banner

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 856 বার পঠিত

 

বৈবাহিক সমস্যা ও কোরআনের সমাধান -৩


কানিজ ফাতিমা


আমরা যখন স্ত্রীদের শাস্তি প্রদান (Chastisement) এবং এর ফলে সৃষ্ট আঘাত, কষ্ট ও অপমানের ব্যাপারটি বিবেচনা করবো তখন একটি কথা আমাদের মনে রাখা উচিত যে কষ্ট, ভয় বা উদ্বেগএর (suffering, fear and anxiety) পরিণাম হল ঘৃণা, বিচ্ছিন্নতা ও অনীহা (hate, isolation, apathy)। পক্ষান্তরে ভালবাসা, সম্মান ও বিশ্বাস (love, respect, trust) এর পরিণাম হল সহৃদয়তা, ত্যাগ ও উৎসাহ (Charity, dedication, and enthusiasm)

আমাদের ইতিহাসে দেখা যায় যে, বিগত কয়েক শত বছর ধরে মুসলিম উম্মাহকে কঠিন দমন ও অপমান সহ্য করতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এর ফলে স্বৈরশাসন ও ক্ষমতার সুবিধা ভোগের {বা অপপ্রয়োগের} একটি সংস্কৃতি ও মানসিকতা এ উম্মাহর মধ্যে তৈরি হয়েছে। অধিকাংশ সমাজেই এ সংস্কৃতি শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় যন্ত্রগুলোর (state police or security apparatus) মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি সমাজের সাধারণ সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। ফলে সমাজে দূর্বল অংশের উপর সবল অংশ ক্ষমতা ও শক্তি প্রদর্শন করে। অথচ এ সংস্কৃতিটি ইসলামের মূল স্পিরিটের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্য ইসলামী সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ যেখানে সুন্নাহ হল “মসলিম উম্মাহ একটি ইমারতের মত যার এক অংশ অন্য অংশকে দাড় করিয়ে রাখে।” “মুমিনদের উদাহরণ হচ্ছে একটি দেহের মত যার একটি অঙ্গ অসুস্থ হলে অন্য সব অঙ্গ মিলে ঐ অঙ্গের সুস্থতার জন্য কাজ করে।”
হাদিসে এসেছেঃ “প্রতিটি মুসলিম একে অন্যের ভাই। কাজেই তারা একে অন্যকে নির্যাতন, অপমান বা ত্যাগ করবে না। একজন মুসলিমের অন্যায়ের জন্য এটাই যথেষ্ট যে সে তার ভাইকে ছোট(বা অপমান) করবে।”
“আল্লাহ সেই ব্যক্তির উপর রহমত করেন না যে অন্যকে দয়া দেখায় না ।”
“আল্লাহ তার দয়ালু বান্দাদের উপরই রহমত করেন।”
“একজন ঈমানদার কখনওই অপবাদ রটনাকারী, মানুষকে নিয়ে ঠাট্টাকারি বা অশ্লীল ও অশালীন হতে পারে না।”
“ঈমানদারদের মধ্যে তার ঈমানই সর্বাপেক্ষা মজবুত যার নৈতিকতা সর্বাপেক্ষা উত্তম এবং তোমাদের মধ্যে সেই সর্বাপেক্ষা উত্তম যে তার পরিবারের প্রতি উত্তম।”
একটি হাদীসে উল্লেখ্য আছে যে, হযরত মুহাম্মদ(সা) একজন ব্যক্তিকে কঠিনভাবে ভৎসনা করেছিলেন কারণ সে তার স্ত্রীকে পিটিয়েছিল। “যে তার স্ত্রীকে ভৃত্যের মত পেটায় আবার তার সঙ্গে শুতে লজ্জাবোধ করেনা। ” (বুখারী , vol-6)। মুসলিম শরীফে vol-6 উল্লেখ আছে যে, আল্লাহর পথে জিহাদ ব্যতীত, হযরত (সা) কোন নারী , ভৃত্য অথবা কোন ব্যক্তির উপর কখনও হাত তোলেননি। [এমনটি যুদ্ধকালীন অবস্থায়ও শত্র“পক্ষের নিরীহ নারীদের প্রতি অঘাত করা নিষিদ্ধ ছিল।] রাসুল (সাঃ) আরও বলেছেন “ তোমাদের মধ্যে অনেক মহিলা তাদের স্বামীদের নির্যাতনের ব্যাপারে রাসুলের পরিবারের কাছে শোক প্রকাশ করতে আসে। এই নির্যাতনকারী স্বামীরা কখনওই উত্তমদের অন্তর্ভূক্ত নয়।” (আবু দাউদ, VOL-8 No-2146, P-608)
