আফরোজা হাসান
ছোট ছেলের বৌকে চুপচাপ বাগানে বসে থাকতে দেখে বুকের ভেতর কষ্টের যে নদীটা সময়ের শীতল প্রবাহে বরফে ঢেকে গিয়েছিলো তা আবার গলতে শুরু করলো আফসানা রহমানের। নিজের বিয়ের পরের সময়গুলোর স্মৃতি ভেসে উঠলো মনের পর্দার। বিশাল বড় পরিবারের বড় বৌ হিসেবে যখন শ্বশুরবাড়িতে ঢুকেছিল, মনে কত হাজারো রকমের স্বপ্নই না ছিল তার। কিন্তু মাস ঘুরতে না ঘুরতেই সেই স্বপ্নের স্থান দখল করে নিয়েছিল অনিশ্চয়তা। মনে হতো যেন মাঝ সমুদ্রে আটকা পড়েছে। চারিদিকে কোথাও কোন কূল কিনারা চোখে পড়তো না। কোন কাজ না পারলে শিখিয়ে দেবার কেউ ছিল না কিন্তু বৌ কিছুই জানে না, কিছুই পারে না, বাবা-মা কিছুই শেখায়নি এসব বলার মানুষের কোন অভাব ছিল না। ভাল-মন্দ পরামর্শ দেবার কেউ না থাকলেও দোষ খুঁজে বের করার মত অনেকেই ছিল। শত কাজ করেও কিছুতেই শাশুড়ির মন রক্ষা করা যেত না।
বুক চিড়ে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আফসানা রহমানের। এটা ঠিক যে সময় ভালো হোক বা খারাপ কেটেই যায় কিন্তু স্মৃতি সবসময় রয়ে যায় মনের মাঝে। তাই সময় যেমনই হোক মানুষের আপ্রাণ চেষ্টা থাকা উচিত স্মৃতি যেন যাতনাকর না হয়। কেননা অতীতের সেইসব স্মৃতিরা বর্তমানের সুন্দর সময়গুলোকেও ম্লান করে দেবার ক্ষমতা রাখে। ধীর পায়ে ছেলের বৌয়ের কাছে রওনা হলেন আফসানা রহমান। শাশুড়িকে দেখে আলিসবা উঠতে গেলে তাকে ধরে বসিয়ে আফসানা রহমান হেসে বললেন, বোস মা আমি তোমার সাথে গল্প করতেই এসেছি। বিয়ের পর নানাধরনের ব্যস্ততা, তারপর তোমাদের ঘুরতে যাওয়া সবকিছু মিলিয়ে তোমার সাথে তেমন করে কথা বলাই হয়ে ওঠেনি। জানাও হয়নি তোমার কেমন লাগছে, কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি।
-শাশুড়ির কণ্ঠের মায়া আলিশবার অন্তরকে ছুঁয়ে গেলো যেন। মৃদু গলায় বলল, আমার কোন সমস্যা হচ্ছে না মা। আর এই বাড়ির সবকিছুই ভীষণ ভালো লাগছে।
-পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে আফসানা রহমান হেসে বললেন, তুমি যে সময়টার ভেতর দিয়ে যাচ্ছো, আমিও একসময় এমন সময় পার করেছি। তাই জানি কেমন লাগে, কেমন লাগছে তোমার। নিজের বাবা-মা-ভাই-বোন, চির চেনা গণ্ডি ছেড়ে নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের মাঝে এসে একটা মেয়ের কেমন অসহায় লাগে সেটা শুধু আরেকটা মেয়েই বোঝে।
-আপনারও বিয়ের পর এমন লেগেছিলো মা?
-কিছুক্ষণ চুপ থেকে আফসানা রহমান হেসে বললেন, সময়ের তারতাম্যে পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবনের ধরণ কিছুটা বদলে গেলেও অভিজ্ঞতা আসলে অনেকটা একই রকম। সেজন্যই তো আমি আপ্রাণ চেষ্টা করি তোমাদের অভিজ্ঞতা যেন সুন্দর হয়।
-আপনার জীবন অভিজ্ঞতা কি অনেক কঠিন ছিল মা?
