banner

সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 414 বার পঠিত

 

বার্ধ্যক্যের সীমাবদ্ধতা : ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম পর্ব -২

বার্ধ্যক্যের সীমাবদ্ধতা : ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম পর্ব -২


জিয়াউল হক


সারা বিশ্বে প্রায় প্রতিটি প্রৌঢ় নারী-পুরুষর ক্ষেত্রেই কমবেশি এমনটা (Confabulation এর ঘটনা) ঘটে। আমাদের দেশে (এবং যে দেশে বা যে সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে গণসচেতনতা নেই, সেসব দেশ ও সমাজে) এসব প্রৌঢ়রা তাদের এ ধরনের আচরণের কারণে অনেক বিড়ম্বনা, অপমান ও নিগ্রহের শিকার হন।
আমার নিজের দেখা বেশ কিছু ঘটনা মনে পড়ছে এ সময়। প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ কিছুক্ষণ আগেও খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, এমন সময়, দূরের গ্রাম থেকে তার বড় মেয়ে বাবাকে দেখতে এসেছেন। বাবাকে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তিনি কিছু খেয়েছেন কি না, বাবার সোজা সাপ্টা উত্তর হলো, না কিছু খাননি।
ষাটোর্ধ বিধবা কন্যা ছোট ভাইয়ের বাড়িতে, তারই আদরের ভ্রাতৃবধুর হাতে বৃদ্ধ বাবার প্রতি এ ধরনের অযতœ আর অবহেলা (!) দেখে ও স্বয়ং বাবার মুখে শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। পাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধের নাতি নাতনীর প্রদত্ত সাক্ষ্যও সেদিন সেই নারীকে এটা বিশ্বাস করাতে পারেনি যে, তার বাবা একটু আগেই নাতি-নাতনীদের সাথে বসে একত্রে খাবার খেয়েছেন। বৃদ্ধের পুত্রবধু তাকে কোনরকম অবজ্ঞা বা অবহেলা করেননি।
বেচারা বৃদ্ধ নাতি-নাতনীর চোখে পাক্কা মিথ্যাবাদী, তাদের মায়ের ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপকারী হয়ে রইলো। আর পুত্রবধুর চোখে তো এক পা কবরে রাখা বুড়ো বদমাশ (!) হয়ে গেল সেদিন থেকেই!
সম্ভাব্য সব ধরনের আদর যতেœ থাকা বৃদ্ধ মনের ভুলে এক সময় বলে ফেলা একটা কথার কারণে আমৃত্যু কি নিদারুণ নিগ্রহ আর মানসিক পীড়নের মুখোমুখি হয়েছিলেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এরকম অবস্থায় পরিবারের কর্তার সাথে পুত্রবধুর, আর পুত্রবধুর সাথে সংসারের অন্যন্য আত্মীয়-স্বজনের সামাজিক সম্পর্ক কোন পর্যায়ে যেতে পারে তা অতি সহজেই আমরা অনুধাবন করতে পারি। ডিমনেশিয়া বা স্মৃতিভ্রষ্টতা যে একটা অসুখ, এবং বৃদ্ধের কথাবার্তা, কাজকর্ম ও আচার-আচরণ যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই অসুখের কারণে প্রভাবিত হতে থাকবে, সে ধারণা আমাদের অধিকাংশেরই নাই।
এর ফলে আমাদের আদরের, শ্রদ্ধার বাবা-মা, বৃদ্ধ আত্মীয়-স্বজনরা অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমাদের অজান্তেই নিগ্রহ (Elderly Abuse) ও মানসিক পীড়নের (Psychological Abuse) শিকার হচ্ছেন। সমাজে এসব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা অত্যন্ত নাজুক (Vulnerable) অবস্থায় তাদের দিন কাটান।
অথচ আল-কুরআনে আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন সুস্পষ্টভাবে নির্দেশ দিয়েছেন তাদের সাথে সদাচারণ ও উত্তম ব্যবহার করার জন্য। যেমন- নির্দেশ দেওয়া হয়েছে :
তোমার পালনকর্তা আদেশ করেছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যাবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়; তবে তাদেরকে ‘উফ’ শব্দটিও বোলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না এবং তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বলো। তাদের সামনে ভালবাসার সাথে, বিন¤্র হও এবং বল- ‘হে আমাদের রব! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’।২২ (সুরা আল ইসরা, ২৩-২৪)
অথচ বাস্তব সত্য হলো, আমাদের বাবা-মা যখন বুড়ো বয়সে উপনীত হন, যখন তারা নিজেদের উদ্যোগে যথাযথ কমিউনিকেশন করতে পরেন না, যখন তাদের নিজেদের প্রয়োজনটাকেও তারা প্রকাশ করতে পারেন না পূর্ণরূপে বা ঠিকভাবে, যখন তারা শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতার কারণে নিজেদের প্রয়োজন সময়মত ও যথাযথ মেটাতে পারেন না, যখন তাদের সবচেয়ে বেশি সাহায্য, সাহচর্য, সান্নিধ্য আর মনোযোগ প্রয়োজন, সেসময়টাতেই আমরা তাদের প্রতি সবচেয়ে কম মনোযোগ দেই, তাদের সাথে সবচেয়ে কম সময় অতিবাহিত করি।
এতে করে আমরা যেমন তাদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে যাই, তেমনি তারা নিজেরাও দুর্বোধ্য হন পরিবারের কাছে, সমাজের কাছে। তদের মানসিক শান্তি ও স্থিতির ভিতটাই নড়বড়ে হয়ে যায়। তারা নিঃসঙ্গতায় ভুগতে শুরু করেন।

Facebook Comments