মাত্র পাঁচ বছর আগের কথা। মাঠ পেরিয়ে মেয়েরা বিদ্যালয়ে আসত। মাঠের মধ্যেই বসে থাকত বখাটে ছেলের দল। মেয়েদের সামনে দাঁড়াত। বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতো মেয়েরা। একা কোনো মেয়ের পক্ষে মাঠ পার হয়ে বিদ্যালয়ে আসা প্রায় অসম্ভব ছিল। হঠাৎ বদলে গেছে সেই দৃশ্য। মাঠের ভেতর দিয়ে পাকা রাস্তা হয়েছে। সেই রাস্তা ধরে মেয়েরা বাইসাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কোনো দ্বিধা নেই।
৭ নভেম্বর রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে গিয়ে মেয়েদের বাইসাইকেলের পিছু নিয়ে এই প্রতিবেদক বাউসা হারুন-অর-রশিদ উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে উপস্থিত হন। বিদ্যালয়ে বাইসাইকেল নিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখে বিস্মিত হতে হয়। শিক্ষকদের হিসাবমতে, বিদ্যালয়ের অর্ধশতাধিক ছাত্রী এখন সাইকেল নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করে। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আজিজুল আলম বললেন, চার-পাঁচ বছর আগেই অমরপুর গ্রামের মেয়েরা মাঠ পার হতে গেলে বখাটেদের ঝামেলায় পড়ত। এখন রাস্তাঘাট হয়েছে। মেয়েরা স্বাচ্ছন্দ্যে সাইকেল চালিয়ে বিদ্যালয়ে আসছে। তাদের দিকে কেউ ফিরে তাকানোর সাহস পায় না। তিনি বলেন, মাত্র তিন-চার বছরের ব্যবধানে এই পরিবর্তন হয়েছে।
২০১৩ সালে এই বিদ্যালয় থেকে নাসিমা খাতুন নামের একটি মেয়ে পাস করে বেরিয়ে গেছে। তার বাড়ি উপজেলার দিঘা গ্রামে। বাড়ি থেকে চার কিলোমিটার দূরে স্কুল। সময়মতো ভ্যান-রিকশা পাওয়া যেত না। হেঁটে আসতেও সময় লাগে বেশি। অনেক সময় প্রথম ক্লাস পাওয়া নিয়ে সমস্যা হতো। নাসিমা বাবাকে বললে তিনি একটি বাইসাইকেল কিনে দেন। এরপর থেকে সে সাইকেলে চড়ে বিদ্যালয়ে যাতায়াত শুরু করে। নাসিমা এসএসসি পাস করার পরে সাইকেলটি আরেকটি মেয়েকে দিয়ে দেয়। এভাবে একজনের দেখাদেখি আরেকজনও সাইকেল নিয়ে আসতে শুরু করে।
শিক্ষকেরা বলেন, বিদ্যালয়ের পুরোনো ভবনের বারান্দায় যত সাইকেল, সব মেয়েদের। দেখানোর জন্য প্রধান শিক্ষক যাদের সাইকেল আছে, তাদের সাইকেল নিয়ে বের হতে বললেন। বিদ্যালয়ের মাঠে রীতিমতো লম্বা সারি হয়ে গেল। কারও মধ্যে কোনো জড়তা নেই। সবাই স্বতঃস্ফূর্ত-স্বচ্ছন্দ। সাইকেলের সঙ্গে আরও একটি জিনিস বেড়েছে, সেটা হচ্ছে স্কুলব্যাগ। কয়েক বছর আগেও মেয়েরা হাতে করেই বই নিয়ে আসত। বেশির ভাগ মেয়ের সাইকেলে ক্যারিয়ার রয়েছে। বাড়ি যাওয়ার সময় বইয়ের ব্যাগটা থাকে ক্যারিয়ারে। আবার কেউ ব্যাগ ঘাড়ে নিয়েও সাইকেল চালিয়ে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সকালে বিদ্যালয়ের রাস্তায় দেখা গেল এক সাইকেলে দুজন করেও উঠেছে। পথে হয়তো বান্ধবীর সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার সাইকেল নেই। তাকে ক্যারিয়ারে তুলে নিয়েছে।
কথা হয় বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী মুক্তি খাতুনের সঙ্গে। দরিদ্র পরিবার। বাবা বেঁচে নেই। মা অভিভাবক। মা তাকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে একটি সাইকেল কিনে দিয়েছেন। মুক্তি জানায়, কিছু টাকা কম পড়েছিল, তার মামা দিয়েছেন। সে বলে, ‘হেঁটে আসতে হলে অনেক সময় লাগে। কোনো দিন প্রথম ক্লাস ধরাই যেত না। আবার ভ্যানে আসতে হলে প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ টাকা খরচ হতো। সময়মতো ভ্যান পাওয়াও যায় না। এখন কোনো ঝামেলা নেই। নিজের খুশিমতো আসতে পারছি।’
একই গ্রামের ষষ্ঠ শ্রেণির সান্তা খাতুনেরও একই কথা। স্বাধীনমতো চলাফেরা করতে পারছে। সকালে প্রাইভেট পড়ে আবার বিদ্যালয়ে আসতে পারছে। কোনো দেরি হচ্ছে না। একই রকম বক্তব্য অষ্টম শ্রেণির নীলা রানি, চাঁদনী খাতুন ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী বৃষ্টি খাতুনের।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনিসুর রহমান বলেন, ‘আগে মেয়েরা অনেক দূর থেকে হেঁটে কষ্ট করে আসত। তখন রাস্তাঘাটও ছিল না। যখন রাস্তাঘাট হলো, আমরাও মেয়েদের বাইসাইকেল নিয়ে আসার জন্য উৎসাহিত করেছি। মানুষের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। এটা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেছে।’
পার্শ্ববর্তী বাউসা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ জন ছাত্রী বাইসাইকেলে চড়ে আসে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আশরাফ আলী বলেন, অভিভাবকেরা এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন হয়েছে। মেয়েরা যে ছেলেদের মতো সব কাজই করতে পারবে, এই আত্মবিশ্বাসটা এই এলাকার মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।