banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 699 বার পঠিত

 

মেয়েদের চাকরী করতে ‘হবেই’??

চারটি চাকা আর ইঞ্জিনের সমন্বয়ে গাড়ি হয়, তাতে চালকের বসার জায়গা হুইল এইসব জুড়ে দেয়ার পরও বহু কাজ বাকি থেকে যায়। অনেক সময় একটা গাড়ির যথাযথ দাম, চমৎকার ইঞ্জিন কিংবা মাইলেজ আর অন্যান্য জিনিস সুবিধাজনক হলেও শুধুই ‘দেখতে ভালো লাগছে না’ এজন্য একজন খদ্দের সে গাড়িটি কিনার আশা বাদ দেন।

মানুষ হিসেবে করণীয়র গন্ডি পেরিয়ে মানুষ যখনই আরও একটু গভীরে গিয়ে ভাবতে থাকে, আমি কে, কেন এসেছি আর কোথায় যাবো, ভাবনা বা যুক্তির সে জগতে তার লিঙ্গবিচারের চেয়ে বড় হয়ে দাঁড়ায় তার বিশ্বাস, জীবনের লক্ষ্য এবং তার চারপাশের জগত।

নারী অধিকারের কথা আসতেই কেনই যেন সবাই দুইটি চরমপন্থার অনুসারী মানুষের কাছ থেকে শুনতে পছন্দ করে। একদল হলেন ইসলামিস্টরা, যাঁরা প্রায়শই কথা বলার সময় ভুলে যান , তাঁর এই কথাগুলো হয়ত এমন কোন বোন শুনছেন যিনি মুসলমান নন, অথবা যিনি মুসলমান হলেও তাঁর জীবনের সবগুলো প্যারামিটার ইসলামিক নয়। আর একদল হলেন নারীবাদী। এই শ্রেণীর বা এই শ্রেণীভুক্ত হতে চাওয়া মানুষ এমন বজ্রনির্ঘোষে মেয়েদের অধিকার বর্ণণা করেন, শুনতে থাকা মেয়েরা উজ্জীবিত হলেও বাস্তব জীবনে এসে সেসব ‘অধিকার’ প্রয়োগের জায়গা না দেখে ‘যাহা লাউ, তাহাই কদু’ নামক চক্রে ঘরতে থাকেন। আর পুরুষ শ্রোতা হলে তো কথাই নেই, নিজের আর সঙ্গের মহিলাদের কর্ণকুহরে সে ‘অধিকারময়’ লু হাওয়া ঢুকতে না দিয়ে কেটে পড়েন। কারণ, নারী অধিকারের শ্লোগানে কেবল নারীই মানুষ, পুরুষ তার প্রতিপক্ষ কোন এক অপ্রয়োজনীয় সৃষ্টি।

মজার ব্যপার হল, এই দুই দলের কোন দলই খুব স্পষ্ট করে একটা বিষয়ে কথা বলেন না। সেটা হল, নারীর ‘কর্তব্য’। বলেন নাকি? আসুন, আমরাও আলোচনা করি।

মোটাদাগে ভাগ করতে গেলে মানুষের জীবনের অনেকগুলো ভাগের মধ্যে কয়েকটাতেই মাত্র এইসব অধিকার-কর্তব্যের টানাপড়েন দেখা যায়। কি সেগুলো? প্রথমতই হল, অর্থনৈতিক কর্তব্য। এরপর আসে, সামাজিক কর্তব্য, পারিবারিক দায়িত্ব ইত্যাদি। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম বা অন্য যে কোন ধর্মে নারীকে যে অধিকারই দেয়া হোক না কেন, আজকাল নারী অধিকার সংস্থা এমনকি রাষ্ট্র পর্যন্ত এ ব্যপারে বেশ সচেতন। ইসলাম যে অধিকার দিয়েছে, তাকে ‘কম’ মনে করে, অন্যান্য ধর্মে একেবারেই না দেয়া অধিকারকে পাশ কাটিয়ে নারী এখন তার ‘সমানাধিকার’ বুঝে নিতে রাষ্ট্রেরও সহায়তা নিয়ে চলেছে। কিভাবে? বিয়ের বেলায় মোহর বুঝে নেয়া, পিতার অবর্তমানে পিতার সম্পত্তিতে সমান হিস্যা ইত্যাদি। এমনকি অনাদিকাল থেকে চলে আসা পুরুষের একমাত্র অধিকার (!) যৌতুকেও বাগড়া এখন রাষ্ট্রের, নিলেই শাস্তি। বেশ! বিয়ের পর? দারা-পুত্র-পরিবারের চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়, সকল প্রকার বৈধ-অবৈধ, ন্যায্য-অন্যায্য চাওয়াকে পাওয়ায় বানানোর সামাজিক দায়িত্ব কার? পুরুষের। বেশ! এমনকি, যদি স্ত্রী ঘরের রান্না করতে না চান, বাচ্চাদের দেখেশুনে মানুষ করার দায়িত্ব নিয়ে তাঁর চব্বিশ ঘন্টা ব্যয় না করতে চান, তবে তার বিকল্প ব্যবস্থার জন্য ব্যয় করবে কে? পুরুষ। বেশ!! এ পর্যন্ত ঠিক আছে। ধর্ম বা মানবিকতার দৃষ্টিতে এইটুকু অধিকার খুব দোষের কিছু না।

