banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 405 বার পঠিত

 

শৈত্যের শুভ উদ্বোধন


নিশাত তাম্মিম


শীতের শুরুটা পুরোদমে না হলেও শেষরাতের ঝিরঝিরে বাতাসে যখন কাথাটি অবচেতনভাবেই গায়ের উপরে স্থান করে নেয় কিংবা সূর্য ঊদয়োত্তর মিষ্টি রোদের আলতো স্পর্শে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়, তখনই মনে পড়ে যায় শীত বুঝি এসেই পড়লো। তবে কাব্যিকভাবে শীতের আগমণ যতটা সুন্দর, বাস্তবতার সাথে লড়াই করে টিকে থাকা মানুষগুলির জন্য সেটি হয়তো ততটা সুখকর নয়। শীতের হিম কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ যতটা সফেদ, কিছু ভাগ্যাহত মানুষের জীবনে ওর অধ্যায়টা ঠিক ততটাই কালো।

IPS না থাকার সুবাদে বরাবরের মতই এবারো অনিচ্ছাস্বত্তেও হাতপাখার সাথে সম্পর্কটা বেশ গাঢ়ই হয়ে উঠেছিল। কোন এক রাতে বৃষ্টির আগমণে এই পাখার সাথে সম্পর্কটা ছিন্ন করার আনন্দে যখন অতিশয় পুলকিত হচ্ছিলাম ঠিক তখনি মনের দরজায় বিবেক সত্ত্বার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পেলাম। ভেবে দেখেছো, সেই মানুষগুলোর কথা? শীত নামক কাব্যিক শব্দটার উচ্চারণও যাদের চোখে জল এনে দেয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশংকায় আকাশপানে চেয়ে যাদের চোখ ঝাপসা হয়ে আসে? নিজের মন আজকাল খুব বেশি ভালো নেই বলে বিবেকের কড়া নাড়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করার তেমন ইচ্ছে ছিলোনা। তবুও পারিনি, আমার হয়তো একটি দীর্ঘশ্বাস, আর অজস্র ভাগ্যাহত মানুষের জীবনের প্রশ্ন। তাই হয়তো মনের সাথে অনেকটা জোর করেই কিছু লিখতে চাওয়ার প্রয়াস….

শীতের সকালে রাস্তার পাশে সামান্য একটি আধোছেঁড়া কাপড়ের আশ্রয়ে মা ও সন্তানের শীত নিবারণের প্রচেষ্টা, কিংবা সারারাত হাড় জিরজিরে বাতাসের সাথে যুদ্ধের পর এক বিন্দু সূর্যালোকের প্রতীক্ষায় ফুটপাথে বসে থাকা মানুষগুলোর আকুতি- এ দৃশ্য নিশ্চয়ই কারো অপরিচিত নয়। প্রতিবছর শীত আসে…. এবারো আসবে….. আবারো শুরু হবে অভাগা এই প্রাণীগুলোর বেঁচে থাকার সংগ্রাম….. ওপরের দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ নিচের চিরচেনা জমিন দুটোই নিমজ্জিত হবে ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারিতা প্রদর্শনের সর্বোচ্চ প্রতিযোগিতায়….

অট্টালিকাবাসীদের না পেয়ে সমস্ত আক্রোশে জাপটে ধরবে ওদের….. যারা পারবে শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে, তারা হয়তো কৈ মাছের প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকবে কোন রকমে আর যারা পরাজিত হবে তারা ধরা দেবে নিশ্চিত মৃত্যুর ছোবলে। জীবন মৃত্যুর এ খেলা চলেছে আজীবন, চলবেও হয়তো। কোথা এর শেষ সে হিসেব কষতে গেলে ইনফিনিটিতে গিয়ে ঠেকবে কিনা জানা নেই। আমাদের কারো একার পক্ষে হয়তো সম্ভব ও নয় গোটা পৃথিবীর প্রেক্ষাপট দুইদিনে চেঞ্জ করে ফেলা। তারপরও হয়তো এতখানি সম্ভব নিজের আয়ত্ত্বের মধ্যে যতটুকু আছে ততটুকু চেষ্টা করা। আমিরুল মুমেনিন খলিফা উমর (রাঃ) এর সেই ইতিহাস জানা নেই এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ছদ্মবেশে রাস্তায় জনগণের দুর্দশার খোঁজ নিতে গিয়ে ক্ষুধার্ত শিশুদের কান্নার শব্দ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গেলেন…..রাজকোষ থেকে নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে এলে আটার বোঝা- “আমার রাষ্ট্রের একটি কুকুরও যদি না খেয়ে মারা যায় সে দায়ভার আমার”। আমরা সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবোনা জানি তবু হয়ত শীতের সকালে রাস্তায় বেরিয়ে দেখতে পারি সেই মানুষগুলোর ভোগান্তির করুণ দৃশ্য। মিলিয়ে দেখতে পারি আমাদের সাথে ওদের জীবনধারার পার্থক্য। কোন এক বিখ্যাত ব্যক্তির একটি উক্তি পড়েছিলাম-

“When the Rain comes, go outside without umbrella, when the winter comes, go without clothes…..that u can feel what life is!”

হয়ত হতে পারবোনা তৃতীয় উমর….তবুও কি পারিনা নিজের অব্যবহৃত বিলাসিতার আস্তরণে রেখে দেওয়া শীতের কাপড়টি রাস্তার পাশে বরফ জমে যাওয়া শরীরটিকে এগিয়ে দিতে? আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে আমাকেও যে জবাবদিহি করতে হবে ঐ স্রষ্টার দরবারে।লেপের তলায় আরাম নিদ্রাযাপনের সময় ভাবতে পারি এই মুহুর্তে হয়তো আমারই মত আর একটি প্রাণ জাপটে ধরা শীতের আক্রমণে বেঁচে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে।

মনে হতে পারে আমার এই ক্ষুদ্র সাহায্যে কি আর হবে? এই অসীম দারিদ্র্য সাগরে আমার এ দান একবিন্দু নীহারিকার মতই মিশে যাবে। ব্যাপারটি অন্য ভাবেও ভাবা যেতে পারে। আমার society তে দশজন মানুষ যদি দশজন দরিদ্রের পাশে দাড়াঁয়, দশটি পরিবার যদি দশটি পরিবারের পাশে দাড়াঁয়, দশটি গ্রুপ যদি আর দশটি বঞ্চিত গোষ্ঠির পাশে দাড়াঁয়, দেশের প্রেক্ষাপট চেঞ্জ করে ফেলা কি খুব বেশি কঠিন হবে??

হয়তো সেদিন আসবেনা তবুও আমাকে এগিয়ে যেতে হবে সে দিনের স্বপ্নকে সামনে রেখেই। Robert Frost এর এ উক্তিটি হতে পারে চলার পথের প্রেরণা
“…..but i have promises to keep
And miles to go before i sleep
And miles to go before i sleep.”

আসুন আমরা এই শীতার্ত মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াই। ব্যক্তিগতভাবে কিংবা সমষ্টিগতভাবে যেভাবেই হোক…… আর একটি জীবন প্রদীপও যেন কেবলি শীতবস্ত্রের অভাবে নিভে না যায়….. এই মন্ত্রেই সূচিত হোক এবারে শীতের উদ্বোধন, শৈত্যের শুভ বরণ…….!

Facebook Comments