banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 839 বার পঠিত

 

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৪

তাহনিয়া খান


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম

Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say. [20:25-28]

যারা হজ্জে গিয়েছিলেন তারা এসে বা ফোন করে আমাকে অনেক উপদেশ দিলেন। কোথায় কি সুবিধা অসুবিধা হতে পারে খুটি নাটি অনেক কিছু জানালেন। খুব কাজে লেগেছিল তাদের উপদেশগুলো।

আমার যাওয়ার দিন চলে আসলো। একি সাথে আনন্দ আর বেদনা আমার মনে। মনে আশা আল্লাহ্‌র মেহমান হতে যাচ্ছি। আমি তো শুধু মেহমান না, আমি জিহাদেও যাচ্ছি। হজ্জ তো মেয়েদের জন্য একটা জিহাদ। এহরামের কাপড় পরে দু রাকআত নামাজ পড়ে ফেলার পর হাত পা কাপতে লাগলো। আমি রীতিমত ভয়ে কাপছি। কাউকে বুঝতে দিচ্ছি না। নামাজে তো আল্লাহ্‌র সামনে হাজির হই। কিন্তু তখনো এমন ফিলিংস মনে আসে না। মাথায় কত কি ঘুরপাক খাচ্ছে। কান্নাও আসছে বাচ্চা দুটোর জন্য। আমার বিশ্বাস তারা তাদের বাবার কাছে ভালো থাকবে। তারপরেও বুকটা কেমন খালি খালি লাগছে। তাদের জন্মের পর তো তাদের কখনো কাছ ছাড়া করিনি। এতদিন প্রস্তুতির ঘোরে বাচ্চাদের ছেড়ে থাকার বিষয়টা অতটা মাথায় আসেনি। আসলে আল্লাহ্‌র ঘরে যাবো, এইটাই বেশী গুরুত্বপুর্ন ছিল। আর যেহেতু স্বামী থাকবে তাই নিশ্চিন্তে ছিলাম। কিন্তু হঠাত যাবার বেলায় যে কি হোল। মনে হচ্ছিল আর যদি ফিরে না আসি, তখন কি হবে? বাচ্চাদের কি আর দেখতে পারবো না ? আমাকে অনেকেই কঠোর হৃদয় এর অধিকারি বলেছিল। কিভাবে আমি স্বামী সন্তান ফেলে চলে যাচ্ছি। তাদের কে আমি বুঝাতে পারিনি যে আল্লাহ্‌র কাজের জন্য এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে দুনিয়ার সম্পর্ক আল্লাহ্‌র সম্পর্কের কাছে তুচ্ছ হয়ে যায়। যদিও এসব সম্পর্কের উপর ভিত্তি করেই মানুষের জীবন চলে । আবার এসব সম্পর্কের সাথে আচার আচরণ বা লেনদেনের কারণে জবাবদিহি করতে হবে।

বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সরাসরি এয়ারপোর্টে চলে আসলাম। সাথে বাচ্চারা, স্বামী, আম্মু আর ভাইয়েরা। ফ্লাইট ছিল ভোর চারটার সময়। আমাদের এজেন্সি রাত দুটোয় আসতে বলেছিল। এয়ারপোর্টের ভিতরে হাজীদের ঢুকার জন্য আলাদা ব্যবস্থা। সেখানে অন্য কেউ ঢুকতে পারবে না। শেষ বিদায় নেওয়ার পালা।

এতক্ষন যে বুকের ভিতর বাচ্চাদের জন্য, স্বামীর জন্য কষ্ট অনুভূত হচ্ছিল, সেটা হঠাত উধাও হয়ে গেল। সবার কাছ থেকে আবারো মাফ চেয়ে বিদায় নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। প্রথম পা ঢুকানোর সাথে সাথে মনে হোল, সব পিছুটান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। পিছুটান না থাকার আরো প্রমান আমি পেয়েছি হজ্জে গিয়ে। খুব কম মানুষকে দেখেছিলাম যারা তাদের পরিবার নিয়ে চিন্তিত ছিল। বেশীরভাগ মানুষই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। একদিন আমার স্বামী ফোন করে কোন এক কথা প্রসঙ্গে বলেছিল যে , তুমি জানো না যে গাদ্দাফীকে মেরে ফেলা হয়েছে? আমি বলেছিলাম জানিনা। সে অবাক হয়ে বলেছিল, পেপার পড় না, টিভি দেখো না ? আমি হেসে বলেছিলাম, এ অন্য জগত। এসবের সময় নাই। সবাই নিজের কাজ করছে। দরকার হলে পাশের মানুষটাকে সাহায্য করছে। সবার মাঝেই কেমন এক ঘোর লাগা অবস্থা। নিয়মের বাইরে কোন কাজ নেই, সময় নষ্ট নেই।

হজ্জের চতুর্থ শিক্ষা— ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি যে, কেয়ামতের সময় সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। সেই অনুভূতি পেলাম এয়ারপোর্টে ঢুকার পর থেকে একেবারে হজ্জের শেষ সময়টুকু পর্যন্ত। আমার সব সময় মনে হয়েছে যে, আমার পরিবার,বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন পৃথিবীর একপ্রান্তে,আর আমি আরেক প্রান্তে। আমি ছুটে যাচ্ছি আমার গন্ত্যবে, পাপ মোচনের আশায়, আল্লাহ্‌ কে সন্তষ্ট করার আশায়। দোয়া করা ছাড়া কেউ আর আমার জন্য কিছুই করতে পারবে না, আমিও দোয়া করা ছাড়া তাদের জন্য কিছুই করতে পারবো না। বেলা শেষে আমরা আসলে সবাই একা।

চলবে….

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৩

Facebook Comments