banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

Daily Archives: April 23, 2024

 

সেল্ফ এস্টিম পর্ব ৬: ক্রিটিকের সাথে পাল্লা দেয়ার উপায়

এই পর্বে ওভার জেনারালাইজেশন ও গ্লোবাল লেবেলিং এর বিরূদ্ধে কী করা যায় সে নিয়ে আলোচনা করা হবে। আগের পর্ব তে বলা হয়েছিল এ দুটো ক্ষেত্রে একটা ব্যর্থতাকে টেনে টেনে পুরো জীবনের/ব্যক্তিত্বের উপর দাগ ফেলা হয়। এই যেমন, মিটিং এ দেরি করে আসলাম, আমার মত অলস, অকর্মণ্য পৃথিবীতে কেউ নেই। বাসায় সুন্দরভাবে মেহমানদারি করতে পারলাম না, আমি জীবনেও ঘরকন্না শিখব না।

ওভারজেনারালাইজেশন গন্তব্য
ওভারজেনারালাইজেশন গন্তব্য

ওভারজেনারালাইজেশন যখনই মনের মধ্যে হতে চাইবে, এ প্রশ্নগুলো করতে হবে,

১. আমার এই চিন্তার ভিত্তি কী? ২. আমার কাছে কি এই সিদ্ধান্তে পৌছানোর জন্য পর্যাপ্ত তথ্য আছে? ৩. ঘটনাটা থেকে আমি যে উপসংহার টানছি, তার বদলে অন্যভাবে কি ভাবা যায়? ৪. গৎবাঁধা মন্তব্য না করে, পরিষ্কারভাবে বল, একদম পয়েন্ট আকারে। ৫. ভবিষ্যৎ দেখার দায়িত্ব তোমাকে কে দিল?

ধরা যাক, সূচি সবসময় মনে করে,

– আমাকে কেউ পছন্দ করেনা – বন্ধুরা কেউ আমাকে দাওয়াত দেয়না – সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করে – আমি একটা গাধা স্টুডেন্ট – পুরো পৃথিবীতে আমার একটাও বন্ধু নেই – আমার সারা জীবনেও কোন বন্ধু হবে না

সূচির এক্ষেত্রে যা করা উচিৎ –

প্রথমেই মনটাকে একটা ধমক দেয়া উচিৎ, এইসব ফালতু চিন্তা মনে আসার জন্য। ধমক দিলে কিছুক্ষণের জন্য ক্রিটিকের বিরূদ্ধে লড়াই করার সাহস পাওয়া যায়। তারপর নিজেকে প্রশ্ন করা উচিৎ, এরকম সারাজীবনের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলার জন্য আমার হাতে কী প্রমাণ আছে? সারা পৃথিবীতে আমার একটাও বন্ধু নেই – আমি সারা পৃথিবীর সবার সাথে মিশি নি। আমি পুরো পৃথিবী ঘুরে দেখিনি! আমাকে ‘কেউই’ পছন্দ করেনা কথাটা কি ঠিক? হ্যা, সঞ্চিতা আমাকে দেখতে পারেনা, মুহায়মিন ও না। কিন্তু রূপন্তি আমাকে ভীষণ ভালোবাসে! হ্যা, দুই দুইটা ক্লাশমেটের জন্মদিনে আমাকে দাওয়াত দেয়নি, কিন্তু সেদিন ও তো পিকনিকের প্ল্যান সবাই মিলে করলাম! তারপর আত্মীয়দের বাসায়, পাশের বাসার আপুর ঐখানে তো আমি প্রায়ই যাই! সুতরাং, আমাকে কেউ পছন্দ করেনা, কেউ দাওয়াত দেয়না – এগুলি ঠিক কথা না। আমার কোন বন্ধু নাই, এটাও ঠিক না! হয়ত যেমনটি চাই তেমন বন্ধু নেই, কিন্তু একেবারে নেই এটা মিথ্যা কথা! সুতরাং এইসব দুঃখবাদি চিন্তাভাবনা আমাকে বাদ দিতে হবে! আমি মোটেও এত একা নই, যতটা আমি ভাবি।

আর আমি গাধা স্টুডেন্ট না। আমি ছবি আঁকতে পারি খুব ভালো। আমার ক্রিয়েটিভিটি আছে। আমি এদের স্ট্যান্ডার্ডে ভালো করতে পারিনা ঠিকই, কিন্তু আমার পছন্দের ফিল্ডে আমি খুব ভালো করি। ক্রিয়েটিভিটি মুখস্ত বিদ্যার চেয়েও অনেক বেশি দামি।

