banner

শনিবার, ১৮ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 708 বার পঠিত

 

‘তিতলি’


ডা.কবীর জুয়েল


দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর হীম শীতল হাওয়ায় এই রাজধানী ঢাকার শাহুরে পরিবেশেও রীতিমতো নিম্নচাপের আভাস পাচ্ছিলাম, সাথে মিডিয়া গুলোর আলাপন ও ক্রমশঃ সতর্ক বার্তায় বার বার ‘তিতলি’ নামটি উচ্চারিত হচ্ছিলো, এবারের আসন্ন দূর্যোগটিকে এমন এক মোহনীয় মিষ্টি নামে ডাকা হচ্ছে , মাঝে মাঝে মনে হয়, কোন আকাশপরি বুঝি শান্তি সুখের বারতা নিয়ে উড়িষ্যা হয়ে বাংলার ভূতলে নেমে আসছে,তবে আবহাওয়া বিভাগের পূনঃপূনঃ
ভয়ংকর পূর্বাভাস আমাকে শংকাজনক নষ্টালজিক করে বছর চারেক আগের স্মৃতিতে টেনে নিয়ে গেলো, ‘তিতলি’-রুপী ঝড়ের কবলে পড়ে আমাকে পরিবারসহ টানা কয়েকদিন ‘নারকেল জিঞ্জিরা-য় আটকে থাকতে হয়েছিলো,শহর থেকে আনা দ্বীপের খাবার যা ছিল,তা প্রায় শেষ;সেলফোন গুলো চার্জের অভাবে নিছক খেলনা মোবাইলে পরিণত হলো,পুরো দ্বীপ ঘুরে দেখতে দেখতে মোটেল ও স্থানীয়দের ঘর বাড়ীর অবস্থান মুখস্থ হয়ে গিয়েছিলো,এ কারনে স্থানীয়দের সাথে হৃদ্যতা অনেক বেড়ে যায়,ওদের জীবন জীবিকা ও আচার ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি আগুন্তুকদের পীড়া দিচ্ছিলো—তা হলো এ নিম্ন চাপের অবসান কবে হবে,এ ঝড়ো হাওয়া কবে শান্ত সুবাতাস রুপে বইবে?
অধীর আগ্রহ নিয়ে বেড়াতে আশা হয়েছিলো এখানে ,কতো পরিকল্পনা করে ছেঁড়া দ্বীপে সাঝ বেলায় বার-বি-কিউ এর কিউরিসিটি ছিলো,
নিরাপত্তাহীনতা আর অজানা শংকায় সব-ই রাতারাতি এক নৈরাশ্যময় বিভিষিকায় পরিণত হলো ,অনেকে নিজেদের এক মৃত্যুপুরির বাসিন্দা ভাবতে লাগলো,
নিজে সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ায় চোখের সামনে ‘মাস প্যনিক এটাকস’ গুলো ডায়াগনসিস করতে পারছিলাম,প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে কাউন্সিলিং করতেও হয়েছে কারন কিছু কিছু দূর্বল চিত্ত মূর্ছা যাবার উপক্রম হলো। আমাদের শশব্যস্ত চলমান বিরামহীন জীবনটাকে তুচ্ছতায় পর্যবশিত করে দিয়ে,মহান স্রষ্টা কদাচিৎ বুঝিয়ে দেন, তার সৃষ্টিকূল কতোখানি অসহায় ! তিনি স্পষ্ট করে তোলেন তার অসীম ক্ষমতার কিয়দংশ মাত্র যা দেখে সম্বিৎ ফিরে পায় অনেকে,,, জীবনে জুম্মার নামাজটিও পড়েননি,ওরাও দেখলাম নামাজী হয়ে উঠলো। কয়েকজন তথাকথিত সেলিব্রেটিও ছিল,প্রটোকল আর অহমিকা ভেদ করে সবাই কেবল এক আলোচনায় মনোনিবেশ করলো; কবে টেকনাফের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছাড়বে?আদৌ আমরা এ যাত্রায় টেকনাফ পর্যন্ত পৌঁছতে পারবো কিনা? না পারলে আমাদের কি হবে? এ দ্বীপেই কি সলীল সমাধী???
