banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 737 বার পঠিত

 

অনন্তজীবনের মূলমন্ত্র

তাহেরা সুলতানা


রবার্ট ফ্রস্টের ‘Stopping by the Woods on a Snowy Evening’ খুব পরিচিত একটি কবিতা, যা বহু সাহিত্যচর্চায় এবং প্রায়ই নির্দিষ্ট ইংরেজি সাহিত্যে পড়া হয়। উক্ত কবিতার ১৬তম লাইনে ফ্রস্ট এমন একজন ভ্রমণকারীকে চিত্রায়িত করেছেন, যে কিনা কোন এক শীতের সময় শুনসান এক ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যাত্রা শুরু করে এবং যাত্রাপথে হঠাৎ তুষারে আবৃত বৃক্ষরাজির অপরুপ দৃশ্য অনুভব করার জন্য কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। সত্যিকার অর্থে, এই ‘থমকে দাঁড়ানো’টাই আমাদের দুনিয়ায় পথ চলার জন্য সংক্ষিপ্ত সময়। আর পুরো পথচলাটা হচ্ছে মৃত্যুর পর পরবর্তী জীবন! ফ্রস্টের ভাষায়, “The woods are lovely, dark and deep. But I have promises to keep, And miles to go before I sleep, And miles to go before I sleep.” যার সারমর্ম হলো, এই অপরুপ সুন্দর বৃক্ষরাজি যতই আমাকে থামিতে রাখতে চাক না কেন, আমি ওয়াদা করছি যে, আমার যাত্রা কোনভাবেই থামাবো না এবং ঘুমিয়ে পড়ার আগেই আমি আমার লক্ষ্যে পৌছে যাব!

বন্ধুরা, হয়তো ভাবছো, রবার্ট ফ্রস্টের কবিতার সাথে আমাদের দুনিয়া এবং আখেরাতের জীবনের মিল কোথায়?

ভ্রমণকারীর ছবিটি গভীরভাবে ইসলামের শিক্ষায় আবদ্ধ।
মুজাহিদ বিন আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বললেন, “এই দুনিয়াতে তুমি এমনভাবে চল, যেন তোমাকে দেখে মনে হয়, তুমি একজন অপরিচিত বা ভ্রমণকারী।” (সহীহ বুখারী)

আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন একটি খেজুরের মাদুরের উপর শুয়ে ছিলেন এবং যখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন তখন তাঁর শিয়রের পাশে একটি চিহ্ন দেখতে পেলেন। আমরা বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আপনার জন্য কি একটি আচ্ছাদন তৈরি করতে পারি?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘এই জগতের সাথে আমি কি করতে পারি? আমি এই দুনিয়াতে একজন রাইডারের মতো, যিনি কিনা বৃক্ষের নীচে ছায়া খুঁজছেন এবং তারপর ছুটে চলেছেন!”(তিরমিযী)।

হাদিস দুটো থেকে এটা স্পষ্ট যে, যেহেতু আমরা রাইডার বা ভ্রমণকারী হিসাবেই এই পৃথিবীতে এসেছি, তাই আমরা যেন সে ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট থাকি, আমরা এই সংক্ষিপ্ত জীবনটা যেন খুব জাঁকজমকপূর্নভাবে না কাটাই! সাময়িকভাবে থাকার জন্য আমাদের যতটুকু দরকার, ততটুকু নিয়েই যেন সন্তুষ্ট থাকি এবং আমাদের অনন্তকালীন জীবনে ভালো থাকার যে মূলমন্ত্র, সেই লক্ষ্য অর্জনে যেন সচেষ্ট থাকি!

রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা দ্বারা আমরা বুঝি, যে যাত্রীটি তুষার ও বৃক্ষরাজির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হয়ে যায়, কিন্তু সে বুঝতে পারে এই প্রশান্তি সাময়িক এবং ভ্রান্তিপূর্ণ। আসলে সচেতন মানুষ ঠিক এই জায়গা থেকেই চূড়ান্ত ভ্রমণের দিকে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান পায়!
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, এই লোভনীয় সাময়িক প্রশান্তি আমাদের সাথে প্রতারণা করতে পারে, আমাদের লক্ষ্যে পৌছাতে বাধার সৃষ্টি করতে পারে! কিন্তু বন্ধুরা, আমাদের ভুললে চলবে না যে, আমরা একটি উদ্দেশ্য নিয়েই এই পৃথিবীতে আবর্তিত হয়েছি এবং সেই উদ্দেশ্য সফলভাবে সম্পন্ন করেই আমাদের অনন্তজীবনে প্রবেশ করতে হবে! মহান সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করা ও সেই বিশ্বাস সবার কাছে পৌছে দেয়া, সর্বদা মানবজাতির জন্য কল্যান বয়ে আনা এবং পরকালীন জীবনের জন্য সাধ্যমতো নিজেকে তৈরী করা-এটাই এই সংক্ষিপ্ত জীবনের মূলমন্ত্র!

‘Miles to go’ before ‘I sleep’. বন্ধুরা, আমাদের এই সংক্ষিপ্ত জীবনের প্রতিটি মুহুর্তের সঠিক ব্যবহার করতে হবে! কিভাবে আরও বেশী স্নেহশীল, আরো আন্তরিক, আরও ক্ষমাশীল, এবং আরও বুঝদার হওয়া যায়, সেগুলো শিখতে হবে এবং ব্যক্তিগত জীবনে তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে! একজন রাইডার বা ভ্রমণকারী হিসাবে আমারা আজ বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ন হয়েছি: শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মী, নেতা, অনুসারী, কর্মী কিংবা স্বেচ্ছাসেবী। আমরা প্রত্যেকে যদি আমাদের নিজস্ব জগতে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে ভ্রমণ করতে থাকি়, তাহলে একটা সময় আমরা ঠিকই একই বিন্দুতে এসে মিলিত হতে পারবো ইনশাআল্লাহ!

আমি একজন বিশিষ্ট স্পিকারের বক্তৃতায় শুনেছি, যিনি উপস্থিত সবাইকে কল্পনা করতে বলেছিলেন, “ধরুন, এই মুহুর্তে এই হলরুম থেকে আলো হঠাৎ করে চলে গেলো! তখন কি করবেন?” তখন অংশগ্রহণকারী সবাই বলেছিল, তাদের মোবাইলের আলো জ্বালাবে, নয়তো লাইটার অন করবে, অথবা যেকোনভাবে আলোর ব্যবস্থা করবে! তখন সেই বক্তা বলেছিলেন, “সবাই একসাথে আলোর খোঁজে বের হবেন, এই তো মূল উদ্দেশ্য? আর যেভাবেই হোক, আলোর ব্যবস্থা করবেন?” আসলে তিনি এটাই আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে এই দুনিয়ার জীবনে আমরা আমাদের যে গুণগত সম্পদগুলো পেয়েছি, সেগুলোর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে জানতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে অনন্তকালীন আলো পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য যে আলো দেওয়া হয়েছে, সেই আলোকে এককাতারে সামীল হয়েই ধারন করতে হবে!

রাসূল (সা:) বলেন; “পাঁচটি বস্তু আসার পূর্বে পাঁচটি বস্তকে সুযোগ মনে করো। বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, অসুস্থ হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে, দারিদ্রতার পূর্বে সচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং মৃত্যুর পূর্বে জীবনকে।”

তাই বন্ধুরা, আমাদের ভুললে চলবে না, ‘Miles to go before we sleep’!

মহান আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে দুনিয়ার সকল মোহ থেকে মুক্ত রেখে অনন্তকালীন আলোর খোঁজে একসাথে সামিল হওয়ার তৌফিক দান করুন! আমিন!

Facebook Comments