banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 955 বার পঠিত

 

মানুষ কেন মানুষকে ছেড়ে যায়? যায়ই? কেন?

মানুষ কেন মানুষকে ছেড়ে যায়? যায়ই? কেন?


সানজিদা সিদ্দিকী কথা


আমি হয়তোবা তখন সতেরো বছরের হবো। স্বপ্ন নিয়ে অস্থির হয়ে যাবো এমন বয়স আমার না।কিন্তু একটা অদ্ভুত স্বপ্ন আমি দেখেছিলাম,ভেতরটা ওলটপালট করে দেবার মত স্বপ্ন। আমি একটা মসজিদে বসে, হঠাত কোথা থেকে একটা ছোট মেয়ে হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে ছুটে আসলো। এইটা কোন অদ্ভুত ব্যাপার না তবে যে প্রশ্নটা করেছিলো সেটাতে আমি হকচকিয়ে গেলাম।
“মানুষ কেন মানুষকে ছেড়ে যায়? ছেড়ে যায়ই? কেন? কেন?

প্রশ্নটা অবশ্যই খুব ব্যক্তিগত ছিল কিন্তু সাথে সাথেই আমি বুঝে গেলাম, এই প্রশ্নের জন্য আমিই কেন আসলে।
সত্যি বলতে কি, আমি মানুষটা এমন যে সবকিছুতেই বড় বেশি মাত্রায় জড়িয়ে যায়।

সেই ছোটবেলা থেকেই আমি কেমন জানি। প্রিস্কুলে আমার সাথের বাচ্চাদের বাবা মা যখন ওদের স্কুলে দিয়ে যেতো কিভাবে জানি ওরা সহজভাবেই নিতো। নিতে পারতাম না আমি। আমি কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল বাধিয়ে ফেলতাম, কি বেইজ্জতি ব্যাপার।কিন্তু আমার কান্না থামায় সাধ্য কার?
বড় হতে হতেই আরেক আলামত শুরু করলাম। আমার আশেপাশের যা কিছু আছে সবকিছুর প্রতিই প্রবল মায়া আমার। সেই ক্লাস ওয়ান থেকে, আমি ভালো বন্ধু খুঁজে বেড়াতাম আর মনে মনে তার কাছেই সুখের চাবিটা দিয়ে রাখতাম। বড় হতে হতে বন্ধুদের সাথে কিছু হলেই দুঃখের পশরা সাজিয়ে বসে যেতাম, ভাবভঙ্গী এমন আমার থেকে দুঃখি মানুষ জগতসংসারে নাই। সুন্দর জায়গা, সুন্দর ঘটনা, পুরাতন ছবি, প্রিয় সময়গুলো আর বন্ধুরা — সব কিছুর সাথে মনটাকে একেবারে সুপারগ্লুর মত জুড়ে রেখে দিতাম। এইসব কিছুর বাইরে নিজেকে কল্পনা করতেও আমার বুক কাঁপতে থাকতো। নিজেকে নিঃস্ব মনে হতো।
একটু ওদিক হলে যেই অনুভূতিটা আমার হতো সেটাকে সাধারণ দুঃখ কিংবা হতাশা ঠিক বলা চলে না, ব্যাপারটা আমাকে একেবারে ভেতরে ভেতরে গ্রাস করে ফেলতো খেয়ে ফেলতো। আর একেকটা দুঃখ থেকে আমি কখনো পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পেরেছিলাম এরকম আমার মনে পড়ে না। অনেকটা যে ফুলদানীটা আমি টেবলের কোনায় রেখেছিলাম, একটু টোকা লাগলো আর ভেঙে খানখান, ভাঙা ফুলদানিটা যেমন কখনোই ঠিক করে জোড়া লাগে নি, তেমন।

দোষটা কাচের ফুলদানির ও না, আবার পড়ে ভেঙে গিয়েছিলো সেটাতেও না বরং আমি কাচের মত একটা জিনিসকে টেবলের একেবারের কোনায় রেখে দিয়েছিলাম।

