banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 305 বার পঠিত

 

সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা – ১০

সমুদ্রের টানে নদীর ছুটে চলা – ১০


আফরোজা হাসান


ঘুম থেকে উঠে চোখ খুলে সামনে যা দেখলো তাতে সাথে সাথে আবার চোখ বন্ধ করে ফেললো শাবাব। যা দেখেছে তা কি সত্যি? ভাবনায় পড়ে গেলো সে। একবার মনেহলো স্বপ্ন দেখছে কিন্তু জানামতে নিশ্ছিদ্র ঘুম তার। স্বপ্ন ঘুমের মধ্যে ঢোকার চেষ্টা করলেও বেশির ভাগ সময়ই ব্যর্থ মনে ফিরে যায়। আর দ্বিতীয় কারণ তার স্বপ্নরা একটু অন্যরকম হয়। স্বপ্নে কখনো সে পরী হয়ে ফুলবাগানে ঘোরে, কখনো পাখী হয়ে আকাশে উড়ে, কখনো বরফে স্কি করে বেড়ায়, কখনো ঘুরে বেড়ায় গভীর সমুদ্রের নীচে।

তারমানে এখন যা দেখছে তা স্বপ্ন হবার কোনই অবকাশ নেই। আরিফী সত্যিই তার সামনে বসে আছে। কিন্তু এইভাবে রুমে আসবে কেন সে? আজ কিছু না করলে এমন কাজ বারবার করার সাহস পেয়ে যাবে আরিফী। ন্যাড়া নাকি বেল তলায় একবারই যায়। কিন্তু সেজন্য ন্যাড়ার মাথায় বেল তো ফেলতে হবে। মগজের সার্চ মেশিনকে অন করে দিলো সে আরিফীর মাথায় ফেলার মত বেলের সন্ধানে।

চোখ খুলেই যে শাবাব আবার ঝট করে বন্ধ করে ফেলেছে সেটা মোটেই আরিফীর চোখ এড়িয়ে যায়নি। খুব ভালো মত চেনে শাবাবকে তাই নিশ্চিত যে দুষ্টুমি করার কোন প্ল্যান করছে এখন। বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলাও অসম্ভব কিছু না শাবাবের জন্য। সুতরাং কিছু করার আগেই পথ বন্ধ করে দিতে হবে। শাবাব তোমার ঘুম কি ভেঙ্গেছে? জানতে চাইলো আরিফী। নাস্তা সেরে তোমাকে নিয়ে শপিংয়ে যাবো ভাবছিলাম।

ধীরে ধীরে চোখ খুললো শাবাব। আরিফীকে হাসিমুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উঠে বসতে বসতে বলল, দাঁত দেখাচ্ছো কেন নতুন লাগিয়েছো নাকি?

স্বশব্দে হেসে ফেললো আরিফী। কি যে অদ্ভুত একটা মেয়ে তুমি সেটা কি জানো?

জানতে চাচ্ছি না। আমি যা জানতে চাচ্ছি তা হচ্ছে বিনা অনুমতিতে কেন তুমি আমার রুমে ঢুকেছো? এত বড় সাহস কোথায় পেলে?

আরিফী হেসে বলল, তুমি কি জানো কিছু কিছু মানুষের কাছে মনের অনুভূতিগুলো সবসময় এভেলেভেল থাকে।

সেটা আবার কেমন?

সেটা এমন যে কিছু কিছু মানুষ আমাদের মনের ঝিমিয়ে পড়া অনুভূতিতে প্রাণের পরশ জাগিয়ে যেতে পারে। যেমন ধরো ভালোবাসা, মায়া, মমতা, রাগ, শোক, বেদনা, ব্যর্থতা, সাহস ইত্যাদি সবই তো আসলে মনের ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতির নাম তাই না? তো কিছু কিছু মানুষ তাদের কথা, কাজ ও আচরণের দ্বারা এই অনুভূতিগুলোকে সতেজ করে তুলতে পারে। আমি আজ সকাল থেকে এমন দুইজন মানুষের দেখা পেয়েছি।

হাসি ফুটে উঠলো শাবাবের চেহারাতে। মাহাম কোথায়?

মাহাম অসুস্থ্য শরীর নিয়ে চাচীকে সাহায্য করছে নাস্তা বানাতে আর তুমি ঘুমচ্ছো! এটা কেমন কথা হলো?

আমাকে তো কেউ ডাকেনি। আচ্ছা আমি এখনই যাচ্ছি।

মুহুর্তেই শাবাবের চেহারা থেকে দুষ্টুমি উবে যেতে দেখলো আরিফী। সেখানে জায়গা করে নিলো বোনের জন্য মায়া-মমতা-ভালোবাসা ও কল্যাণকামীতা। শাবাবের হাসি-মজা-দুষ্টুমিকে তার কাছে যতটা পরিচিত, নীরবতা ঠিক ততটাই অপরিচিত। তবে শাবাবের যে জিনিসটা তার সবচেয়ে ভালো লাগে তা হচ্ছে ওর আবেগের মধ্যে কোন উপরি উপরি ভাব নেই। ওর অনুভুতিতে অগভীর বলে কিছু নেই। দুষ্টুমির ছলে প্রচুর জ্বালা যন্ত্রণা দেয় কিন্তু সম্পর্কের প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধে কোন ঘাটতি নেই ওর মনে। বরঞ্চ শাবাবের চমৎকার কৌতুকবোধ তার মনে ভালোবাসা আর উষ্ণতাই জাগিয়ে যায় সবসময়। জানে না কেন কিন্তু শাবাবকে দেখলেই তার চার্লি চ্যাপলিনের কথা মনে পড়ে যায়। শাবাবের দুষ্টুমির পারফেক্ট বর্ণনা চার্লি চ্যাপলিনের সেই উন্মত্ত মজার হাসির সিনেমা গুলোই।

