banner

শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1546 বার পঠিত

 

সৌন্দর্য্য সচেতনতা নাকি স্বাস্থ্য

মিথিলা ফেরদৌস


জীবনে প্রথম বিউটি পার্লার গিয়েছিলাম, ডাক্তার হবার পর, আমার দুই কাজিনের সঙ্গে , যারা আমার হাঁটুর বয়সি, তাদের কাজে, আমার কাজে না।

সেই বয়সেই তারা সৌন্দর্য সচেতন। বাসার কাছেই পার্লার। গিয়ে অপেক্ষা করছি, সোফায় দুই বোন আমার দুই পাশে বসে, কিছুক্ষন পর আরও দুইটা মেয়ে ঢুকলো, আমাদের সামনের সোফায় বসলো। আমার দুইবোন সঙ্গে সঙ্গেই , আমার দুই পাশে দুই হাত ধরে টেনে পার্লার থেকে বের করে আনলো, বুঝলাম না কি হইছে। একজন বললো, পরে আসা ওই দুই মেয়ের মধ্যে একজন তাদের কাজের বুয়ার মেয়ে।

আমি একটু অবাক, তাতে কি? তাদের কথায় বুঝলাম শ্রেণী সচেতনতা। তারা ডিক্লেয়ার করলো, এই পার্লারে তারা জীবনেও আসবে না।

রংপুর শহরে এক রাস্তার দুই কিমি. এর মধ্যে ১৩ টা পার্লার আছে। মানুষ দিন দিন সৌন্দর্য সচেতন হচ্ছে। খারাপ না। চাকুরী সুবাদে অনেক রিমোট অঞ্চলে আমার পোস্টিং ছিলো, সেইসব জায়গায়ও বিউটি সেলুন দেখেছি অনেক।

আমার বাসার কাছে একটি পার্লারের নতুন একটি ব্রাঞ্চ খুলবে ব্যাপক প্রচার। মসজিদে পর্যন্ত লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে, জুম্মার নামাজের দিন আমার ছেলে হাতে করে লিফলেট আনলো, এছাড়া নেটে মোবাইলে প্রতিদিন ম্যাসেজ আসে।

একটু উৎসুক হইলাম। হইতেই পারি।মেয়ে তো। উদ্বোধনের দুইদিন পর গেলাম।১০% ছাড় চলতেছে। তিন তলায় পার্লার,শুধু পার্লারের জন্যে আলাদা লিফট। ভিতরে ঢুকেই আমার মাথা নষ্ট। এত্তো সুন্দর ইন্টিরিয়র ডিজাইন। সুন্দর সুন্দর মেয়েরা ঘুরছে চারিদিকে, সবাই দেখে সুন্দর হাসি দিচ্ছে, গুডমর্নিং ম্যাম,ওয়েলকাম, জটিল অবস্থা, কারে কি উত্তর দিবো।

যেখানে চাকরী করি সেখানে তো এইসবের কারবার নাই, তাই অভ্যস্ত ও নই। যাইহোক ঢুকার পর আমাকে একগাদা ফর্ম ফিল আপ করতে দেয়া হলো। এই একটা কাজ আমার বিষের মত লাগে, ফর্ম ফিল আপ। মনে হচ্ছে বিসিএস এর ফর্ম ফিল আপ করতেছি।ভাগ্য ভালো গোল্লা পুরন নাই। এককপি ছবিও দিতে হইলো। আটাস্টেড লাগে নাই।যথারীতি কাটাকুটি করে ফর্ম ফিল আপ করে দিলাম। একটা পয়েন্ট কার্ড দিলো।

এরপর বিশাল লাইনের পিছনে কাউন্টারে দাড়ালাম, আমার সামনে যারা, তারা বেশির ভাগ মধ্যবয়সি, অথবা কম বয়সি মেয়ে। বেশির ভাগ দেখলাম, ৫০০০ টাকা থেকে ২০০০০ টাকার কাজ, মনে মনে ভাবলাম, এরা কি সারাদিন এখানেই থাকবে?!

