banner

বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 839 বার পঠিত

 

মনের জানালা


বৃত্তের বাইরে


ছোটবেলায় পাঠ্য বইতে পন্ডশ্রম কবিতাটা পড়েছিলাম। চিলে কান নিয়ে গেছে, কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। সারাদিন খালে-বিলে, পাড়ায় নানান জায়গায় সবাই মিলে কানের খোঁজে ঘুরে দেখা গেল কান কানের জায়গাতেই আছে। স্কুলেও আমরা এমন খেলা খেলতাম যার নাম ছিল চাইনিজ হুইস্পার। কথা যে এ-কান ও-কান করে পরিবর্তন হয় তার প্রমাণ হিসেবে দশ-বারোজন মিলে কোন একটা গান বা কবিতার লাইন একজনের কানে বলে সবার কান ঘুরে নিজের কানে এলে দেখা যেত লাইনটির অর্থ পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এর আরো বড় প্রমান পেলাম বাবার চাকরির কারণে যখন আবুধাবি ছিলাম সেই সময়।

সময়টা ঠিক মনে নেই তবে সম্ভবত ২০০০ সালের গোড়ার দিকে। আমাদের এক পরিচিত বাংলাদেশী ফোন করে আমার মাকে জানালেন,’ভাবী শুনেছেন দুবাইয়ে ভূমিকম্প হয়েছে। আমরা আবুধাবি থাকাকালীন একদিন হঠাৎ বৃষ্টি দেখে খুব অবাক হয়েছিলাম। স্থানীয় লোকজনের কাছেও মরুভূমিতে বৃষ্টি হওয়াটা খুবই অবাক ব্যাপার ছিল। শেখদের দেখেছিলাম গাড়ি নিয়ে হৈচৈ করে বৃষ্টি দেখার জন্য রাস্তায় বের হয়েছিল। এই হিসেবে তখন ভূমিকম্পের ব্যাপারটাও অনেকের কাছে বেশ অবাক করার মত ঘটনা ছিল যদিও আমাদের দেশে আমরা এসব দেখে অভ্যস্ত। যাই হোক দুবাইয়ের ভূমিকম্পের খবরটা মুহূর্তে ফোনের মাধ্যমে এই কান সেই কান হতে হতে আবুধাবিতে বাঙ্গালীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়লো। প্রথমে খবরটা ছিল দুবাইতে হয়েছে, এরপর শোনা গেল আবুধাবিতে হতে পারে, দুপুরের মধ্যে শুনলাম আবুধাবিতে ভুমিকম্প হবে সবাই যেন যে যার বিল্ডিঙয়ের নিচে রাস্তায় চলে আসে। এর মধ্যে আবার যেসব ভাইরা চাকরির কারনে দূরে অবস্থান করছিলেন তারা ভাবিদের পরামর্শ দিলেন ঘরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, পাসপোর্ট, গয়নাসহ যেন ঘর থেকে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যান । আমি মায়ের সাথে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম ফেরার সময় দেখি মরুভূমির এই কাঠ ফাঁটা রোদে আমাদের এক পরিচিত স্ট্রলারে দুই বাচ্চা নিয়ে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। জিজ্ঞাসা করে জানলাম উনি ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী বাচ্চা আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ৩/৪ ঘণ্টা থেকে দাঁড়ানো। বাইরে ৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে তিনি সমানে ঘামছেন আর ভূমিকম্পের অপেক্ষা করছেন। মা দেখে বললেন, শিগগির বাসায় যান, এই গরমে বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়বে। একটা কথা শুনলেন আর অমনি বিশ্বাস করলেন! ভূমিকম্প কখনো বলে কয়ে আসে! পরদিন শুনেছিলাম ভুমিকম্পের ভয়ে সেদিন বিভিন্ন বিল্ডিঙয়ের নিচে অনেক বাঙ্গালীরা এমন রাস্তায় বেরিয়ে অপেক্ষা করছিলেন যা পরে সবার মধ্যে কৌতুকের সৃষ্টি করেছিল। মজার ব্যাপার হল মহিলারা না হয় আবেগপ্রবন বেশী, না বুঝে অনেক কিছু করে কিন্তু পুরুষরা! ঘটনাটা বলার উদ্দেশ্য হল আমরা বাঙালীরা হুজুগে মাতি। কোন কিছু শুনলে পুরুষ মহিলা উভয়েই ঘটনার সত্যতা যাচাই বাছাই না করে সহজে বিশ্বাস করে ফেলি।

ভার্চুয়াল জগতটাও অদ্ভুত। কোন একটি খবর যখন একজন মানুষ অন্য একজনকে বলে তখন কিছুটা হলেও পরিবর্তন হয় কেননা প্রত্যেক মানুষেরই নিজেকে প্রকাশ করার স্ব-স্ব স্টাইল থাকে। এই খবরটাই যখন অন্য একজনকে বলতে যাই তখন কিভাবে বললে তা অন্যের কাছে সত্য, বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হবে সেই চিন্তায় আমরা আসল কথার সাথে নিজেদের মনগড়া আরো কিছু যোগ করে অন্যের কাছে প্রকাশ করি। এভাবে যদি খবরটা একজন মানুষ থেকে অন্য আরেকজন মানুষের কাছে যেতে সামান্য পরিবর্তনও হয়ে যায় তবে ঐ খবরটা হাজার মানুষের মাঝে বা পুরো মহল্লায় জানাজানি হলে কি অবস্থা হবে! মূল কথাটা শেষে গিয়ে কতটুকু সত্য হয়ে দাঁড়াবে? তাই যে কোন ধরনের উসকানিমূলক বা হঠকারী পোষ্ট দেবার আগে একটু চিন্তা করুন খবরের উতস সম্পর্কে আপনি কতটুকু জানেন? চলুন, প্রথমে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমি কি এগুলোর সাথে জড়িত? আমি কি মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছি? আমার আচরণে কি অন্য কেউ কষ্ট পাচ্ছে? আমি যে খবরটা প্রচার করছি তার সত্যতা কতটুকু? আমি কি অন্যের কাছে প্রচার করার আগে ঠিকমত যাচাই করে নিয়েছি? মানুষ হিসেবে এইটুকু দায়িত্ববোধ আশা করাটা অন্যায় নয় নিশ্চয়ই।

Facebook Comments