banner

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1039 বার পঠিত

 

স্বাবলম্বিতা ও সহযোগিতাই ঠেকাতে পারে ডিভোর্স

জান্নাতুন নুর দিশা


অনেকেই মনে করেন ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে ডিভোর্স হওয়া না হওয়ার বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ডিভোর্স নিয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখতে গেলেও দেখা যায় অনেকেই ধর্মীয় অনুশাসনের কথা টেনে আনেন, অনেকেই ঢালাওভাবে দোষারোপ করেন নারীদের স্বাধীনচেতা মানসিকতার উত্থানকে।
ডিভোর্স বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া যে মোটেও ধর্মীয় অনুশাসনের সাথে সম্পর্কিত কোনো বিষয় নয় তা এই দুটো ছবি থেকেই পরিষ্কার হওয়ার কথা।
বিবাহ, সংসার, বিচ্ছেদ এই বিষয়গুলো যতটা না ধর্ম সম্বন্ধীয়, তার চেয়ে বেশি সামাজিক ও অর্থনৈতিক। বৈবাহিক বন্ধন টিকে থাকা এবং না টিকে থাকার বিষয়টি একটি সমাজের অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক সংস্কার-কুসংস্কারের উপর নির্ভর করে।
পৃথিবীতে সবচেয়ে কম ডিভোর্স হয় ভারতে। ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু ধর্মালম্বীদের ডিভোর্সের হার অন্য ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় অনেক অনেক কম।
তারমানে কি এই দাঁড়ায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তুলনায় অন্য ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের ধর্মীয় অনুশাসন কম মানেন? বিষয়টা কিন্তু মোটেও তেমন নয়।
হিন্দু ধর্মে গত শতকেও সতীদাহপ্রথার মত ভয়াবহ কুসংস্কার ছিল। ছিল না বিধবাদের বিবাহের অনুমতি। হিন্দু ধর্মের সংস্কারকরাই এসব রদে রেখেছিলেন ভূমিকা।
এখনো হিন্দু ধর্মালম্বীরা বিয়েকে জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধন মনে করে। সাত জন্মের জন্য সঙ্গী হবার ধারণাও রয়েছে অনেকের মধ্যে।
ভারতের নাটকগুলো দেখলেই বুঝা যায় পারিবারিক কলহ, দাম্পত্য কলহ, সাংসারিক অশান্তি নিয়ে এক একটা পরিবার কতটা ভোগে। কিন্তু বিচ্ছেদের কথা তারা ভাবতে পারে না। পারিবারিক কলহ থেকে সহিংসতার পর্যায়ে চলে গেলেও উপমহাদেশে পরিবারগুলো বিচ্ছেদের কথা ভাবতে পারে না।
বিচ্ছেদ হচ্ছে না মানেই একটি সমাজ আদর্শ সমাজ আর বিচ্ছেদ বাড়লেই সমাজ ধ্বংস হয়ে গেছে এই ধারণা ভ্রান্ত। সাংসারিক কলহ, পারস্পরিক অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভুল বুঝাবুঝি, অশান্তি, খুনাখুনি, মেরিটাল রেইপ, পারিবারিক সহিংসতা না কমিয়ে কেবল বিচ্ছেদ ঠেকিয়ে রাখা গেলেই মূল্যবোধ ঠিক থাকে এমনটা ভাবা অনেকটা “উপরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট” প্রবাদের মতই হয়ে যায়।
হিন্দু ধর্ম ছাড়া অন্যান্য ধর্মে ডিভোর্সের ব্যাপারে ফ্লেক্সিবিলিটি থাকায় এসব ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী পারিবারিক সংঘাতের চেয়ে বিচ্ছেদকে উত্তম সমাধান মনে করছে। যে কারণে এসব ধর্মের মানুষের ডিভোর্স রেট কাছাকাছিই।
অনেক ধর্ম বিচ্ছেদ নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম তৈরি করে নি। তাই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরা নিজেদের জাতিগতভাবে নিয়ম তৈরি করে নেয় বিভিন্ন দেশে। ইসলাম ধর্মে বিচ্ছেদের ব্যাপারে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট নিয়ম দিয়ে দেয়া হয়েছে।
ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা সৌদি আরবেও ডিভোর্সের হার খুব যে কম তা কিন্তু নয়। তারাও সংঘাতের চেয়ে বিচ্ছেদকেই বেছে নিতে পছন্দ করে। মোহরানা পরিশোধ বিয়ের সময়ই হয়ে যাওয়ায় তাদের বিচ্ছেদে বিশেষ আইনি জটিলতাও পোহাতে হয় না।