না, আমি এই বিচারে যাবো না যে কয়টা মেয়ে এ অধিকারটুকু পাচ্ছে। যেহেতু এটি সংবিধানে লিখিত অধিকার, এর ওজন আছে এবং সেই ওজন রক্ষা করে তাকে বাস্তব রূপ দান রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। আজ না হোক, কাল এই অধিকার আদায় হবেই। সেই বিশ্বাস আমার আছে। তবে? নারী, যে অধিকারের দিক থেকে ‘সমঅধিকার’ পাচ্ছে, অন্তত সে ব্যবস্থা করতে সবাই আন্তরিক, কর্তব্যের বেলায় সে কেন ‘সমদায়িত্ববোধ’ অনুভব করবে না? যে নারী, সমাজের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যাকে শিক্ষিত করে তোলার জন্য বাবা মা থেকে শুরু করে পাড়ার রিকশাওয়ালা পর্যন্ত বাড়তি কষ্ট করে, তার সেই ঋণ কে শোধ করবে? সেই দায়িত্ববোধ, এক কাঁড়ি গয়না পরে ঘন্টাচারেক ধরে ‘ওয়েডিং ফটোগ্রাফী’ তুলে, কিংবা নয় মাস সমাজের জন্য নতুন একজন সুনাগরিককে বহন করেই কি শেষ? কেন? কেন নয়?  

সোজা কথা একটাইঃ সমাজের প্রতি নারীর দায়িত্ব কি? আদর্শ অবস্থা ধরে নিই, নারী তার অধিকার বুঝে পাচ্ছে। মুসলিম হলে মুসলিম পারিবারিক আইনে ভাইয়ের অর্ধেক আর অন্য ধর্মের হলে, ধর্ম না দিলেও সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে ভাইয়ের সমান অংশ পাচ্ছে পিতার সম্পত্তিতে। আর মুসলিম হলে মাহর পাচ্ছে। তো, এই পরিমাণ সহায় সম্পদ অর্জনের পর রাষ্ট্র/ সমাজ /পরিবার বলছে, “নেও এইবার আলমারিতে তালা দেও। খুশী তো?”। ব্যাস, সমঅধিকারবাদীদের কাজ কিন্তু আর নাই। এইবার কে আছে, নারীকে কোন কাজ দেবেন? আপাতদৃষ্টিতে কেউই নাই। সুতরাং বৈভব দেখাতে এই মহিলারা বাচ্চাকে স্কুল থেকে আনতে যান বেনারসী বা সাউথ কাতান পরে, বাচ্চাকে হরেক কোচিং এ দিয়ে আত্নতৃপ্তিতে ভুগতে থাকেন, অথবা গয়নার স্টাইল জানতে সিরিয়ালের শরণাপন্ন হন। একটা অংশ আছেন, ধর্মকর্মে মন দেন। বাচ্চাদের মানুষ করার সময়টুকু বাদে বাকিটা সময় দেন ইসলামকে জানতে। হায়! এই লাইটহাউসেরা যদি জানতেন, তাঁরই পাশের কোন এক অন্ধকারে হাতড়ে মরছে অন্য কোন নারী। জানেন কি? খুব কম!