পাশাপাশি, সূচি যদি মনে করে সে মোটা, নাকটা বিচ্ছিরি, অসামাজিক, তখন মনে মনে নিজেকে ধমক দিতে হবে, বলতে হবে, আমি ছোট ব্যাপারকে বড়সর করে ফেলছি। মোটা বললে যদি মন খারাপ হয়, তখন বলতে পারে, টার্গেট ওজনে আসার জন্য আমাকে ষোল কেজি কমাতে হবে।

আমি এই, আমি সেই – এই চিন্তাটা দূর করতেই হবে। তাতে করে সত্যিটা মিথ্যে হয়ে যাবেনা। কিন্তু বিষয়টাকে মোকাবেলা করা অনেক সহজ হয়ে যাবে।

আমার নিজের বেলায় যেমন, আমি বলতে ভালোবাসি আমি নিওফোবিক (নতুন যে কোন কিছুকেই আমি ভয় করি।) কথাটা সত্যি, পিএইচডি শেষ করে চাকুরি খুঁজতে ইন্টারভিউ দিতে হবে, আমি কখনও ইন্টারভিউ দেইনি, তাই ওটা ভাবতেই ভয় করে, মনে হয় আমাকে কেউ কখনও চাকরি দেবেনা। কনফারেন্সে প্রথমবার পোস্টার প্রেজেন্ট করতে কেমন দুরু দুরু বুক – অথচ ব্যাপারটা কিছুই না! প্রথমবার ক্লাশে লেকচার দিতে গিয়ে ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসার অবস্থা।

যাই হোক, সেল্ফ ক্রিটিক এর এই পর্যায়ে পেছন ফিরে দেখি, জীবনে নতুন কাজের সংখ্যা কম না। রিসার্চ প্রজেক্ট নিয়েছি এমন একটা, ডিপার্টমেন্টে আর কেউ আগে করেনি। সোশ্যাল ওয়ার্ক এর নতুন কোন সুযোগ আসলে যেটুকুই হোক অংশ নেয়ার চেষ্টা করেছি। আর অত কিছু কেন, নতুন পরিবেশে, নতুন দেশে টিকে থাকতে পারে যে, তার আর কিছু নিয়ে ভয় করার দরকার আছে?

মোকাবেলা
মোকাবেলা

নতুন জিনিস দেখলে এখনো ভয় লাগে, কিন্তু আবার পুরনো সফলতা মনে করে মনকে সাহস দিলে, আর একটু একটু করে একধাপ করে এগোলে জিনিসটাকে মোকাবেলা করা যায়। এতদিন পর্যন্ত নতুন কাজের কথা কেউ বললেই পিছিয়ে যেতাম, মনকে বলতাম, আমি নিওফোবিক, আমার সময় লাগবে। তারপর ফেলে রাখতাম অনেকদিন। এখন মনে হচ্ছে, তার বদলে এভাবে ভাবতে হবে, আগে করিনি? জানিনা কেমন হবে? ঠিক আছে, আরো একটু জেনে বুঝে নেই। পুরনো কাজগুলিও তো একসময় নতুন ছিল। শুরু না করলে তো ওগুলো চিরকাল নতুনই থেকে যেত!

নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)

 

সেল্ফ এস্টিম পর্ব ৫: এস্টিম ধ্বংসকারী চিন্তাগুলো

গত কয়েক পর্ব মন দিয়ে পড়লে আশা করা যায় ক্রিটিক কে ভাল করে চেনা, ও তার সাথে ফাইট করার একটা মোটামুটি আন্দাজ হয়ে যাবে। ক্রিটিক কে চেনার ও বোঝার শেষ নেই। যতই চেনা যাবে, ততই মাথায় হাত দিয়ে ভাবতে হবে, হায় আল্লাহ! আমি ত এগুলোর সবগুলোই করি! হ্যা, ক্রিটিক অমনই চতুর। কখনও লজিক, কখনও ইনটুইশন, কখনও পর্যবেক্ষণের ভেক ধরে মনের ভেতর হানা দেয়। বস্তুতঃ একটা বাস্তব ঘটনাকে অবাস্তব পন্থায় বিশ্লেষণ করার এই পুরো প্রক্রিয়াটাই ক্রিটিক ভদ্রলোকের ছলচাতুরি ছাড়া আর কিছু না। এই পর্বে ক্রিটিকের কয়েকটা অতিপরিচিত কৌশল আলোচনা করা হবে।
ওভারজেনারালাইজেশন
ওভারজেনারালাইজেশন

