banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 539 বার পঠিত

 

জোনাক নগরের আঙিনায়…২


আফরোজা হাসান


প্রচন্ড রকম ভালো লাগা নিয়ে নূরি যেই কাজগুলো করে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে যায়েদ যেদিন রান্না করে হেল্পার হিসেবে সাথে থাকা। বিয়ের আগে মামণিকে দেখে প্রায় সব ধরণের রান্নাই শিখে নিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর গত দেড় বছরে যায়েদের হেল্পারের কাজ করে পাকা রাঁধুনি বনে গিয়েছে। তবে যায়েদের সাথে যখন রান্না করতে আসে তখন রাঁধুনির চেয়ে হেল্পার হিসেবেই সাথে থাকতে ভালো লাগে নূরির। অন্যান্য ছুটির দিনের মতো আজও বাড়ির সবার জন্য সকালের নাস্তা বানানোর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিলো যায়েদ। নূরির হাজির হয়ে গেলো হেল্পার হিসেবে। অন্যান্য দিনের তুলনায় কেমন যেন চুপচাপ লাগছিল যায়েদকে নূরির কাছে। কিন্তু এই অনুভূতিটা কি তার নিজের মনের খুঁতখুঁত নাকি সত্যিই যায়েদ আজ চুপচাপ ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। গতরাতে নিজেকে অনেক শাসন করেছে। এরপর বুঝিয়েও বলেছে আর কখনো অন্যকারো সমস্যার প্রভাব নিজের জীবনে পড়তে দেবে না। অন্যের সমস্যা নিয়ে মশগুল না থেকে বরং যায়েদকে খুলে বলবে। কারণ যায়েদ শুধু বোঝেই না, তাকেও বুঝিয়ে দেয় অনেক সহজ করে সবকিছু। আরো কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার সাথে একটা ব্যাপার শেয়ার করতে চাচ্ছি।

যায়েদ নূরির দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, হুম, বলো।

সমস্যাটা আমার এক ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম ইলমা। মাস চারেক আগে বিয়ে হয়েছে ইলমার।

হুম, শুনেছিলাম বিয়ের কথা। তুমি বলেছিলে। কি সমস্যা ইলমার?

সমস্যা ওর শ্বশুরবাড়ির মানুষজন। আমার কাছে ইলমা পরামর্শ চেয়েছিল কিভাবে আপন করে নেবে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে। এমন কি করবে যাতে শ্বশুরবাড়ির সবাইও ওকে আপন করে নেবে। আমি ওকে আমার মতো করে পরামর্শ দিয়েছিলাম। আইমিন, আপনি যেমন আমাদের বিয়ের পর আপনার পরিবারের সবার সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। এবং আমি যেভাবে আম্মি আর বাপীর পছন্দ- অপছন্দ, ভালো লাগা ইত্যাদি জেনে এবং সেই মতো খেয়াল রাখতে চেষ্টা করেছি। জাকিয়া, জারিফা, রাওনাফ ভাবী, মাঈশা ফুপির সাথে যেভাবে বন্ধুত্ব হয়েছিল আমার। সেভাবেই সবকিছু করার পরামর্শ দিয়েছিলাম।

যায়েদ হেসে বলল, এটাকে কি ইলমার শ্বশুরবাড়ির মানুষেরা নেগেটিভ ভাবে নিয়েছে?

জ্বি। আপনি কি করে বুঝলেন?

এক মুহুর্ত সময় নিয়ে যায়েদ বলল, আমাদের পাশের ঐ বাড়িটাকে আগে আমার বড় ফুপি থাকতেন নিশ্চয়ই শুনেছো?

জ্বি আমি শুনেছি।

ফুপির বড় ছেলে মঈন আর আমি প্রায় সমবয়সী। আমরা দুইজন পড়াশোনাও করেছি একই সাবজেক্টে। ফুপির খুব ইচ্ছে ছিল জাকিয়ার সাথে মঈনের বিয়ে দেবার। কিন্তু মঈন আমাদের এক ক্লাসমেট ফারিয়াকে পছন্দ করার কারণে অমত থাকা স্বর্ত্বেও ফুপি বাধ্য হয়ে ওদের বিয়েতে রাজী হয়েছিলেন। বিয়ের পর প্রথম মাস খানেক ফুপি চুপচাপই ছিলেন। কিন্তু এরপর শুরু করেছিলেন কিচেন পলিটিক্স।

নূরি হেসে ফেলে বলল, কিচেন পলিটিক্স?

