banner

মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1147 বার পঠিত

 

সম্পর্কের মূল্যায়ন -১ম পর্ব

রেহনুমা বিনতে আনিস


স্ত্রী বিগত হবার পর এক ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করছিলেন, ‘আহারে! ওর সাথে কত সময় কত রাগারাগি, কত দুর্ব্যবহার করেছি! কত সময় সে আমার জন্য কতকিছু করেছে, অথচ আমি কোন অ্যাপ্রিশিয়েশন দেখাইনি! এখন আমি এসব খুব অনুভব করি। কিন্তু সে বেচারী তো জানতেও পারল না আমি আসলে তাকে কতখানি ভালবাসতাম। এই মূহূর্তে হয়ত সে আল্লাহর সামনে আমার নামে নালিশের ফিরিস্তি নিয়ে বসে আছে!’
এমন আফসোস অনেকেই করে থাকেন। যেমন স্বামীকে তালাক দিয়ে চলে যাবার বিশ বছর পর এক ভদ্রমহিলা অনুশোচনা করে বলছিলেন, ‘তখন বয়স কম ছিল। রাগের মাথায় তালাক দিয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু এতে করে যে কেবল ওর ক্ষতি হয়েছে তা নয়, আমার জীবনটাও এলোমেলো হয়ে গিয়েছে। ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার জন্য বাবা বা মা কেউ এককভাবে যথেষ্ট নয়। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা সত্ত্বেও আমি আমার ছেলেমেয়েদের কাঙ্ক্ষিতভাবে মানুষ করতে পারিনি। আমার জেদ বিজয়ী হয়েছে, কিন্তু আমার সন্তানগুলোর জীবন তছনছ হয়ে গিয়েছে। সেদিন যদি আমার আজকের মত মানসিক পরিপক্বতা থাকত, তাহলে আমি আমার সংসারটাকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধ করতাম’।

পরিণত বয়সী এক ভদ্রমহিলা। স্বামী সন্তান নিয়ে গুছানো সংসার। কিন্তু পরম সুখের মূহূর্তগুলোতেও তিনি হঠাৎ হঠাৎ আনমনা হয়ে যান, বিষণ্ণতায় ভোগেন। কারণ তিনি সার্বক্ষণিক একটা মৃত্যুকে বয়ে নিয়ে বেড়ান। নিজেকে দায়ী করেন, ‘আমি যদি একটু সচেতন হতাম, হয়ত আজ সে জীবিত থাকত। হয়ত তার একটা চমৎকার সংসার থাকত, একটা ফুটফুটে বৌ থাকত, তিন চারটা বাচ্চাকাচ্চা থাকত!’ কিন্তু কিছু কিছু আক্ষেপের কোন প্রতিকার থাকেনা। তাঁরও নেই। কিশোরী বয়সে যখন তিনি পর্দা করতেন না তখন এক ছেলে তাঁর প্রেমে পড়ে যায়। প্রেম নিবেদন করায় তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন, সবার সামনে তাকে অপদস্থ করেন। অপমানের জ্বালা সইতে না পেরে ছেলেটি পরদিন আত্মহত্যা করে বসে। তিনি আজও ভাবেন, যদি সে সময় তিনি পর্দা করতেন, সিগনাল দিতেন, ‘I am not available’, হয়ত ছেলেটি তাঁর দিকে তাকাতও না, প্রেম নিবেদনের প্রশ্নও আসতনা, তিনি কটু কথা বলে ঝাল ঝাড়তেন না, ছেলেটি সুইসাইড করতনা, তিনি এই অপরাধবোধ আজীবন বয়ে বেড়াতে বাধ্য হতেন না। কিন্তু মাঝে মাঝে চোর পালালে যখন বুদ্ধি বাড়ে তখন আর হৃত সম্পদ ফিরে পাবার কোন উপায় থাকেনা।

