banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1502 বার পঠিত

 

ছোটবেলার স্মৃতি

রেহনুমা বিনত আনিস


আমার জন্ম নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা দেয়ার কয়েকবছর পর, এক দ্রুত পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে – যেখানে প্রতিদিন বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কার মানুষকে চমৎকৃত করছে, আগ্রহী করে তুলছে জ্ঞানের নতুন নতুন দিগন্তের প্রতি, ইউরোপ অ্যামেরিকা থেকে প্রকাশিত বই ম্যাগাজিন ডাকযোগে পৌঁছে যাচ্ছে সাধারন বাংলাদেশী পাঠকদের দুয়ারে; আজকের ব্ল্যাক অ্যান্ড ওয়াইট টিভি কাল রঙ্গিন হয়ে যাচ্ছে, টিভির পর্দায় বাংলার পাশাপাশি ভেসে আসছে ইংরেজী অনুষ্ঠানও; উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পাজামা পাঞ্জাবী শাড়ি ছেড়ে প্যান্ট শার্ট সালোয়ার কামিজের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, বিদেশ থেকে ক্যাটালগ এনে নকল করে জামা তৈরী হচ্ছে বাংলাদেশে; ড্যাটসান আর কচ্ছপের মত ভক্স ওয়াগন গাড়ীর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে গরীবের টয়োটা আর আরবী শেখদের মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ী; আর শবে বরাতে তারাবাতি আর বাজিপটকা ফুটানোর পরিবর্তে নামাজ পড়ার প্রতি তাগিদ আসতে শুরু করেছে।
যেকোন পরিবর্তনশীল সমাজের মতই এই সমাজে ছিলো অস্থিতিশীলতা, পরিবর্তনের কিছু ভালো আর কিছু খারাপ ফলাফল। অল্প বয়সে পড়তে শেখায় চার পাঁচ বছর বয়সেই পরিণত হয়েছিলাম সর্বভুক পাঠকে। বাসায় ইংরেজীর চল ছিলো, যা জ্ঞানের দিগন্ত প্রসারিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করে যেহেতু তখনো অধিকাংশ তথ্যমূলক বই এবং অনুষ্ঠান ছিলো ইংরেজীতে। তার ওপর ছিলো লেখালেখি করার অনুপ্রেরণা যা সেই ছ’বছর বয়সেই ভাবনার কুঁড়িগুলোকে মেলতে সহায়তা করে।
স্বভাবগতভাবে ছোটবেলা থেকেই ছিলাম চিন্তাশীল ও চুপচাপ যার ভালো বাংলা হল ‘অলস’। ছুটোছুটির চেয়ে ভাল লাগত টেবিলের নীচে ঘর বানিয়ে রান্নাবাটি আর পুতুল খেলা। দুষ্টুমীর মধ্যে সবচেয়ে পছন্দ ছিলো জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে পা গলিয়ে বাইরে পা ঝুলিয়ে বসে বৃষ্টি দেখা আর ফুল চুরি করা। একদিন ফুল ছেঁড়ার সময় বাবা দেখে ফেলল। বাসায় এসে পাশে বসিয়ে বলল, ‘যারা অন্যের জিনিস তাদের অনুমতি ছাড়া নিয়ে নেয় তাদের বলে চোর। এখন তুমিই বল, তুমি কি চোর?’ সেদিন থেকে এই বদস্বভাবের পরিসমাপ্তি ঘটে। এর পর থেকে ফুলটাইম মুখচুরির পেশা হয় যায়, যেখানেই যাই একটা নির্জন জায়গা দেখে বসে পড়ি একটা বই নিয়ে।