১. ওভারজেনারালাইজেশন: একটা ঘটনা থেকে পুরো পৃথিবীর সমুদয় ঘটনার প্রতি জেনারেল ধারণা করা। একটা ইন্টারভিউ খারাপ হল, ধরে নেয়া, আমি জীবনেও ভাল ইন্টারভিউ দিতে পারব না। একবার প্রেজেন্টেশনে হাঁটু কাঁপল, ঘোষণা করে দেয়া, বক্তৃতা আমার জন্য না।

ক্রিটিক ওভারজেনারালাইজেশন টেকনিক ব্যবহার করছে কিনা তা বুঝতে পারবেন যদি সে ঘন ঘন ‘never’, ‘always’, ‘all’, ‘every’, ‘none’, ‘nobody’, ‘everyone’, ‘everybody’ – এই শব্দগুলো ব্যবহার করতে থাকে।

 গ্লোবাল লেবেলিং
গ্লোবাল লেবেলিং

২. গ্লোবাল লেবেলিং: একটা ঘটনা থেকে পুরো ব্যক্তিত্বটার উপরে একটা জেনারেল ধারণা করা। যেমন, ভাইভা বোর্ডে ভাল উত্তর দিতে পারলাম না, ‘আমি একটা স্টুপিড, আনস্মার্ট গাধা।’ ওভারজেনারালাইজেশনের মতই, তবে এখানে ঘটনার বদলে মানুষটাকে বাজে বাজে বিশেষণ দেয়া হয়।

গ্লোবাল লেবেলিং হচ্ছে কিনা বুঝতে পারবেন, যদি আপনার ক্রিটিক আপনার চেহারা, পারফর্মেন্স, বুদ্ধিমত্তা, সোশ্যাল স্কিল নিয়ে কমন, আজেবাজে মন্তব্য করতে থাকে। এই যেমন, ‘আমি একটা অকর্মণ্য কুঁড়ে অলস’, ‘আমি কিছুই পারিনা’, ‘আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা’, ‘আমি একটা স্পাইনলেস’, ‘আমার ফ্যামিলি একটা আজাব।’
চিন্তার ফিল্টারিং
চিন্তার ফিল্টারিং

৩. ফিল্টারিং: এই প্রক্রিয়ায় ক্রিটিক বাস্তব ঘটনার সবগুলো আলো শুষে নিয়ে কেবল অন্ধকারটাই দেখায়। আপনি কেবল বিশেষ কয়েকটা মন্তব্যই শুনতে পাবেন, বাকিগুলো কর্ণকুহরে প্রবেশও করবে না। একটা ফাটাফাটি প্রেজেন্টেশন দিলেন, বস একফাঁকে বলল, তোমার বক্তব্যে coherence কম। ব্যাস! এত বছর ধরে প্রেজেন্টেশন দিয়েও যদি একটা গুছানো প্রেজেন্টেশন দিতে না পারি, তাহলে করছি টা কী? এই নিয়ে মন খারাপ, ছোট হয়ে থাকা, আপসেট থাকা, লেবেলিং করা… ইত্যাদি ইত্যাদি। এদিকে বস যে এতগুলো তথ্যের উপস্থাপনকে প্রশংসা করলেন, প্ল্যানটা সুন্দর বললেন, এত পরিশ্রমের জন্য ধন্যবাদ দিলেন – এগুলো মনের কোথাও ঠাঁই পেলনা।

ফিল্টারিং হতে থাকলে প্রশংসাগুলো মনে হতে থাকে বানিয়ে বানিয়ে বলা, আর সমালোচনাগুলো অনেক মৃদু আকারে বলা। এক ফোঁটা সমালোচনা তখন বড় একটা কাজের ফলাফলকে ম্লান করে ঐ অতটুকুর মধ্যেই নিয়ে আসে।

পোলারাইজড থিংকিং
পোলারাইজড থিংকিং
৪. পোলারাইজড থিংকিং: পোলারাইজড চিন্তাভাবনায় পৃথিবীটা আপনার কাছে সম্পূর্ণ সাদা আর কালো। প্রতিটা ঘটনা, কাজ হয় মন্দ নাহয় ভালো। আপনি নিজেকে সাধু নয় চোর, সফল বা লুজার, হিরো বা ভিলেইন – এভাবে চিত্রিত করে ফেলেন।

মনের ভেতর ভাবনাগুলো যদি এমন হয়, ‘স্কলারশিপটা না পেলে আমার জীবন শেষ’, ‘বউ ভাল না বাসলে বেঁচে থেকে আর লাভটা কী’… তবে বুঝবেন আপনি পোলারাইজেশন জ্বরে আক্রান্ত।