আমি আমার মনের মত একটা স্পর্শকাতর জিনিসের সাথেই সবচেয়ে বড় অন্যায়টা করেছিলাম। আমি আমার জীবনে আসা প্রত্যেকটা মানুষকে, প্রত্যেকটা সম্পর্ককে এমন এক দানবীয় ক্ষমতা দিয়ে রেখেছিলাম যে এরা চাইলে আমাকে হাসাতে পারে, চাইলে কাঁদাতে পারে আর চাইলে একেবারে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে পারে। আমি সবকিছুর উপর নিজেকে নির্ভরশীল করে নিজেকে এতটাই অপমান করতাম যে, হতাশা, নিরাশা, একের পর এক নিজেকে চূর্ণবিচূর্ণ করবার জন্য সব কিছুকে কার্ড হাতে দাওয়াত দিয়ে আসতাম।

আমার এইসব কষ্টের কারন হিসেবে অন্য মানুষকে দোষারোপ করা অনেকটা ফুলদানি ভেঙে ফেলবার জন্য মাধ্যাকর্ষণকেই শাপশাপান্ত করবার মত হাস্যকর। আমরা কখনই শুকনা পাটখড়ি কে অভিযুক্ত করতে পারি না, এতে ভর করে পাহাড় বাইতে গিয়ে কেন ভেঙে পড়েছে, এই বলে!

আমাদের ওজন তো একজন ই নেয়ার যোগ্য। আমার রব।

…………নিঃসন্দেহে হেদায়াত গোমরাহী থেকে পৃথক হয়ে গেছে। এখন যারা গোমরাহকারী ‘তাগুত’দেরকে মানবে না এবং আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল যা ভাংবার নয়। আর আল্লাহ সবই শুনেন এবং জানেন।

(-Sura Al-Baqarah, Ayah 256)

এই নিরীহ আয়াতটাতে একটা কঠিন শিক্ষা আছে। পৃথিবীতে একটি মাত্র হাতই আছে যা কখনো ছেড়ে যাবে না। একটি মাত্র জায়গাই আছে ভরসা করবার মত। নিজের আত্মসম্মান, আনন্দ, নিরাপত্তা শুধু এই একটা সম্পর্কেই পাওয়া যাবে। আর কোথাও না, একেবারে কোথাওই না।

যদিও পৃথিবী এমন এক জায়গা যেখানে মানুষ এইসবগুলো নিজের রব বাদে আর সবখানে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ক্যারিয়ার, টাকা, ক্ষমতাতে কেউ খুঁজছে।আবার আমার মত কিছু উচ্চপর্যায়ের গাধা আরো ভয়ংকর জিনিসে সুখটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিসে?
সম্পর্কে।একে অপরের সাথে সম্পর্কে।
এলিজাবেথ গিলবার্ট তার বইতে খাবার,প্রার্থনা, ভালোবাসাতে আনন্দ খুঁজবার কথা বলেছেন, বিশ্ব চষে বেড়ানোর কথা বলেছেন পূর্নতা পেতে। উনি বলেছেন ভালোবাসা, সম্পর্ক, ধ্যান কিংবা খাবারে তার পূর্নতা খুঁজতে খুঁজতে সফলভাবে অসফল হবার গল্প।

আর ঠিক এই কাজটাই আমি করেছি জীবনভর। ভুলভাল জিনিসে মধ্যে নিজের ভেতরকার শুন্যতা পূরন করতে গিয়ে আরো বেশি শূন্যতায় হারিয়ে গেছি বারবার।
এতে কোন সন্দেহই নাই, ছোট্ট মেয়েটা যে প্রশ্নটা আমাকে স্বপ্নে করেছিল সেটার উৎপত্তি ক্ষতি থেকে, হতাশা থেকে, হারানোর বেদনা থেকে, কোন কিছু প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে খুঁজতে গিয়ে শুন্য হাতে ফেরত আসার গল্প থেকে।
ব্যাপারটা ঠিক তখনই ঘটে যখন মানুষ খালি হাতে ক্রংকিটের দেয়াল খুঁড়ে কিছু বের করতে যায়।

সে তখন শুধু খালি হাতেই ফেরত আসে না বরং রক্তাক্ত, ভাঙা হাতে ফেরত আসে। এগুলো আমি শুধু পড়ে আর শুনে শিখে ফেলেছি এমন ভাববার কোন কারন নেই। খুব কষ্ট পেয়ে,খুব চেষ্টা করে, বারেবারে, এরপরেই বুঝতে পেরেছি।

