banner

রবিবার, ০৫ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 550 বার পঠিত

 

প্রতিবেশিনী……৩


আফরোজা হাসান


রাতের মেঘলা আকাশ খুব ভালো লাগে আয়ানের। আর যদি সেই মেঘলা আকাশটা হয় জোছনা ধোয়া তাহলে তো ভালো লাগার মাত্রা বেড়ে যায় কয়েক গুণ বেশি। মেঘের সমুদ্রে চাঁদের ভাসমান ভেলা, সারাটা ক্ষণ জুড়ে চলে উভয়ের লুকোচুরি লেখা। অবশ্য এই লুকোচুরি খেলা আয়ানকে একাই দেখতে হয় সবসময়। মাহাম শুধু সেদিনই তার সাথে আকাশে চোখ রাখে যেদিন জোছনা বান ডেকে যায় হাজার তারার সমারোহে। এখনো পাশে বসে থাকলেও মাহামের চোখ বইয়ের দিকে।

এত রোম্যান্টিক বই পড়াচ্ছি তোমাকে কিন্তু রোমান্টিক দু’একটা বাক্য শোনার সৌভাগ্যও তো হচ্ছে না আমার কানের। মাহামের পাশে বসতে বসতে বলল আয়ান।

বই বন্ধ করে মাহাম বলল, ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল। ভাব-সম্প্রসারণ পড়োনি?

ভাব-সম্প্রসারণ তো পড়েছি কিন্তু মাহাম ভাবের কি সম্প্রসারণ করতে চাইছে সেটা বুঝতে পারছি না।

আমি শব্দে শব্দে ছড়িয়ে দিতে চাই না তোমাকে ঘিরে আমার ভালোবাসা। তাই শব্দদের সংরক্ষণ করছি মনের ভাঁড়ারে। যখন পর্যাপ্ত শব্দ একত্রিত হবে তোমাকে একটা প্রেমের উপন্যাস উপহার দেবো। আমি তো কয়েকটা উপন্যাসের নামও ঠিক করে ফেলেছি। “আমরা দুজন ভাসিয়া আসিয়াছি যুগল প্রেমের স্রোতে” কিংবা “একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে”।

উপন্যাসের শুরুই করবে অন্যের থেকে ধার করা শব্দে?

তাই তো! এভাবে তো ভেবে দেখিনি। আচ্ছা নামও আমিই দেবো আমার শব্দ ভাণ্ডার থেকে। কিন্তু তুমি ঠোঁট টিপে হাসছো কেন? আমি উপন্যাস লিখতে পারবো না ভাবছো?

হাত বাড়িয়ে মাহামকে কাছে টেনে নিয়ে হাসতে হাসতে আয়ান বলল, উহু…এমন ভাবার কোন অবকাশই নেই। আমার তো বরং ধারণা অতি উন্নত মানের উপন্যাস লিখতে পারবে তুমি।

এমন ধারণার পেছনে কারণটা কি জানতে পারি?

অবশ্যই জানতে পারো। একজন ঔপন্যাসিক হবার সব গুণ তোমার মধ্যে আছে। ছোট একটা কথাকে তুমি ইলাস্টিকের মত টেনে লম্বা করতে পারো, রহস্য করতে পারো, বিভ্রান্ত করতে পারো, কথার মার প্যাঁচেও তোমার তুলনা মেলা ভার। আর সব চাইতে বড় কারণ শব্দের সাথে শব্দ বুনে চমৎকার মুগ্ধতার আবেশ সৃষ্টি করতে পারো তুমি।

ঠেলে আয়ানকে কাছ থেকে সরিয়ে দিয়ে চোখ বড় বড় করে মাহাম বলল, তুমি কি বলতে চাইছো সোজাসুজি বলো।

হাসি চাপার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আয়ান বলল, আরে আমি তো তোমার প্রশংসা করছি। তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?

তোমার সাথে তো আমি আর কথাই বলবো না। বলে তো মাহাম উঠে গজগজ করতে করতে ভেতরে চলে গেলো। মাহামের অভিমান ভাঙাতে আয়ানকেও বাধ্য হয়ে পিছু নিতে হলো।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে খাবার মুখে দিয়েই মাহামের দিকে তাকালো আয়ান। স্বাদ-ঘ্রাণ দুটোই অন্যরকম লাগছে খাবারের। আয়ানকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মাহাম হেসে বলল, আজ নাস্তা আমি বানাইনি। হাদিয়া এসেছে।

হাদিয়া এসেছে! কোত্থেকে?