আমার পালা আসলো,
–কি করবেন ম্যাম??
কি করবো বুঝতে পারছিনা,বললাম
–চুল কাটাবো
মেনু বের করে দিলো, মেনু দেখে চুল কাটার নাম না পড়ে দাম দেখা শুরু করলাম ১২০০ টাকা থেকে শুরু, আমার মুখ দেখে ওরা বুঝেছে, বললো
–ম্যাম আপনি কি রেগুলার হ্যান্ডে(আনএক্সপার্ট হ্যান্ড)
কাটতে চান তাহলে খরচ একটু কম পড়বে।
— হুম।
সেই মেনুর ও দাম শুরু ৬৫০ টাকা দিয়ে।মনে মনে ভাবলাম, আমার চার টা চুল, আমার রেগুলার হ্যান্ড, জামাই কেটে দিতে পারবে।
বললাম
–চুল কাটবো না। ফেসিয়াল করবো।
ফেসিয়ালের লিস্ট বের করলো, কি কি সব নাম, আবার দাম দেখা শুরু করলাম, সবচেয়ে কম দাম ৩০০০টাকা। বললাম
–আর কিছু নাই?
–ম্যাম এইটা স্পা,রেগুলারে কম খরচ পড়বে।
ওরা আমারে বুঝে গেছে। বললাম দেখি।আবার মেনুতে নাম না দেখে দাম দেখা শুরু করলাম, সবচেয়ে কম দাম ৯৫০ টাকা, নাম টাও চেনা। অরেঞ্জ ফেসিয়াল।কি আর করা। কাউন্টারে বিল দিয়ে স্লিপ নিয়ে অপেক্ষার পালা। তখন পুরাটা খুটে খুটে দেখা শুরু করলাম।

চারিদেকে সুরুচির চিহ্ন। একটা দেয়ালে দুই প্বার্শে গ্লাসের মধ্যে ফোয়ারা, সুন্দর লাইটিং তার মধ্যে, চারিদিকে দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ছবি ঝুলানো, প্রতিটা কর্নারে দামী দামী ক্রিস্টালের শো পিস। এমন কি ওয়েটিং কর্নার গুলো এতো সুন্দর সুন্দর চেয়ার। কোথাও ইংলিশ গান, কোথাও হিন্দি গান, কোথাও শুধু মিউজিক। ক্লিনার রা পরিষ্কার করে যাচ্ছে, কিছুক্ষন পর পর পারসোনা লোগো এর কাপে চা দিয়ে যাচ্ছে। একগাদা পত্রিকা। এর মধ্যে মাইকে আমার নাম শুনে চমকে উঠলাম, যাইহোক আমার পালা।গেলাম,সেখানে আমাকে একেবারে নতুন একটা ড্রেস দেয়া হলো।

আমি তীব্র ভাবে বললাম,আমি অন্য ড্রেস পরতে পারবোনা,আমার শুধু মুখ পরিষ্কার করে দেয়া হোক।যাই হোক ফেসিয়াল শুরু।আমার মত একটা রেস্টলেস মেয়ের জন্যে যা বিভিষিকা।চোখ বন্ধ করে থাকা। আমি বার বার বলছিলাম,
–কখন শেষ হবে?
বাসায় আসার পর আমার জামাই অফিস থেকে এসে বলে
—তোমাকে এত কালো লাগতেছে কেনো? কি হইছে?তোমার না আজ পার্লার যাবার কথা!!
—গেছিলামতো।
—-তাহলে এই অবস্থা কেন?
—–তোমার কি ধারণা,পার্লার গেলে একদিনে বাজিগরের কাজল,কাভি খুশি কাভি গমের কাজল হয়ে যায়?অসহ্য।

আমার ছেলে যে সেলুনে চুল কাটে,ঢাকা শহরে,সব বড় মার্কেটে তার ব্রাঞ্চ আছে।কয়দিন পর পর দাম বাড়ায়,আর আমার জামাই বলে আর জীবনেও আসবোনা।কিন্তু ছেলে জিদের কাছে পরাজিত বাবা বার বার যেতে হয়।কারণ সেখানে গাড়ীতে বসে চুল, কাটতে কাটতে কার্টুন দেখে, চুল কাটার পর খেলনা পাওয়া যায়।

আমার আজকে লেখা মুল উদ্দেশ্য,মানুষ দিনে দিনে যতটা সৌন্দর্য সচেতন হচ্ছে, ততটা স্বাস্থ্য সচেতন হতো যদি। একজন ডাক্তারকে ৫০০ টাকা ভিজিট দিতে তাদের যে কষ্ট, অবলীলায় পার্লারে হাজার হাজার টাকা দিতে তাদের তেমন কোনো কষ্টই হয়না। অথচ এইসব পার্লার থেকে কত কত স্কিন ডিজিস এনে ডাক্তারদের ৫০০ টাকা দিতে তাদের এত পরান কান্দে কেনো?

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ
______________________________
মিথিলা ফেরদৌস

Facebook Comments