banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 604 বার পঠিত

 

ভুলে ভরা জীবন


জাহেদ উদ্দীন মোহাম্মদ


(১)
আমি বাবা-মা’র পঞ্চম সন্তান। আমরা তিন ভাই দুই বোন। আমি সবার ছোট । বড়গুলো শহরে পড়াশোনা করে। আমি গ্রামের বাড়িতে থাকি। গ্রামের বাড়িতে এমন কোন কাজ নাই, যা আমাকে দিয়ে করানো হয় না।
প্রতিদিন সকালে লঙ্কাপোড়া দিয়ে পানতা খেয়ে মক্তবে যাই। তারপর স্কুল। স্কুল ছুটি হলে প্রতিদিন বাজারের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বাবার সাথে বাজারে যাওয়া রুটিন কাজ। বাজার হতে এক বস্তা সস্তা তরকারি নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। সন্ধ্যায় মুড়ি-চা খেয়ে পড়তে বসি। ছুটির দিনেও বাড়িতে অনেক কাজ। কোন রেহাই নাই। বাবাও সারাক্ষণ একাজ সেকাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। অথচ, বাবা চাইলে এই কাজের জন্য একটা শক্ত সামর্থ্যেবান লোক রাখতে পারে। সে টাকা তাঁর আছে। কিন্তু খালি পয়সা বাঁচানোর ধান্ধা।
দাদা-দাদির একমাত্র সন্তান বাবা। উত্তরের বিলে কানি কানির ধানী জমি আছে। সবগুলো দো’ফসলি। বাড়ির এক পাশে বিরাট পুকুর। বিকালবেলা পুকুরে বড় বড় রুই-কাতলা ভুশ ভুশ করে ভাসে। কিন্তু এই মাছ আমাদের কপালে জোটে না। মোটা দাগে বিক্রি হয়, স্থানীয় স্কুল-কলেজের হোস্টেলে। বাড়ির জন্য বরাদ্দ ছোট মাছ।
গ্রামে লোকজন আড়ালে বাবাকে হাড় কিপ্টে, বখিল বলে। পথে-ঘাটে আমাকে “পোতাইয়ার পোলা” বলে। কাউকে লজ্জায় মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না।

মানুষের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাবা আসলে কিপটা। মাত্র দুইটা পাঞ্জাবি। একটার কলার ছেঁড়া অন্যটার বগলের তলে জোড়াতালি দেয়া। এইসব বাইরের যে কারো চোখে পড়ে।
একবার ছোট মামা মস্করা করে পাঞ্জাবির ফুটোতে আঙুল দিয়ে ছিড়ে দিল, বাবা তাকে বাড়ি ছাড়া করেছিল। মামা আর কখনো বাবার সামনে পড়েননি।
পরিবারে কারো দু’টার বেশী জামা-প্যান্ট নেই। অথচ গ্রামে আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ গরীব গৃহস্থের ছেলেমেয়েদের কত রঙিন জামা! এই নিয়ে মনে মনে রাগ পুষে রাখি বটে বাবার মুখোমুখি হবার সাহস হয় না।

আমার অন্য ভাইবোন, যারা শহরে পড়াশোনা করে, সবাইকে বাবা নিয়মিত মানি-অর্ডার করেন। হিসাব পাক্কা। মাস শেষে কত টাকা বাঁচলো তার চুলচেরা হিসাব চাই।
পড়ালেখার খরচ দিতে কোন কার্পণ্য নেই। তবে কড়ায়-গন্ডায় তার হিসাব চাইই। নইলে পরের মাসে টাকা পাঠানো বন্ধ।
বাবা বাজারে গেলে, সব্জিওয়ালা, মাছওয়ালা হাসি-ঠাট্টা করে। সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,
– হাক্কু, অনে পরে আইসসুন। এহনো বড় মাছ বেচা শেষ ন অয়।
সবার শেষে উনি মাছ কিনবেন। এটা জেলেরাও জানে।কি লজ্জ্বার কথা! একবার ভাবুন তো! বাবা বাজারে গিয়ে পাহাড়ি লোকজনের ভাগে বেচা শাক-সবজি খুঁজে বেড়ান। সস্তার জন্য নয়তো আর কি হতে পারে?
মাংসের দোকানে গিয়েও সস্তা খুঁজে মরেন। আমি বন্ধু-বান্ধবের সামনে পড়ে যাই। ওদের বাবা কিনেন গরুর রানের মাংশ আর বাবা কিনেন সস্তা গরুর নলা-পায়া আর হাড়ওয়ালা মাংশ। লজ্জ্বায় মাথা হেটঁ হয়ে আসে। পরদিন বন্ধুরা স্কুলের এ নিয়ে আলোচনা করে আর হাসাহাসি করে।
অথচ ধান বেচা, মাছ বেচা আর বাগানের ফল বেচা টাকায় আমাদের রাজকীয় হালে চলার কথা কিন্তু বাবার এইসব কিপ্টামির কারণে আজ ফকিন্নী হালতে চলাফেরা। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সমস্যা নেই। তবে জিনিসপত্র একটার বেশি দুটো কারো নেই। নতুন কিছু কেনার আগে পুরানোটা তিনি বারবার চেক করেন। কাপড় না ছেঁড়া পর্যন্ত কোন নিস্তার নাই। ইচ্ছেকৃত ছিঁড়লে,তিনি ঠিক ঠিক ধরে ফেলন। শাস্তি হিসাবে বাধ্যতামূলক ঐ ছেঁড়া কাপড় পরতে হবে।