কিছু কিছু ধনীর দুলাল হেলিকপ্টার পাঠাতে অনুরোধ করছিলো,কিন্তু আবহাওয়া এতোটাই প্রতিকূল যে বেশ কয়েকদিন ঢাকা থেকে কোন সিগনাল-ই পাওয়া যায়নি। তবে দ্বীপবাসীর মাঝে আমি বিন্দুমাত্র দ্বীধা,
ভয়, আশংকা দেখিনি, স্থানীয় ভাষায় বলছে ‘আল্লাহু-ই রক্ষা করবে’; ৬৫ বছর ধরে আমাদের পূর্বপুরুষরা থাকে, কোনদিন আমাদের ক্ষতি হয়নি,অদ্ভুত রকমের আত্মবিশবাস,নি:সন্দেহে এতে প্রঘাঢ় স্রষ্টা ভক্তি
রয়েছে, আমি সেই মানুষগুলোকে নিয়ে এসে আমাদের শাহুরে ননীর পুতুলগুলোকে অভয় দিতাম,এদিকে
দ্বীপের সব গুলো হোটেল মোটেল সকল পর্যটকদের
বিল ৭৫% কমিয়ে দিলো, এমন কি জেটিমুখি গরীব ডাব ওয়ালারা ডাব খাওয়ার পর টাকা আছে কিনা জিজ্ঞেস করছে,না থাকলে দিতে হবেনা, মনে মনে ভাবছিলাম এ জন্যই এদের প্রতি করুণাময়ের অবারিত রহমত অব্যাহত থাকে,এরা এখনো মওজুদ্দারী কিংবা সিন্ডিকেটেড ট্রেডিং বোঝেনা, বিপদে ফেলে লোক ঠকানো তো দূরের কথা, তাই আমদের মতো অলীক ভীতি( Phobia/ Panic /Stress) তাদের কক্ষনোই চেপে ধরেনা,আমি জানি আমার টেক্সবুকের ‘Panic Attack’ এদের জন্য মোটেও প্রযোজ্য হবেনা,তবে Psychology -তে পড়া ‘Altruistic Behaviour’ -এর সাথে ওদের আচরণ একেবারেই মিলে যাচ্ছে,ওদের উছিলায় হলেও এই মানুষ গুলো বেঁচে যাবে সে আস্থা আমার পুরোই ছিলো,পাঠক সে যাত্রায় আমরা রক্ষা পেয়েছিলাম তবে শেষ সময়ে দ্বীপে আর খারার ছিলোনা।
যতোটুকু মনে পড়ে কোন এক উপন্যাসে-র নায়িকা ছিলো ‘তিতলি’,এক জনপ্রিয় ধারাবাহিকের একটি চরিএের নাম ‘তিতলি ভাইয়া’ ,আমার পরিচিত কয়েকজন মেয়ের নাম-ও তিতলি,ওরা সবাই অত্যন্ত উদারমনা, আর পেশাগত জীবনে তিতলি নামের প্রতিটি রোগী-ই বেশ ভদ্র হয়ে থাকে, অথচ হঠাৎ ক দিন ধরে
তিতলি’ নিয়ে যে ভীতি ছড়াচ্ছে তা নামটিকে তেতো করে তুলেছে,
ইতিমধ্যেই ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ,ওডিসাসহ আশপাশে ডজনখানেক প্রানহানী ঘটিয়ে জন জীবনের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এই তিতলি বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে,উল্লেখ্য তিতলির ভয়ে পটুয়াখালী ও বরগুনা-র সাগর সংলগ্ন মানুষগুলোও ঝড়াক্রান্ত তিতির পাখির মতো আশ্রয় খুঁজছে , প্রাকৃতিক দূর্যোগ এমনি ভয়াবহ
