banner

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 543 বার পঠিত

 

এক বছরে নারী নির্যাতন বেড়েছে ৭৪ শতাংশ

দেশে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। ৫৫টি জেলায় নিজস্ব কর্মীদের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নারীর প্রতি সহিংস ঘটনার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। নথিভুক্ত হলে সংখ্যাটি আরও বাড়ত।
আরও কয়েকটি সংস্থার নিজস্ব পরিসংখ্যানও নারী নির্যাতন পরিস্থিতির অবনতির চিত্র দিচ্ছে। পুলিশের মামলার হিসাবও বলছে, নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। নারী আন্দোলনকর্মী, মানবাধিকারকর্মীরা প্রতিনিয়তই এ ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন।
তবে মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম, গণমাধ্যমে প্রচার—সব মিলিয়ে আগে মানুষ যে বিষয়গুলোকে নির্যাতন বলেই মনে করত না, এখন তা যে নির্যাতন, সেই সচেতনতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে নির্যাতন নিয়ে মানুষ মুখ খুলতে শুরু করেছে। ফলে নারী নির্যাতনের সংখ্যাটি বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে।
এরই মধ্যে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী সোহাগী জাহান তনু হত্যাকাণ্ড নিয়ে সারা দেশে বিক্ষোভ চলছে।
ব্র্যাকের পরিসংখ্যান: দেশের বৃহত্তম বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক তাদের সামাজিকÿক্ষমতায়ন কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫৫টি জেলা থেকে নির্যাতনের ঘটনার তথ্য সংগ্রহ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে গত বছরের জুন মাসে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৪ সালে ২ হাজার ৮৭৩টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। পরের বছর সংখ্যাটি ৫ হাজার ৮টিতে পৌঁছায়। এই এক বছরে নারীর প্রতি প্রায় সব ধরনের সহিংসতাই বেড়েছে। এই প্রতিবেদনে দেখা যায়, দরিদ্র নারীরা সচ্ছল নারীদের থেকে বেশি (৫৪ শতাংশ) সহিংসতার শিকার হয়েছেন। আর নারী নির্যাতনকারীদের ৮৮ শতাংশই পুরুষ। এই পুরুষেরা নির্যাতনের শিকার নারীর পরিবারের সদস্য বা প্রতিবেশী। ব্র্যাকের জরিপ অনুযায়ী, নির্যাতনের বেশি ঘটনা ঘটে কুমিল্লা, বগুড়া, রাজশাহী, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায়। বছরের মে মাসে নির্যাতনের সংখ্যা বাড়ে। অন্যদিকে জানুয়ারি মাসে নির্যাতনের ঘটনা কম থাকে।
ব্র্যাকের পল্লিসমাজ নামের ওয়ার্ডভিত্তিক ও নারীকেন্দ্রিক সংগঠনের নেটওয়ার্কের সদস্যদের কাজে লাগিয়ে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটলে ভুক্তভোগীর পরিবার, প্রতিবেশী, পল্লিসমাজের সদস্যরা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সেসব তথ্য রাজধানীতে ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে পাঠান এবং প্রধান কার্যালয় এ তথ্য ডেটাবেইসে সংরক্ষণ করে।
ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির পরিচালক আন্না মিন্স প্রথম আলোকে বলেন, নির্যাতনের পর পরিবারগুলো আইনি সেবা নিতে উৎসাহ দেখায়। তবে প্রভাবশালী মহলের চাপে দরিদ্র পরিবারগুলোর পক্ষে আইনি লড়াইয়ে টিকে থাকা কঠিন হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত যায় মাত্র এক-চতুর্থাংশ মামলা। তবে এর মধ্যে মামলার দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন কারণেই ভিকটিমের পরিবার আসামিপক্ষের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে বা বিভিন্নভাবে আপস করে ফেলে।
অন্যান্য পরিসংখ্যান: বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের মোট মামলা ছিল ১৭ হাজার ৭৫২টি। গত বছর এ সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ২২০টি। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়েবসাইটেও গুরুত্বপূর্ণ মামলার তালিকায় ‘নারী নিপীড়ন’ শিরোনামে মামলার তথ্য দেওয়া হচ্ছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এ শিরোনামে ১০০ মামলার কথা উল্লেখ আছে।
সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) করা ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে নির্যাতনের শিকার হন। ২০১৪ সালে এ জরিপ প্রকাশ করা হয়।