এক মূহূর্ত রাগ সংবরণ করতে না পারার ফলে কত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, মনের ঝাল ঝাড়তে পারার আনন্দ কিছুতেই সেই বিচ্ছেদের বেদনা নিবারণ করতে পারেনা। একটা ‘ধন্যবাদ’ কিংবা একটু মৃদু হাসি দিতে কার্পণ্য করার কারণে কত আশা ভালোবাসার ফুল কুঁড়িতেই ঝরে যায়, শত উপহার উপঢৌকনে সেই না পাওয়ার কষ্ট মুছে দেয়া যায়না। কত হৃদয়বিদারক কথা ক্ষোভের মূহূর্তে বাক্যবাণ হয়ে বেরিয়ে যায়, যে ক্ষত পরে আর কোন মলম দিয়ে সারানো যায়না। কত অবুঝ আচরণ সারাজীবনের জন্য দুঃস্বপ্ন বনে যায়, যার কোন প্রতিকার করা যায়না।
হুম, জানি, আমরা সবাই ভুল করি। বুঝবোনা কেন ভাই, আমি নিজে কি সেই পথ পাড়ি দিয়ে আসিনি? মানসিক পরিপক্বতা যে বয়সে আসে তার আগে অপরিণত অবস্থাতেই আমরা জীবনের অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে ফেলি। সেই পথ যেমন পদে পদে কন্টকাকীর্ণ তেমনই বিপদসংকুল। সে বয়সে সবারই মনে হয় শুনিয়ে দেয়া, দেখিয়ে দেয়া, নিজেকে জাহির করা এক বিরাট কৃতিত্বের ব্যাপার। এখানেই নিজের মনের চাকায় ঈমানের ব্রেক লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। কারণ, একজন মানুষের মাঝে অপরিণামদর্শিতা থাকতে পারে। আবেগের সামনে বিবেকের ব্রেক ফেল করতে পারে। কিন্তু যার ঈমান আছে তাঁর নিজেকে প্রতিরোধ করার জন্য ‘আমি আল্লাহর সামনে কি জবাব দেব?’-এর চেয়ে ভাল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আর নেই। কারণ, আমাদের সম্পর্কগুলো তো আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম! এগুলোর প্রত্যেকটির হক আদায় করার ব্যাপারে আমাদের আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এজন্যই আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং প্রতিটি সম্পর্কের স্বরূপ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, সম্পর্কগুলোর দাবী বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এগুলোর সীমারেখাগুলোও অংকন করে দিয়েছেন। হ্যাঁ, এই কাজগুলো সহজ কিংবা মসৃণ হবে মনে করার কোন কারণ নেই। কিন্তু পরীক্ষা সহজ হলে কি পাশ করায় কোন কৃতিত্ব থাকে? সম্পর্কগুলো জিইয়ে রাখার জন্য হয়ত কখনো আমাদের নিজেদের, কখনো অন্যদের ঘষামাজা করার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু সেটা কিভাবে এবং কতটুকু হবে তার জন্যও নীতিমালা দিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমাদের প্রত্যেকের অবস্থান আমাদের জন্য একটি পরীক্ষা। আমার অবস্থানে আমি হয়ত অপর কোন ব্যক্তির সাথে অযাচিত আচরণ করতে পারি, তবে তার মূল্য দেয়ার জন্য আমাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। নতুবা ন্যায়সঙ্গত আচরণ করার জন্য সর্বদা সচেতন থাকতে হবে। আমার আচরণ সঠিক হচ্ছে কিনা তা নিরূপণ করার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হোল সেই ব্যক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর প্রতি আমার ব্যবহার যাচাই করার চেষ্টা করা। কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন, কারণ আমাদের মন কেবল অন্যের ত্রুটিগুলো দেখে, নিজেরগুলো কিভাবে যেন দৃষ্টিগোচর হয়না। কিন্তু চর্চা করলে এই বোধ নিজের মাঝে গড়ে তোলা অসম্ভব নয়।কারণ অতিরিক্ত অনুভূতিপ্রবণ লোকজন ব্যাতিরেকে সাধারণত সব মানুষ একই ধরণের আচরণে আনন্দিত হয় কিংবা কষ্ট পায়।
