banner

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 864 বার পঠিত

 

বিয়ে বৈধ হবার শর্তাবলী


কানিজ ফাতিমা


একটি বিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য যেসব শর্তাবলী পূরণ হওয়া বাধ্যতামূলক- তা নিয়েই সামনের আলোচনা। ইসলামের দৃষ্টিতে বিয়ে কেবল একজন নারী ও একজন পুরুষের একত্রে বসবাসের জন্য অর্থনৈতিক ও দৈহিক সুব্যবস্থাযুক্ত নয় (Financila and physical arrangement) বরং এটি আল্লাহর দেয়া একটি নেয়ামত, যার মাধ্যমে মানুষ সুখ ও স্বস্তি লাভ করে, জীবনকে উপভোগ করে এবং নিজের বংশধারা অব্যাহত রাখে। বিয়ের শর্তের ব্যাপারে আমাদের সমাজে নানা ভুল ধারণা প্রচলিত রয়েছে। যা দূরীভূত হলে জীবন সহজ ও সুন্দর হতো। অনেকে বিয়েতে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান বা মহাভোজের (Grand feast) আয়োজনকে বিয়ের জন্য অপরিহার্য মনে করে। আবার ভারী স্বর্ণের অলংকার আদান প্রদান না করলে বিয়েটা যেন ঠিক সামাজিক বৈধতা পায় না। এগুলো একেবারেই ভুল ধারণা। এর ফলে পাত্র, পাত্রের পরিবার এবং পাত্রীর অভিভাবকের উপরে একটি বড় খরচের বোঝা এসে পড়ে- যা বিবাহকে কঠিন করে তোলে। এ খরচের কথা চিন্তা করে অনেক মুসলিম যুবাই বিয়ের ব্যাপারে পিছপা হন এবং পাত্রীর পরিবারও কঠিন আর্থিক সমস্যায় নিপতিত হয়। অথচ ইসলামে বিবাহকে যতটা সম্ভব সহজ করতে বলা হয়েছে।মহাভোজ, জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান বা ভারী স্বর্ণালংকার কোনটিই বিবাহ বৈধ করার শর্ত নয়। বিশেষতঃ স্বর্ণালংকারের দাম যেভাবে বেড়েই চলছে তাতে অধিক পরিমাণ স্বর্ণ দেয়া বর, বরপ, পাত্রী, এমনকি দেশের অর্থনীতি কোনটির জন্যই কল্যাণকর নয়। ভারী অলংকার কিনতে বর বা বরপরে একবারে মোটা অংকের টাকা খরচ করতে হয় (কিস্তিতে অলংকার কেনার রেওয়াজ যেহেতু নেই)। পাত্রীর জন্যও এটা ততটা লাভজনক নয়। কারণ স্বর্ণালংকার কেনার টাকাটা তার মোহরানার উসুল হিসেবে ধরা হয়। এটি স্বর্ণ হিসেবে আলমারীতে থাকার চেয়ে ক্যাশ হিসেবে ব্যাংকে থাকার সুবিধাটা বেশী। প্রয়োজনে এটাকে কাজে লাগানো সহজ হয়। অনেকে বলতে পারেন স্বর্ণ বিক্রি করে ক্যাশ পাওয়া সম্ভব। বাস্তবে এটা সত্যিই সহজ নয়। স্বর্ণ বিক্রিতে বর বা বরপরে আপত্তি থাকতে পারে। এটা বিক্রি করা ঝামেলাপূর্ণ। তাছাড়া বিক্রির সময় স্বর্ণের খাদ বাবদ মূল স্বর্ণ থেকে অনেকটা বাদ দেয়া হয়। ফলে মূল্য অনেক কম পাওয়া যায়। উপরন্তু ছিনতাই বা চুরি হওয়ার ভয়তো রয়েছেই। বর্তমানে কিছুদিন পরপরই