banner

শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1080 বার পঠিত

 

সারপ্রাইজ

আফরোজা হাসান


টিভিতে নতুন একটা কমিকসের অ্যাড দেখার পর থেকে সেটা কেনার জন্য ঘ্যানঘ্যান শুরু করেছে আমার পুত্র। কমিকসের সাথে আবার একটা খেলনা ফ্রি। নাকীবের মূল আগ্রহ কমিকসের সাথে দেয়া সেই খেলনার উপরই ছিল। সেজন্যই কিনে দিতে চাইছিলাম না। কিন্তু রোজই নানান যুক্তি পেশ করতে লাগলো কেন কমিকসটা সে কিনতে চায়। পরীক্ষাতে ভালো করার পুরস্কার হিসেবে কমিকসটা চাইলে শেষ পর্যন্ত হার মেনে নিলাম। নিয়ে গেলাম ওর বহু আকাঙ্ক্ষার সেই কমিকস কিনে দেবার জন্য।

কিন্তু দোকানে ঢুকতেই নাকিবের চোখ চলে গেলো অন্য একটি প্যাকেটের দিকে। সেটা ছিল একটা সারপ্রাইজ প্যাকেট। মানে খুব সুন্দর করে প্যাকেট করা কিন্তু ভেতরে কি আছে সেটা দেখার কোন উপায় নেই। বহু আকাঙ্ক্ষার কমিকস রেখে তো তখন সেই সারপ্রাইজ প্যাকেট নেবার ইচ্ছে পোষণ করলো পুত্ররত্ন। আমি ওকে ভালো মত চিন্তা করে দেখতে বললাম। কিন্তু পুত্রের মাথায় তখন সারপ্রাইজ ঢুকে গিয়েছে। শেষমেশ সেই সারপ্রাইজ প্যাকেটই কিনে দিলাম ওকে। ভেতরে মহা মুল্যবান কিছু অপেক্ষা করছে এমনই ধারনা মনে নিয়ে খুশিতে টগবগ করতে করতে দোকান থেকে বের হলো।

“চকচক করিলেই সোনা হয় না” এই প্রবাদ পুত্রের জানা না থাকলেও আমার জানা ছিল। কিন্তু সেভাবে করে মনে আসেনি তখন। প্যাকেটের ভেতর কি আছে সেটা নিয়ে আমি নিজেও কিছুটা কৌতুহলি ছিলাম। আর পুত্রের চোখ তো ঝলঝল করছিল না জানি ভিতরে কত সুন্দর সারপ্রাইজ প্রতিক্ষারত। বাসা পর্যন্ত আসার অপেক্ষাও করতে চাইছিল না সেটা চেহারা দেখে বুঝতে পারছিলাম। অনুমতি দেবার সাথে সাথেই বিরাট একটা হাসি দিয়ে খুলতে শুরু করলো প্যাকেট।

প্যাকেটের ভেতর থেকে যা বের হলো তা দেখে বিরাট একটা ঢাক্কা খেলো বাচ্চা আমার। সারপ্রাইজ ছিল একটি প্যাকেটের মধ্যে পেন্সিল, ইরেজার, শার্প্নার, ছোট্ট একটি ডায়েরী আর একটি কমিকস। তাও সেই ব্র্যান্ডের কার্টুনের যেটা একদম ছোট বাচ্চাদের। আর নিজেকে বড় ভাবা আমার আদরের পুত্র যেই কার্টুনটি দেখতে নারাজ। জিনিসগুলো স্পাইডারম্যান, গোরমিটি, স্পঞ্জ বব ইত্যাদি ব্র্যান্ডের হলে হয়তো মনখারাপ একটু কম করতো। সত্যি ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে ভীষণ মায়া লাগছিল।