সচরাচর সমবয়সীদের তুলনায় কথা বলতাম কম, যা বলতাম তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হত ফিলোসফিকাল টাইপের, মানে এই দুনিয়ার সাথে সম্পর্কচ্যূত। এক পার্ফেক্ট পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতাম। ছোটবেলা থেকেই খুব শেল্টারড পরিবেশ বড় হলেও বুঝতাম এই পৃথিবীটা খুব একটা ভাল জায়গা না। তাই হোসেন ভাইয়া যখন বারান্দায় মরিচ শুকাতে দিতে দিতে ক্ষ্যাপাতে থাকত তখন বলতাম, ‘দাঁড়াও, মানুষ অলরেডি চাঁদে পৌঁছে গিয়েছে, কিছুদিন পর মঙ্গলেও চলে যাবে। কিছুদিনের ভেতর পৃথিবীর সব ভাল মানুষগুলো চাঁদে চলে যাবে, আর সব পঁচা মানুষগুলো পৃথিবীতে রয়ে যাবে। তোমাকে এখানেই থাকতে হবে, কারণ তুমি যে পঁচা!’ তবে অনেক বড় হয়ে বুঝেছি ভাল আর মন্দের তফাতটা এত স্পষ্ট বা এত সহজ নয়, একই মানুষ পরিস্থিতি এবং দৃষ্টিকোণ ভেদে দু’টোই হতে পারে। তাই হয়ত এত বছর পরেও আমি আর হোসেন ভাই এই একই পৃথিবীতে অবস্থান করছি।
বইয়ের পাতায় ডাইনোসরদের সাথে প্রাগৈতিহাসিক যুগে আর কল্পনার রকেটে বিভিন্ন গ্রহতারায় ঘুরে বেড়ালেও বাস্তবতার স্পর্শ তখনো জীবনে এসে লাগেনি। ছোটবেলায় আদর করে সবাইকে ডাকতাম কদু, শুধু রঙ হত আলাদা আলাদা। মৃত্যুর কন্সেপ্ট তখনো ছিলোনা। ভাবতাম আমার এই লাল কদু নীল কদুরা সবাই বুঝি অমর! আমি যখন বড় হয়ে যাব তখন ওরা আবার ছোট হয়ে যাবে, আবার ওরা বড় হতে হতে আমি ছোট হয়ে যাব। বাবা-মাকে বলতাম, ‘চিন্তা কোর না, যখন আমি বড় হয়ে যাব তখন তো তোমরা ছোট হয়ে যাবে, তখন আমি তোমাদের দেখব’। প্রথম মৃত্যু দেখি সাত বছর বয়সে, পাশের বাসার হাজী সাহেবের, আমি নিশ্চিত ছিলাম তিনি ঘুমোচ্ছেন আর তাঁর মেয়েরা কান্নাকাটি করে তাকে ডিস্টার্ব করছে, যেকোন সময় তিনি জেগে উঠে বলবেন, ‘অ্যাই কি শুরু করলি তোরা? ঘুমোতেও দিবিনা নাকি?’
যখন মৃত্যুর কন্সেপ্টটা মাথায় ক্লিয়ার হোল, তখন আবিষ্কার করা প্রয়োজন হয়ে পড়ল এর পর মানুষটা কোথায় যায়। তখন পড়াশোনা শুরু করলাম আখিরাত এবং কিয়ামাত নিয়ে। এতটুকু বুঝলাম, আমার পার্ফেক্ট পৃথিবীর অস্তিত্ব অলীক নয়, যদিও এর অবস্থান চাঁদ কিংবা মঙ্গলে নয়, জান্নাতে। তখন আবার গবেষনা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ল জান্নাতে যেতে হলে কি কি প্রস্তুতি লাগবে। রাসূল (সা)সহ বিভিন্ন নবী রাসূল এবং বিখ্যাত ব্যাক্তিবর্গের জীবন থেকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করতে শুরু করলাম কি কি যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। আট বছর বয়সে তাপসী রাবেয়ার জীবনী পড়ে পুরাই উতলা হয়ে গেলাম। নানী যখন রাতে ঘুমাতে ডাকল, বললাম, ‘তোমার জান্নাতে যাবার প্রয়োজন নেই তুমি ঘুমাও। আমি সারারাত নামাজ পড়ব’। নানী বলল, ‘না ঘুমালে শরীর খারাপ হবে’।