 সেল্ফ ব্লেইম
সেল্ফ ব্লেইম

৫. সেল্ফ ব্লেইম: সব ঘটনার দোষ আপনার। সবকিছুর জন্য আপনি পরোক্ষভাবে হলেও দায়ী। নিদেনপক্ষে আপনার ভাগ্য দায়ী। রাস্তায় অভাবনীয় জ্যামের কারণে মিটিং এ দেরি হল, আপনার দোষ। আপনার স্বামী আপনার সাধের এক্সপেরিমেন্টের রান্নাটা পছন্দ করল না, আপনার দোষ।

সেল্ফ ব্লেইম আপনার ভাল দিকগুলোর ব্যাপারে আপনাকে পুরোপুরি অন্ধ করে দেয়। আপনার চালানো তিনটি প্রজেক্টের দুটি সফল আর একটি চরমভাবে ব্যর্থ হলে আপনি আজীবন তৃতীয়টির জন্য নিজেকে দায়ী করে গেলে, আর বাকি দুটোর জন্য সমভাবে গর্ববোধ না করলে আপনার মাঝে সেল্ফ ব্লেইম রোগ আছে।

পারসোনালাইজেশন
পারসোনালাইজেশন
৬. পারসোনালাইজেশন: পার্সোনালাইজড জগতে আপনি নিজেই আপনার জগত হয়ে বসে থাকেন। প্রতিটা ঘটনাই যেন আপনাকে ঘিরে আবর্তিত। কিন্তু আপনার হাতে কোন কন্ট্রোল নেই। আপনি হতভাগা, সবাই আপনাকে কষ্ট দেয়।

পারসোনালাইজেশনের মধ্যে একধরণের সেল্ফ অবসেশন বা নার্সিসিজম আছে। ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে ঢুকলেন, সাথে সাথে আর সবার সাথে তুলনা করা শুরু করে দিলেন, কে আমার চেয়ে বেশি স্মার্ট, কার চেহারা বেশি ভাল, ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ বলল, ‘ভাল লাগছে না’, আপনি ধরে নিলেন আপনার সাথে তার বিরক্ত লাগছে।

মাইন্ড রিডিং
মাইন্ড রিডিং
৭. মাইন্ড রিডিং: আমি অন্যের ভাব বুঝতে পারি। সে কী ভাবছে আমি জানি। আমি থিসিস দেরি তে জমা দিলাম, সুপারভাইজরের থমথমে ভাব। পরিষ্কার বলে দেয়া যায় তিনি আমার উপর বিরক্ত। আমার শাশুড়ি জানতে চাইলেন এতক্ষণ কোথায় ছিলাম। তার মানে উনি হিসাব চাচ্ছেন আমি কোথায় কোথায় গিয়ে ঘরের কাজ ফাঁকি দিচ্ছি।

মনের মধ্যে যদি, ‘আমি জানি’, ‘আমি শিওর’, ‘আমার মনে হচ্ছে’, ‘আমি এগুলি ভাল বুঝি’ – ইত্যাদি ইত্যাদি চিন্তা আসে, তাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করে দিন। এসব আপনার সাইকিক পাওয়ার না, ক্রিটিকের হাতিয়ার।

 ইমোশনাল রিজনিং
ইমোশনাল রিজনিং
৮. ইমোশনাল রিজনিং: প্রবল দুঃখের সময় আবেগতাড়িত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া। কোন ঘটনায় ক্রিটিক হয়ত এসে কানে কানে বলল, ‘কুঁড়ে, অলস।’ আপনার হালকা একটা মন খারাপের ভাব হল। মন খারাপ ভাবটা বাড়তেই থাকল।

ক্রিটিক এইবার আবার এসে বলবে, ‘তুমি যা মনে কর, তুমি ত তাই। তোমার নিজেকে অলস মনে হচ্ছে, তুমি ত আসলেই অলস।’ এর মধ্যে আপনি হয়ত ভুলেই বসে আছেন, ‘অলস’ আপনি আপনাকে বলেন নি, ক্রিটিক বলেছে। এই পুরো চিন্তার শুরুটা ক্রিটিক কে দিয়ে। মাঝপথে মন খারাপকে পুঁজি করে ক্রিটিক আপনার সেল্ফ এস্টিমটাকে নাড়া দিয়ে গেল।

Ref: Self Esteem by McKay and Fanning
নুসরাত রহমান
পিএইচডি(বায়োলজি)