banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 907 বার পঠিত

 

ড্রাইভার


জাহেদ উদ্দীন মোহাম্মদ


আজ দিনটা খারাপ যাবে, নিশ্চিত। অফিস হতে বের হবার সময়, বড় স্যারের সাথে একদফা গরম-গরম হয়ে গেছে।
ভীষণ বিরক্তিতে রমিজ গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরলো। গাড়ির কাগজপত্র নেয়া হয়নি। স্যারের রুমে ঢুকতে আর ইচ্ছে করছে না। পিয়ন কামাল ভাইকে কাগজ আনতে পাঠালো।
-কি ব্যাপার, কামাল?
-গাড়ির কাগজ নিতে এলাম,স্যার।
-রমিজ কোথায়?
-অফিসের ফোর্চের নীচে গাড়িতে।
-আচ্ছা, যাও।
স্কুল ডিউটিতে গিয়ে মনটা ভালো হয়ে গেল। স্যারের মেয়ে মিমি ক্লাস থ্রিতে পড়ে। মেয়েটা এমন মোলায়েম স্বরে চাচ্চু ডাকে, মনটা এমনিতে ভালো হয়ে যায়। কোন কোন সময় মনে হয়, এ যেন সাক্ষাৎ ফেরেশতা!
-চাচ্চু, এসেছ? আমি ঐ সিঁড়িতে উঠে, কতক্ষণ ধরে ডাকছি! সেই খেয়াল আছে?
-সরি মা, ভুল হয়ে গেছে । আর হবে না।
-সরি বললেই হলো! তুমি সবসময় এইরকম করো। দাও, এবার চকলেটগুলো দাও।
-আচ্ছা মা, দিচ্ছি দিচ্ছি। তুমি চোখ বড় বড় করে এভাবে তাকিয়ো না। আমি ভয় পাই, মা।
মেয়েটি ফিক করে হেসে ফেলেল। সামনের দুটি দাঁত নেই, হাসলে আরো মায়াবতী লাগে।
রমিজ শার্টের বুক পকেট হাতড়িয়ে চকলেট বের করে হাতে দিলো।
-কি চাচ্চু, চকলেট দু’টো কেন? আমি এখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। তোমার মনে থাকে না, কেন?
-সরি মা, সরি।
রমিজ পকেট উল্টিয়ে আরো একটা চকলেট মিমির হাতে দিল। রমিজে সাথে মিমির শর্ত হলো, ক্লাস যত চকলেট তত।
প্রতিদিন স্কুল শেষে এই চকলেট তার চাই। তারপর ১৫কিমি পথ পাড়ি দিতে দিতে দু’জন মিলে রাজ্যের কথার ঝাঁপি খুলে বসে।
-জানো চাচ্চু, আমাদের ক্লাসে দুটো ভুত আছে। যারা বেশি কিউট তাদেরকে ওরা চিমটি কাটে।
-কি বলো! সত্যি? তুমি দেখেছ?
– আমি দেখিনি। আজ শ্রাবন্তীকে চিমটি কাটলো। ও চিৎকার দেয়ার পর পর পালিয়ে গেলো। ও অনেক কিউট তো, তাই। সবাই ওকে “কিউটের ডিব্বা” বলে ডাকে।
-ও হ্যা, আমাদের অঙ্ক স্যারের বিয়ে হবে। আমাকে বলেছে, তোমাকেও নিয়ে যেতে। দাওয়াত করেছে। তুমি যাবে?
-তোমার চ্যার আমাকে দাওয়াত করেছে। চত্যি বলছো?
মিমি ছোটকালে স’কে উচ্চারণ করতো ‘চ’। তখন আধো আধো আদুরে কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগত। রমিজ প্রশ্নটা করে মুখ ফিরিয়ে চুপচাপ হাসতে লাগলো।
-চাচ্চু, ভালো হবে না বলছি। একদম ভালো হবে না।
মিমি চোখ বড় বড় করে রমিজের দিকে কটমট করে তাকালো।
কিছুই হয়নি এমন ভাব নিয়ে রমিজ বলল,
-কেন মা? কি হয়েছে?
– কি হয়েছে বুঝনি? আর একবার বললে, একদম আড়ি দিয়ে দেব। তুমি আমাকে টিজ করছো কেন?
-আমি? কি করলাম আবার? বলেই এবার হো হো করে হাসতে লাগলো।
-সরি মা, সরি। ভুল হয়ে গেছে, মা। আর হবে না। এবার মাফ করে দাও। কেমন?
– তুমি প্রত্যেকদিন ভুল করবে। আর বলবে- সরি! এই সরিকে কাছে পেলে আমি…..।
মিমির চোখমুখের এই ভাবটা রমিজের খুব ভালো লাগে। নিজের মেয়েটার কথা মনে পড়ে। মেয়েটা এখন বড় হয়ে গেছে। ছোটকালে সে ছিল এমন আদুরে আর বাবা-পাগলী।
রমিজ ড্রাইভারের দুই ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে ঢাকায় চাকরি করে। বিয়ে দিয়েছেন। পরিবার নিয়ে ঢাকা থাকে। ছেলে অফিসে গেলে, ছেলের বৌ বাসায় একা একা থাকে। ছেলের বাসায় ফিরতে কখনো কখনো রাত হয়ে যায়। বৌমা একা থাকতে খুব ভয় পায়, তাই বড়টা ছোটভাইকে ঢাকা নিয়ে গেছে। ওখানে কলেজে পড়ে।