তাপসী রাবেয়ার প্রতিধ্বনি করে বললাম, ‘কবরে গেলে ঘুমোনোর অনেক সময় পাওয়া যাবে’। আধঘন্টা পরই দেখি ঘুমে ঢুলে পড়ে যাচ্ছি! ভাবলাম, নামাজই পড়তে হবে এমন তো কথা নেই, তাপসী রাবেয়া তো জিকরও করতেন, শুয়ে শুয়ে জিকর করলে নিশ্চয়ই কোন অসুবিধা নেই! নানীর পাশে শুলাম, নানী মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল, আরামে কোথায় যে হারিয়ে গেলাম! সকালে উঠে চোখ কচলাচ্ছি, দেখি নানী সামনে বসে মিটিমিটি হাসছে, ‘কি গো তাপসী, তোমার ফজরের নামাজ গেল কই?’ ঐ প্রকল্পের ওখানেই করুণ পরিসমাপ্তি!
কিন্তু শৈশবের এই জিনিসটাই সবচেয়ে মূল্যবান। অসম্ভব স্বপ্নকেও পরিপূর্ণ সততার সাথে লালন করা কেবল একজন শিশুর পক্ষেই সম্ভব। এই ইনোসেন্সই শৈশবের শক্তি। এই স্মৃতি আমাকে কাতর করেনা, বরং প্রেরণা জোগায়।
স্কুলে ভাল ছাত্রী ছিলাম না। স্কুলের বই বড় আটপৌরে লাগত। আমি তখন বিশ্বের এনসাইক্লোপিডিয়া পড়ছি – সম্রাট অ্যালেকজান্ডারের সাথে বেরিয়ে পড়েছি বিশ্বজয়ে, রাধানাথ শিকদারের সাথে এভারেস্টের উচ্চতা মাপঝোঁক করছি, মারিয়ানাস ট্রেঞ্চে ঊঁকিঝুঁকি করে দেখার চেষ্টা করছি কিছু দেখা যায় কিনা। কিছুদিন পরপরই নতুন বইয়ের সাপ্লাই আসে বাংলাদেশ থেকে। ছুটির দিনে বাবার সাথে সমুদ্রের পাড়ে মাছ ধরতে যাই; বাবার স্পন্ডিলাইটিস, ওজন আল্গানো নিষেধ, তাই বাজার ঘাট দোকানপাটেও আমি বাবার নিত্যসঙ্গী; ছোট ভাই দু’টোর গার্ডিয়ান আমি; আমার পড়াশোনার সময় কই?
একদিন হুট করে জীবনের সব গতি স্তব্ধ হয়ে গেল। দিন কাটতে লাগল হাসপাতালে, ডাক্তার থেকে ডাক্তারের চেম্বারে। তিনমাস পর একদিন নিশিযাপনের জন্যও ভর্তি হয়ে গেলাম। এগারো বছরের একটা কিশোরী যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয় তখন এক ঝটকায় তার বয়স অনেক বেড়ে যায়। আবুধাবীতে ভিজিটর্স আওয়ারের বাইরে কেউ দেখতে আসার অনুমতি নেই, বয়স কম বলে পরিবারের বাইরে কেউ আসার প্রশ্নই আসেনা। বাবা অনেকগুলো রিডার্স ডাইজেস্ট দিয়ে গেল। সেই প্রথম কল্পনাপ্রবণ মেয়েটির বিজ্ঞান, ইতিহাস আর কল্পকাহিনী ছেড়ে সত্যিকার মানুষদের সত্যিকার জীবনের সত্যিকার সমস্যার সাথে পরিচয়। পরিচয় হাসপাতালে আসা দুঃখী মানুষগুলোর সাথে, তাদের কষ্টের কাহিনীর সাথে, নিজের ভালোবাসা দিয়ে অ%?৯পরের দুঃখহারিনী নার্সদের উদারতার সাথে।
তখন মাত্র নানাপ্রকার গেম বাজারে আসতে শুরু করেছে। প্রথম দিককার গেমগুলো ছিলো ঘড়ি কাম গেম, সাইজে আজকালকার গেমগুলোর রিমোটের চেয়েও ছোট, নাম ছিলো গেম অ্যান্ড ওয়াচ। এসব জিনিসের প্রতি তেমন বিশেষ আকর্ষন ছিলোনা আমার। কিন্তু নিদ্রাহীন রাতে হসপিটালের বিছানায় একা শুয়ে কাঁহাতক ব?