-হেসে, আমাদের সময়টাই অন্যরকম ছিল। পুত্রবধূর সাথে একজন শাশুড়ি সেই আচরণই করতো যেমন আচরণ সে পেয়ে এসেছে তার শাশুড়ির কাছ থেকে। জীবনের শুরুতে শাশুড়ির প্রতি অনেক অভিমান ছিল কিন্তু একটা সময় বুঝেছি যে কন্টকাকীর্ণ পথে আমি চলছি, উনার পদযুগলও ক্ষত বিক্ষত তেমন পথে চলে। তাই তো নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমার পুত্রবধূদের এমন পথে চলতে দেবো না।
-কিন্তু এই বুঝ আসতে তো নিশ্চয়ই অনেক সময় লেগেছে তার আগে কিভাবে সহ্য করেছেন সবকিছু?
-অনেক চেষ্টার পরও যখন শ্বশুরবাড়ির কারো আচরণের মধ্যে কোন পরিবর্তন দেখলাম না আমার মনে হয়েছিল, যদি কিছু বদলায় তা শুধু আমার পক্ষ থেকেই বদলাবে, অপর পক্ষ থেকে না। তোমাদের শ্বশুর তখন আমাকে বলেছিলেন, মানুষের সবসময় আশা ধরে রাখা উচিত। এটা ঠিক যে আশা সবাই করে কিন্তু খুব কম মানুষের সেই আশার প্রতিফলে ভালো কিছু পায়। এমন তো হতে পারে যে তুমি সেই খুব কম সংখ্যক মানুষদের একজন। উনি সবসময় আমাকে আশা ধরে রাখার প্রেরণা যুগিয়েছেন এই বলে যে, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
-ঠিক কি হয়েছিলো মা?
-হেসে, ধীরে ধীরে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছিল। আসলে কি জানো একটা মেয়ে চাইলেই সংসারকে গড়তে পারে। সংসার গড়ার অপরিসীম ক্ষমতা দিয়ে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন প্রতিটা মেয়েকে। সমস্যা হচ্ছে নিজের এই ক্ষমতা সম্পর্কে বেশির ভাগ মেয়েই অবগত নয়। আর যারা অবগত তাদের বেশির ভাগই সবর ধরে রাখতে পারে না বেশিদিন। বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে যেহেতু আমরা নিঃস্বার্থভাবে ত্যাগ করতে শিখি না তাই রাখাটা কঠিনও বটে।
-আপনি কিভাবে সবর ধরে রেখেছিলেন?
-হেসে, আমি যে দুঃখ কষ্ট ব্যথা বেদনার মুখোমুখি হয়েছি, কাউকে আমি এরজন্য দায়ী মনে করিনি কখনোই। সবকিছুকে আমার নিয়তি মনেকরে নিয়েছি। তাই হয়তো আমার সাথে যা কিছু হয়েছে সবই আমাকে আরো মজবুত হতে সাহায্য করেছে। আমাকে কম্প্রোমাইজ ও সবর করতে শিখিয়েছে। এরপরও কখনোই যে ভেঙ্গে পড়িনি তা না। পালাতেও চেয়েছি একেকবার কিন্তু তোমাদের শ্বশুরের জন্য পারিনি।
-হেসে, বাবা সবসময় আপনার সাথে ছিলেন সেজন্যই আসলে আপনি কঠিন পথ পাড় করে আসতে পেরেছেন।
-হেসে, আলহামদুলিল্লাহ্! সত্যিই উনি পাশে না থাকলে আমি হাল ছেড়ে দিতাম। তবে সবচেয়ে বড় কথা কি জানো? যেদিন থেকে আমি শ্বশুর-শাশুড়িকে নিজের বাবা-মা, দেবর-ননদেরকে ভাইবোন ভাবতে পেড়েছিলাম মন থেকে সবকিছু অনেক সহজ হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। থাক এসব কথা এখন। তোমার কথা বলো।
-আজ বিকেলের নাস্তা সবার জন্য আমি বানাতে চাই মা।
-হেসে, রান্না করতে কি খুব পছন্দ করো?
-হেসে, জ্বী মা ভীষণ।
-হেসে, ঠিকআছে চলো নাস্তা বানানোর ফাঁকে ফাঁকে তোমার কথা শুনবো।
চলবে…….