banner

শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 484 বার পঠিত

 

রূপান্তরের যাত্রা – পর্ব ৮


তাহনিয়া খান


বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম
Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.
O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জুম্মার নামাযের জন্য হারাম শরীফে চলে আসলাম। এত মানুষ যে হাটার জায়গা পর্যন্ত নেই। বসা তো দুরের কথা। ঠিক করলাম দোতালায় যাব। সেখানেও একি অবস্থা। চলে গেলাম ছাদে। সেখানে গিয়ে বসার জায়গা পেলাম। জীবনের প্রথম জুম্মার নামায পড়বো, তাও আবার হারাম শরীফে। খুবই এক্সাইটেড ছিলাম। নামাযের অনেক দেরি। অথচ সবাই বসে আছি কখন নামায শুরু হবে তার আশায়। কত ধরনের মানুষ। কালো, মোটা, ফর্সা, চিকন, লম্বা, খাটো। পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষকে যদি কেউ একসাথে দেখতে চায় , তাহলে এই হারাম শরীফে এসে দাড়ালেই হবে। কেউ কাউকে চিনি না, জানি না, তারপরেও মনে হয়েছে কত আপন। নিজের পাশের মানুষটার যাতে সমস্যা না হয়, সবাই এটা খেয়াল রাখে।

বসে থেকে কেউ দোয়া পড়ছে, কেউ একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। কেউ খাচ্ছে। যখন কেউ কিছু খায় , তখন পাশের মানুষটাকেও তারা আপ্যায়ন করে। খুব ভাল লেগেছিল ব্যাপারটা। সবচেয়ে ভাল লেগেছে ইন্দোনেশিয়ানদের। সব সময় হাসিখুশী অবস্থায় থাকে এবং খুব হেল্পফুল। আমি সবসময় তাদের পাশে বসার চেষ্টা করতাম। একবার আসরের নামাযের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমার পাশের এক ইন্দোনেশিয়ান মহিলা দেখি তার হিজাবটা এমন ভাবে টেনে নিল যে, তার চেহারা থেকে শুরু করে সব শরীর ঢেকে ফেললো। একটু পর দেখি ‘পিস পিস’ আওয়াজ। আর তার হিজাবের কিছু অংশ ভিজে যাচ্ছে। আমি বুঝতেই পারছি না কি হচ্ছে। তার পাশের জন আমার অবাক চাহনি দেখে মিট মিট করে হাসছিল। কিছুক্ষন পর মহিলা তার হিজাব ঠিক করে বসলেন এবং দেখলাম যে তার হাতে স্প্রে করার বোতল। সে স্প্রে করে পানি হাতে নিয়ে এতক্ষন ওজু করছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমি বড় একটা হাসি দিলাম। সেও প্রতি উত্তরে হাসলো। বেশ ভালো বুদ্ধি তো ! ওজু ভেঙ্গে গেলে জায়গাতে বসেই ওজুর ফরজগুলো পালন করে ওজু করে ফেলা যায়। খেয়াল করলাম সব ইন্দোনেশিয়ানদের সাথে একটা পানি স্প্রে করার বোতল থাকে। তাদের দেখা দেখি আমিও পরে কিনে নিয়েছিলাম। এখনো কোথাও ট্র্যাভেল করার সময় সেটা সাথে রাখি। এটা খুবই ভালো বুদ্ধি, কারণ হারাম শরীফে যে ভিড় থাকে, একবার ওজু করার জন্য উঠে গেলে আর সেখানে জায়গা পাওয়া যাবে না।

একজন বয়স্ক মহিলাকে দেখেছিলাম যার কপালে ছেলেদের যেমন নামায পড়লে দাগ হয়, সেরকম দাগ হয়ে আছে। আমি উনার চেহারা কোনদিন ভুলবো না। কপালের ঐ দাগ দেখলেই বুঝা যায় দাগটা নামাযের কারনেই হয়েছে। চোখে নির্লিপ্ত ভাব। নাইজেরিয়ান ছেলেমেয়েদের দেখতাম কি লম্বা আর গায়ে কি শক্তি। আসলে নাইজেরিয়ান বলা সঠিক হবে না, আফ্রিকান কোন এক কান্ট্রি বলাই মনে হয় শ্রেয়। তারা তাদের জিনিসপত্র মাথায় করে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এত তাড়াতাড়ি হাটে কিন্তু মাথার জিনিস পরে যায় না। আমরা দু’ ভাই বোন খেয়াল করলাম যে, তাদের বডি যতই নড়াচড়া করুক না কেন, ঘাড় সব সময় সোজা থাকে। ডানে বামে তাকালেও ঘাড় সোজা রেখে ঘুরায়। তাদের অনেকের ঘাড়ে, মুখে বিভিন্ন চিহ্ন দেখতাম। এসব চিহ্ন দিয়ে নাকি বুঝা যায় কে কোন গোত্রের।

