banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1424 বার পঠিত

 

শরীয়ত ভিত্তিক দাম্পত্য কাউন্সিলিং (কেস স্টাডি) – শেষ পর্ব

আফরোজা হাসান


স্বামীর অনৈতিক কর্মকান্ডের পেছনে আমারো দায় থাকতে পারে এমন চিন্তা নিজ থেকে হয়তো কখনোই মনে আসতো না।

কিন্তু চিন্তাটা মনে ঢোকার পর অনেক ভেবেছি এটা নিয়ে। নিজেকে দেখতে চেষ্টা করেছি বিবেকের আয়নায়। তখন খুঁজে পেয়েছি নিজের মাঝে বিদ্যমান অসংখ্য ভুল ও ত্রুটি সমূহকে।

ভেবে দেখলাম আমাদের জীবনে বাচ্চারা আসার পর থেকে দূরত্ব বাড়তে শুরু করেছিল ধীরে ধীরে। বাচ্চারা স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর সেই দূরত্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছিল। স্বামী সাথে তেমন করে সময় কাটানো, গল্প করা হয়ে উঠতো না খুব একটা। বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা বললেও বেশির ভাগ সময়ই আপত্তি করেছি। কেননা দুই বাচ্চাকে রেডি করে নিজে রেডি হওয়া। ফিরে এসে আবারো বাচ্চাদের এবং সংসারের সবকিছু গোছানো। অনেক ঝামেলা মনে হতো।

আসলে সংসার আর বাচ্চাদের পিছনেই আমার পুরো মনোযোগ ছিল। স্বামীর দিকে যে খেয়ালই দিচ্ছি না সেই উপলব্ধিটিই কাজ করেনি মনে। এখন বুঝতে পারছি কি ভুল করেছি আমি। আমার এইসব আচরণের কারণেই হয়তো দেরি করে বাসায় ফেরা শুরু করেছিল। এবং একসময় জড়িয়ে পড়েছে অনৈতিক কাজের সাথে। এখন অনুধাবন করতে পারছি যে আসলেই যতটা ভালোবাসা ও কেয়ার সে দাবী করতো ততটা হয়তো আমি প্রকাশ করে দেখাতে পারিনি কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা। আর সেজন্যই হয়তো আজ ভুক্তভোগী আমি।

নুসরাহ বলল, আলহামদুলিল্লাহ! আপনি নিজের ভুলগুলো ধরতে পেরেছেন তাই ভীষণ ভালো লাগছে। এখন আপনাকে সেই ঘাটতিগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে যার কারণে আপনাদের সম্পর্ক আজ এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।

নিজের ভুল স্বামীর কাছে সুন্দর করে স্বীকার করুন। একে অন্যকে সাহায্য করুন নিজ নিজ ভুল থেকে বের হয়ে আসতে।

দুজন মিলে কাজ করুন সম্পর্কটিতে আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে। উদারতা, ক্ষমা, ধৈর্য্য, অপরকে অগ্রাধিকার দেয়া, ভালোবাসা, ত্যাগ ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পর্কের মাঝে মধুরতা ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করুন।

জানি বেশ কঠিন কাজ এটা। তবে সব জটিলতা, কাঠিন্যতা দূরীভূত হয়ে যাবে যদি আপনারা শরীয়তের দেখানো পথে নিজেদের জীবনকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। দুনিয়ার নানান প্রলোভন, মায়াজাল ইত্যাদি সবকিছুর হাত থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচানোর একমাত্র রক্ষা কবচ হচ্ছে শরীয়ত। তাই দুজন মিলে সর্ব শক্তি দিয়ে শরীয়তকে আঁকড়ে ধরুন।

রামিছা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এটাই আসলে ভুল হয়ে গিয়েছে আমাদের। আমরা শরীয়তের আলোকে নিজেদের জীবনকে সাজাতে চেষ্টা করিনি। তা না হলে আমি কখনই স্বামীর হক আদায়ে গড়িমসি বা অবহেলা করতে পারতাম না। আর উনিও একাকীত্ব বা মনের শান্তি লাভের আশায় যিনার মত গোনাহতে নিমজ্জিত হতেন না।

হুম.. আমরা বেশির ভাগ সময়ই জীবনে এমনি আসা বা পাওয়া নিয়ামত সমূহের কদর করতে পারিনা। একজন প্রেমময় স্বামী বা স্ত্রী এবং তাদের ভালোবাসা যে কত বড় একটা নিয়ামত সেটা জীবনে কোন দুর্ঘটনা সংঘটিত হবার আগে আমরা বেখবর থাকি।