আমাদের দেশে যে বিয়েতে উচ্চ মোহরানা ধার্য করা হয়, এটা কিন্তু বিচ্ছেদ আটকে রাখতেই করা হয়। পাত্রের সামর্থ্যের বাইরে একটি অর্থ ধরা হলে এবং বাকির খাতায় রেখে দেয়া গেলে সহজে ডিভোর্স দেয়া যাবে না, করা যাবে না বহুবিবাহ। অর্থাৎ দিনশেষে বিয়ে অর্থনৈতিক চুক্তিই! এভাবেই আর্থিক চুক্তিনামায় বৈবাহিক সমস্যাদির বিচার-আচার আগে সামাজিক ভাবে এবং এখন কোর্ট-কাচারিতে হয়। মোহরানা বাকি রাখা ধর্মীয় অনুশাসন না হলেও উভয়পক্ষই নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় এই নিয়ম মেনে নিচ্ছে।
তাই দিনশেষে বিবাহবিচ্ছেদ বা বৈবাহিক সম্পর্কের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে উভয়পক্ষের সামাজিক ও আর্থিক স্ট্যাটাসের উপর। খেয়াল করে দেখবেন পত্রিকায় ডিভোর্সি পাত্রীর জন্য “পাত্র চাই” বিজ্ঞাপন দেয়ার সময় “ধনী, প্রবাসী অভিজাত ডিভোর্সি পাত্রী” এইভাবে সামাজিক আর্থিক ব্যাপারগুলো ফলাও করে লেখা হয়। অর্থাৎ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী পাত্রীর ডিভোর্সি হলেও ঠিকই পাত্র মিলছে। অথচ দরিদ্র হলে কুমারীর পিতার কাছেও চাওয়া হচ্ছে যৌতুক।
ছেলের অর্থনৈতিক অবস্থান দেখা তো বিয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। উপার্জনহীন পুরুষের সংসারে সুখ থাকেনা।
মানুষ যত বাড়ছে, একজনের উপার্জনে একটা সংসার চালিয়ে নেয়া তত চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। তাই সংসারে প্রাপ্তবয়স্ক উপার্জনহীন নারী বা পুরুষ যত বেশি, সংসারে অন্তঃসংঘাত তত বাড়ছে।
গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠবার পর দরিদ্র পরিবারগুলোতেও কলহ, সংঘাত কমে গেছে। মধ্যবিত্তের চেয়ে দরিদ্রদের সংসারে এখন টানাপোড়ন কম। নারীদের উপার্জনহীন বসে থাকবার প্রবণতা এদেশে মধ্যবিত্ত সমাজেই বেশি। আর যারা ক্যারিয়ারে আসছে, তাদের হাজবেন্ডের ফেক্সিবল মেনটালিটি না রাখা ও রুলিং মাইন্ড জন্ম দিচ্ছে আরেক ধরণের সংঘাতের। একে বলে ব্যক্তিত্বের সংঘাত।
মধ্যবিত্তের এসব ঘুণে ধরা সেন্টিমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা খুব জরুরী।
সম্প্রতি ছেলেদের ওয়ালে ওয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে একটি নিউজ। “সৌদি নারীদের পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশী ছেলেরা।” যদিও এই নিউজের কোনো নির্ভরযোগ্য সোর্স খুঁজে পাই নি, তবু কেন এত উৎসাহ নিয়ে এই ফান নিউজ শেয়ার করছেন ছেলেরা?
যদি নিউজটা হত আফ্রিকান কোনো দরিদ্র দেশের মেয়েদের পছন্দের তালিকায় বাংলাদেশের ছেলেরা। এত পুলকিত হতো কেউ?
সৌদিআরব, কাতার এসব দেশ এদেশের মানুষের কাছে আর্থিক স্বাবলম্বী হবার একটা নির্ভরযোগ্য গন্তব্য। তাই সৌদি নারীরা তাদের পছন্দ করলে সেখানে যে বঞ্চনা সহ্য করতে হয় তা আর করতে হবে না। তাই সৌদি নারী মানে কেবল নারী নয়, সৌদি নারী মানে আর্থিক নিশ্চয়তার প্রতীক। তাই এই অনির্ভরযোগ্য খবরটিও এত মুখরোচক।
মজার ব্যাপার হল, সৌদি নারীরা আসলেও বিদেশী বিবাহে ঝুঁকেছেন।তাদের পরিসংখ্যান বলছে ইদানীংয়ে মোট বিয়ের প্রায় দশ ভাগ বিয়ে হয়েছে বিদেশি পুরুষের সাথে।
এর কারণ হিসেবে ভাবা হচ্ছে সেখানে প্রচলিত বহুবিবাহ এবং ডিভোর্স হার। অর্থাৎ বিদেশী বিশেষ করে এশিয়ান পুরুষদের আরবদের মত অধিক বিবাহ প্রবণতা কম থাকা ও সৌদি স্ত্রীর প্রতি অনুগত থাকার মনোভাবই এশিয়ানদের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করছে।
সবশেষে বলা যায়, পরিবারে প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির আর্থিক উপার্জন ও স্বাবলম্বিতা, পরস্পরের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতামূলক ও সহনশীল আচরণ ও ব্যক্তিত্ব গঠনই পারিবারিক ভাঙন এবং বিবাহ বিচ্ছেদ কমাতে পারে। মানসিক উৎকর্ষ সাধন করে এসব গুণাবলী আনতে না পারলেও পারিবারিক সংঘাতে প্রতিনিয়ত লিপ্ত থাকার চেয়ে বিচ্ছেদেরই তো উত্তম!

আসলেই কি বিচ্ছেদ উত্তম? নাকি স্বাবলম্বিতা ও সহযোগিতা জরুরী?

সিদ্ধান্ত আপনার!

Facebook Comments