banner

সোমবার, ০৬ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 422 বার পঠিত

 

শত কষ্টের পর এখন স্বাবলম্বী নুরজাহান

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের কোনো এক বর্ষণের দিনে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামে জন্ম নূরজাহান বেগমের। চার ভাই তিন বোনের সংসারে তার অবস্থান পাঁচ। জন্মের সময় পরিবারের আর কেউ তেমনভাবে খুশি হতে না পারলেও তার বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন। জন্মের পর পরই বাবা ঘোষণা দিয়েছিলেন তার এ মেয়েটিকে এমএ পাস করাবেন।
নূরজাহান বেগম এমএ পাস ঠিকই করেছেন কিন্তু তার বটবৃক্ষ, সব থেকে ভালোবাসার মানুষটি তা দেখে যেতে পারেননি। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন তখন তার বাবা মমতাজ আলী শেখ মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর কিছুটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল তাদের পরিবার। সপ্তম শ্রেণিতেই হয়তো থেমে যেত তার লেখাপড়া। কিন্তু মা হালিমা বেওয়ার দৃঢ়চেতা মনোভাবে সব ঠিক হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৬ সালে ইব্রাহিম খাঁ সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি ও একই কলেজ থেকে ১৯৮৮ সালে বিএ পাস করেন।
এরপর তার জীবনে বয়ে যায় ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের এক ঝড়। সবকিছু উলট পালট হয়ে যায়। থমকে যায় প্রতিদিনের জীবনের গতি। কিন্তু যোদ্ধা মানুষ কি যুদ্ধ না করেই সমাজ জীবনের কাছে হারতে পারেন? না, তিনিও ঝড়ের অস্বাভাবিকতা কাটিয়ে ওঠার জন্য ২০০০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বরে যোগ দেন ব্র্যাকের মাইক্রো ফিন্যান্স প্রোগ্রামে। সেখানে থেকে ২০০২ সালের জানুয়ারিতে যোগ দেন ব্র্যাকের আরেকটি প্রোগ্রামে। মূলত এই প্রোগ্রামে কাজ করতে করতেই পাল্টে যেতে থাকে জীবনের গতি। নিবিড়ভাবে শিখতে থাকেন তার ভালোবাসার কাজটি।
কৃষির প্রতি ভালোবাসা আর চাকরিতে মোটরসাইকেল চালনায় শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে খুঁজে পান ফিরে আসার পথ। পরিবারের শত বাধা উপেক্ষা করে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারির এক পিকআপ ভ্যান চায়না-৩ জাতের লিচু কলমের চারা নিয়ে হাজির হন টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর উপজেলার চরনিকলা গ্রামের নিজ বাড়িতে।
শুরু করেন নতুন জীবন। বাবার দেয়া ২০ শতক জমি আর নগদ ১ লাখ টাকা দিয়ে গড়ে তুললেন ‘তোয়া’ নামের এক নার্সারি। বাড়ির সবাই বিরোধিতা করলেও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোটভাই ফরিদ সাহস জুগিয়েছেন নানাভাবে। শুরুতেই সফলতা পাননি নার্সারিকন্যা নূরজাহান বেগম। প্রথম বছর লিচু কলমের চারা ছাড়া আর সবই ছিল বনজ গাছের চারা। চারা বিক্রির সময় হলে তিনি দেখলেন বনজ গাছের চারায় যত টাকা ব্যয় করেছিলেন সবই লোকসান। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, মানুষ যে ধরনের গাছের চারা চায় তিনি সে ধরনের চারা তার নার্সারিতে ঠাঁই দেননি। মানুষের চাহিদা ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি গাছের চারা আর তিনি করেছেন নিম থেকে শুরু করে দেশীয় জাতের বনজ চারা। পাড়া-প্রতিবেশীদের টাকা ছাড়া চারা দিতে চেয়েও দিতে পারেননি। সবাই এক বাক্যে বলেছেন কি হবে এই চারা দিয়ে? এক দিকে ৩০ হাজার টাকা লোকসান আর অন্যদিকে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বিদেশি কোনো জাতের চারা না করার অঙ্গীকার। বড়ই টালমাটাল অবস্থা। কি করবেন জানা নেই। আবার হেরে যেতেও তার বড় লজ্জা।
নূরজাহান বেগম জেলা পর্যায়ে চারবার সেরা নার্সারির পুরস্কার পেয়েছেন। সার্বক্ষণিক ২ জন কর্মচারী আর ৬ হাজার বিভিন্ন জাতের ফলজ গাছের চারায় ভরপুর তার নার্সারি। ১ লাখ টাকা মূলধনের নার্সারি নিষ্ঠা আর সাধনায় ফুলে-ফেঁপে হয়েছে ১০ গুণ। এতকিছুর পরেও আর বিয়ে করেননি নার্সারিকন্যা নূরজাহান বেগম। করতেও চান না। তার ভাষায়, ‘রক্তের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাওয়া এই নার্সারিই আমার পরিবার, আর সব ফলদ গাছের চারা আমার সন্তান।’
Facebook Comments