অথচ রাসূল (সঃ) বলে গিয়েছেন, “তোমরা কাউকে ভালোবাসলে সেটা মুখে প্রকাশ করো এতে তোমাদের ভালোবাসা আরো বৃদ্ধি পাবে।”

তিনি আরো বলে গিয়েছেন, “ যে ব্যক্তি মানুষের শুকরিয়া জানায় না সে আল্লহর শুকরিয়া জানায় না।”

স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের মনেই থাকে না এই রাসুল (সঃ) এর বলে যাওয়া এইসব বানীর কথা। তাই তো আমরা একে অন্যেকে শুকরিয়া জানাই না, ভালোবাসা প্রকাশ করি না। মনে করি কি দরকার আছে এসবের?!

ভালোবাসি সেটা তো জানেই। স্বামীকে আবার শুকরিয়া বলার কি আছে? স্বামী সাহায্য করবে এটাই তো স্বাভাবিক। অথচ এই স্বাভাবিক কাজগুলোতে ছোট্ট ছোট্ট স্বীকৃতি আমাদের জীবনে প্রবাহিত করতে পারে জান্নাতি সুবাতাস।

আমি এখন বুঝতে পারছি সবকিছুই। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ।

ইনশাআল্লাহ! আরেকটা খুব বড় ভুল স্বামী-স্ত্রী করেন জীবনে সন্তান আসার পর। সন্তানের অযুহাত দেখিয়ে তারা একে অন্যের কাছ থেকে দূরে সরে যান ধীরে ধীরে।

অথচ হওয়াতো উচিত ছিল উল্টো তাই না? সন্তান আসার পর আরো মজবুত হবার কথা বন্ধন। স্বামী বাড়িতে থাকেন না সবসময়। সন্তানদের নিত্যনতুন দুষ্টুমি, মজার মজার কান্ড ইত্যাদি উপভোগও করতে পারেন না তেমন করে। এসবই হতে পারে স্বামী-স্ত্রীর আন্তরিকতা ও ভালোবাসা বৃদ্ধির অসাধারণ একেকটি উপকরণ। সন্তানদের দুষ্টুমিতে আনন্দ পান না এমন বাবা-মা খুব কম আছেন।

কখনো সন্তানদের দুষ্টুমির ফিরিস্তি দিতে গিয়ে কপট রাগ বা অভিমানের স্বরে একে অন্যকে বলা, একদম তোমার মত দুষ্টু বা এখন থেকেই বাচ্চাকে শাসন করতে হবে নয়তো তোমার মতো অবাধ্য হয়ে যাবে, ইত্যাদি। এসব খুনসুটি দাম্পত্যকে আরো মাধুর্যময় করে তুলতে পারে। কিন্তু শুধু আমরা সচেতন নই বলেই এসব আনন্দ থেকে বঞ্চিত হবার সাথে সাথে, জীবনেও ডেকে আনি নানান বিপর্যয়।

আসলে আমরা জানিই না জীবনকে কিভাবে উপভোগ করতে হয়।

অথচ দেখুন শরীয়তে কিন্তু সবই বলে দেয়া আছে।

হাদীসে এসেছে, “স্ত্রীদের সাথে রাসুল (সঃ) খুবই উদার, প্রেমময় ও হাসিখুশি ছিলেন। তিনি মুচকি হাসি ছাড়া কথা বলতেন না।”

হাদীসে আরো বলা আছে, “যে ব্যক্তি পরনারীর দিকে নজর পড়লে দৃষ্টি সংবরণ করে নেয় তার জন্য আল্লাহ হৃদয় শীতলকারী ইবাদত সৃষ্টি করেন”।

আমরা কুরআন ও হাদীসের চর্চা করি না বলেই একটা ভুল পরিস্থিতিতে কি আচরণ করতে হবে সেটা জানি না। তাই নিজেকে বিরতও করতে পারি না। আর শয়তান এই সুযোগগুলোকেই কাজে লাগায়।

হুমম…!