ইরানীদের দেখতাম সবসময় চুপচাপ। দল বেধে থাকলেও তারা নিজেদের দোয়া দরুদ নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। কিছু ইরানী মহিলাদের কপালে, গালে ট্যাটু আঁকা দেখে অবাক হয়েছি। আর রাশিয়ান বেল্টের দিকের দেশগুলোর মানুষদের দেখতাম ছেলে মেয়ে সব এক কাতারে দাড়িয়ে নামায পড়তে। এক কাতারে কীভাবে ছেলে মেয়দের নামায হয় তা আল্লাহ্‌ই জানেন। ব্যাপারটা শুধু মক্কাতেই ঘটেছে। কারণ মদিনাতে মেয়েদের নামাযের জায়গা একদম আলাদা করা। ছেলেরা চাইলেও ঢুকতে পারবে না। আমার ভাই আর আমি খেয়াল রাখতাম ছেলে মেয়ে মিশানো কাতারে যেন না দাড়াই। অনেক সৌদি পুলিশ তাদের সরিয়ে দিত। পুলিশ চলে গেলেই আবার তারা হাজির হতো।

একবার এক আফ্রিকান মহিলা কাতার ফাঁকা না রাখার জন্য সবাইকে ইশারা করে বলছিল। তারপর আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আমার ডান পায়ের সাথে তার বাম পা ঘষা দিয়ে রাখলো। আর অন্যদিকে আরেক মহিলা এত দূরে দাঁড়িয়েছিল যে তাকেও উনি কাছে ডাকছিল। কাছে না আসায় তার বাম পায়ের সাথে আফ্রিকান মহিলা নিজের ডান পা এমনভাবে রাখলো যে, সে কি নামায পড়বে নাকি জিমন্যাস্টিক খেলবে বুঝতে পারছিলাম না। আমার তো হাসি চলে আসছিল। এমনিতেই আমার একটুতেই হাসির ব্যারাম আছে। এত বড় পা ফাঁকা করে সে যে কীভাবে নামায পড়লো , আল্লাহ্‌ মালুম।

কত বয়স্ক মানুষ যে দেখেছি হজ্জে। হজ্জ করতে গায়ে অনেক অনেক শক্তি লাগে। তারপরেও আল্লাহ্‌ এদেরকে দিয়ে হজ্জ করিয়ে নিয়েছিলেন। একবার আমার পাশে এক কাজাখিস্তানের এক মহিলা বসেছিলেন। তার ব্যাগ দেখে বুঝেছিলাম তিনি কাজাখিস্তানের। মাগরিবের সময় কাছে চলে আসছিল। নামাযের জায়গা সহজে কেউ ছাড়ে না। তাই অনেক আগে থেকেই সবাই জায়নামাজ বিছিয়ে জায়গা দখল করে বসে থাকে। জায়নামাজের এই এক সুবিধা, জায়গা দখল করা যায়। আমার বাম পাশে তখনো ফাঁকাই ছিল।

আমার বাম পাশে তখনো ফাঁকাই ছিল। কোন ফাকে সেই মহিলা এসে বসলেন খেয়াল করিনি। একটু পর আমার খিদা লাগার কারনে ব্যাগ থেকে খেজুর আর বাদাম বের করে খেলাম। পাশের সবাইকেও দিলাম। ঐ মহিলার পোশাক আশাক দেখে মনে হলো উনি আর্থিকভাবে স্বচ্ছল না। আমি যেহেতু তাকে খেজুর আর বাদাম দিলাম উনিও তার ব্যাগ থেকে নাড়ু টাইপের একটা জিনিস বের করে দিলেন। দেখে খেতে ইচ্ছা করলো না। আবার ভাবলাম মাত্র দুই তিনিটা নাড়ু উনার কাছে। হয়তো এটাই উনার এক মাত্র খাবার হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। উনার চাহনি দেখে মনে হলো খুব শখ করে দিলেন , না নিলে মনে কষ্ট নিতে পারে। তাই ভেঙ্গে অর্ধেক নিলাম। উনি নিজের ভাষায় আর আকার ইংগিতে বুঝাতে চেষ্টা করলেন কি দিয়ে সেটা বানিয়েছেন। আমার হাতের বাদাম আর খেজুর দেখিয়ে ইশারা করলেন। নাড়ুটা মুখে দিয়েই বুঝলাম ছাতু, খেজুর,বাদাম আর গুড় দিয়ে বানানো। কেন জানি না উনি আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলেন। খেয়াল করলাম তার একটা পা স্বাভাবিক, আরেকটাতে গোদ রোগ। এত মোটা আর ফুলে আছে পা টা। ভাবলাম কীভাবে এই পা নিয়ে এত হেঁটে উনি হজ্জ করবেন ? যখন নামায পড়লাম উনার উঠা বসায় কষ্টের চিহ্ন আমি দেখিনি। হয়তো আমার নামায পড়ার মনোযোগের কারণে সেভাবে উনাকে খেয়াল করিনি। সালাম ফেরানোর পর দোয়া পড়তে পড়তে পাশে তাকাতেই দেখি উনি নেই। আশেপাশে তাকালাম , কোথাও নেই। এত তাড়াতাড়ি ঐ পা নিয়ে উনি কীভাবে চলে গেলেন আমি আজও ভাবি সেটা। কত অসুস্থ মানুষকে দেখেছি, কত দরিদ্র মানুষকে দেখেছি। অবাক হয়েছি। অনেকের থাকার জায়গা নেই। মসজিদে থেকেছেন তারা। আল্লাহ্‌ এমন সব মানুষদেরকে দিয়েও হজ্জ করিয়েছেন।