*+৯(ই পড়া যায়? তাই বসলাম খেলনাটা নিয়ে। স্ক্রীনের দু’পাশে ওপরে নীচে দু’টো করে মুরগীর খোপ, প্রতিটি খোপ থেকে নেমে এসেছে একটি করে পাটাতন, মুরগীগুলো ডিম পাড়ে আর ডিমগুলো নাচতে নাচতে পাটাতন বেয়ে গড়িয়ে পড়তে থাকে, মাঝখানে ঝুড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে মিকি মাউস ডিমগুলোকে নীচে পড়া থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করতে করতে অস্থির, কারণ মুরগীগুলো প্রথমে ডিম পাড়ে একটা দু’টো করে, তারপর ডিম পড়তে থাকে অজস্র, অথচ তিনটা ডিম মাটিতে পড়লেই গেম ওভার!
গেম খেলতে খেলতে দু’টো সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম। এক, জীবনে সব প্রজাপতির পেছনে ছুটে লাভ নেই, একটা প্রজাপতিকে লক্ষ্য সাব্যাস্ত করতে হবে, সংকল্প করতে হবে এটিই আমার চাই, পথে যদি আরো কোন প্রজাপতি জালে আটকা পড়ে ভালো, কিন্তু অন্য প্রজাপতি ধরতে গিয়ে আসলটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে চলবেনা। দুই, অসামাজিক হবার কারণে সামাজিক কথাবার্তা এবং আচরনে যে ডিপ্লোমেসি লুব্রিকেন্ট হিসেবে কাজ করে সেগুলো আমার অভাব ছিলো। মনের কথা উগড়ে দিতাম চাঁচাছোলা অবস্থায়, তেলমসলা ছাড়া! বাবামা সারাক্ষণ অস্থির থাকত আমার কথাবার্তা কিভাবে ভদ্রস্থ করা যায়। যদিও এর জন্য ওদের পরিশ্রম করতে হয়েছে বহু বছর, তবু সুন্দর করে কথা বলা শিখতে পারিনি, শিখেছি বড়জোর চুপ করে থাকা। তবে জীবনের অভিজ্ঞতা এটাই শিখিয়েছে, বোবার শত্রু নেই কথাটা ভুল। যে আমাকে ভালবাসবে সে আমার ভুলত্রুটিগুলোকেও আপন করে নেবে। আর যে আমাকে ভালোবাসেনা সে আমার নীরবতার মাঝেও ত্রুটি খুঁজে নেবে। জীবনে সব ডিম রক্ষা করা যাবেনা, করার প্রয়োজনও নেই, সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে হবে, তারপরও ডিম ভেঙ্গে গেলে তোয়ালে দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করে বাকী ডিমগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
এর একমাস পর আল্লাহ আলৌকিকভাবে সুস্থতার পথ বাতলে দিলেন। হসপিটাল থেকে ফিরে এসে নিজের মাঝে এক বিশাল পরিবর্তন অনুভব করলাম। কল্পনাপ্রবণ কিশোরীটা রূপকথার জগত থেকে বেরিয়ে এসে একটু একটু করে বাস্তবতার দিকে পা বাড়াতে লাগল। তেরো বছর বয়সে আমি লিখি এক ঘোড়ার আত্মকাহিনী যেটা ইয়াং টাইমসের মূল ফিচার হিসেবে প্রকাশিত হয়। আমার নিজের লেখাগুলোর মাঝে এই লেখাটা আমার খুব প্রিয়।
এর শেষ লাইনটি ছিলোঃ Wanderers of the desert, heroes of war, we now stand in dirty stables, waiting for death’.

উপসংহার হোল, জীবনের গতিপ্রকৃতির ওপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে আমরা কি করব সে সিদ্ধান্তগুলো একান্তই আমাদের নিজেদের। জীবনের শেষপ্রান্তে এসে জাবর কাটার মুহূর্তে কোন আক্ষেপ যেন আমাদের মনকে আচ্ছন্ন করতে না পারে সে সংকল্প আমাদের জীবনের শুরুতেই নিতে হবে। এই আমার শৈশবের শিক্ষা। এই শিক্ষাই আমার জীবনের প্রাপ্তি।

Facebook Comments