধ

সচেতনতা সচেতনতা থাকলেই এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পরিছন্নতা ব্যাক্তিগত পরিছন্নতা রক্ষা করা।
পয়ঃ প্রণালী সাস্থ্য সম্মত পয়ঃ প্রণালীর ব্যাবস্থা করা।
খাবার পচাঁ বাসি, খাবার না খাওয়া।

মনে রাখবেন, বিশ্বে প্রতি ২ মিনিটে একজন মা এই মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে করুণ ভাবে মৃত্যু বরণ করেন। আমাদের দেশে মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ এই জরায়ুতে ক্যান্সার। একটা কথা মনে রাখা দরকার, জরায়ু ক্যান্সারের রোগীকে সারাজীবন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে রাখা দরকার। রোগীর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা অথবা ক্যান্সারের পুনরুত্থান-ইত্যাদি কারণে রোগীকে নিয়মিত ডাক্তারের নিবিড় তত্ত্বাবধানে রাখার নিয়ম।

রেফারেন্স

  • ১. উইকিপিডিয়া
    ২. বিবিসি নিউজ
    ৩. পরিবার পরিকল্পনা পরিষদ
    ৪. ন্যাশনাল ডাক্তার ফোরাম
    ৫. ক্যান্সার অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ
    ৬. ইউনাইটেড হাসপাতাল বাংলাদেশ
  • ছবিসুত্র: ইন্টারনেট
Facebook Comments