গহনার ফ্যাশন বা ডিজাইনে পরিবর্তন আসে। সেেেত্র বাজারে অনেক ধরনের অলংকার পাওয়া যায় যেমন ইমিটিশন, সিটি গোল্ড ইত্যাদি। এর ডিজাইন বাহারী, রঙ টেকসই, খরচও কম। অনায়াসে এক দেড় বছর চালানো যায়, তাই ফ্যাশন সচেতনদের জন্য এটাই উত্তম পন্থা। আমরা জানি স্বর্ণের যাকাত দিতে হয়। যেসব নারীদের নিজেদের উপার্জন নেই তারা এ ব্যাপারটিতে এক ধরনের দোটানায় ভোগেন। যেমন- স্বর্ণেল মালিক তার স্বামী নন। তাই যাকাত দিতে তিনি বাধ্য নন। স্বর্ণের মালিক হিসেবে যাকাত ঐ মহিলার উপর ফরজ (অনেক আলেমদের মতে)। অথচ যাকাত দেয়ার মতো ক্যাশ তার নেই। সেক্ষেত্রে হয় ঐ স্বর্ণ বি ক্রি করে ঐ স্বর্ণের যাকাত দিতে হবে নতুবা স্বামীর নিকট থেকে অর্থ নিয়ে যাকাত দিতে হবে। এ সমস্যার সব থেকে সহজ সমাধান স্বর্ণ কমিয়ে সাড়ে সাত ভরির নীচে নামিয়ে আনা। এটা আপনার সমস্যাকে যেমন হাল্ক করে তেমনি দেশের অর্থনীতিতেও পজিটিভ ভূমিকা রাখে। কারণ স্বর্ণটা স্থবির অবস্থায় আপনার আলমারিতে পরে থাকা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। এটা লিকুইড করলে তা কোন না কোন উপায়ে দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের কাজে আসে। আর মুসলমান হিসেবে আমাদের সেটাই করা উচিত যেটা আমাদের জন্য সহজ কিন্তু অধিক কল্যাণকর। এবার দেখা যাক একটি বিবাহ বৈধ হবার শর্তগুলো কী কী- বিয়ে মূলত একটি সামাজিক চুক্তি। ইসলামী বিধান অনুযায়ী নিুলিখিত শর্তসমূহ বিয়ের বৈধতার জন্য অপরিহার্য – ১. পাত্র ও পাত্রীর পূর্ণ সম্মতি : বিয়েতে পাত্র ও পাত্রীর পূর্ণ ও স্বতঃস্ফূর্ত সম্মতি প্রয়োজন যা ইজাব (প্রস্তাব) ও কবুল (গ্রহণ) এর মাধ্যমে গৃহীত হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত পাত্র প্রস্তাব করে ও পাত্রী কবুল করে। তবে পাত্রীর প্রস্তাব করা ও পাত্রের গ্রহণ বা বর্জন করার নীতিও ইসলামে স্বীকৃত। দ্রষ্টব্য বুখারী, কিতাবুন নিকাহ। অনেক আলেম মনে করেন পাত্রী পরে অভিবাবকের সম্মতিও বিবাহ বৈধতার শর্ত। তবে অনেক আলেম ভিন্নমত পোষণ করেন। যেমন আবু হানিফার মতে সাবালক নারীর ক্ষেত্রে তার মতই যথেষ্ট, অভিভাবকের সম্মতি বাধ্যতামূলক নয়। অর্থাৎ সাবালক নারীর অভিভাবকের সম্মতি ব্যতীত তার নিজের সম্মতিতে বিবাহ বৈধ হবে। ২. স্বামী : বিবাহ দু’জন নির্ভরযোগ্য স্বামী থাকতে হবে। ৩. . প্রচার : স্কলাররা এ ব্যাপারে একমত যে বিয়ের ব্যাপারটি গোপন রাখা ঠিক নয় বরং সেটিকে সমাজে প্রচার (Publicize) করা জরুরী। এজন্য বর (বা বর প) তার সামর্থ্য অনুযায়ী ভোজের ব্যবস্থা করবে। আগেই বলা হয়েছে যে, বড় ভোজের আয়োজন করা বাধ্যতামূলক নয়। বড় বা ছোট ভোজ এ ব্যাপারে ইসলাম কোন বাধ্য-বাধকতা দেয় নি। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী ভোজকেই (কৃপণতা বা বিলাসিতা দু’ই ইসলাম অপছন্দ করে) ইসলাম উৎসাহিত করে। এখানে উল্লেখ্য আমাদের সমাজে বেশীর ভাগ সেক্ষেত্রে পাত্রী পরে ওপর বড় ভোজ আয়োজনের দায়িত্ব বেশী থাকে। অথচ ইসলাম ভোজ আয়োজনের দায়িত্ব দিয়েছে বরপকে। তবে পাত্রী প যদি স্বেচ্ছায় সামর্থ্য অনুযায়ী ভোজের আয়োজন করে তাতে দোষের কিছু নেই। পাত্র পরে উচিত হবে না পাত্রী পরে উপরে এ ভোজ আয়োজনের জন্য প্রত্য বা পরো চাপ প্রয়োগ করা। আমাদের দেশে অনেকেই বরযাত্রীর নাম করে একটি বড় সংখ্যা পাত্রীপরে উপর চাপিয়ে দেন। ৪. দেনমোহর : আর একট গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো দেনমোহর (Bridal gift)। এটি আদায় করা প্রতিটি স্বামীর জন্য ফরজ, তা মিলনের পূর্বে হোক বা পরেই হোক। এক্ষেত্রে স্বামীর উচিত তার সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা সম্ভব দ্রুত দেনমোহর আদায় করায় সচেষ্ট হওয়া। অনেকে মনে করেন কেবল তালাক হলেই মোহর দিতে হয়। এটি একেবারেই ভুল ধারণা। দেনমোহর বিয়ে বৈধতার একটি শর্ত। কাজেই বিয়ের সময়ই দেনমোহর ফরজ হয়ে যায়। এবার জানা যাক বিয়ের সময় একজন ইমাম বা কাজীর উপস্থিতি বাধ্যতামূলক কি না। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কাজী বা ইমামের উপস্থিতি বাধ্যতামূলক নয়। উপরোক্ত চারটি শর্ত পূরণ হলেই ধর্মীয়ভাবে বিয়ে হয়ে যাবে। তবে বিয়ে পড়ানোর জন্য (Solemnize) বিয়ে পড়ানোর অনুমতি প্রাপ্ত (Authorized) কেউ উপস্থিত থাকা উচিত। যেমন আমাদের দেশে রেজিষ্টার্ড কাজী। এবার আলোচনা করবো আইনগত ব্যাপারটি নিয়ে। উল্লিখিত চারটি শর্ত পূরণের মাধ্যমে বিয়ে ধর্মীয় বৈধতা পেয়েও আইনগত বৈধতা পাবার জন্য দেশীয় আইন মতে কিছু কাগজপত্র (Legal paper) তৈরী করা বাধ্যতামূলক। এটা না করা হলে বিবাহের েেত্র কোন সমস্যা দেখা দিলে (Event to dispute) তার আইনী সমাধান পাবার কোন সম্ভাবনা থাকবে না। এক্ষেত্রে আমাদের দেশের চাহিদা কাবিন করা ও বিবাহ রেজিস্ট্রি করা আইনগত বাধ্যতামূলক যাতে মোহরানা ও অন্যান্য শর্তাবলী উল্লেখ থাকে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এ আইনী কাগজপত্র বাধ্যতামূলক না হলেও বর্তমানে আলেম সমাজ এ ব্যাপারে একমত যে এটা প্রতিটা মুসলমানের করা কর্তব্য।

Facebook Comments