banner

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1679 বার পঠিত

 

গাছা ও গাছি

কানিজ ফাতিমা


নদীর ধারে একটু নির্জন বাঁকে আপনা থেকেই জন্ম নিয়েছে দু’টি গাছ। পাশাপাশি, কাছাকাছি। তাদের পাতার সতেজ নবীন আভাই বলে দেয় খুব বেশী দিন হয়নি ওরা জন্মেছে। কতইবা বয়স হতে পারে? গাছার হয়তো পনের আর গাছির দশ-বারো। শাখায়-পাতায় জড়াজড়ি করেই বেড়ে উঠেছে ওরা।

একই বাতাসে দোল খায় তারা। একই সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজে, রোদে পুড়ে। দূর-দূরান্ত থেকে পখিরা এসে বসে ওদের ডালে। একটু জিরোয়, ফুরুৎ করে এ ডাল থেকে ও ডালে উড়ে, নাচানাচি করে, আপন মনে ডাকে আর তারপর পাখনা মেলে পাড়ি জমায় নিজ ঠিকানায়। কখনও কখনও একঝাঁক পাখি এসে কিচির মিচির মেলা বসায়। এ সবই উপভোগ করতে করতে দিনে দিনে ওরা বেড়ে উঠেছে।

জন্মের পর প্রথম ক’টি বছর গাছা খুবই নিঃসঙ্গ ছিল। নির্জন বাঁকে মাঝে মাঝে পাখিদের গান অথবা দূর নদীতে দু’ একটি নৌকার ছলাৎ শব্দ এই ছিল তার সারা দিনের বৈচিত্র। তাই গাছি যখন মাটির উপরে মাথা তুলে প্রথম পৃথিবীর আলোতে পাতা মেলেছিল, বাতাসে থির থির কেঁপেছিল তখন গাছার মনেও আনন্দের বন্যা বয়েছিল। সে পরম যত্নে গাছির মাথার উপরে নিজের পাতা মেলে দিয়েছিল। গাছিও গাছার পাতার কোমল ছায়ায় ধীরে ধীরে বাড়ালো। সেদিন থেকেই ওদের এ শখ্যতা।

কয়েক বছরের মধ্যেই গাছা তার ডাল পালা মেলে মাটির নীচে শেকড়ের জাল বুনে মোটামুটি এক বিশাল দেহে আবির্ভূত হল, যেন শক্ত সমর্থ এক বীর মূর্তি।

গাছি বললো,
– আমিও ডাল মেলি?
– কি দরকার? আমি তো আছি। আমার ডালপালাই তোমাকে ঝড় থেকে বাচাঁবে।

গাছি বললো,
– শেকড় মেলে একটু শক্ত হই
– কি দরকার? আমার শেকড়ের জালই মাটি শক্ত করে ধরে রেখেছে। আমাদের দু’জনের জন্য এই যথেষ্ট। বুক পেতে আমি তোমায় ঝড় থেকে বাঁচাবো।

গাছা তার ডাল সরিয়ে গাছিকে ডালপালা মেলার জাগয়া করে দিল না। গাছার শেকড়ের ফাঁকে গাছি তার শেকড় ছড়ানোর সুযোগ পেলনা। ফলে গাছি দুর্বল আর গাছা-নির্ভর হয়ে রইলো।

একদিন হঠাৎ দশদিক দাপিয়ে ঝড় শুরু হল। ঝড়ের সেকি তান্ডব – বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নদী পানিও যেন দুকূল ছাপাতে চাইছে। উপরে বাতাস আর নীচে নদীর জোয়ারের তোড়-গাছা একা আর সামলে উঠতে পারলোনা। বাতাস গাছার শক্ত ডাল এক এক করে ভেঙ্গে ফেলল। নদীর জোয়াড়ে গাছার শেকড়ের বুণনকে আলগা আলাদা করে দিল।

গাছি তার দুর্বল শরীর দিয়ে গাছাকে সাহায্য করতে চাইলো। চাইলেই কি আর সব হয়? সামর্থ থাকা তো চাই।

ঝড়ের সাথে ঝুলতে ঝুলতে দুর্বল গাছা বললো – “গাছি, যদি তোমার শাখাকে বাড়তে দিতাম তবে আজ ‘আমরা একসাথে’ পাগলা হাওয়া রুখতে পারতাম, তোমার শেকড় যদি মজবুত হতে দিতাম তবে আজ দু’জনে মিলে মাটি আঁকড়ে রাখতে পারতাম। হায়! তোমার বশ্যতা পাবার লোভের আজ এ পরিনতি। শ্রেষ্ঠত্বের অহংকার আর বশ্যতার নিস্ক্রিয়তায় ভালবাসা নেই; পারস্পারিক সম্মানের ভারসাম্যেই ভালবাসা।”

বাতাসের শোঁ শোঁ গোঙ্গানী ছাপিয়ে মড়-মড়াৎ শব্দ হল। পরের দিন পাখির ঝাঁক এসে তাদের চিরপরিচিত বসার জায়গা আর খুঁজে পেলনা। তারা দেখল নদীর চরে শিকড় উপড়ে পাশা পাশি পড়ে আছে দু’টি গাছ।

কানিজ ফাতিমা
লেখিকা, ট্রেইনার, শিক্ষিকা এবং গণসচেতন কর্মী

Facebook Comments