আমাদের প্রতিবেশিনী পাঠিয়েছেন। হাদিয়ার সাথে একটা চিরকুটও ছিল। তাতে লেখা ছিল-“ রাসূল(সঃ)বলেছেন, ‘তোমরা হাদিয়া আদান-প্রদান করো। এর মাধ্যমে তোমাদের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি হবে।” অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত রাসূল(সঃ)বলেছেন, ‘হে আবুজর! যখন তুমি তরকারি পাকাও তাতে একটু বেশি পানি দিয়ে ঝোল বাড়াও এবং তোমার প্রতিবেশীকে পৌঁছাও।” আর রাসূল (সঃ) স্পেশালি নারীদেরকে এই বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করে বলেছেন, ‘হে মুসলিম নারীগণ! তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশিকে হাদিয়া দিতে সংকোচবোধ না করে। যদিও তা বকরির খুড়ের মতো একটি নগণ্য বস্তুও হয়।”

আয়ান হেসে বলল, যাক তোমার প্রতিবেশিনীর তাহলে অন্যের হকের জ্ঞানও আছে।

হাসলো মাহামও। হ্যা আর শুধু হাদিয়াই না আজ ডিনারের দাওয়াতও দিয়েছে আমাদেরকে। কারণ আজ নাকি হঠাৎ উনার মনে পড়েছে রাসূল(সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও আখিরাতে বিশ্বাসী তার উচিত মেহমানের মেহমানদারী করা।” কি নিয়ে যাবো দাওয়াতে সেটা ভাবছি। তুমি কি কোন পরামর্শ দিতে পারো এই ব্যাপারে?

দুম করে বিয়ে করা কাকে বলে তা কি জানো তুমি?

নাতো। কাকে বলে?

যেই বিয়ের পর দুমাদুম শব্দে বৃষ্টির ন্যায় দুশ্চিন্তাটা মনে বর্ষিত হয় তাকে বলে।

আয়ানের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠলো মাহাম।

আয়ানও হেসে বলল, আমরা তখন সবে মাত্র মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। আমাদের দুই ক্লাসমেট দুম করে বিয়ে করে ফেললো। বিয়ে মেনে নিলেও উভয় পরিবারই বয়কট করলো দুজনকে। তখন আমরা সব ফ্রেন্ডরা মিলে নিজেদের পকেটমানির টাকা একসাথ করে ওদেরকে ঘর ভাড়া করে দিয়েছিলাম। এবং প্রায় ছয় মাস ধরে একটু একটু করে সবাই মিলে সাজিয়ে দিয়েছিলাম ওদের সংসারকে। সেই সময়ের অনুভূতি, সেই আনন্দ প্রকাশ করার মত না। তখন আমরা একটা জিনিস উপলব্ধি করেছিলাম কাউকে ফুল-কার্ড-চকলেট উপহার দেবার চেয়ে তার প্রয়োজনীয় ও দরকারি কোন জিনিস কিনে দেবার মাঝে উভয় পক্ষের জন্যই কি আনন্দ ও প্রাপ্তি লুকিয়ে থাকে।

শুনেই তো আমার মনে অদ্ভুত আনন্দধারা বইতে শুরু করেছে। হাসিমুখে বলল মাহাম।

এরপর থেকে আমি যখনই আমার কোন ফ্রেন্ডকে উপহার দিতে চাই আগে খোঁজ নিয়ে দেখি তার কোন জিনিসটার প্রয়োজন রয়েছে। আমার কাছে সবসময় মনেহয় উপহার এমন কিছু দেয়া উচিত যেটা ব্যক্তির কাজে লাগবে। ফ্রেন্ডের সন্তানদেরকে উপহার দেবার সময়ও আমি এটা খেয়াল রাখতে চেষ্টা করি। আমাদের সবারই আসলে খেয়াল রাখা উচিত উপহার যেন অপচয়ের মধ্যে শামিল না হয়। আমাদের প্রতিবেশীদের নতুন সংসার। তাই অনেক কিছুর প্রয়োজন থাকতে পারে। তুমি খোঁজ নিয়ে দেখো। দরকারী যেই জিনিসটা দিলে উনারা লজ্জিত বোধ করবেন না কিন্তু উনাদের একটা প্রয়োজন পূরণ হবে এমন কিছু দেবার চেষ্টা করো।

আরেকবার নতুন করে মাহামের মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেলো আয়ান। মুগ্ধ কণ্ঠে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিলো কিন্তু এই সময় কানে ভেসে এলো চিৎকার ও কোন কিছু পড়ার হুড়মুড় শব্দ! আয়ান ও মাহাম দুজনই উঠে পাশের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে ছুট লাগালো…………

চলবে..

পর্ব-২

Facebook Comments