হুম, হোম পলিটিক্সকে পরিকল্পনা সমূহকে যেখানে আনজাম দেয়া হয়। কাঁটা-ছেঁড়া, জ্বালানো-পুড়ানো, বয়েলড-হাফ বয়েলড ইত্যাদি ইত্যাদি। যাইহোক, ফারিয়া চমৎকার একটি মেয়ে ছিল। ভীষণ আন্তিরক, মানিয়ে চলা স্বভাবের। ওর ফ্যামেলি খুব একটা ইসলামিক ছিল না। কিন্তু যেহেতু আমরা স্কুল থেকেই একসাথে ছিলাম। আমাদের উৎসাহে এবং নিজের চেষ্টায় ফারিয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করতো শরীয়তের সবকিছু মেনে চলতে। বিয়ের পরেও ফারিয়া আপ্রাণ চেষ্টা করতো শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দুই ননদ আর দেবরদের মন জুগিয়ে চলার। মঈন আর ফারিয়ার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আমরা মেডিকেল ফাইনাল ইয়ারে ছিলাম। এত পড়াশোনা চাপ থাকার পরেও যখনই সময় পেত ফারিয়া ছুটে আমাদের বাড়িতে চলে আসতো আম্মির কাছে রান্না শেখার জন্য। ক্লাস থেকে ফেরার পথে ননদদের জন্য চকলেট, কেক বা ওদের পছন্দের কিছু না নিয়ে আসতো না কখনোই। প্রায়ই ফুপির জন্য টুকটাক গিফট নিয়ে আসতো। এসব ফারিয়া করতো শ্বশুরবাড়ির সবাইকে আপন করে নেবার জন্য। তাদের ভালোবাসা পাবার জন্য। প্রায়ই আমার কাছে এসে পরামর্শ চাইতো আর কি করা যায় শ্বশুরবাড়ির মানুষগুলোর জন্য। আমি আমার জ্ঞানানুযায়ী পরামর্শ দেবার চেষ্টাও করতাম। ফারিয়াকে দেখে আমি জীবনে প্রথম জেনেছিলাম কখনো কখনো মানুষের প্রতি অকৃত্রিম আন্তরিকতা দেখানোর অনেক কঠিন প্রতিদান পেতে হয়। কারণ অকৃত্রিম আন্তরিকতা প্রদর্শনের জন্য যেমন বিশাল বড় একটা মনের দরকার হয়। ঠিক তেমনি কারো অকৃত্রিম আন্তরিকতাকে গ্রহণ করার জন্যও অনেক উদার দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী হতে হয়।

ফারিয়া ভাবীর আন্তরিকতাকে কি কেউ সহজ ভাবে মেনে নেয়নি?

মেনে তো নেয়ইনি উল্টো ফারিয়ার আন্তরিকতাকে ওর চালাকি, ধোঁকা দিয়ে মন জয় করার চেষ্টা ইত্যাদি নামকরণ করা হয়েছিল। আইমিন, সামনে সামনে ঠিকই ফারিয়াকে ভালো বলতো কিন্তু আড়ালে ওর উত্তম গুণাবলীর প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করা হতো। ফুপি যখনই সুযোগ পেতেন মঈনের কাছে ফারিয়ার ভালো কাজগুলোকে মন্দ ভাবে উপস্থাপন করতেন। ফুপির দুই কন্যাও নিষ্ঠার সাথে মায়ের সহযোগী হিসেবে একই ডিউটি পালন করতো।