মেয়েটা চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। ইকোনমিক্স সেকেন্ড ইয়ার। মেয়েটার জন্য বুকে তার বড় মায়া। এক একটা বছর যায় আর মেয়েটার জন্য বুক ধকধক করে উঠে।
মনে হয়, মেয়েটা বড় হচ্ছে মানে শ্বশুর বাড়ির দিকে এক’পা এক’পা করে এগোচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতে রমিজ কখন যে অফিস ক্যাম্পাসে পৌছে গেছে, খেয়াল করেনি।
মিমির “চাচ্চু- চাচ্চু” ডাকে সম্বিত ফিরে এলো। অনেকক্ষণ চুপচাপ দেখে মিমি বলল,
– বকা দিয়েছি, তাই রাগ করেছ, চাচ্চু? আমি আড়ি দিইনি তো!
-না, মা। রাগ করিনি। মা’র সাথে কি ছেলে রাগ কর‍তে পারে? এসো মা, তোমাকে নামিয়ে দিই।
মিমিকে পাজাকোলা করে বাসায় নামিয়ে দিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে চলে এলো।
মেয়েটা আজকাল রমিজকে বেশি কেয়ার করছে। মিমির কান্ডকীর্তি দেখে, কয়েকদিন যাবত মনে একটা প্রশ্ন কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে,
-আচ্ছা, প্রতিটি মেয়ে কি অন্য মেয়ের বাবার না বলা বেদন বুঝতে পারে?
-কি জানি। হবে হয়তো।
ছেলেমেয়েদের ছাড়া রমিজের বাসা এখন নিসঙ্গতায় ভুগছে। ছোট ছেলের পোষা গিরিবাজ কবুতরের বাকবাকুম ডাক কিংবা লাভ বার্ডগুলোর কিচিরমিচির শব্দে বেঁচে আছে রমিজের বৌ।
কিন্তু আজকাল রমিজ বড় একলা লাগে। মেয়ের শূন্য খাটপালং এর দিকে তাকালে বুকে কেমন করে উঠে।
বাপ-পাগলী মেয়েটা জন্য রমিজের মন হুহু করে। যতক্ষণ মিমির সাথে থাকে, ততক্ষণ মনে হয় নিজের মেয়েটার কাছে আছে।
এখন তার সকল আদর-মায়া-মমতা যেন মিমিকে ঘিরে।
এখন তার দৃঢ় বিশ্বাস, দুনিয়াতে মেয়েরা অন্য মেয়ের বাবার মনটাও বুঝতে পারে। হয়তো মিমিও পেরেছে।
রমিজের চাকরি পঁয়ত্রিশ বছর চলছে। কত স্যার এলো গেলো। কত জনের ছেলেমেয়েদের স্কুল-কলেজে আনা-নেয়া করলো। কিন্তু মিমির মতো কেউ তার মনে দাগ কাটেনি। মনে নানা রকম কত কত ভাবনাচিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। রমিজ মনে মনে যুক্তি খাড়া করে,
-তখন তাঁর ছেলেমেয়েরা কাছে ছিল। অফিস শেষে সবাই তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তো। সারাদিনের ক্লান্তি নাশ হয়ে যেত। তাই হবে হয়তো।
কয়েক মাস আগে মিমির এক ঘটনা রমিজকে একদম কাঁদিয়ে ছাড়লো। তখন মিমির অর্ধবাষিকী পরীক্ষা শুরু হলো। ম্যাডাম অসুস্থ। তাই রমিজকে বলল,
-রমিজ, আমি তো যেতে পারছি না। ভাই, তুমি আমার মেয়েকে একটু দেখো।
মিমিকে রমিজ স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে দিয়ে যেই ফিরে আসছে। ওমনি পিছন হতে ডাক। পিছন ফিরতেই দেখে চাচ্চু, চাচ্চু, বলতে বলতে মিমি দৌড়ে আসছে।
বিপদের আচঁ পেয়ে রমিজ দৌড়ে গেল।
মিমি কাছে এসে টুপ করে তাঁকে কদমবুচি করলো। কপালে একটা চুমু দিতে দিতে বলল,
-চাচ্চু, আমি পরীক্ষা দিতে গেলে সবসময় মাকে সালাম করি আর কপালে চুমু দিই। আজ মা আসেনি, তাই তোমাকে দিলাম। দোয়া করিও। কেমন।
মিমি এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে পরীক্ষা হলের দিকে দৌড় দিল।
রমিজের মুখে হঠাৎ কোন কথা সরে না। চোখ ছলছল করে উঠে। এত ছোট্ট একটা মেয়ে,এটা কি করলো!!!
অদৃশ্য এক আহবানে তাঁর দু’হাত যেন আকাশের দিকে উঠে গেলো।
-খোদা, এই পঁয়ত্রিশ বছরের ড্রাইভারের চাকরিতে কত তুচ্ছতাচ্ছিল্য পেয়েছি! তুমি আজ যে সম্মান আমায় দিলে, তুমি তাঁর হেফাজত করো, তুমি তাঁর হেফাজত করো। আমিন, আল্লাহুম্মা আমিন।
রমিজের এই আকুল মুনাজাতে চারপাশে জড়ো হওয়া ফেরেশতারা কেবল আমিন-আমিন বলছিল।
কেউ শুনেনি, শুধু রমিজ শুনেছে।
অদৃশ্য ফেরেশতাদের কেউ দেখেনি, শুধু রমিজ দেখেছে।

ছবি সূত্র: ইন্টারনেট।

Facebook Comments