আবঞ্ছিতভাবে কাউকে আঘাত দিয়ে ফেলা থেকে বিরত থাকার সবচেয়ে সহজ উপায়ঃ ‘ভাবিয়া করিয়ো কাজ করিয়া ভাবিওনা’। যেকোন অবস্থায় তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার পরিবর্তে খানিক সময় নিয়ে চিন্তাভাবনা করে কথা বললে বা কাজ করলে অসাবধানতাবশত অপরের কষ্টের কারণ হওয়া থেকে আত্মরক্ষা করা যায়। আমাদের সমাজে, যেখানে ভদ্রতাকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়, হয়ত আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণকে কমজোরী হিসেবে দেখা হতে পারে, জনসমক্ষে আপনার ইমেজ হেয় হতে পারে। কিন্তু যে কঠিন মূহূর্তে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাঁর ইমেজ আল্লাহর কাছে অনেক উচ্চে স্থান পায়। কারণ তিনিই বলেছেনঃ
‘রাহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং মূর্খরা তাদের সাথে কথা বলতে থাকলে বলে দেয়, ‘তোমাদের সালাম’ (সুরা ফুরক্কানঃ আয়াত ৬৩)৷
আবার তিনিই উল্লেখ করেছেনঃ
‘আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না, পৃথিবীর বুকে উদ্ধত ভঙ্গিতে চলো না, আল্লাহ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরী ও অহংকারীকে৷ নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো৷ সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ’ (সুরা লুকমানঃ আয়াত ১৮-১৯)৷
সুতরাং, যতই কঠিন মনে হোকনা কেন, অপরের সাথে সেই আচরণ করাই সঙ্গত যে ব্যবহার আমরা নিজেরা অপরের কাছে পেতে চাই। একইভাবে অপরের প্রতি সেই ব্যবহার বর্জনীয় যা আমাদের কষ্ট দেয়।
তখন প্রশ্ন আসে, তাহলে কি আমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাব না? হুম, সেখানে চুপ থাকলে আবার আমরা আল্লাহর কাছে আটকে যাব। প্রতিক্রিয়া দেখাতেই হবে। তবে কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাব সে ব্যাপারে কিছু নীতিমালা দিয়ে দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন শুধু নির্যাতিত ব্যক্তিকে নয়, নির্যাতনকারীকেও সাহায্য করতে। কারণ, তাঁর এই আচরণ তাঁকে শাস্তির জন্য নির্ধারিত করে ফেলছে অথচ তিনি তা বুঝতে পারছেন না। তবে আমরা নির্যাতিত ব্যক্তিকে ধৈর্য্যধারণের উপদেশ দেই, কিংবা নির্যাতনকারীকে আত্মনিয়ন্ত্রণের উপদেশ দেই, পদ্ধতি একই। প্রথমে সেই ব্যক্তিকে ব্যক্তিগতভাবে বুঝানোর উদ্যোগ নিতে হবে। তাঁকে নিয়ে আড়ালে বসতে হবে যেন তিনি অপরের সামনে লজ্জা না পান। তাঁর মুখোমুখি বসে, তাঁর চোখে চোখ রেখে, সম্ভব হলে তাঁর হাতে হাত রেখে, চেহারায় আন্তরিকতা মেখে, কণ্ঠে আন্তরিকতা ঢেলে, বার বার প্রিয় সম্বোধনে সম্ভাষন করে তাঁকে নিজের আন্তরিকতার ব্যাপারে আশ্বস্ত করতে হবে। কোন পর্যায়ে তাঁকে অভিযুক্ত করে বা হেয় করে কথা বলা যাবেনা। মনে রাখতে হবে, আমার আচরণ বা কথা যদি ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের পর্যায়ে নিয়ে যায় তাহলে আমি ব্যর্থ হয়েছি। কারণ একজন মানুষ যখন defensive mode-এ চলে যায় তখন সে আর আপনার কথা গ্রহণ করতে প্রস্তুত কিংবা ইচ্ছুক থাকেনা। কিন্তু আপনি যদি আন্তরিকতা দিয়ে তাঁকে বুঝাতে পারেন আপনি কথাগুলো কোন ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে নয় বরং তাঁর কল্যাণ কামনায় বলছেন, সেক্ষেত্রে মানুষ অনেক তিক্ত কথাও সহজভাবে গ্রহণ করে পারে।

চলবে

Facebook Comments