আর তাই ছোট মেয়েটার প্রশ্নটা আমার নিজের প্রতি ছুড়ে দেয়া নিজেরই প্রশ্ন ছিল।

প্রশ্নটা ছিলো আসলে দুনিয়ার ধরন নিয়েই। দৌড়াতে থাকা সময়ের সাথে অযথা নৈকট্য নিয়ে। যেই দুনিয়ার মানুষগুলো ছেড়ে যেতে পারে, মরে যেতে পারে তাদেরই সাথে কেন নিজেকে এই শক্তভাবে জুড়ে দেয়া? এটা নিজের গর্ত নিজে খোঁড়ারই নামান্তর।

অথচ এটা খুবই প্রকৃতি বিরুদ্ধাচরণ। মানুষের গড়নই এমন, আমরা ভালোবাসা খুঁজতে থাকি, একেবারে নিখুঁত কিছুর সন্ধানে থাকি যেটা কিনা চিরস্থায়ী ই না। হাস্যকর। আমরা স্থায়ী কিছু চাই। কেন চাই?

কারন আমাদের এই দুনিয়ার জন্যই প্রস্তুত করা হয় নি। আমাদের বাড়িগুলো তো জান্নাতে রয়ে গেছে, যে বাড়ি চিরস্থায়ী আর নিখুঁত। তাই স্থায়ী কিছুর আকাঙ্ক্ষা আমাদের ভেতর মজ্জাগত ভাবে রয়ে গেছে।

বিপত্তিটা বাধে যখন সেই জিনিসটা আমরা এইখানে খুঁজতে যাই। আমরা তৈরি করে ফেলি যৌবন ধরে রাখবার প্রসাধনী, প্লাস্টিক সার্জারি করি। কিন্তু ফলাফল?

শুধুমাত্র শুন্য।আর কিছুই না।

তাই আমরা যদি এই দুনিয়াকে খুব ভালোবেসে ফেলি এটা আমাদের কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিবে না। কিচ্ছু না।

কারন দুনিয়ার সংগা….. নশ্বরতা। মরীচিকা।

কেউ যদি আগুন থেকে পানি বের করবার চেষ্টা করে পুড়ে ছাড়খাড় হওয়া ছাড়া কি থাকবে তার জীবনে? কিচ্ছু না।

যখনই দুনিয়া থেকে স্থায়ী আর নিখুঁত কিছু খোঁজা বন্ধ করতে পারবো তখনই দুনিয়াও আমাদের কষ্ট দেয়া বন্ধ করে দিবে।

আরো একটা জিনিস এসবের বাইরেও মনে রাখা খুব জরুরী, কারন ছাড়া কিচ্ছু ঘটে না এখানে। ভাঙাচোরা হৃদয়ও কারনেই ভাঙে। ক্লেশে জর্জরিতা মন আর তার ভেতরে ফুটতে থাকা ব্যথাগুলো শিক্ষা আর সাথে আরেকটা জিনিস। আরেকটা জিনিসের চিহ্ন। এটা ইংগিত করে কিছু তো গড়বড় আছে! কিছু তো বদলানো দরকার। অনেকটা আগুনে জ্বলতে থাকা হাত জানান দেয়, হাত সরাও বাছা, পুড়ে যাচ্ছে।

এই কষ্টগুলো আমরা যে দুনিয়ার সাথে সেঁটে আছি সেটা বোঝায়, এই কষ্ট টা সেঁটে থাকা আমাদের জোর করে উপড়ে ফেলার চিহ্ন। ভালোবাসার মানুষটা যখন বারেবারে কষ্ট দিয়ে রক্তাক্ত করে, তখন একপর্যায়ে আমরা সরে যাই। দুনিয়াও রবের প্রিয় মানুষগুলোকে কষ্ট দিয়ে দিয়ে নিজের থাকে সজোরে ছুড়ে ফেলে দেয়।

#ভাবানুবাদ

#Sanjida_Kotha

#Reclaim_Your_Heart_by_YasminMogahed

#repost

Facebook Comments