banner

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 493 বার পঠিত

 

অতিমাত্রায় ভালোবাসেন?

অতিমাত্রায় ভালোবাসেন?


ডা. মারুফ রায়হান খান


গতকালের অভিজ্ঞতাটা বলতে চাই৷

অতিরিক্ত ভালোবাসা জিনিসটা বোধহয় কখনও কখনও খারাপ ফল নিয়ে আসে। শুধু খারাপ না, বেশ খারাপ। গতকালের অভিজ্ঞতা বলি।

মধ্যবয়স্ক রোগী। প্রচণ্ডমাত্রার বুকে ব্যথা। বুক ধড়ফড়। ঘাম। পেশেন্ট শকে। অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা করা যাচ্ছে সম্ভবত রোগীর হার্ট এটাক হয়েছে। ইসিজিতে চলে এলো ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া। মনিটরে দেখাচ্ছে হার্ট রেইট ২৪৩ বিটস পার মিনিট! এটা এমনই এক খারাপ অবস্থা যে কার্ডিওলজিতে কাজ করে এমন কোনো চিকিৎসক আমি দেখিনি যিনি বিশেষভাবে এলার্ট না হয়ে যান এমন রোগী এলে। ব্রেইনের মাঝে অটোমেটিক্যালি ‘স্পেশাল ইমার্জেন্সি এটেনশান’-এর সাইরেন বেজে ওঠে। পেশেন্টের যা অবস্থা তা হৃদরোগ শাস্ত্র অনুযায়ী ডিসি শক দিয়ে তার হার্টের রিদম স্বাভাবিক আনার চেষ্টা করতে হবে অনতিবিলম্বে। ডিসি শক দেওয়ার আগে আমরা পেশেন্ট পার্টিকে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলি। পরে আবার অভিযোগ না যায় ডাক্তার শক দিয়ে আমার ভালো রোগী মেরে ফেলেছে। কে-ই বা চায় অনলাইন পত্রিকার “এ কী করলেন লোভী ডাক্তার : কারেন্টের শক দিয়ে কথা বলতে থাকা রোগীকে খুন (দেখুন ভিডিওসহ)” শিরোনাম হতে?

বুঝিয়ে বলা হলো বিস্তারিত। শক না দিলে মৃত্যুর সম্ভাবনা যে প্রবল তাও জানালাম। রোগীর স্ত্রী অসম্মতি জানালেন এবং যুক্তি হিসেবে যা দাঁড় করালেন তা আমাকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে। বললেন উনি ‘নরম’, শক দেবেন না৷ পেশেন্ট পার্টি পারমিশান না চাইলে আমরা শক দিই না। ভাবলাম ওষুধ দিয়ে চেষ্টা করে দেখা যাক। প্রোটোকোল ম্যানেজমেন্টের সব ওষুধ দেওয়া হলো। এমিওডারোন (এ রোগের প্রধান ওষুধ) নামক ওষুধটি সাপ্লাই নেই। লিখে দিলাম বাইরে ফার্মেসি থেকে ৮ এম্পুল নিয়ে আসতে। রোগীর সাথের লোক গেলেন। এই যে গেলেন তার আর দেখা মেলে না৷ আমি আরও আড়াইশো রোগীর ব্যস্ততার মাঝেও চিন্তিতবদনে রোগীর কাছে যাই। সেই ওষুধ তো আর আসে না। রোগীর স্ত্রী বসে বসে পান খায়। মেজাজ চরমে উঠে গেলো। কিছু বললে বলবে রোগীর সাথে দুর্ব্যবহার করলেন ডাক্তার। ঘণ্টা যায় দুঘণ্টা যায় তিন ঘণ্টা যায়… সে তো আসে না। রোগীর অবস্থা খারাপ থেকে খারাপ হতে থাকে। এরমধ্যে একবার এসে বলে রোগীর এখানে অস্থির লাগছে, বাসায় চলে যেতে চায়, ছুটি দিতে! আক্কেল দেখলে! দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টা পর তারা ওষুধ নিয়ে এসেছেন। ততোক্ষণে রোগী মৃতপ্রায়। শুরু করা হলো ওষুধ। কী ভাবছেন? বেঁচে গেলো? নাহ ডাক্তাররা ম্যাজিশিয়ান না। এই রোগী বাঁচানো যায় না। কোনো চিকিৎসকের পক্ষে সম্ভব না। মনিটরে প্রায় যখন স্ট্রেইট লাইন চলে এসেছে তখন রোগীর ওয়াইফ বলে আপনারা রোগী বাঁচাতে যেভাবে ভালো হয় করেন শক দিতে চাইলে দিন!! এই কথাটা সাড়ে ৪ ঘণ্টা আগে যদি বলতেন তিনি!

এই মৃত্যুর দায়টা আসলে কার? এই রোগের চিকিৎসা আমি জানি, আমার কাছে মেশিন ছিল আমি কেন দিতে পারলাম না? আমার চোখের সামনে কেন রোগী মারা গেলো? আপনি আপনার স্বজনকে অতিমাত্রায় ভালোবাসেন মানলাম, আমিও আমার রোগীকে কম ভালোবাসি না। জানপ্রাণ এক করে আমার রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। মাঝেমধ্যে আপনার ‘আলগা আজাইরা দরদ’-এর জন্য পারি না। লোকটা শুধু তড়পাচ্ছিল–এই স্মৃতি আমাকে দংশন করে। এটা তো শুধু একটা রোগীর কথা… গতকাল ডিউটিতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগ ছিল না এমন অবস্থা ছিল। তবুও এক রোগীর লোক প্রায় তেড়ে এসেছিল তার সিরিয়াস রোগীর জন্যে আরেক রুমে অন্য ডাক্তারকে ডাকতে বলায়। আমি আর ইন্টার্ন–কয়জনকে একসাথে দেখা সম্ভব? …রাত সাড়ে এগারোটায় যখন ফিরলাম তীব্র মাথাব্যথা, ঘুমের ওষুধ খেয়েই আমাকে ঘুমাতে হয়েছে। আমি বিনা বেতনে কাজ করি।

#পোস্টগ্রেজুয়েশানের_দিনগুলো -১০

Facebook Comments