মা যেন কেমন। দু’টোর বেশী শাড়ি নাই। এইসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই। বাবার সব কাজের এ যেন অন্ধ সমর্থক।
আমি প্রতিদিন এই কারাগার হতে মুক্তি চাই। কবে ম্যাট্রিক দিয়ে শহরে পা দেব, এই চিন্তায় দিন যায়। এই রকম কিপ্টা বাবাকে আমি ঘৃনা করি। আমি এভাবে মানুষের হাসি-ঠাট্টার পাত্র হতে চাই না।

(২)
সময়ের সাথে টেক্কা দিয়ে বয়স বাড়ে। বড় বোনদের বিয়ে হয়ে গেল। খুবই সাধারণ বিয়ে। অনেকটা গছিয়ে দেয়ার মতো। কোন ঢাকঢোল নেই, মাইকের গানবাজনা নেই,। কেবলমাত্র পঞ্চাশ জনের মতো লোকের খাওয়া-দাওয়া।ভাগ্য ভালো, বোনদের গায়ের সুন্দর রঙের কারণে বিয়ে আটকায় নি। বড় ভাই বৃত্তি নিয়ে বিদেশে পড়াশোনা করছে। হাড়কিপটে লোকের ছেলেকে কোন পাগলে মেয়ে বিয়ে দেবে? ওরা বিদেশি মেম বিয়ে করে ভালো কাজ করেছে।

আমি পড়াশোনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দিই। আজ এই জেলা, কাল এই জেলা। এখন নিজের টাকা নিজে ইচ্ছেমতো খরচ করি। মাকে দামী শাড়ি কিনে দিই। বাবার জন্য কিছু কিনতে ইচ্ছে করে না। কিনলে রাগারাগি করেন। বাড়তি খরচ তাঁর সহ্য হয় না। হাতে নগদ টাকা পেলে খুশি। তিনি জমিয়ে রাখেন।

তিনি সহজে গাড়ি চড়েন না। চা খান না। পান-বিড়ির অভ্যাস নেই। এতে নাকি খালি পয়সা খরচ হয়। আত্মীয় স্বজনের বাড়ি যান না, পাছে কিছু কিনতে খরচ হয়। বাটা কোম্পানির অক্ষয় সেন্ডেল জোড়ার ফিতে ছিঁড়ে গেলে, নতুন ফিতে লাগিয়ে নেন। সেন্ডেল ক্ষয় হয়ে মাটি স্পর্শ না করা পর্যন্ত কোন তালাক নাই।
-এই শালার পুত টাকা জমিয়ে কি করবে বুঝি না।
মাঝে মাঝে রাতেরবেলা ঘর ফিরতি মাছওয়ালা বাড়িতে হাঁক দেয়, কাক্কু, বাড়ি আছোনি?
তিনি ধড়পড় করে উঠে বলেন, হ বাজি; আছি।
-একটা বড় মাছ আছিল। অনর লাই রাহি দি।
এটা সম্ভবত পঁচা মাছ। খুবই সস্তা। বাবা মাছটা কেনার জন্য লাফিয়ে উঠেন।
-আইচ্ছা। রাহি জ। টেঁয়া পরে লইয়ু।
মা দ্রুত হাত চালিয়ে মাছ কুটেন আর রান্না ছড়িয়ে দেন। কোন ক্লান্তি নেই। কোন অভিযোগ নেই।
মাঝে মাঝে চমকে উঠি, কিভাবে এইরকম এক কিপটে লোকের সাথে ৪০ বছর একটা মেয়ে সংসার করে!
আমার কোন মান -সম্মান নেই। স্কুলে আমার সাথে জেলে-মুচি-কামার-কুমারের ছেলেমেয়েরাও পড়ে। অথচ গ্রামে একটু সচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা কিন্ডারগার্টেন-এ পড়ে। কি সুন্দর ড্রেস পড়ে, মাথায় ক্যাপ আর উজ্জ্বল রঙের ব্যাগ পিঠে স্কুলে যায়। আর আমি পড়ি অতি সাধারণ এক স্কুলে,যেখানে লুঙ্গি পরে টিচাররা স্কুলে আসে।
বাবার কোন রুচি নেই। টাকা বাঁচাতে গিয়ে ছেলের ইজ্জতের দিকে খেয়াল নেই।।
বাবার প্রতি কেমন বিতৃষ্ণা জমে রইল। মাঝে মাঝে একটু আধটু পত্র যোগাযোগ হয়। বছরে দুইটা ঈদের যে কোন একটাতে বাড়ি যাই। বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না। দশজনে মন্দ বলবে, এই ভয়ে তবু বাড়ি যাওয়া।

