banner

বুধবার, ০৮ মে ২০২৪ ইং, ,

পোস্টটি 1012 বার পঠিত

 

খেলনার বদলে শিশুর মোবাইল চাই!


নজরুল ইসলাম টিপু


শিশুর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার প্রতি নজর রাখুন। দেখবেন সে পুরোদিন কাজ করে চলেছে। এটা হাত থেকে খসিয়ে নিলেন তো অন্যতা হাতে নিচ্ছে! আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একজন সুস্থ-সামর্থ্য মানুষ একটি প্রাণ চঞ্চল শিশুর মত অনবরত কাজ করতে পারবে না…………
মানব শিশু দুনিয়াতে আসার কিছুদিন পরেই সে বুঝতে শিখে যে, তাকে সর্বত্র অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। তখন সে খুশিতে আপ্লুত হয়। একপর্যায়ে দেখে, খাদ্য ও খেলনা সামগ্রীর ক্ষেত্রে সে অগ্রাধিকার পেলেও, কিছু ব্যাপারে তাকে সে অধিকার দেওয়া হয় না। বড়দের টস-লাইট, মোবাইল, ছুরি, দা, বটি ধরতে গেলে তাকে বারণ করা হয়। অথচ এটা ধরে দেখা ও কাজে লাগাতে তারও মন চায়। এটা আদায় করতে পরিস্থিতি অনুসারে সে দুটি পদ্ধতি গ্রহণ করতে চায়। একটি হল জেদ করা অন্যটি হল আবদার করা। জেদের বিষয়টিতে পরে আসা হবে। তবে বেশীর ভাগ শিশুই কিন্তু আবদার করে।
শিশুর দুটি পদ্ধতির মধ্যে, আবদার করার পদ্ধতিটি হল মানবিয় পদ্ধতি। এটা শিশু জীবনের বড় ইতিবাচক দিক। সে ভালবাসা অর্জন করেই জিনিষটি হস্তগত করতে চায়। তখন সে বলতে থাকবে, “আমি তোমাদের ছোট না! তুমি আমার আপু না”! ইত্যাদি। এখানে সে স্বার্থ অর্জনের জন্য ভালবাসাকেই পূঁজি বানাতে চায়। দেখা যায় বড় জনেরা এই ধরনের আদরণীয় আবদারে ছাড় দিয়ে জিনিষটা কিছুক্ষণের জন্য হলেও তাকে দেয়। এখান থেকেই শুরু হয় শিশুর প্রথম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ। সে বুদ্ধি খাটিয়ে জিনিষ হস্তগত করার মানবিয় একটি বৈশিষ্ট্য অর্জন করল।
কিছুদিনের মধ্যেই শিশু একটি পরিবর্তন বুঝতে পারে। সে দেখতে পায়, সর্বত্র ছোট বলে বাহানা দিলেও, কিছু জিনিষ হস্তগত হয়না! সে সব জিনিস শুধুমাত্র বড়দের জন্যই নির্ধারিত। সেই পরিস্থিতিতে শিশু ভিন্নভাবে ভাবতে শিখে। তখন সে বড় হবার ভাব নেয় এবং বড়দের আচরণ গুলো অবিকল অনুসরণ, অনুকরণ করে। বড়দের জুতো, স্যান্ডেল, চশমা, বস্ত্র পরিধানের কসরত করে। এটার মাধ্যমে সে বুঝাতে চেষ্টা করে যে, সে এখন বড় হচ্ছে। অতঃপর সে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিষে হাত দিতে চাইবে। যখন বলা হবে তুমি এখনও ছোট, বড় হলেই এসব ধরা যাবে। শিশু তৎক্ষণাৎ বলে দিবে আমিতো বড় হয়েছি। ঐ যে স্যান্ডেল পড়া হল, চশমা লাগানো হল এসব তো বড় হবারই আলামত। শিশুর এই চরিত্রও মানবীয় গুণাবলীর অন্তর্ভুক্ত।
আমি-আপনি হয়ত এসব কে তামাশা মনে করছি। সে কিন্তু প্রতিটা ধাপকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েই অগ্রসর হচ্ছে। তার মনের আয়নায় ধাপে ধাপে বহু স্বপ্ন গেঁথে পথ পরিক্রমায় ব্যস্ত। কোন একদিন দিয়াশলাই দিয়ে, মোমবাতি ধরানো হয়েছিল। এই স্মৃতিই তাকে পেরেশান করে ছাড়ছে। সে দিয়াশলাই আর মোমবাতির সন্ধানেই ব্যস্ত। সে তার মনের কথা বড়দের বুঝাতে পারছে না। এজন্য অগণিত চিন্তা ও কাজ তাকে সারাদিন কর্মব্যস্ত করে রাখছে। পাখির প্রয়োজনীয় লাফালাফি দেখে মানুষ নাচ বিবেচনা করে আনন্দ পায়। সেভাবে শিশুর এই সমস্ত অপ্রয়োজনীয় কাজকে খেলনা মনে করে; মা-বাবা, দাদা-দাদী আনন্দ পায়। কিন্তু চিন্তাশীল মানুষ দেখতে পায়, শিশু সারাদিন ভেবে চলেছে, কিভাবে নিজেকে বড় হিসেবে জাহির করা যায়, কিভাবে বড় হওয়া যায়।