হয়ে থাকে, মূহুর্তে-ই সব লন্ডভন্ড,তবে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকলে মোকাবিলা সহজ হয়ে যায়। বরগুনাস্থ বামনা থানার বিষখালী নদীটি এ সময় ভয়ানক রুপ পরিগ্রহ করে, বামনার ডেউয়া(এক ধরনের ফল)তলা সহ ছোট্ট শহরটি পানিতে তলিয়ে যায়,নদী তীরবর্তী প্রান্তিক মানুষ গুলো এ সবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে, তবে কোমল মনা অনেকেই সিডর,আইলা ইত্যাদির ভয়াল ছোবল আজো ভূলতে পারেনা। ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা ও বি,সি,এস -এর সিরিয়ালে প্রথম দিকে থাকা সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারনে ২০০১-এ আমার প্রথম পদায়ন হয়েছিল এই বামনায়,তাই আমি খুব কাছ থেকে দক্ষিণাঞ্চলের এই মানুষগুলোকে প্রত্যক্ষ করেছি,অন্য যে কোন দেশের নাগরিকদের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষগুলোর্প্রাকৃতিক দূর্যোগের চাপ প্রক্ষেপণের ক্ষমতা অনেক অনেক বেশী, মধ্যপ্রাচ্যে মানসিক বিশেষজ্ঞ হিসেবে থাকাকালীন সময়ে সামান্য মরুঝড়( Desert Storm)-এর কিছু ধূলিক্ণায় আরবদের নেত্রে রাজ্যের ত্রাস & ভীতি দেখতে পেতাম,অনেক আরবকে ভর্তি রেখে ঔষধ ও কাউন্সিলিং করতে হতো,আমাদের ঝড় ঝঞ্জাক্রান্ত মানুষগুলোর কাছে এ ধরনের ধুলিমাখা ঝড় নস্যি মাত্র।
আশা করি আমাদের দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ‘তিতলি’ নামীয় নিম্নচাপটি আমাদের নাটক, সিনেমার নায়িকাদের মতোই নরম গোছের একটি দমকা হাওয়া হবে,যথেষ্ট প্রস্তুতি থাকায় প্রাণঘাতি রুপ নেবেনা।আমাদের সমাজ ও ব্যক্তি জীবনেও তিতলি-র প্রভাব পড়তে শুরু করেছে,পরিশেষে একটি আবহাওয়া সংবাদ দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই,আজ এক রোগীনী অত্যুৎসাহে আমাকে জানালো সে তার সদ্যোজাত শিশু কন্যার নাম রেখেছে ‘তিতলি’, আমিও অনুসন্ধিৎসু হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
বললো “আমি চাই আমার মাইয়া ঝড়ের লাহান শক্তিশালী হউক যাতে জামাইরে হারা জীবন ওর কথায় উঠ বস করাইবার পারে।”
তিতলি নামটি নিয়ে আমার মাঝে যে সুন্দর স্বচ্ছ
ধারণা বাসা বেধেঁছিল, রোগীনী-র কথায় তা মূহুর্তেই কুর্পুরের মতো উবে গেলো।

 

ডা. এম এস কবীর জুয়েল
এমবিবিএস, বিসিএস, এম.ফিল(নিউরো-সাইকিয়াট্রি), ডক্টর অফ মেডিসিন(এম.ডি) মনোরোগ
সৌদি বিশেষায়ীত স্বাস্থ্য কমিশন সার্টিফাইড ইন সাইকিয়াট্রি এন্ড সাইকোথেরাপী
ভূতপূর্ব মনোরোগ ও মাদকাসক্তি বিশেষজ্ঞ, সাইকিয়াট্রিক হাসপাতাল, আল জউফ, সৌদি আরব
ভূতপূর্ব সহযোগী অধ্যাপক
এশিয়ান ইনষ্টিটিউট অফ মেডিসিন, সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি কেদাহ্, মালয়েশিয়া
ইউনিট প্রধান, সাইকোথেরাপি ও কাউন্সিলিং ইউনিট, মনোরোগ বিভাগ
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল

Facebook Comments