আর পুরুষেরা? কামাই করেন উদয়াস্ত খেটে, বাসায় ফিরে পানের ওপর যথাস্থানে চুন দেখতে ভালোবাসেন। আর পার্টিতে গল্প করেন, “আপনার ভাবি, বুঝলেন না, মার্কেটে গেলে আমাকে কাঁদায় ছাড়ে। এতো কেনে তবু শেষ নাই। হে হে হে…” এই সমাজের সুবিধাভোগীদের কেউ স্মরণ করিয়ে দেন না, ইসলাম নারীকে অর্থনৈতিক অধিকার যেমন দিয়েছে, অলাভজনক সেবামূলক কাজের ভারও নারীকেই দিয়েছে। প্রমাণ চান? সন্তানকে লালন পালনের কাজ, বিনে পয়সায় স্তন্যদান কে করবে? দুই/আড়াই বছর পর্যন্ত? এরপর কে তার প্রাথমিক শিক্ষা দেবে? কি বলে আপনার জ্ঞান?

20121106053453

পুরুষের সাথে নারীর কাজের পার্থক্য মূলত দুইটি। এক, নারীর বাড়তি শারীরিক মানসিক যোগ্যতা। আর দুই, নারীকে অর্থোপার্জনের বাধ্যতামূলক কাজ করতে হবে না। তাই এই কাজ তিনি করতে পারবেন, ইচ্ছেমত, সানন্দে, অন্যদের স্বস্তি দিতে। এবার আসি আর একটু বড় প্রসঙ্গে, সমাজ বা রাষ্ট্র এক্ষেত্রে কি করবে? জবাব হল, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পুরুষ যেমন সময়/সুযোগ/ইচ্ছেমতন পেশা বাছাই করে নেন, কোন পিছুটান ছাড়াই, নারীকে সে ব্যবস্থা করে দিবে। উদাহরণ দিই। গুলশান বনানী বলুন, কিংবা ঠাকুরগাঁওয়ের কোন গ্রাম বলেন, সব জায়গায় একদুইজন মুচি থাকে, মাছওয়ালা থাকে, দর্জি থাকে, মুদি দোকানদার থাকেন। কয়জন থাকবে, সরকার সে সংখ্যা ঠিক করে দেন না, তবে কোন পুরুষ যখন সে পেশা বেছে নেয় বাকিরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। ঈদ সামনে রেখে কাজের চাপ বাড়লে দর্জিবাড়ির ধান কেটে বাড়িতে আনতে গেরস্থবাড়ির পুরুষটিও হাত বাড়ান। অর্থাৎ এক্ষেত্রে শুধু নিজের লাভ না ভেবে সমাজের উন্নতির কথা ভাবে সবাই। কিন্তু নারীর কাজের বেলায় কি আমরা এমনভাবেই হাত বাড়াই?

আপনার আমার স্ত্রী-বোন-মা অসুস্থ হলে খুঁজেপেতে মহিলা ডাক্তার বের করি, আমার আত্নীয়াটির মানসিক আরামের কথা ভেবে, কিংবা মেয়ে সন্তানটির জন্য শিক্ষক হিসেবে কোন মহিলাকেই দেখতে চাই, প্রবাসী হলে চাই আমার আত্নীয়াটি ব্যাঙ্কে কোন মহিলা কর্মকর্তার সহায়তায় সঞ্চয়পত্র খুলুক বা সাহায্য নিক। কিন্তু সমাজের সদস্য হিসেবে, সে ডাক্তার মহিলাটিকে এক বেলা রেঁধে খাওয়াবার পরামর্শ দিই আমার আত্নীয়াদের? আমার মা বোনকে বলি প্রতিবেশী ডাক্তার বা শিক্ষিকা বা অন্য পেশায় নিয়োজিত মহিলাটির সন্তানকে নিজের সন্তানের মত দেখে রাখতে? যতক্ষণ না তিনি নিজে বাসায় ফিরে আসেন? তবে?