নারী নির্যাতন বেড়ে যাওয়া প্রসঙ্গে জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডও কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন সালমা খান বলেন, আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের এক জরিপে পুরুষদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন কি না। এর উত্তরে শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সব ধরনের বেশির ভাগ পুরুষই জানান, তাঁরা নারীদের অধস্তন মনে করেন। অর্থাৎ এখানে নারীদের নিয়ে পুরুষদের মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত নারী নির্যাতনের তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করে। তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত, অর্থাৎ গত ১১ বছর দুই মাসে বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হত্যা ও আত্মহত্যা করেছেন ৫৬ হাজার ৬৫৬ জন নারী। পরিষদ যৌতুক, বাল্যবিবাহ, ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনের পর হত্যা, নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা এবং অন্যান্যসহ মোট ৩৪টি নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০৫ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে তিনজনকে। আর গত বছর পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৭৩টি। এর মধ্যে ২১২ জনকেই স্বামী হত্যা করেন। বছরটিতে ৫৪ জন নারী বিভিন্ন কারণে আত্মহত্যা করেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নারী অধিকার কমিটির চেয়ারপারসন অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, আগের তুলনায় নারী নির্যাতনের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। দেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে এগিয়েছেন, তা যেমন সত্য; তেমনি নির্যাতন পিছু ছাড়ছে না, তা-ও সত্য। আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব, ডিজিটাল সংস্কৃতি, আইনের কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, ধনতান্ত্রিক সমাজের অস্থিরতাসহ বিভিন্ন কারণে নির্যাতন বাড়ছে।
গত রোববার রাজধানীর উত্তর বাড্ডার গৃহবধূ পূর্ণিমা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা গেছেন। স্বামী মিজানুর রহমান কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে রান্নাঘর থেকে গরম পানি এনে ঢেলে দেন পূর্ণিমার মাথায়। ঘটনার পর থেকে মিজানুর পলাতক।
২৭ মার্চ পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার গজালিয়া ইউনিয়নে সালিস বৈঠকে এক গৃহবধূ ও এক যুবককে কক্ষে আটকে রেখে মারধর করে তাঁদের মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হয়।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধে ‘আমরাই পারি’ জোটের চেয়ারপারসন সুলতানা কামালও মনে করেন, নারী নির্যাতনের মূল কারণ সমাজ ও পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থা। অনেক মৌলিক মানবাধিকারের প্রশ্নেও নারীরা পুরুষতান্ত্রিকতার সঙ্গে আপস করছেন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ) আইনসহ সরকার বিভিন্ন উদ্যোগও নিয়েছে। তবে আইন ও অন্যান্য উদ্যোগকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে যা যা করা দরকার, তা সেভাবে হচ্ছে না।
মন্ত্রণালয়ের কিছু উদ্যোগ: গতকাল মঙ্গলবার মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও নারী নির্যাতন পরিস্থিতি আলোচনায় আসে। এতে বলা হয়, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ ট্রাইব্যুনালে দ্রুততার সঙ্গে মামলা নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ২৪ মার্চ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আইন ও বিচার বিভাগকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতনকারীদের আইনের আওতায় এনে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা করার কাজে সহযোগিতা করার জন্য মহিলা-বিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই মন্ত্রণালয়ের নারী ও শিশু নির্যাতন কেন্দ্রীয় প্রতিরোধ সেলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তনু হত্যাসহ মোট নয়টি মামলা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর মধ্যে নারী নির্যাতনের মামলা তিনটি। হেলপ লাইন নম্বর ১০৯২১। আটটি বিভাগীয় শহরে ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি), জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৬০টি ওসিসি সেলসহ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ ও সমাজকর্মী হিসেবে সালমা খান বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে দেশের অগ্রগতিতে নারীর অবদানকে দৃশ্যমান করতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি মানবিক করতে হবে। নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলন জোরদার করতে হবে। সেই সঙ্গে বিচারহীনতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে গণমাধ্যম ও রাজনীতিবিদদের সোচ্চার হতে হবে।

Facebook Comments