(৩)
বাবার মৃত্যুর খবরে চমকে উঠি। আমার তখন সিলেটে পোস্টিং। মাইক্রোবাস নিয়ে বাড়ি ফিরি। বাড়ি লোকে লোকারণ্য। পা ফেলার জো নেই। বোনেরা ফ্যামিলি নিয়ে আগেই হাজির। লোকজন সামলাচ্ছে। বোনের জামাইরাও ব্যস্ত। প্রবাসী ভাই দ্রুত বিমানের টিকেটের অভাবে আসতে পারে না।
এত কিপ্টামির পরও এখানে মানুষের ঢল নামে। শেষ পর্যন্ত ভালোই ভালোই দাফন কাফনের কাজ শেষ হলো। পথে হরি কাকার সাথে দেখা, তিনি কাঁদছেন।
-বাবু, তোয়ার বাপর নান মানুষ আর নইবু। ইবা উগগা ফেরেশতা আছিল।
আমি দোটানায় পড়ি। জানি, মানুষ মারা গেলে, সবাই ভালো ভালো কথা বলে, কত কত তারিফ করে! অথচ জীবিতকালে সবাই তাঁরে কিপটে ছাড়া কিছু ভাবল না। তিনি কেঁদে কেঁদে হিক্কা তোলেন। বললেন,
-বাবু, তোয়ার বাপ আত্তুন মাছ কিনিতো। টেঁয়া আছে তবু হনোদিন ধুম গরি মাছ ন লইতো। একদিন আঁই পুচ গরনের পরে কি হওইয়ে জানো না?
– ওডা, আঁই যদি বেয়াগ মাইনসের আগে মাছ লই ফেলি, মাইনষে বদ দোয়া দিব। মনে গরিবু টেঁয়ার গরমে বড় মাছ আগে লই ফেলাই। আঁই এতাল্লাই আস্তে ধীরে মাছ লই। কেউত্তুন বড় মাছ খাইতু মন চাইলে, ইতারা আগে লই ফেলক।

বাড়িতে এতগুলো পাহাড়ি লোকজন বাবাকে শেষ দেখা দিতে এসেছে দেখে অবাক হই। তাদের মধ্যে বয়স্ক একজন বলল,
-বাবু, তোয়ার বাপ আরারঁতুন বেয়াক সময় শাক-সব্জি কিনিতো। আরাঁর লগে হনোদিন দরদাম ন গইরতো। দামের তুন বেশি টেঁয়া দিতো। আঁরা ত ভিক্ষা ন গরি; এতাল্লাই আঁরারে বেশি দয়া গইরতু। তোয়ার বাপ বেশি গম মানুষ আছিল।

বোডিং স্কুলের হল সুপার আমাকে অনেক্ষণ জড়িয়ে ধরলেন। বললেন,
-তোমার বাবা আমাদের হোস্টেলে তোমাদের পুকুরের মাছ অর্ধেক দামে দিতো। আমাদেরকে বলতেন,
-মাস্টার সাব, বাপ-মা ছাড়া ছেলেরা এখানে একা একা থাকে। আমি না হয়,অর্ধেক দামে মাছ দিয়ে একটু সাহায্য করি। ওরা এখানে কিইবা খেতে পায়, তাতো জানি না।

গ্রামের অনেকগুলো এতিমখানাগুলো কিভাবে চলে,আমরা কোন্দিন ভুলেও টের পাইনি। আমরা এতদিন জানতে পারিনি, আমাদের জমিনের অর্ধেক ধান কোথায় যায়? একজন কিপটে মানুষের জানাজায় হাজার হাজার মানুষ শরীক হবার আগে কেউ বাবাকে চিনতে পারিনি। আমরা কখনো তাঁর ভেতরটা পড়তে পারেনি। তিনি হয়তো নিজেকে আড়াল করেছিলেন নতুবা আমরা ছিলাম নির্ঘাত অন্ধ। এই যে ভুলেভরা জীবন! বাবাকে কখনো বলা হয়নি, তাঁকে কত্ত ভালোবাসি।

আমরা ভীষণ স্বার্থপর। আমরা শুধু নিজের সুখের কথা, আরামের কথা ভেবেছি।

ছবির উৎস : ইন্টারনেট।

Facebook Comments