আমার একটা কিছু ভুল হলেই সেটা নিয়ে আমাকে ঘুরে ঘুরে লেকচার দেয় এই দুষ্টু ছেলে। তাই ওর সাথে একটু দুষ্টুমি করার লোভ সামলাতে পারলাম না। হাসি দিয়ে বললাম, ওয়াও কি সুন্দর সবকিছু। তোমার পছন্দ হয়েছে তো বাবুতা? পারলে চিৎকার করে কান্না করে এমন অবস্থায় আমার কথা শুনে জোড় করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে দেখে অনুভব করলাম ‘জীবন নামক নাট্যশালায়’ পদার্পন করতে শুরু করেছে আমার পুত্র। অর্থাৎ,পুত্র আমার সত্যিই বড় হচ্ছে। তাই তো হাসির আড়ালে নিজের মনের প্রকৃত অবস্থা গোপন করার চেষ্টা করছে।

কাছে টেনে নিয়ে বললাম, মনখারাপ করো না বাবা আম্মুতা তোমাকে তোমার পছন্দের সেই কমিকসটা কিনে দেব ইনশাআল্লাহ। চেহারাটা তখন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো বলল, আম্মুতা এটা ফেরত দেয়া যাবে না? বললাম, তুমি তো প্যাকেট খুলে ফেলেছো তাই এখন আর ফেরত দেয়া যাবে না। এজন্যই তো তোমাকে বলেছিলাম ভালো ভাবে চিন্তা করে নিতে। ভুল বুঝতে পেরেছে এমন স্বরে বলল, হু ভুল হয়ে গিয়েছে। আমার ঐ কমিকটাই কেনা উচিত ছিল। কবে থেকে কিনবো ভাবছি। কেন যে এটা কিনতে গেলাম! হাসি মুখে বললাম, থাক যা হবার তা তো হয়েই গিয়েছে। এটা নিয়ে এখন আর মন খারাপ করতে হবে না। এরপর থেকে চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

বিকেল বেলা সুপার মার্কেটে গিয়ে পুত্র কোকো পাউডার কেনার বায়না ধরলো। চকলেট খুব একটা পছন্দ করে না সে। আর চকলেট দুধ তো ওর জানের দুশমন তাই চকলেট দুধ কেনার কথা বলতে দেখে বেশ অবাক হলাম। প্যাকেট হাতে নেবার পর বুঝলাম কিনতে চাইবার রহস্য। প্যাকেটের গায়ে লেখা ভেতরে খেলনা আছে। ওকে তখন দুপুরের সেই সারপ্রাইজের কথা মনে করিয়ে দিলাম। বিনা
তর্কে তাড়াতাড়ি প্যাকেট জায়গায় রেখে দিল। ফেরার পথে ওকে বোঝাতে বোঝাতে এলাম যে “চকচক করলেই সোনা হয় না”। এখন প্রতীক্ষা ভবিষ্যতে আবারো যদি কখনো এমন কোন পরিস্থিতিতে পড়ে তখন কিভাবে সিদ্ধান্ত নেয়।

আলহামদুলিল্লাহ আমি সবসময় চেষ্টা করি আমার সন্তান যাতে মনের এবং দেহের উভয় দৃষ্টি সবসময় খোলা রেখে জীবনের পথে চলে। যাতে একই গর্তে কখনোই দু’বার হোঁচট খেতে না হয় ওকে, একই ভুল যাতে বার বার না করে। তাই ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও ওর সাথে কথা বলি, আলোচনা করি। ঐ বিষয়টাকে নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে উৎসাহিত করার চেষ্টা করি।

কারণ আমি চাই আমার সন্তান চিন্তাশীল হয়ে বেড়ে উঠুক। জীবনকে শুধু যাপন করে না যাক, সাথে সাথে উপলব্ধিও করুক। ভুলকে ভুল ভেবে ভুলে না যাক, বরং ভুল থেকে শিক্ষা খুঁজে নিয়ে চলার পথের পাথেয় সংগ্রহ করুক।

Facebook Comments