এক চাইনিজ মহিলাকে দেখেছিলাম সবাইকে একটা করে মলম দিতে। প্রায় অনেকেরই ঠাণ্ডা লাগে সেখানে। আমিও একটা পেয়েছিলাম। কেউ কিছু দিলে খুশী মনে নিতাম, যাতে সেই ব্যক্তি কষ্ট না পায়। আমি সহজে কোন মলম লাগাই না। তারপরেও নিয়ে রাখলাম। রাতে রুমমেট ঘুমাতে পারছিল না ঠাণ্ডার জন্য। নিঃশ্বাসই নিতে পারছিল না। আমি সেই মলম বের করে দিলাম তাকে। শান্তিতে ঘুমালো তখন। অবাক লেগেছে আল্লাহ্‌র প্ল্যান দেখে। কোথাকার কোন চাইনিজ এর মাধ্যমে আল্লাহ্‌ আমার রুমমেটের জন্য মলম পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

শুধু তাওয়াফ করার সময় মানুষের ধাক্কাধাক্কি ভালো লাগেনি।হাজরে আসওয়াদ কে ধরার জন্য, কাবা ঘরকে ধরার জন্য আরেকজন মানুষকে কষ্ট দিয়ে, ব্যথা দিয়ে মানুষ কি পুণ্য অর্জন করতে চায় তা আমার জানা নেই। এমন অনেক মানুষকে দেখেছি যাদের ৬/৭ টা বাচ্চা। বাবা-মা তাওয়াফ করে, সায়ি করে, বাচ্চাগুলোও সাথে সাথে থাকে। এক বাবাকে দেখেছি দু মাসের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তাওয়াফ করতে।
বিচিত্র সব মানুষ, বিচিত্র তার জীবন যাপন। শুধু এক আল্লাহ্‌র ডাকে সবাই এক সাথে হয়েছে। জুম্মার নামাযের প্রথম রাকআতে সূরা ফাতেহার পর সবাই একসাথে যখন ‘আমিন’ বলে উঠলো , সে সময়ের সেই শিহরণ আজীবন মনে থাকবে।

হজ্জের ৮ম শিক্ষা– জীবনে কখনো আগে জামাতে নামায পড়িনি। খোলা আকাশের নীচে এত মানুষের ‘আমিন’ বলা শুনে মনে হয়েছিল, মুসলিম উম্মাহ যদি আজ ঐক্য বজায় রাখতো , তাহলে আজ পৃথিবীর বুকে মুসলিমদের এত দুঃখ আর বঞ্চনা থাকতো না। কালো, ফর্সা , ধনী, গরীব, লম্বা, বেঁটে, সুস্থ, অসুস্থ, যুবক, বৃদ্ধ যে যেমনই হোক না কেন, হজ্জের সময় সবাই কিন্তু হাসিখুশি অথবা সামান্য মন মালিন্য হলেও এক থাকার চেষ্টা করেছে। অন্যের ভুলগুলো নিয়ে কেউ বাড়াবাড়ি করেনি। অনেক কিছুই ছাড় দিয়েছে। শুধু হজ্জের সময় না করে সারা বছর যদি এমন মন মানসিকতা আমাদের থাকতো ! এক  কষ্টে কোটি মুসলিম ভাই এগিয়ে আসতো , যেমন করে আল্লাহ্‌র আনুগত্য স্বীকার করে একসাথে আমরা ‘আমিন’ বলেছিলাম।

পর্ব-৭

Facebook Comments