যাইহোক, যে ভুল সংঘটিত হয়ে গিয়েছে আপনাদের দ্বারা সেটা আর ঠিক করার কোন উপায় নেই।

সেজন্য একে অন্যেকে দোষারোপ বা পাপী তাপী না ভেবে মন থেকে ক্ষমা করে দিন। এরপর নতুন ভাবে আবারো শুরু করুন জীবন। যখনই কোন সমস্যা আসবে জীবনে সমাধানের জন্য শরীয়তের কাছে যাবেন।

ইনশাআল্লাহ দেখবেন সবকিছু সহজ হয়ে যাচ্ছে। বাসার কুরআন ও হাদীসের চর্চা শুরু করুন। নিজেরা তো করবেনই সাথে সন্তানদেরকেও রাখবেন। আর শরীয়ত স্বামী-স্ত্রী ও সন্তানদের প্রতি যে হক নির্ধারণ করেছেন তা আদায়ের ব্যাপারে সচেষ্ট থাকবেন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে রামিছা বলল, জাস্ট জানার জন্য বলতে জিজ্ঞেস করছি। ধরুন এই সবকিছু করার পরও যদি আমার স্বামী ফিরে না আসে বা নিজেকে ফেরাতে না পারে বিপথ থেকে তাহলে আমার কি করণীয়?

আপনার স্বামীর ক্ষেত্রে যদি এমনটা ঘটে তাহলে সর্বশেষ যে সমাধানটি রয়েছে সেটি হচ্ছে উনাকে ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়ে দেয়া।

জানি খুব অবাক হচ্ছেন আমার কথা শুনে। কিন্তু আপনি নিজেই ভেবে দেখুন এত কিছুর পরও যদি আপনার স্বামী নিজেকে ঐ মেয়েটির কাছ থেকে নিজেকে ফেরাতে না পারেন। এর অর্থ উনি মেয়েটার সাথে এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছেন যে ফিরে আসাটা উনার পক্ষে সম্ভব নয়। আবার আপনার পক্ষেও সম্ভব নয় এই বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়া। সেক্ষেত্রে একমাত্র সমাধান আসলে দ্বিতীয় বিয়েই। এতে করে অন্য একটি মেয়ের সাথে আপনার স্বামী নাজায়েজ সম্পর্কে জড়িত এই দহন পীড়া থেকে মুক্তি মিলবে আপনার।

শরীয়ত ও সমাজের চোখেও নিন্দিত হতে হবে না আপনাদের কাউকে। আপনাদের সন্তানদের উপরও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির সুযোগ কমে যাবে। বাবার নাজায়েজ সম্পর্কের চেয়ে বাবার দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নেয়াটা অনেক বেশি সহজ সন্তানদের জন্য।

আর যেহেতু সন্তানদেরকেও আপনি শরীয়ত দিয়েই বিষয়টা বোঝাতে চেষ্টা করবেন। প্রথমে রাগ, ক্ষোভ থাকলেও একটা সময় বুঝবে ও মেনে নেবে ইনশাআল্লাহ। আশা করি বোঝাতে পেরেছি আপনাকে।

যাইহোক, কি হবে, কি হবে না এসব ভেবে নিজের কাজকে জটিল করতে যাবেন না। বর্তমানে যা করণীয় সেটি আগে ভালোমতো করার চেষ্টা করুন। যদি ব্যর্থ হন তখন পরের চিন্তা করবেন। ব্যর্থ হবার পর কি করবেন সেই চিন্তা আগে থেকেই করার অর্থ হচ্ছে নিজের সফলতার ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত নন।

আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আপনাকে শতভাগ ইতিবাচক মন নিয়ে নিজের জীবনকে সাজানোর লক্ষ্যে কাজ শুরু করতে হবে। চলার পথে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মৌলিক বিষয় সমূহের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন শুধু।

দ্বিতীয় বিয়ের কথাটা শুনে চেহারায় আঁধারে ছেয়ে গিয়েছিল রামিছার। সেখানে সামান্য উজ্জলতা দেখা দিল। হেসে বলল, ঠিক বলেছেন আগে থেকেই কি হবে, না হবে ভাবার কোন মানে নেই। এতে শুধু মন দুর্বল হবে। আর শয়তান সেই দুর্বলতার সুযোগ নিতে চাইবে।

আল্লাহর উপর ভরসা রেখে আমি আজ থেকেই আমার সংসারের সুখ-শান্তি ও পবিত্রতা ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম শুরু করলাম। ইনশাআল্লাহ নিজের শক্তি ও সামর্থ্যের শত ভাগ দিয়ে আমি চেষ্টা ততদিন পর্যন্ত জারি রাখবো যতদিন পর্যন্ত আমার স্বামীকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে না পারি।

  1. নুসরাহও হেসে বলল, ইনশাআল্লাহ।

পর্ব-১

পর্ব-২

Facebook Comments