সবকিছু মিলিয়ে শান্ত, সমঝদার স্বভাবের মঈন কেমন যেন অস্থির স্বভাবের হয়ে যেতে শুরু করেছিল। নিজের ভালো কাজগুলোকে অবমূল্যায়নের পাশাপাশি নিন্দিত হতে দেখে ফারিয়ার মনেও ধীরে ধীরে ক্ষোভের জন্ম হয়েছিল। আর ফুপি এটাই চাইছিলেন। মঈন আর ফারিয়ার মধ্যে সমস্যা তৈরি করতে। তাই ওদের মানসিক অস্থিরতার আগুণে ফুপি বিদ্বেষের ঘি ঢালতেন খুব যত্ন সহকারে। ফলশ্রূতিতে বিয়ের সাত মাসের মাথাতেই ডিভোর্স। ফারিয়া নিজেকে সামলে নিতে পারলেও মঈন পারেনি। সবকিছু মিলিয়ে মঈনের নার্ভাস ব্রেকডাউন হয়েছিল। এরপর আর মেডিকেলও কমপ্লিট করলো না। জীবনের প্রতি মঈনের সমস্ত আকর্ষণ, ভালো লাগা সব শেষ হয়ে গিয়েছিল। এখনো মঈন ছন্নছাড়া। পরবর্তীতে ফুপি আবার বিয়ে দিয়েছেন মঈনকে। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হয়নি। কোথায় হারিয়ে গিয়েছে ওর জীবনের উচ্ছলতা, আনন্দময়তা।

আর ফারিয়া ভাবী?

আলহামদুলিল্লাহ ফারিয়া অনেক ভালো আছে। আমার হসপিটালেই জব করছে চাইল্ড স্পেশালিষ্ট হিসেবে। তবে এরপর আর এখন পর্যন্ত বিয়ে করেনি। কিন্তু বদলে গিয়েছে ভীষণ রকম ওর চরিত্র। একমাত্র শিশুরা ছাড়া আর সবার সাথে ফারিয়ার আচরণ খুব বেশি কঠোর। মনেহয় যেন আন্তরিকতার রেশ মাত্র অবশিষ্ট নেই আর ফারিয়ার ভিতরে। কোমলতা, ভালোবাসা এখন ওর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। মঈন আর ফারিয়া আমার জীবনের অনেক বড় একটা শিক্ষা। বড় ফুপি যখন আমাদের বাড়িতে এসে মঈনের কথা বলেন আর আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন তখন আমার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটা কথা মনে পড়ে।

কি কথা?

“মেয়ের সম্মান মেয়েদের কাছেই সব চেয়ে কম। তারা জানেও না যে, এইজন্যে মেয়েদের ভাগ্যে ঘরে ঘরে অপমানিত হওয়া এত সহজ। তারা আপনার আলো আপনি নিবিয়ে বসে আছে”। নূরি একটু চিন্তা করলে তুমিও বুঝতে পারবে আমাদের সমাজে মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ব্যথিত, অপমানিত মেয়েদের দ্বারাই হয়। শ্বাশুড়ি হয়ে বৌকে, বৌ হয়ে শ্বাশুড়িকে, ননদ হয়ে ভাবীকে, ভাবী হয়ে ননদকে, ছেলের মা হয়ে মেয়ের মাকে, প্রতিবেশিনী হয়ে প্রতিবেশিনীকে, মেয়েরাই মেয়েদেরকে ছোট করে। একে অন্যের সুখের ঘরে বিষধর সাপ ঢুকিয়ে দেয়। মেয়েরাই আসলে মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু। একজন শ্বশুর বা দেবরের কারণের কোন মেয়ের ঘর ভেঙেছে এমন কথা কিন্তু সচারচর শোনা যায় না। কিন্তু মেয়েরাই যে মেয়েদের ঘর ভাঙে সেই উদাহরণ চোখ মেলে তাকালেই দেখা মেলে। সংসারে তাই মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকা উচিত অপর মেয়েদের থেকেই। বুঝেছো?

হুম! কিন্তু এমনটা হবার কারণ কি?

যায়েদ হেসে বলল, আচ্ছা তুমি সারাদিন চিন্তাভাবনা করো এই কথাগুলো নিয়ে। তারপরও যদি কারণ খুঁজে বের করতে না পারো আমি রাতে বুঝিয়ে বলবো ইনশাআল্লাহ।

এতটা ক্ষণ আমাকে টেনশন দেবেন আপনি?

হুম, দেবো। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় সেটা তো জানোই। ঠিক তেমনি জীবনকে নতুন উপলব্ধির রঙে রাঙাতে হলে চিন্তার সাগরে হাডুবুডু তোমাকে খেতেই হবে। সো তুমি হাবুডুবু খেতে খেতে খেতে ভেজিটেবল স্টু রান্না করো।

চলবে…

Facebook Comments