শিশুর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার প্রতি নজর রাখুন। দেখবেন সে পুরোদিন কাজ করে চলেছে। এটা হাত থেকে খসিয়ে নিলেন তো অন্যতা হাতে নিচ্ছে! আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, একজন সুস্থ-সামর্থ্য মানুষ একটি প্রাণ চঞ্চল শিশুর মত অনবরত কাজ করতে পারবে না! তার অবিরাম কাজের প্রেরণা, নতুন নতুন ইচ্ছা তাকে বড়দের হয়ে কাজ করতে আরো উদ্যমী করে তুলে। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে, যখনই তার কাঙ্ক্ষিত জিনিষ পেতে বাধা প্রাপ্ত হবে তখনই সে উত্তেজিত ও ক্ষিপ্ত হবে। একটি শিশুর উত্তেজনা ও ক্ষিপ্রতা দুটোই উপরোক্ত জিনিষের আবর্তে ঘুরপাক খেতে থাকে। বাচ্চা দিনে দিনে উত্তেজিত হতে থাকলে এক পর্যায়ে এটা তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। তখন সে জানতে শিখে, আবদার করলে যা পাওয়া যায় না; রুক্ষ ও বাজে আচরণ করলে তা সহজে পাওয়া যায়। শিশুর এই চরিত্র পিতা-মাতা কিংবা তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
শিশুদের সঙ্গ দিলে রুক্ষ খাসিয়ত কম হয় কিংবা হয়ই না। অনেক শিশু এমনিতেই শান্ত থাকে, কর্মে দক্ষ হয়; যাদের ঘরে বেকার দাদা-দাদী থাকে! তারা শিশুদের অদৃশ্যমান অভাব পূরণে অনেক কাজে আসে। যদিও অধুনা অনেক পিতা-মাতা বুঝতে পারে না দাদা-দাদীর উপকারিতা কি? ওদিকে শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য অকাতরে টাকা খরচ করে নিজেরা সুখে থাকার জন্য। শিশুদের এই চিন্তার খোরাক জোগাতে কোম্পানিগুলো, শিশুদের চেনা-জানা জিনিষের বাহারি পণ্য নিয়ে বাজার সয়লাব করে দিচ্ছে। সে সব বস্তুর অনুকরণে প্লাস্টিক সামগ্রীর বিশাল খেলনা বাজার আজ দুনিয়া জোড়া বিস্তৃত হচ্ছে।
অনেক পিতা-মাতা হয়ত আশা করে এসব খেলার সামগ্রী সন্তানের মনোবৃত্তি গঠনে সহায়ক হবে। শিশুর চাহিদা সৃষ্টি কিংবা আবদার হবার আগেই তাদের খেলনা সামগ্রী কিনে দিচ্ছে। শিশুর আগ্রহ আছে কিনা সে বিবেচনাও তারা করছে না। কিন্তু দেখা গেছে প্রচুর খেলার সামগ্রীর বিপরীতে শিশু একটি মোবাইলের জন্য অনেক বেশী আগ্রহী হচ্ছে। এটা জন্য জেদ করা হচ্ছে, সাময়িক সমস্যা দূর করার নিমিত্তে মা-বাবা তার ইচ্ছা পূরণ করছে। এটাতেই শিশুর অভ্যাস বদলাচ্ছে। বেশীরভাগ ক্ষেত্রে জেদি শিশু পিতা-মাতার ভুল সিদ্ধান্তের কারণেই হয়। শিশুরা বড়দের অনুসরণ করে দেখতে পায়, সবাই মোবাইল নিয়েই বেশী আগ্রহী, তাই তারাও সেটা হাতে নিয়ে দেখতে ও খেলতে চায়! তাকে মূল্যায়ন না করলেই বিপত্তির শুরু হয়।
শিশুকে যদি যথাযথ সঙ্গ দেওয়া হয় এবং সে দেখে, তার পিতা-মাতা, ভাই-বোন, দাদা-দাদী, দা, বটি, থালা-বাসন, মাস্তুল, পেরেক, করাত, পানের বাটি, হামান-দিস্তা দিয়ে একটা সময় পার করছে, তাহলে সেও সে সব সামগ্রীর প্রতি আকৃষ্ট হবে। দাদা-দাদীর সঙ্গ পেলে, শিশুরা কিছুটা হলেও ভিন্ন মাত্রার সঙ্গী পেত। যদিও বর্তমানের গৃহীনীরা দাদা-দাদীকে উপদ্রব কিংবা ঘরের চাকরানীর বিকল্প মনে করে। তাই দিনের একটি বিরাট সময় শিশুরা সঙ্গ বিহীন থাকে। আমরা যেভাবে লুডুর মত তুচ্ছ খেলা খেলতেও দু’জনের সান্নিধ্য চাই, সেভাবে শিশুরাও বড়দের সঙ্গ এবং জীবনোপকরণ দুটোকে একসাথে পেতে আশা করে। এর একটির অভাবেই শিশু একমুখো, জেদি ও বদমেজাজি হয়ে বেড়ে উঠবে। এটা প্রতিকারে তাকে যত টাকার খেলনাই সরবরাহ হউক না কেন, কোন কাজেই আসবেনা।

Facebook Comments