banner

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1356 বার পঠিত

 

বৈবাহিক সমস্যা ও কোরআনের সমাধান – ১


মূল
আব্দুল হামিদ আবুসুলাইমান
অনুবাদ
কানিজ ফাতিমা


 

অনুবাদকের কথা
স্ত্রী পিটানো কি ইসলাম সমর্থন করে?- এ প্রশ্নটি দীর্ঘকাল ধরে ধর্মপরায়ন শিক্ষিতা মুসলিম নারীদের মনে কাটা হয়ে বিঁধে ছিল। বিভিন্ন সময়ে সুরা নিসার এই ‘দরাবা’ সংক্রান্ত ৩৪ নং আয়াতটির বিভিন্ন ব্যাখ্যা এসেছে। কোন কোন ইসলামী চিন্তাবিদ একে ‘চল্লিশ ঘা’ আবার কেউ কেউ ‘মৃদু আঘাত’ বলেছেন। কিন্তু সবকটি ব্যাখ্যার সঙ্গেই শারীরীক আঘাত ব্যাপারটি জড়িত রয়ে গেছে। ফলে এর একটি সুস্পষ্ট প্রভাব আমাদের সমাজে দেখা যায়। কারণে অকারণে স্ত্রীকে আঘাত করা তাই অনেক মুসলিম পুরুষই তাদের অধিকার মনে করেন। অনেকে আবার একটু আগ বাড়িয়ে স্ত্রীকে পিটিয়ে শাসন করাকে নিজ পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন।
শরীরের আঘাত শুধু শরীরের সঙ্গেই সম্পর্কিত থাকেনা, তা মনের সঙ্গেও গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। শারিরীক আঘাত কম হোক বা বেশি হোক তা আতœসম্মানবোধ সম্পন্ন যেকোন নারীর মনেই কঠিন অপমানবোধ সৃষ্টি করে। এমনকি তা ঐ নারীর পুরুষ আত্মীয়দের মনেও কষ্ট দেয়। এ আঘাতে শরীরে দাগ পড়ুক কি নাই পড়ুক, নারীর মনে দাগ পড়বেই। শরীরের দাগ বা কষ্ট যত দ্রুত মিলিয়ে যায় মনের এ দাগ বা কষ্ট তত দ্রুত মিলিয়ে যায় না। কাজেই বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান বলেছেন সুরা নিসায় ব্যবহৃত ‘দরাবা’ শব্দটির অর্থ ‘পিটানো’, ‘প্রহার’, এমনকি ‘মৃদু আঘাত’ হিসাবেও নেয়ার অবকাশ নেই। এর কারণ হিসাবে তিনি পেশ করেছেন কঠিন যুক্তি। তিনি তার Marital Discord: Recapturing the Full Islamic Spirit of Human Dignity বইতে বোঝাতে চেয়েছেন- আরবী অভিধানে ‘দরাবা’ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে; সেক্ষেত্রে অন্য সব অর্থ বাদ দিয়ে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ‘পিটানো’ বা ‘আঘাত করা’ অর্থটি গ্রহণ করা কতটা যুক্তিযুক্ত, বিশেষ করে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে, তা ভেবে দেখতে হবে। তাছাড়া কোরআনের ব্যাখ্যা আমাদের গ্রহণ করতে হবে রাসূল (সা.) এর জীবনী থেকে। রাসূল (সা.) এর জীবনে দেখা যায় স্ত্রীদের সঙ্গে বিরোধ বা সমস্যার ক্ষেত্রে তিনি স্ত্রীদের কখনই আঘাত করেননি। বরং দু-দুবার এমন ঘটনায় তিনি একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন, আর তাহলো স্ত্রীদের থেকে দুরে সরে যাওয়া । কাজেই সুন্নাহ অনুযায়ী ‘দরাবা’ শব্দটির অর্থ ‘আঘাত করার’ তুলনায় ‘দূরে সরে যাওয়া’ বা ‘সাময়িক দূরত্ব বজায় রাখা’ বেশি সামঞ্জস্যশীল ।
প্রবন্ধে আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান দুটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করেছেনÑ
প্রথমত, সূরা নিসার ৩৪ও ৩৫ নং আয়াতকে (যাতে এই শ্বাস্তির ব্যাপারটি বিধৃত হয়েছে) বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখা করা যাবে না। তিনি বলেছেন এ আয়াতের ব্যাখার সময় কোরআনের অন্যান্য আয়াত বিশেষ করে সূরা রূমের ২১ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ পারস্পরিক দয়া ও ভালবাসাকে বিবাহের উদ্দেশ্য হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন তা বিবেচনায় আনতে হবে।
দ্বিতীয়ত: অতীতে পরিবারে নারীদের ভূমিকা একরকম ছিল। অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে তারা বিরত থাকত। অন্যদিকে পুরুষরা অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করত। অর্থনৈতিক ব্যাপারে পুরুষদের উপর নির্ভরশীলতা নারীদেরকে ক্ষমতাহীন করে রাখতো । কিন্তু বর্তমান সময়ে পরিবারে নারী ও পুরুষের এ ভূমিকার অনেক পরিবর্তন এসেছে। পুরুষের উপর নারীর অসহায় নির্ভরশীলতা কমেছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে ফলে নারীদের উপর পুরষের একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রও হ্রাস পেয়েছে। বর্তমানে পরিবারের কোন সমস্যা সমাধানে বা স্বামী-স্ত্রীর কোন বিরোধ নিরসনে পরিবারের এই কাঠামোকে বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান এর এ ধারণাটি ইবনে আব্বাসের ব্যাখ্যার সঙ্গেও অসামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ ইবনে আব্বাস স্বামীদেরকে সাবধান করেছেন যে, তাদের রাগের বহিঃপ্রকাশ যেন কয়েকটি মেসওয়াকের আঘাত বা অনুরূপ কোন কিছূর আঘাতের বেশি কিছু না হয়। অর্থাৎ তিনিও দরাবাকে পিটানো অর্থে নেননি [মেসওয়াক দিয়ে পিটানো সম্ভব নয়]। আব্দুল হামিদ আবু সুলেমান মিসওয়াকের মৃদু আঘাতকেও সমর্থন দেননি বরং তিনি বলেছেন একটি কঠিন বৈবাহিক সম্পর্কের উন্নয়ন ও পুনরায় মিলন ঘটানোর এ প্রেক্ষাপটে দরাবা শব্দটির যে অর্থ গ্রহণ করা উচিত তা হল-বাড়ি থেকে চলে যাওয়া (to “leave” the marital home),অথবা স্ত্রী থেকে আলাদা হওয়া (“separate” from her)।
এমন একটি বিতর্কও ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে রয়েছে যে স্বামী – স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ বা অবাধ্যতার (নুশুজ) পরিপ্রেক্ষিতে ‘মৃদু শারীরিক আঘাত’ এর বিধান দেয়া হয়নি বরং এটা এসেছে স্ত্রী কর্তৃক অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে অবৈধ শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ স্ত্রী অবৈধ শারীরিক সর্ম্পকের দোষে দুষ্ট হলে সীমিত শারীরিক আঘাতের কথা বলা হয়েছে। নুশুজ এর ক্ষেত্রে শারীরিক আঘাত প্রযোজ্য নয়।

চলবে……

Facebook Comments