banner

রবিবার, ১৯ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 547 বার পঠিত

 

নিজের গল্পটা নিজেই বদলে দিলেন তাসলিমা

গল্পটা হতে পারত এমন, স্কুলে পড়া দরিদ্র পরিবারের একটি মেয়ে।  লেখাপড়া আর খেলাধুলার উচ্ছল দিন কাটত তার। মেধাবী ছাত্রী সে। কিন্তু মা-বাবা ভাবলেন অভাবের সংসার, খরচ চালানো যাচ্ছে না। ছোট মেয়েটি বড় হচ্ছে। তাই শিশু বয়সেই মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেওয়া হলো বিয়ে। তারপর যা ঘটল—বিয়ের পর কিশোরী বয়সেই দুই-তিন সন্তানের মা হলো মেয়েটি। অসময়ে সন্তান ধারণের কারণে শরীর ভেঙে যেতে লাগল। অভাবের সংসার। সন্তানেরা অপুষ্টিতে ভুগছে। বিয়ের কয়েক বছর পর মেয়েটির চোখে-মুখে হতাশার ছাপ।
কিন্তু গল্পটা এমন হয়নি। হয়েছে উল্টোটাই। গল্পটা এখন এমন, যে মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল সেই মেয়ে ‘দেশ জয়’ করতে চাচ্ছে। আর তাই নিজের জীবনকে সুন্দর করে সাজাতে মেয়েটি তার কিশোর বয়সে প্রথম জীবনযুদ্ধে জয়ী হয়েছে। আজ সে জয়িতা। বাল্যবিবাহ না করায় তার লেখাপড়া ও কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।মায়ের সঙ্গে তাসলিমা আক্তার
যে মেয়ের কাহিনি নিয়ে গল্প বলা হচ্ছিল তাঁর নাম তাসলিমা আক্তার। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের ফরিদপুর মধ্যপাড়া গ্রামের রমিজ উদ্দিন শেখের ছোট মেয়ে তিনি। শিক্ষাগ্রহণ ও কর্মক্ষেত্রে অবদান রাখায় তাসলিমা আক্তারকে এবার ঈশ্বরদী প্রশাসন ও উপজেলা মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তর সেরা জয়িতার পুরস্কার দিয়েছে। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে সম্মাননা ও সনদপত্র এবং একটি ক্রেস্ট।
১১ ডিসেম্বর দুপুরে যাওয়া হয় তাসলিমার গ্রাম ফরিদপুরে। পাকা সড়ক থেকে অনেক দূরে গ্রামের আঁকাবাঁকা কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে হয় তাঁর বাড়িতে। একখণ্ড জমির ওপর তাসলিমাদের বসতভিটা। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে তাসলিমা সবার ছোট। বাবা ছিলেন দরিদ্র কৃষক। মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। তিনি ছাড়া বাকি ভাইবোনদের বিয়ে হয়ে গেছে। সবার আলাদা সংসার। তাসলিমা বৃদ্ধা মাকে নিয়ে বাড়িতে থাকেন। পশ্চাৎপদ এই গ্রামে প্রায় বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটে। কিন্তু গ্রামের সব কুসংস্কার দূরে ঠেলে দিয়ে তাসলিমা লেখাপড়া করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে আসছেন। মেধাবী হলেও বাড়িতে লেখাপড়ার তেমন পরিবেশ ছিল না। তবুও তাসলিমা ২০১০ সালে এসএসসিতে জিপিএ-৫ এবং ২০১২ সালে এইচএসসিতেও জিপিএ-৫ পেয়েছেন। এখন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে লেখাপড়া করছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের দুটো পরীক্ষাতেই তিনি প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন।

তাসলিমা বলেন, ‘অভাবের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। ভাবতে পারিনি এত দূর লেখাপড়া করতে পারব। তবুও একটা স্বপ্ন ছিল আমার। স্বপ্নটা হলো নিজেকে প্রতিষ্ঠা করা। বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্ত রাখা।’ কিন্তু তাসলিমার সে স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হচ্ছিল ২০১১ সালের দিকে। তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৫ বছর।

‘সবেমাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। এরই মধ্যে বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে। পাত্র ঠিক করা ছিল। কিন্তু কিছুতেই রাজি হইনি। আমি জানতাম বাল্যবিবাহ একটি সামাজিক ব্যাধি। এখন বিয়ে হয়ে গেলে আমার স্বপ্নটা ভেঙে যাবে। বাল্যবিবাহের পরিণতি আমি জানি। এমন ভাবনা থেকেই বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে তখন সংগ্রাম শুরু করলাম। বললাম, কিছুতেই এই বয়সে বিয়ে করব না। আমি লেখাপড়া করতে চাই। বন্ধ হয়ে গেল বিয়ে।’ বললেন তাসলিমা। এরপর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করলেন লেখাপড়া।

কলেজে ভর্তির পর দেখা দিল আরেক সমস্যা। প্রচণ্ড অর্থসংকট। একে তো পরিবারে অভাব-অনটন। কেউ তাঁর লেখাপড়া ও কলেজে যাতায়াতের খরচ দিতে রাজি হয়নি। তাই লেখাপড়া ও নিজের খরচ জোগাড় করার জন্য শেখেন কিছু কাজ। প্রথম দিকে শার্টের বোতাম লাগানোর কাজ করতেন। পরে গ্রামের শিশুদের প্রাইভেট পড়ানো শুরু করেন। এ থেকে লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের জন্য কিছু জোগান দেওয়া সম্ভব হয়। তবুও খরচ চালানো যাচ্ছিল না।

এরপর জমানো কিছু টাকা দিয়ে কয়েকটি ছাগল কিনে লালন-পালন শুরু করেন তাসলিমা। এক বছর পর থেকে ছাগল বিক্রি করে যে টাকা পেতেন তা দিয়ে পড়াশোনার খরচ চালাতেন। তাসলিমা বলেন, ‘এভাবেই আমি এগিয়ে যাচ্ছি। এখন স্বপ্ন দেখি বাল্যবিবাহমুক্ত দেশের।’

কথা হয় তাসলিমার মা ছালমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছোটকালে মাইয়াড্যারে বিয়া দিবার চাইছিলাম। হেঁয় (সে) তো দেখতে সুন্দর। বিয়া ঠিকও করছিলাম। কিন্তু মাইয়াড্যা আমার রাজি হয় নাই। এখন বুঝতাছি, ছোটবেলা   বিয়া দিলে মাইয়াড্যা এত দূর আগাইতে পারত না।’

Save

Save

Save

Facebook Comments