পুরুষের যেমন কাজের বৈচিত্র্য আছে, থাকাই দরকার, নারীরও তাই থাকা চাই। কাউকে যেমন হোমমেকার হতে হয়, বা হতে পারার যোগ্যতা দেয়া হয়েছে, কেউ পারেন, চাকুরীক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় কাজ করে আরও দশজন নারীর জন্য অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা করে দিতে। তবে, এজন্য পুরোটা সমাজকেই একত্র হতে হবে। আবার যারা ঘরে বসে কাজ করতে চান, তাঁরাও যেন কাজ করতে পারেন, এমন দরজাও খোলা থাকা দরকার। কে করবে এই কাজ? আপনি। আপনি পুরুষ না মহিলা, যা ই হোন, আপনিই শুরু করে দিতে পারেন।

আপনি যদি গ্রামে থাকেন, আপনার বাড়ির মেয়ে বউদের নিয়ে বসুন। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী সামষ্টিক কাজ ভাগ করে দিন। লেখাপড়া জানা বউটিকে বলুন, রান্নার কাজের সহায়তা করে বিকেল থাকতেই বাড়ির বাচ্চাদে রপড়ানো শুরু করতে। আর তার কিছু কাজ আপনারাই এগিয়ে দিতে পারেন। আর যদি শহরে থাকেন, আপনার এলাকার না পারেন, বিল্ডিং এর মেয়ে বউদের একত্র করুন। অযথা আত্নম্ভরিতা বা নাক উঁচু ভাবের খোলস ছেড়ে বের করে আনুন। যে তিনটি মহিলা কর্মজীবি, তাঁদের বাচ্চার দেখাশোনার জন্য আর এক দুইজন সমবয়সী বাচ্চাদের মা’কে অনুরোধ করুন, খানিকটা বেতনের আদানপ্রদানও হলে ক্ষতি নেই। অন্য দুই একজন রান্নাবিলাসীদের বলুন, সবার জন্য কম দামে বাড়িতে তৈরী খাবার বানিয়ে বিক্রী করতে। যেন, কর্মজীবি মা’টি কাজের তাড়ায় বাচ্চাদের কেনা খাবার খাওয়াতে গিয়ে ঠকে না যান।

এ তো গেলো, ক্ষুদ্র পর্যায়ে। চাইলে আর একটু দূরেও আপনি প্রসারিত করতে পারেন ইনসাফের হাত। মোটের ওপর কথা হল এই যে, যেহেতু মহিলাদের হাতে সংসার চালাবার ভার নেই, এমন কাজ তিনি করতেই পারেন যাতে অন্যদের উপকার হয়, আর তিনি চাইলে অন্তত সে উপকারের খরচটূকু তুলে নিতে পারেন। আর যে মা’কে অর্থোপার্জনের জন্য কাজ করতেই হয়, তিনি তো আরও সাহায্য পাবার দাবীদার। মূল লক্ষ্য হল, নিজেরা ভালো থাকা আর ভবিষ্যত প্রজন্মকে হাত-পা-মাথাওয়ালা ‘প্রাণী’ না বানিয়ে মানুষ বানানো।

মহিলারা যেইদিন নিজেদের এভাবে তুলে ধরতে পারবেন, সেদিন অবশ্য পুরুষের একটা কাজ কমে যাবে। কি? “আর বলবেন না ভাই, আটটা থেকে এগারোটা রিমোটটা পাই না, কিনেই ফেললাম একটা ট্যাব” গল্প করতে পাবেন না, অথবা বাজারে বাজারে ‘বিবির বিবি (bag bearer)’ হয়ে ঘুরতে হবে না আগের মত। ভাগ্যবান হলে, আপনার স্ত্রী-কণ্যা-বোন বা মা-ও হয়ে যেতে পারেন, মনের রঙ দেখানোর কারিগর। বাইরের রঙ কেনার ঝোঁকে আর সন্ধেগুলা খরচ করতে নাও রাজী হতে পারেন তিনি। কাজ বাড়বেও বৈকি, বাইরে যাবার সময় আপনার চশমাটি এগিয়ে দিতে যেমন আপনার স্ত্রী হাতের মশলা মুছে ছুটে আসেন, মাঝে সাঝে আপনিও দৌড়াতে হতে পারে স্ত্রীর আধখাওয়া চা নিয়ে।

তাতে কি? সুস্থ শরীর আর সুস্থ মনে বেড়ে উঠতে থাকা আপনার সন্তানদের মুখগুলো আপনাকে ভালোবাসার আধার বানিয়ে দিতেই পারে, না? ইচ্ছে করেই মুখ‘গুলো’ বললাম। হোক সে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোন পেশার, আপনার স্ত্রী সামাজিক নিরাপত্তা পেলে হয়ত আপনার সন্তানটিকে একাকীত্বের ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে বাঁচিয়ে দিতে আপনারা দুজনেই একমত হয়ে যেতে পারেন, নয় কি?

লেখক- ব্লগার অর্ফিয়ুস

Facebook Comments