পরিবারের সবাই মিলে একসাথে নাস্তা করার মজাটাই আসলে অন্যরকম। এই মজা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে নারাজ জাহিদ সাহেব। যেখানেই থাকেন না তিনি পরিবারের একজন সদস্যও যদি সেখানে উপস্থিত থাকে খাবার টেবিলে একসাথে হতেই হবে। দুই মেয়ে আর মেয়ে জামাইরা, পুত্র-পুত্র বধূ-নাতি সবাইকে নিয়ে একসাথে বসে নাস্তা করতে গিয়ে বারবার আজ চোখ ভিজে যাচ্ছিলো ফাইয়াজ সাহেবের। সবার আড়ালে বারবার চশমা খুলে অশ্রু মুছে নেয়া কি কম মুশকিলের ব্যাপার! এই মুশকিল কাজটি করতে করতে নাস্তা সারতে হল আজ ফাইয়াজ সাহেবকে।

নাস্তার পর অনেক ক্ষণ মাহামকে শপিংয়ে যাবার জন্য রাজী করাতে চেষ্টা করলো শাবাব। একসময় বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো। মামণিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে শাবাব সুরে সুরে বলল, এখন বিদায় দাও মা ঘুরে আসি।

সাবিহা বললেন, কোথায় যাচ্ছিস?

হাসি হাসি পড়াতে ফাঁসি! একই সুরে শাবাব জবাব দিলো।
সাবিহা হেসে বললেন, আজ কার কপাল পুড়লো আবার?
শাবাব হেসে বলল, যার কপাল তিনমাস আগেই পুড়েছে তাকেই আজ নতুন করে পোড়াবো ঠিক করেছি। মামণি দোয়া করে দাও।

কিসের দোয়া?

কপাল পুড়িয়ে যাতে হনুমান বানিয়ে দিতে পারি সেই দোয়া।

কি যে সব তুই বলিস না শাবাব। সাবধানে যাস। আর এত জ্বালাস না ছেলেটাকে। মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন সাবিহা।

মাকে আদর করে দিয়ে হাসতে হাসতে বেড়িয়ে গেলো শাবাব। মাহাম নিশ্চয়ই একা ভেবে মেয়েদের ঘরে রওনা করলেন সাবিহা। ঘরে ঢুকে মাহামকে না দেখে বুকের মধ্যে কেঁপে উঠলো। কোথায় গেলো মাহাম? বাগানে তো দেখেননি ওকে! তাহলে? বীচে যায়নি তো আবার? কত বার করে বলেছেন একা একা ঘুরঘুর না করতে। একটা মেয়ে যদি তার কথা শুনতো। অস্থির চিত্তে মেয়ের খোঁজে বের হলেন সাবিহা।

মেয়ের খোঁজে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেড়োতে গিয়ে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেলেন সাবিহা। মাহাম রুমে ঢুকছিল আর তিনি ঝড়ের গতিতে বেড়োচ্ছিলেন যার ফলে এই সংঘর্ষ। মা-মেয়ে দুজনই কমবেশি ব্যথা পেলো। মাহাম বলল, মামণি তুমি ঠিক আছো তো? ব্যথা লাগেনি তো বেশি?

মাহামকে ধরে মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে সাবিহা বললেন, তোর কোথাও লাগেনি তো মা? একটু দেখে কেন চলিস না বল তো! মেয়ের সামনে সাধারণত কখনোই দুর্বল হতে চায় না সাবিহা কিন্তু আজ কেন জানি ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। মাহামকে বুকে টেনে নিলো। চোখ বেয়ে ঝরঝর অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

কিছু না বলে চুপ করে রইলো মাহাম। বুঝতে পারছে কোন কারণে আপসেট মামণি। নিজেকে কিছুটা সামলে নেবার সুযোগ দিলো মাকে। কিছুটা স্থির হয়ে মাহামকে নিয়ে বিছানাতে বসলেন সাবিহা। কোথায় ছিলি তুই? তোকে না বলেছি একা একা কোথাও না যেতে? তোকে রুমে না দেখে জানিস আমার কি অবস্থা হয়েছে? জবাব না দিয়ে আবার হাসছিস কেন ফাজিল মেয়ে?

মা’র মুখ থেকে একের পর এক প্রশ্ন বেড়োতে দেখে মাহাম হাসতে হাসতে বলল, আমার খুব শখ আল্লাহ যদি আমাকে বাবু দেন তাহলে যেন মেয়েই দেন। তোমার কান্ড কারখানা দেখে আমার খুব মেয়ের মা হতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে কি সেই অনুভূতি যা এতটা দুর্বল করে দেয় একজন মাকে!

চলবে

পর্ব-৯

Facebook Comments