সূরা নিসার ব্যবহৃত ‘দরাবা’ এর সঠিক ধারণা পেতে হলে আমাদের ইসলামের এই সাধারণ মূলনীতিগুলোর আলোকে বিষয়টিকে দেখতে হবে। এবং এর সাথে সাথে বর্তমান আধুনিক সময়ে মুসলিম পরিবারগুলোর কাঠামোকেও আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
এখানে দুটি বিষয় বিশেষ গুরুত্বপূর্ন-
প্রথমত, সূরা নিসার ৩৪ও ৩৫ নং আয়াতকে (যাতে এই শ্বাস্তির ব্যাপারটি বিধৃত হয়েছে) বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাখা করা যাবে না। এ আয়াতের ব্যাখার ভিত্তি হতে হবে সূরা রূমের ২১ নং আয়াত যেখানে আল্লাহ পারস্পরিক দয়া ও ভালবাসাকে বিবাহের উদ্দেশ্য হিসেবে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে।
“আর এক নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সংঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন। ” (আর রূম-২১)
শুধু বিবাহের ক্ষেত্রে নয় এমনকি বিবাহ বিচ্ছেদ বা তালাকের সময়ও নারীকে অসম্মান করা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
“আর যখন তোমরা স্ত্রীদেরকে তালাক দিয়ে দাও, অতঃপর তারা নির্ধারিত ইদ্দত সমাপ্ত করে নেয়, তখন তোমরা নিয়ম অনুযায়ী তাদেরকে রেখে দাও অথবা সহানুভূতির সাথে তাদেরকে মুক্ত করে দাও। আর তোমরা তাদেরকে জ্বালাতন ও বাড়াবাড়ি করার উদ্দেশ্য আটকে রেখো না । আর যারা এমন করবে, নিশ্চয়ই তারা নিজেদের ক্ষতি করবে।” (বাকারা-২৩১)
যেখানে বিবাহরে ভিত্তি সম্প্রীতি ও দয়া এবং এই বিবাহরে সমাপ্তিতেও নারীর প্রতি সহানুভূতি ও সম্মানের কথা বলা হয়েছে সেখানে বিবাহকালীন সময়ে সম্পর্ক ধরে রাখার মাধ্যম হিসাবে আঘাত ও মানসিক যন্ত্রণাকে ব্যবহার ঠিক সামঞ্জস্যশীল মনে হয় না।
দ্বিতীয়ত: অতীতে পরিবারে নারীদের ভূমিকা একরকম ছিল। তখন মহিলাদের সকল কার্যক্রম পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থনৈতিক কার্যক্রম থেকে তারা বিরত থাকতেন। অন্যদিকে পুরুষরা অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালন করত। পুরুষদের এই অর্থনৈতিক শক্তি তাদেরকে বাড়তি ক্ষমতা প্রদান করত। অর্থনৈতিক ব্যাপারে পুরুষদের উপর নির্ভরশীলতা নারীদেরকে ক্ষমতাহীন করে রাখতো ফলে সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও তারা পুরুষদের উপর নির্ভর করতো। কিন্তু বর্তমানে এ চিত্রের পরিবর্তন ঘটেছে। পরিবারে নারী ও পুরুষের এ ভূমিকায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। পুরুষের উপর নারীর অসহায় নির্ভরশীলতা কমেছে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে; ফলে নারীদের উপর পুরষের একচ্ছত্র ক্ষমতা ব্যবহারের ক্ষেত্রও হ্রাস পেয়েছে। কাজেই বর্তমান সময়ে পরিবারের কোন সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বা স্বামী-স্ত্রীর কোন বিরোধ নিরসনে পরিবারের এই কাঠামোকে বিবেচনায় রেখেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

চলবে….

পর্ব-২

Facebook Comments